বিখ্যাত সিঁড়ি ট্রেক – মার্দি হিমালের ইতিকথা

জীবনের আঙিনায় নব অধ্যায়
পর্বতের কোলে থাকা আয়নায়
দেখা দিক উত্তরে বারেবার
কষ্ট সাধনের মার্দি হিমাল।।

মে মাসের শেষে হঠাৎ ছোট্ট বোনটির ম্যাসেজ এলো – মার্দি হিমাল (Mardi Himal) যাবে? তারপর একটি ভিডিও, ব্যস আর কি চাই। এই পথেরই তো স্বপ্ন দেখি রোজ। এক কথায় রাজি। তখন থেকেই একে একে জোগাড় শুরু হল।

২২শে ডিসেম্বর

Hwh to Rxl Mithila exp এ চেপে রওনা। রক্সৌল থেকে নেপালের পোখারা  যেতে বীরগঞ্জ অবধি টাঙ্গা (১০০/- জনপ্রতি) তারপর গাড়ীতে পাড়ি। বীরগঞ্জ হল সীমানা।

Himalayan Passion এর সৌজন্যে, Pokhara to Pokhara ছিল আমাদের schedule. Arjan Hotel এ‌ রাত্রি কাটিয়ে ভোরের সূর্যোদয় দেখে রওনা কান্দে। ঘন্টাখানেকের রাস্তা। পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সেতী নদী। এটি, মার্দী (মচ্ছপুচারের বামদিকে) আর মোদি (মচ্ছপুচারের ডানদিকে) খোলার মিলিত রূপ। এতক্ষণ অবধি শিবালিক রেঞ্জেই সীমাবদ্ধ ছিলাম। এরপরের গল্পটা একটু অন্যরকম।

এক ছোট্ট (৮বৎসর) ছেলের প্রায় ৪০০০ মিটার উচ্চতায় পদার্পনের ইতিকথা। যদিও সে ইতি উতি ছোট খাটো সহজ ট্রেক অনেকবারই করেছে এবং পাহাড়কন্যা জয়িতা বর্মনের (+919804947282) সহচর্যে অনেক কিছু শিখেছে ও জেনেছে।

Kande (1770 m) থেকে ধাপে ধাপ ফেলে পাথুরে সিঁড়ি ভেঙ্গে শুভারম্ভ।‌ ঘন্টা সাতেকের পথ। চড়াই উৎরাই সহ ঘন্টা পাঁচেকের পথে আমরা পৌঁছলাম পিতম দেউরালি (2100m)। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেলের কিনারায় হাত ঠেকিয়েছে। সুন্দর একটি হাউসে ছিল আমাদের আস্তানা।

 প্রথমদিন এতগুলো সিঁড়ি ভেঙ্গে যখন ক্লান্তির আবেশ শরীরটাকে পরখ করছিল, ঠিক সেই সময় চলে এলো গরম গরম ভাত, ডাল, শাকভাজা, পাঁপর, তরকারি আর আচার। সাধু সাধু। কাঁসার থালা সাজিয়ে সে এক এলাহি অভ্যর্থনা। Tea house এর লন ছাড়িয়ে তখন উঁকি দিচ্ছে অন্নপূর্ণা সাউথ, হিউনচুল্লী, ধৌলাগিরি ও মচ্ছপুচারে। লনের দোলনায় দুলতে দুলতে সূর্যাস্তের সে এক অপরূপ রঙীন শোভা।

সময়ে সাথে সাথে সূয্যি গেল অস্তাচলে।

পরদিন ভোরে সূর্যোদয়ের মোহময়ী রূপই হল morning vives. প্রাতঃরাশ সেরে সকাল সাড়ে নয়টার সময় সকলে রওনা দিলাম Low camp (2970m) এর উদ্দেশ্যে। Pitam Deurali – Forest camp (lunch break) to Low camp. এই উচ্চতা অর্জন করার সময় সকলেরই কম বেশী একটু কষ্ট হয়েছে। ছোট্ট মানুষটির একটি সময় পরে মনে হচ্ছিল যেন ঘুম নেমেছে চোখে আর শ্বাসের বড় জ্বালা। সবই altitude sickness এর অন্তর্ভুক্ত।

প্রতিদিনই মাঝে কোথাও একবার tea break হতো। যে যার কাপ বের করে ক্যাম্পিং গ্যাস ও কন্টেইনারে জল গরম করে টি-ব্যাগ দিয়ে চা। আহা!

