সন্ত্তক – একটি নিখুঁত পাহাড়ী গ্ৰাম যেমন হয়

একটি নিখুঁত পাহাড়ী গ্ৰাম কেমন হয়? প্রশ্নটি আজকের নয় অনেকদিন থেকেই উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল মনে। অনেকদিন বলতে সেই ছোটবেলা থেকেই বলা যেতে পারে।

গত বছর যখন‌ মার্দি হিমাল ট্রেকে যাই, এক ভাই বলেছিল  সন্ত্তক এর কথা। তখন‌ থেকেই মনের মধ্যে নাড়া দিচ্ছিল জায়গাটা। এদিক ওদিক ফেসবুকে খানিক ঘাঁটাঘাঁটি করেও ফেললাম সেই মত। কিন্তু ছুটি নেই। তাহলে উপায়। এই ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ এক কাজে শিলিগুড়ি থেকে তলব এলো। ব্যস আর কে বাঁধ সাধে।

গুগল থেকে ফোন নম্বর নিয়ে অমৃতাদির (ফুরৎক্যাম্প) সাথে যোগাযোগ করি। খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিলেন সব। অগ্ৰিম 50% দিয়ে বুক করে দিন গুণতে থাকলাম।

অবশেষে এক সপ্তাহের শেষে সেই তলব নাড়া দিল দরজায়। আমরাও (ছেলে আর আমি) উড়ে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি। কাজ সেরে তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড  থেকে কালিম্পঙের বাসে চেপে বসলাম দুজনে। একদম শেষের সীট। তবে ঝাঁকুনি তেমন খাইনি। আধো ঘুমে তিস্তা বাজার পেরিয়ে কালিঝোরা হয়ে বাস তখন রাম্বির দিকে। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে জল থৈ থৈ তিস্তা। কে বলবে কদিন আগেই এই তিস্তাই ভাসিয়েছে কত কী…

কখনো কখনো উঁকি দিচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘার কোন এক শৃঙ্গ। খুব ছোটবেলায় বাবার সাথে প্রথম বাসে কালিম্পং যেতে যেতে এমনই দৃশ্য দেখেছিলাম। এইখানটায় এক ঝলক তিনি দেখা দেন। এখনো দিলেন, শুধু এবারে ছেলে আর আমি। এইভাবে ঘন্টা তিনেক পেরিয়ে পৌঁছলাম কালিম্পং বাসস্ট্যাণ্ড।

বাসস্ট্যাণ্ডের পিছনেই স্টেডিয়াম। ছোট ছোট ছেলেরা খেলায় মত্ত। স্ট্যাণ্ডে রয়েছে সেয়ার কার. আবার রিজার্ভ করেও যাওয়া যায়। আমরা খোঁজ করলাম আলগড়া যাওয়ার গাড়ি। পেয়েও গেলাম। একদম সামনে ড্রাইভারের পাশের সীট। মা, বেটায় বেশ আনন্দে চেপে বসলাম। একঘন্টায় পৌঁছলাম আলগড়া।

সেখান থেকে গাড়ী রিজার্ভ করে যেতে হবে রামাইলো সন্ত্তক।  প্রায় ৯-১০ কিমি পথ। আলগড়া থেকে যে রাস্তা লাভার দিকে চলে গেছে সেই পথে কিছুটা গিয়ে ডানদিকে নেমে গেছে  একটি পথ, সেদিকেই সন্ত্তক। এইপথে কিছুটা এসে নাথুলার পর্বতশৃঙ্গ গুলি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ডানদিকে নেমে প্রথমে আসে চার্চ, তারপর সেন্ট অ্যান্থনি স্কুল। এই জায়গাটির নাম মিরিক। স্কুলের সামনে খেলার মাঠ। ছিমছাম সুন্দর সাজানো গোছানো। এই সবুজ পাহাড়টির ওপর থেকে নীচ অবধি সান্তুক গ্ৰামটি (Santuk Khasmahal) বিস্তৃত। দু একটি হোমস্টে আছে বইকি। তবে আমরা চলেছি একদম নীচে অবিনাশজীর ফুরুৎ (furutcamp) ক্যাম্পে।

