তাজিংডং বিজয়

স্থানীয় উপজাতীয়দের ভাষায় ‘তাজিং’ শব্দের অর্থ বড় আর ‘ডং’ শব্দের অর্থ পাহাড়, এ দুটি শব্দ থেকে তাজিংডং (Tazing Dong) পর্বতের নামকরণ করা হয়। সরকারি ভাবে, একে বিজয় পর্বত নামেও সম্বোধন করা হয়। তাজিংডং বাংলাদেশের বান্দরবন জেলার রুমা উপজেলার রেমাক্রী পাংশা ইউনিয়নে সাইচল পর্বতসারিতে অবস্থিত। এটি বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলার, উপজেলা সদর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই পর্বতের অবস্থান। তাজিংডং (বিজয় নামেও পরিচিত) বাংলাদেশের একটি পর্বতশৃঙ্গ। তাজিংডং পর্বতের উচ্চতা ১,২৮০ মিটার (৪১৯৮.৪ ফুট) বর্তমানে বেসরকারী গবেষণায় (৪৩০০ ফুট)। পূর্বে কেওক্রাডংকে দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মনে করা হত, আধুনিক গবেষণায় এই তথ্য ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বর্তমানে বেসরকারী গবেষণায় সাকা হাফং পর্বতকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ দাবী করা হয়, তবে এটি এখনও সরকারি স্বীকৃত নয়। সরকারিভাবে তাজিংডং বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ।

২২-০৩-২০১৮ (বৃহস্পতিবার)

ঢাকা ফকিরাপুল গাউসিয়া হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট থেকে রাতের খাবার খেয়ে ফকিরাপুল থেকে ইউনিক বাসে উঠলাম। যথাসময়ে গাড়ী ছাড়লো রাত ১০ঃ২০ মিনিটে। ঢাকার জ্যাম পার হয়ে কাচপুরের জ্যাম, ব্রিজের জ্যাম। প্রায় বৃহস্পতিবার রাতে এমন জ্যাম থাকে, আজও তাই। স্বাধীনতা দিবসের বাড়তি ছুটি থাকায় বাড়তি জ্যাম।

মাঝ রাতে হাই্ওয়ের এক রেস্টুরেন্টে গাড়ী থামল। রাতের খাবার খেয়ে গাড়ীতে উঠেছি খুদা তেমন নেই তাছাড়া খাবারের প্রচন্ড দাম শুধু দই খেয়েই চলে আসলাম। আবার গাড়ী ছুটছে পাশে বন্ধু তালেব ঘুমাছে আমারও তন্দ্রা এসে গেল। হটাৎ প্রচন্ড শব্দে চোখ মেলেই “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মদের রাসুলুল্লাহ” একসিডেন্ট। আল্লাহ রক্ষা করেছেন সকল যাত্রীদের। পিছন থেকে একটি বাস ধাক্কা দিয়েছে। পিছনের গ্লাস ভেঙ্গে পিছনে থাকা যাত্রীরা সামান্য আহত বাকীরা নিরাপদ। বাস থেকে নেমে দেখলাম পিছন থেকে যে গাড়ীটা ধাক্কা দিয়েছে ঐ গাড়ীর অনেকে আহত এবং সামনে থাকা যাত্রীরা বেশী আহত। অতপর ড্রাইভারকে খুজে পাওয়ার পর পিছনে গ্লাস ভাঙ্গা অবস্থায় গাড়ি ছুটে চললো৷

২৩-০৩-২০১৮ (শুক্রবার)

সকালে চট্রগ্রাম এসে যাত্রীদের রোসানলে একই কম্পানির গাড়ী বদল করে আবার রওনা দিয়ে কয়েক ঘন্টা লেটে সকাল ১০টায় পৌছালো বান্দরবন শহর৷ রেস্টুরেন্টে ফ্রেস হয়ে সকালের নাস্তা সেরে বাসস্টান্ডে এসে জানতে পারলাম দুপুর ১২ঃ৩০মিঃ বাস ছাড়বে থানচির উদ্দেশ্যে। টিকিট কাটার পর আশেপাশে ও সরকারী বাংলোয় ঘুরাঘুরি করে সময় পার করলাম।

