আপনি কি বন্য পরিবেশে সত্যিকারের কায়াকিং-এর অভিজ্ঞতা নিতে চান, খাড়া ৬০০ ফিট দুই পাহাড়ের মাঝে ভেলায় ভাসতে চান তাহলে চলে যান বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার কচ্ছপতলি ইউনিয়নের অন্তর্গত তারাসা খালের পাড়ে মারমা পাড়া “শীলবান্ধা”র দেবতাখুমে। দেবতাখুম বান্দরবানের থানচি উপজেলার নাফাখুম, ভেলাখুম, সাতভাইখুম, আমিয়াখুমের মতই বিশাল বিশাল পাথরখন্ড এবং পাহাড়ের ভাজে আরেকটি খুমের স্বর্গরাজ্য। আপনি বান্দরবানের যতই ভিতরে যাবেন ততই এর বুনো সৌন্দরয্যে মুগ্ধ হবেন।
আমাদের
ট্যুর প্ল্যান ছিল প্রথমদিন রোয়াংছড়ির শীলবান্ধ্যা পাড়ায় তাবুতে রাত্রিযাপন এবং
পরেরদিন দেবতাখুমের ভিতরে ভেলায় ভাসতে ভাসতে এর আশেপাশের সৌন্দরয্য অবলোকন।
যথারিতি আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে
বান্দরবানের বাসে করে, কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারী হওয়াতে ঐদিন প্রচুর ভিড় ছিল
বাসস্ট্যান্ডে, তাই আমাদের অন্য একটি বাস রিজার্ভ করে ঊঠে পড়ি।
অতিরিক্ত জ্যামের কারনে আমাদের বান্দরবান পৌঁছাতে ৩ ঘন্টার বেশী লেগেছিল। দুপুর ১২ টার পর বান্দরবানে পৌঁছে আমরা টমটম রিজার্ভ করে রোয়াংছড়ি বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে রোয়াংছড়ির বাসে উঠি, আমাদের ১জন ট্যুর মেম্বার আমাদের জন্য আগে থেকেই বান্দরবানে অপেক্ষা করছিলেন, আমাদের দেরী হওয়াতে উনি রাতের খাবারের জন্য মুরগী আর স্টোভের চুলা কিনে রেখেছিলেন।
বান্দরবান থেকে রোয়াংছড়ি যেতে সময় লাগে ৪০ মিনিটের মতো। আমরা রোয়াংছড়ি বাজারের একটু আগে গোলঘর নামে একটি জায়গায় বাস থেকে নেমে যাই। ওখানে আমাদের জন্য সিএনজি অপেক্ষা করছিল, সেখান থেকে আমাদের গন্তব্য ছিল কচ্ছপতলি গ্রাম। কচ্ছপতলি গ্রামে নেমে আমরা বেলা সাড়ে ৩টা নাগাদ দুপুরের খাবার খেয়ে নিই(ভাত, আলুভর্তা আর মুরগী)। সকালে নাস্তার পর তেমন কিছুই না খাওয়াতে প্রচুর ক্ষুধার্ত ছিলাম তাই সব কিছুই অমৃত লাগছিল। যদিও খাবার টেস্ট ছিল, পাহাড়িদের রান্না এমনিতেই অনেক মজার হয়। পাহাড়ে খুব দ্রুত সন্ধ্যা হয় তাই আমরা বিকাল ৪টায় গাইড নিয়ে(আমাদের গাইড আগে থেকে ঠিক করা ছিল) দ্রুত ট্রেকিং এর জন্য বেড়িয়ে পড়লাম। প্রায় ঘন্টাখানেকের উচু-নীচু পাহাড়ি পথে ট্রেকের পর আমরা তারাসা খালের অন্তর্গত শীলবান্ধ্যা পাড়ায় পৌঁছুলাম। ট্রেকিংটা খুব একটা কঠিন ছিলনা। প্রথমে একটু খাড়া পাহাড় পরে এরপর প্রায় সমান রাস্তা।
শীলবান্ধ্যা পাড়াটা অনেক সুন্দর,পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন গ্রাম,এটা মারমা পাড়া। মানুষজনও অনেক ভালো। সেখানে হালকা চা-নাস্তা সেড়ে আমরা একটু সামনে নিচে গিয়ে তারাসা খালের পাশে আমাদের ক্যাম্পসাইট প্রস্তুত করে নিই। তাবু ঠিক করতে করতে সন্ধ্যা নেমে আসে। এরপর চলে রাতের খাবারের প্রস্তুতি। সবাই যে যার যার কাজ (লাকড়ি কুড়ানো, পানি আনা, মসলা তৈরি করা, সালাদ কাটা, গোস্ত পরিষ্কার করা ইত্যাদি) ভাগ করে নেই। সবাই অনেক আনন্দ নিয়েই আমাদের ভ্রমণটাকে উপভোগ করতে থাকি। স্টোভের চুলা থাকলেও আমরা আশেপাশের লাকড়ী দিয়ে ৩টা বড় বড় পাথরখন্ড দিয়ে লাকড়ির চুলা বানিয়েছিলাম(লাকড়ির চুলায় রান্না করা খাবার অসাধারণ মজার)। রাতের খাবারে আমাদের মেন্যু ছিল চিকেন বিরানি, ডিম আর গ্রেভি সালাদ।