রমাইলো সান্তুক অ্যাডভেঞ্চার বেস ক্যাম্প (Ramailo Santook Adventure base camp) ছবি – Devki ManjUsha

গোটা গ্ৰাম জুড়েই ওনার আত্মীয়রা রয়েছেন। দুপুর নাগাদ এসে পৌঁছলাম আমরা। পশ্চিমের ঘরটি বেছে নেওয়া হল। পাশেই ওনাদের নিজস্ব ঘর। আর নীচে রয়েছে রান্নাঘর ও ডাইনিং। সুন্দর বাগান। কমলালেবু ঝুলছে গাছে‌গাছে। একপাশে চাষাবাদ। বন তুলসী, কুমড়ো, কপি, টমেটো, লঙ্কা, ঝাঁটা গাছ। অন্যদিকে গবাদি পশুখানা। রয়েছে টেন্টে থাকার ব্যবস্থাও। প্রতি টেন্টের পাশে বায়ো টয়লেট। আছে নানান ফুলের বাহার। লঙ্কা জবা, লোকটা, ক্যাকটাস, বোগেন বেলিয়া, লিলি, গাঁদা, গোলাপ আরো কত কি। দুটি কাপড়ের দোলানাও রয়েছে। একটি ছোট্ট উঠোন। চারপাশে ফার্ণের বেড়া। ঠিক যেমনটি শয়নে স্বপনে দেখতাম। নিটোল পাহাড়ী গ্ৰামের বাড়ি। বাড়ির পিছন দিয়ে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে যাওয়ার। নীচেও নেমে গেছে একটি পথ।

কালসিন ওয়াটারফলের কাছেই বাঁশের তৈরী পাটাতনের ওপর ক্যাম্পিংয়ের ব্যাবস্থা। ছবি – Devki ManjUsha

আমরা দ্বিপ্রহরিক আহারাদি সেরে গেলাম পিলতুক দারা‌  একটু হাইকিং আর কি। বনজঙ্গল ভেঙে ওপরে উঠে সবুজ পাহাড়ে ঘনঘটা, দূরে দেখা যায় দুটি গ্ৰাম ও লাভা। নীচে বয়ে চলেছে রেলি খোলা ছমছম শব্দে। যত ওপরে উঠছি হাওয়া ততই বাড়ছে। ঝুম চাষ পেরিয়ে এক সময়ে একদম ওপরে এসে পৌঁছলাম। কত পাখির ডাক। হাওয়ার নড়নচড়ন সাথে নদীর কুলকুল সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। যে পথে উঠেছিলাম, নামলাম কিন্তু অন্যদিক দিয়ে, গ্ৰামের ভিতরে ভিতরে ঠিক বাড়ির পিছনের সিঁড়ি দিয়ে। ঘন্টা খানেক লাগল। সব মিলিয়ে ১-১.৫ কিঃমিঃ হাইকিং।

সন্ধ্যায় পেলাম ভেষজ চা ও সাথে পাকোড়া। আর রাত্রে ভাত মাংস। এস্বাদের ভাগ হবে না। এখানের মানুষজনেরা খুব সুন্দর গান করেন। খুব আপন করে নেন।

রাত্রের আকাশ ছিল দেখার মতো। কালপুরুষ মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে। আরো কত তারা। বৃহস্পতিও নিজ গুণে বিদ্যমান। তারা খসা থেকে শুরু করে স্যাটেলাই যাওয়া উফ সে এক পাগল পাগল করা আনন্দ। একে উত্তুরে কনকনে হাওয়া কিন্তু এসব কি না দেখে থাকা যায়। মন ভরে‌ স্বাদ সেবনে ব্যস্ত হৃদয়।