ঠিক সময়ে বান্দরবন থেকে বাস ছুটছে অপরূপ সৌন্দর্য আকাঁ বাকাঁ পাহাড়ী পথ বেয়ে উপরের দিকে। কখনও আকাশের দিকে উঠতে থাকে তো আবার কখনও নিচে নামতে থাকে। মাঝে মধ্যে পাহাড়ের বাঁকে খুব সামনের পথও দেখা যায় না। মনে হয়, এই বুঝি পাহাড়ের খাদে পড়ে যাচ্ছি। এই জার্নিটা ঠিক রোলার কোস্টার রাইডের মতো অ্যাডভেঞ্চারে ভরপুর। সারাজীবন আপনাকে মনে রাখতে বাধ্য করবে। পাহাড় কেটে বানানো রাস্তা নীচের দিকে তাকালে গা ছমছম করে, এতটা নীচে যে আর দেখা যায়না মেঘের কারনে। পাহাড় আর পাহাড়৷ পাহাড় গুলো মেঘের চাদরে ডাকা, মেঘ পাহাড়ের সেকি অলিঙ্গন৷ আল্লাহতায়ালার কি অপুরূপ সৃষ্টি৷

চিম্বুক পাহাড়ের আর্মি ক্যাম্পের পাশে যাত্রা বিরতি৷ জনস্বার্থে আর্মিদের বানানো কুয়া থেকে পানির খালি বতল গুলো ভরে নিলাম৷ ক্যাম্পে প্রবেশের অনুমতি না পেয়ে কুয়ার পাশে গাছের ছায়ায় যাত্রা বিরতির সময়টা পার করলাম গল্প করে৷

১৮২৪ সালে বার্মা-ব্রিটিশ যুদ্ধের পর থানচি উপজেলা আরাকান ব্রিটিশ-ভারতের প্রদেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে থানচি ও এর প্রতিবেশী অঞ্চলে আরাকানীদের অভিবাসন সহজ হয়। অভিবাসীরা এ অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করে এবং ১৯০০-এর রেগুলেশন-১ (পার্বত্য চট্টগ্রাম ম্যানুয়াল) এদের স্থায়ী বাসিন্দার স্বীকৃতি দেয়।

মার্মা শব্দ থাইন চৈ বা বিশ্রামের স্থান থেকে থানচি নামটির উৎপত্তি। ধারণা করা হয়, ১৯৫০ সালে বা তার পূর্বে নৌপথে চলাচল কালে যাত্রীগণ বিশ্রামের জন্য এ স্থানে থামতেন বলে থাইন চৈ নামে স্থানটি পরিচিত ছিল, পরে তা থানচি হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

বান্দরবান জেলা সদর থেকে এ উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৮৫ কিলোমিটার। এ উপজেলার উত্তর-পূর্বে রাঙ্গামাটি জেলার বিলাইছড়ি উপজেলা, উত্তরে রুমা উপজেলা; পশ্চিমে লামা উপজেলা, আলীকদম উপজেলা ও দক্ষিণে মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশ এবং পশ্চিমে মায়ানমারের চিন প্রদেশ অবস্থিত।

সমুদ্র সমতল থেকে আড়াই হাজার ফুট উপরে নির্মাণ করা হয়েছে বাংলাদেশের উঁচু সড়কপথ। আলিকদম-থানচি আঞ্চলিক সড়ক এই মুহূর্তে বাংলাদেশের উঁচু রাস্তা। আলীকদম থেকে এই রাস্তা উপরের দিকে উঠেছে এবং ডিম পাহাড়ের কাছাকাছি রাস্তার উচ্চতা দাঁড়িয়েছে ২৫০০ ফুট। আলীকদম উপজেলা থেকে ৩০ কিলোমিটারের দুরের থানচি-আলীকদমে ডিম পাহাড়ের পুরোটাই পাহাড়ী পথ।