রাতের
খাবারের পর ছিল ক্যাম্পফায়ার, আড্ডা আর কারাওকেতে গান, সাথে ছিল পূর্ণিমার চাঁদ
যেন সোনায় সোহাগা। পূর্ণিমার চাঁদ,আকাশের অজস্র তারার আলোর ঝলকানি আর তারাসা খালের
সৌন্দরয্য জীবনের খাতায় লিখে রাখার মতোই একটি সোনালী রাত। সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে
কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম টেরই পেলামনা।
পরদিন খুব সকালে পাখির ডাক আর তারাসা খালের পানির ঝুমঝুমানি আওয়াজে ঘুম থেকে উঠলাম। পাহাড়ে সকালের সৌন্দরয্য অনিন্দ্যসুন্দর। রাতের খাবারের বেচে যাওয়া অনেকটা অংশ দিয়ে সকালে নাস্তা সাড়লাম। এরপর চলল হিমশীতল পরিবেশে গরম ধোঁয়া উঠা ইনস্ট্যান্ট কফি। উফফ জীবনটা আসলেই কত সুন্দর!!!
ক্যাম্পসাইট ঘুছিয়ে আমাদের ব্যাগপ্যাক শীলবান্ধা পাড়ায় একটি ঘরে রেখে আমাদের যাত্রা শুরু হলো দেবতাখুমের উদ্দেশ্যে। পাহারি ঝিরি, পাথরের সাম্রজ্য, উচু-নীচু পথ পেড়িয়ে ২০মিনিট পর পৌঁছুলাম দেবতাখুমে। আমরা আগে থেকেই ভেলা ঠিক করে রেখেছিলাম, সবাই যার যার পছন্দমতো সাথী নিয়ে ভেলায় (১ভেলায় ২জন) ভাসতে শুরু করলাম।
ভেলায় নামার আগে লাইফ জ্যাকেট পড়ে নিবেন। প্রায় ৬০-১০০ ফুট গভীর এই খুমের দৈর্ঘ্য, পাহাড়গুলোর উচ্চতা ৬০০ ফুট। তাই আপনাকে লাইফ জ্যাকেট সাথে রাখার অনুরোধ রাখলো। কথিত আছে এই খুমে লুকিয়ে আছে বিশালাকার এক নাম না জানা প্রানী। স্থানীর প্রবীনদের মধ্যে কেউ কেউ একে দেখেছেন বলেও দাবি করে থাকেন। এমন মিথগুলো কিন্তু ভ্রমনের আকর্ষন বাড়িয়ে দেয় বহুগুন। দেবতাখুমের পানি অসম্ভব পরিষ্কার, সবুজাভ-নীল।দেবতা খুমে আসার ঠিক আগেই ছোট্ট একটা খুম আছে যেটার স্থানীয় নাম “পং সু আং খুম”। এই খুমে সাতার কেটে বা খুমের সাথের নব্বই ডিগ্রী এংগেলের দেয়ালের সাথে লেগে থাকা গাছের শিকড় ধরে টারজানের মত ঝুলে ঝুলে আসতে হয় দেবতাখুমে।
সত্যিকারের কায়াকিং-এর অভিজ্ঞতা নিতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই আসতে হবে এই দেবতাখুমে। ছোট-বড় পাথরকে পাশ কাঁটিয়ে আপনাকে ভিতরে যেতে হবে। যতই ভিতরে যাবেন ততই অন্ধকার হতে থাকবে আর পানির রঙ ততই সবুজ থেকে নীল হবে, সূর্যের আলো খুব একটা ভেতরে আসেনা।দেবতাখুম আসলেই খুমের স্বর্গরাজ্য। আমরা ঘন্টা দেড়েকের মতো খুমের ভিতরে ছিলাম।
ঢাকা > চট্টগ্রাম > বান্দরবান > রোয়াংছড়ি > কচ্ছপতলি > শীলবান্ধ্যা গ্রাম > দেবতাখুম
দেবতাখুম খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা জায়গা। দয়াকরে কেউ সেখানে ঘুরতে গিয়ে কোন ধরনের ময়লা ফেলে জায়গাটা নোংরা করবেন না। পাহাড়িদের সাথে কোন খারাপ আচরণ করবেন না।
Leave a Comment