ভোরে ঘুম ভাঙে মোরগের ডাকে। দরজায় কড়া নাড়ে সারমেয়। নাম না জানা পাখির দল গান গেয়ে বলে যায় – ‘ভোর হল দোর খোল-‘

দরজা খুলতেই সবুজ পাহাড়ে সূর্যোদয়। অদ্ভুত তার শোভা। আঁধার সরিয়ে আলোয় ভরিয়ে দিনের শুভারম্ভ। শুরু হয় নিত্য দিনের কর্মকাণ্ড। চা পান করে সকলে একসাথে। তারপর রান্নার তোড়জোড়। ক্ষেত থেকে তুলে এনে রান্না। সেদিন রোববার। তাই সকলেই একটু আয়েশে দিন কাটাচ্ছে। আমরা যাব নীচের রেলি খোলায় দুটি ঝর্ণা দেখতে। কালসিন আর থারে ফলস।

ছবি – Devki ManjUsha

খাড়া নীচে নেমে গেছে পথ। ঝুরো মাটির পথ। পা হড়কায় বেশ। সারমেয়রা সাথে দেয় অনেকটা। নীচে কালসিন ফল্সের ওখানেও টেন্টে ক্যাম্পিং করা যায়। টেম্পোরারি টয়লেটের ব্যবস্থাও আছে। ওপর পাহাড়ে যে গহন জঙ্গল নাম তার সাইহুর ফরেস্ট।  অনেক রকম জন্ত্ত রয়েছে। পাথরের অলিগলি টপকে এগিয়ে চললাম। এই জায়গাটির সাথে ইয়েলবঙের বেশ মিল আছে। নদীর গতিপথের সাথে চলতে চলতে পৌঁছলাম থারে। কী অপূর্ব শোভা। মন ভরে যায়। প্রজাপতি, লাল হলুদ ছোট্ট ছোট্ট পাখির ঝাঁক (Himalayan honey creeper, Himalayan bluetail, scarlet finch, red whiskered bulbul, yellow bellied prinia, crimson sun bird, Himalayan hummingbird) ও কুহুতান মনের মণিকোঠায় মুক্ত ঝরায়। খানিকক্ষণ বসে অবশেষে ফিরে আসার পালা। এই পথটি সুপ্রসস্থ। বাইক নামতে পারে। দুঘন্টা কাটিয়ে উঠে এলাম আমরা। স্নান সেরে গরম গরম খেয়ে রোদ গায়ে মেখে বসলাম দোলনায়। ছেলে তখন বাগানে বাগানে খেলছে নিমার সাথে। নতুন বন্ধু। দুটির ভাষা অন্য কিন্তু একে অপরকে বুঝে নিয়ে খেলায় মেতেছে ওরা।

হিমেল হাওয়ায় দুলে দুলে একটা শান্তির দুপুর কাটালাম অজানা পাহাড়ী গ্ৰামের কোলে। একেই কি বলে স্বর্গসুখ?

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল।‌ বিকেল তখন গোধূলীর আকাশ ছুঁলো, পশ্চিমে তখন নোখভাঙা চাঁদ – ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে। তারপর ঝুপ করে অন্ধকার। এক এক করে পাহাড়ের গায়ে গায়ে আলো জ্বলে উঠলো।

মোহময়ী হিমালয়। রূপকথারা কথা কয়, দূরের বনে শিকারী শিকার করতে বের হয়, গাছে গাছে দোলা লাগে, মড়মড়িয়ে পাতায় পাতায় আঁচড় কাটে সূক্ষ্ম শব্দেও ভিতরে দুরুদুরু ভালো থাকুক রামাইলো সন্ত্তক।

সন্ত্তক যাওয়ার বিস্তারিত এবং খরচাদি

  • Njp to Kalimpong Bus 110/- to 130/- per head
  • Kalimpong to Algarah share car 70/- per head
  • Algarah to Santook 600/- reserved car.
  • Ramailoo Santook Avinashji’s Homestay
  • 1500/- lodging (Log house) and fooding (4times) per head per day.
  • Guide cost – 500/- per day
Leave a Comment
Share