সিঁড়ি পর সিঁড়ি পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আসা forest camp (2600m). এখানে দ্বৈপ্রহরিক আহারাদি সেরে আবার রওনা low camp   এর উদ্দেশ্যে। এই পথের বাহার রডোড্রেনড্রন। কিন্তু শীতকালে শুকনো গাছ আর ঝুরঝুরে মাটি ছাড়া বাকি সব মেলা ভার। পাথুরে সিঁড়ি পর সিঁড়ি চলে গেছে ১১নং 🧑‍🦯গাড়ী চেপে সোজা low camp. এক সময় হাড় কাঁপানো শীত গ্ৰাস করতে শুরু করল। ইলশেগুঁড়ি তুষারপাত শুরু হল। ক্লান্তি যেন অবয়বকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে। কোন এক অমোঘ শক্তি ভরে এগিয়ে চলেছে সব। না আছে খিদে না আছে তেষ্টা। অদ্ভুত এক ক্লান্তি। সবটাই altitude sickness.

এই জঙ্গলের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। যদিও অনেকেই বলে চলেছে এখানে কোন জন্তু জানোয়ার নেই, কিন্তু পরিবেশ তো সায় দিচ্ছে না। কীরকম যেন মনে হচ্ছে কেউ আমাদের পরখ করছে। এরকম পথে তো আগেও গিয়েছি, সে স্থান কাল পাত্র অন্যত্র। তো গাইডজীকে প্রশ্ন করে অতঃপর জানতে পারলাম, barking deer, bear and leopard সকলেই মজুত আছেন।  তবে দেখা মেলা ভার।

ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে পাঁচটায় এসে পৌঁছলাম low camp Tea house. তাপমাত্রা তখন মাইনাসে। হাড়হিম করা শীতে তখন অদ্ভুত এক বিরক্তি। মন বলছে খেতে হবে, শরীর বলছে শুয়ে পড়। জোর করে ors খেয়ে যেন জান ফিরে পাওয়া। তারপর লোহা দিয়ে ঘেরা আগুনের তাপের আবেশে গা সেঁকা ডাইনিঙে। রাতটা ছিল পূর্ণিমার আগেরদিন। বারোটা নাগাদ টয়লেট যাওয়ার তাগিদে উঠে পড়ে‌ বেরতেই – প্রাণোচ্ছ্বাস।

আহা কি দেখিলাম , জন্ম জন্মান্তরেও ভুলিব না। ক্লান্তি পরিশ্রান্তি এক‌নিমেষে উধাও। চেয়ে দেখি মচ্ছপুচারে একাকী দাঁড়িয়ে অন্ধকারে। মাথায় তার সপ্তর্ষির আশীর্বাদ। বামদিকে চন্দ্রিমার জোছনা‌। এক অদ্ভুত মায়াবী পরিবেশ।‌ আরো‌ কত তারাদের উল্লাস। ক্যাসিওপিয়া, কালপুরুষ সহ কত কি। ঠিক তখনই টুং টুং শব্দে একে একে ঘরে ফেরে ইয়াকের দল। “এই রাত তোমার আমার, হে মচ্ছপুচারে শুধুই দুজনার —“

ভোর হতেই soupy noodles খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়া high camp (3550m) এর উদ্দেশ্যে। প্রায় ৭ কিলোমিটার সিঁড়ি ভাঙা পথ ।

Low camp পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পথে পা ফেলে ফেলে প্রথম আসে Badal danda (3300m). এটি টেবিল টপ। এখান থেকে সব পর্বতই যেন মনে হয় ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। মেঘরাশি এক এক করে নীচের পৃথিবীতে ছেয়ে এক বিশাল সমুদ্রের সমাবেশের আয়োজনে যেন ব্যস্ত। এই পর্যন্ত বিভিন্ন টি হাউসে নিজেদের wifi বিদ্যমান। শিশির পড়ে জমে বরফ হয়ে গেছে কিছু কিছু স্থান।

দুপুরের মধ্যে পৌঁছে গেলাম high camp.

ছোট্ট মানুষ তখন অন্য জগতে। পায়ের তলায় মেঘের মহাসাগর, আকাশ জোড়া অন্নপূর্ণা সাউথ হিউনচুল্লী আর মচ্ছপুচারে। দূরে অন্নপূর্ণা III ও গঙ্গাপূর্ণা। একবার করে করে মেঘে ঢেকে যায় আর একবার ক’রে ক’রে পর্দা সরে যায়। সে এক নৈস্বর্গিক নয়নাভিরাম।

পরদিন summit day 4500m. Mardi Himal base camp. Mt. Fishtail এর ঠিক নীচেই Mt. Mardi Himal. High camp থেকে সম্পূর্ণই হিমাদ্রী অঞ্চলে। তার আগে অবধি হিমাচল range এর মধ্য দিয়ে আসা। রাত 3.30am soupy noodles খেয়ে ভোর 4.30am রওনা হওয়া। সকলের মধ্যেই এক অনন্য উত্তেজনা। View point 3960m এ প্রথম সূর্যোদয় দেখে তারপর 4500m পৌঁছানো ও নেমে আসা।

সকলের মাথায় head torch. যেন‌ মনে‌ হচ্ছে সেই Journey of the centre of the earth এর উদ্দেশ্যে যাত্রা। যদিও তখন আমরা স্বর্গ ছোঁয়ার অপ্রাণ প্রচেষ্টায় লিপ্ত। সাধে বলে স্বর্গ প্রাপ্তি বড়ই কষ্টকর। সোজা খাড়া সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। মনে‌হয় ঐখানে শেষ। গিয়ে দেখা যায় আরো আ—-রো—-। অনেক বিদেশী চলেছে পথ বেয়ে। ছোট্ট মানুষ ধাপে ধাপে পা ফেলে একটু একটু করে এগিয়ে চলেছে। এভাবে প্রশ্বাস নিঃশ্বাসের বাঁধ ভেঙে সকাল সাতটায় পৌঁছে গেলাম view point. একেই বলে view আর এহেনই point. আক্ষরিক অর্থেই তাই। আট বৎসর বয়সী প্রথম হাত তুলে জানান দিল এটিই তার বেস ক্যাম্প। আর নয়। তার জন্য আসা তার কথাই শেষ কথা। মা হয়ে আর কি চাই। একে অপরকে জড়িয়ে নিয়ে আনন্দ উল্লাস। তাপমাত্রা তখন মাইনাসে (-১৩)

বাকি টিম এগিয়ে চলল ৪৫০০ মিটারের উদ্দেশ্যে। ৪২৫০ মিটার অবধি তারা পৌঁছেছিল।

এই ভিউ পয়েন্টের সৌন্দর্য অপরিসীম। মেঘের মহাসাগরে হঠাৎ জাগা দীপ তথা অন্নপূর্ণা সাউথ, হিউনচুল্লী, মচ্ছপুচারে, অন্নপূর্ণা III, গঙ্গাপূর্ণা, Singu chulli, Tharpu Chulli ও তাদের হিমবাহ।‌ মাঝে মাঝে কিছু ব্রাউন পর্বত। বহু নীচে সবুজের সমারোহ। অক্সিজেনের অভাবে সবুজ তখন অনেকদূর। কিছু কাঁটা ঝোপ ও বুনো কুলের শুকনো ছোট্ট ছোট্ট গাছ। বাকি সব পাথুরে পথে হলুদ ঘাস। এখানে বৃষ্টি পড়ে না। ঘন মেঘে হয় তুষারপাত। উত্তুরে হিমেল হাওয়া রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাড়া জাগায়। গুটি কয়েক গুমটির একটিতে চায়ের দোকান বাকীগুলি বন্ধ। কত ছোট ছোট পাখি আর কালো কুচকুচে কাক। মাঝে মাঝে হেলিকপ্টার যায় এই পথে‌ পর্বত পরিক্রমায়। পাশে‌পাশে‌ অল্পস্বল্প বরফ জমা। আট বৎসর তখন অভিজ্ঞতার পাহাড়ে আশি। আনন্দে আত্মহারা।

একেই বলে দুর্গম গিরি… কিন্তু পারাপারের জয়ের আনন্দ অপরিসীম। সব কষ্ট তখন ধূলিসাৎ।

প্রায় তিন ঘন্টা থেকে নেমে আসি হাই অল্টিচ্যুড এর শিকার হয়ে। আমাকে নামিয়ে আনে আমার ছোট খোকা। নতুনভাবে চিনি ছেলেকে। সকলের সাথে interact করতে‌ করতে আমাকে বুঝিয়ে বুঝিয়ে কথা বলিয়ে ডাইভার্ট করিয়ে বিজ্ঞের সাথে high camp নিয়ে আসে আমার আট বৎসর। সাধে কি নামখানা যুধিজিৎ। ভাল লাগা ও ভালবাসায় প্রথম নতুনভাবে চিনলাম আমার ছেলেকে। এতটা matured এইটুকু বয়সে, এটাই আমার‌ এই ট্রিপের অপরিহার্য পাওনা।

এরপর দুপুরের খাবার সেরে‌ সেদিনেই নেমে আসি badal danga. ততক্ষণে আবহাওয়া অসম্ভব কুয়াশাচ্ছন্ন।

পরদিন সকালের নাস্তা সেরে low camp অবধি এসে বামদিকে সিঁড়ি পথে নেমে যাওয়া siding 1700m. এইপথে প্রথম পাওনা জলপ্রপাত‌ ও নদীর জলের শব্দ। ঘন জঙ্গলের পর প্রথম tea house. একজন অসম্ভব সুন্দরী এক মহিলা এই tea house এর মালকিন। একাই চালান। দারুণ রান্না। সুন্দর সাজানো গোছানো ছটা রুম, একটি ডাইনিং ও রান্নাঘর। পিছনে সবজি বাগান আর লন জুড়ে গাঁদা ফুল। লনে দাঁড়ালে সোজা মচ্ছপুচারে। অপরূপ শোভা। এখান থেকে view point ও low base camp দেখা যায়। Tibetan bread, apple pan cake, egg rice, chilli chicken অসাধারণ সে রান্না। নেপালের থাকা খাওয়া উভয়ই ভীষণ ভালো।

এইখানেই হল সেই অনুভব। মালকিন তো খাওয়া হয়ে যাওয়ার পর পরই সকলকে রুমে পাঠিয়ে দিলেন। তৎসত্ত্বেও দু’জন বাইরে রয়ে গেল। এ প্রকৃতির শোভা কি ছেড়ে থাকা যায়। নিজেদের আপন গোপন তথ্যে যখন আবৃত, ঠিক সেই সময়, হঠাৎ লনে থাকা সারমেয় তীব্র স্বরে সম্মুখে তেড়ে গিয়ে tea house এর পিছনের দিকে মুখ করে গররর গরররর গররর। হিংস্র চোখে দাঁতে দাঁত। সামনের ঝোপে কিছু একটা কি?

প্রশ্ন প্রশ্নই রয়ে গেল। একলাফে যে যার রুমে। এ পথে রহস্য রহস্যই থেকে যায়। তাকে খোলসা করার সাহস কারুর নেই। এ জঙ্গলে তারাই মালিক ও মালকিন। পরদিন siding থেকে হাঁটা পথে lumre (১২০০ মিটার) এসে গাড়ীতে পোখরা। এইপথে যদিও গাড়ী চলে তবুও বলা ভালো গাড়ীতে চড়লে হাড় ভেঙে যাওয়া নির্ধারিত। এই পথে‌ ঘোড়াও চলে। আছে ঝুলন্ত ব্রিজ। শোভায় শোভায় প্রতিটি মোড় থেকে Mt. Fishtail উদিতমান।

তবে Pokhara থেকেই একমাত্র দেখা যায় মা অন্নপূর্ণা রেঞ্জ সহ মচ্ছপুচারের অপরূপ শোভা , সঙ্গে উপরি পাওনা ফেওয়ালেক ও Pokhara street festival.

Raxual এ অবশ্য একরাত কাটাতে হয়েছিল স্টেশন এর ডর্মিটরিতে, নিরাপদ আশ্রয়। ছেলে মেয়ে একসাথে ডর্মিটরি। এছাড়া একটি ডাবল বেডের রুম আছে। অনলাইনে বুকিং হয় IRCTC দিয়ে। ফিরে আসার পর থেকে এখনও প্রতি রাত্রে শয়নে স্বপনে মনে হয় যেন সিঁড়ি আর শেষ‌ হচ্ছে না।

এইসব কিছুর সাথে যাঁর নাম না বললেই নয় তিনি হলেন আমাদের গাইড Taraji ও তাঁর ছেলে Prajjal. +977 984-6385822. চকোলেট থেকে wiwi সবকিছু নিজে খাইয়েছেন। আর মানুষ হিসাবে কোন কথা হবে না।

খরচ

পোখারা থেকে পোখাড়া – ১৫৫০০ রুপী (Accorsing to Himalayan Passion)
এরপর বাকীটা নিজেদের।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Mardi Himal Trek