বান্দরবন থেকে ৮৫ কিঃমিঃ পার হয়ে বিকাল ৫টায় আমরা পৌছালাম সাংগু নদীর পাড়ে থানচি বাজারে৷ চাচির হোটেলে ফ্রেস হয়ে খাবারে অপেক্ষায়। ঢাকা থেকে কথা বলে রাখা আমাদের গাইড নুরুল ইসলাম নুরু চলে এসেছে। দুপুরের খাবার বিকালে সেরে বাজারে ঘুরাঘুরি করলাম। পাহাড়ীদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের পাশাপাশি শহরের পন্য রয়েছে এই বাজারে। থানচি বাজারের পাশে পাহাড়ী সাংগু নদী, বাজারের পিছনে এসেই নদী দেখে প্রান জুড়িয়ে গেল। নৌকা, ট্রলার চলছে, দুটো বাচ্চা ছেলে ভার দিয়ে পানি নিচ্ছে নদী থেকে, একটু দুরেই পাহাড়ী মেয়েরা গোসল করছে, ট্রলার বা নৌকায় নিয়ে আশা পাহাড়ী গাছ গুলো কাধে করে নিয়ে পাড়ে উঠে যাচ্ছে স্থানীয় লোকজন। আকাশটাকে পর্দা দিয়ে ডেকে রাখা নদীর ওপাড়েই বিশাল ডিম পাহাড়। নদী দেখেই বুজা যায় ভরা মৌসুমে নদীতে ডেউ থাকে। পাহাড়ের উপরে নদী ৷ আল্লাহতায়ালার কি আশ্চর্যজন, বিস্ময়কর, অপূর্ব, অপরূপ সৃষ্টি৷

আজ রাত এখানে কোন হোটেল/মোটেলে থেকে আগামীকাল সকালে রওনা দিব এই প্লান ছিল। কিন্তু গাইড দুজনে আলোচনা করে ঠিক করে আজ সন্ধ্যার আগে রওনা দিব। রাতে রোদের তাপটা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে, রাতে যেতে তেমন কোন সমস্য হবেনা, তাছাড়া আমরা তিন জন নতুন রাতেই রওনা দেয়াটা ভাল হবে আরো কত রকম যুক্তি দাড় করালো। গাইড দুজনের জোরালো চাপে বাধ্য করলো রাজি হতে।

আগামী ২দিনের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করা হল তেল মসল্লা ইত্যাদি ইত্যাদি৷ পিনাটবার, মেঙ্গবার, বাদাম, খুরমা পথের জন্য শুকনা খাবার ঢাকা থেকে নিয়ে এসেছিলাম৷

আমাদের পথ দেখানোর দায়িত্ব গাইড নুরুর, টাকা পয়সা খরচের দায়িত্ব তালেবের এবং টিম লিডারের দায়িত্ব পালন করছি আমি৷ তারেক আজিজ, ইসতিয়াক, আবু তালেব, নুরু ও আমি রওনা দিলাম শেষ বিকালে। বাজার পার হয়েই অ্যাডভেঞ্চারপূর্ণ রোমাঞ্চকর পাহাড়ী পায়ে হাটা পথ শুরু, শেষ বিকালে রওনা দিয়ে রাতের অন্ধকার হতেই ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার হাটা শুরু মোবাইল ও এলইডি লাইটের আলোয়। আধফালি চাঁদের তেমন আলো নেই, আকাবাকা উচু নীচু পাহাড়ী পথ, হাটছি আর হাটছি, যাচ্ছি আর যাচ্ছি। দম আসছে আর যাচ্ছে, খেয়ে রওনা হবার জন্য এমন হচ্ছিলো। প্রথম দর্শনেই হচকে গেলাম এমন খাড়া পাহাড় থেকে নামার পথ দেখে , একেবারে খাড়া ভাবে নেমে গেছে নিচে। একবার পা ফসকে গেলে কই গিয়ে পরব তা ভেবে গা শিরশির করছিল, সাহস নিয়ে পা বাড়ালাম। নামছি তো নামছি খাড়া ঢাল বেয়ে ,আর ভাবছি এইখান থেকে কি আমি ফিরে যেতে পারব সুস্থ ভাবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রনে হাতে নেয়া লাঠিটা দারুনকাজে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে আর পারবোনা, আবার কি ভাবে যে পারছি তাও জানিনা। চারিদিকের নিরব নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে হটাৎ আক্রোমানর্তক শব্দে ভয় পেয়ে গেলাম৷ রাতে আসাটা ঠিক হয় নি৷ মহিষের মত দেখতে গরুটা আসলে আমাদেরকে দেখে ভয় পেয়ে দৌড় দিয়েছে৷ 

ব্যাগটাকেও অনেক বোঝা মনে হচ্ছে, ইসতিয়াকের পুরা সংসার ভরে নিয়ে আসা ব্যাগটা তালেব নিয়ে কাহিল আমার চেয়ে খারাপ অবস্থা ইসতিয়াকের। একটার পর একটা, এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়, দূর্গম পাহাড়ী পথ হাটছি আর হাটছি, যাচ্ছি আর যাচ্ছি। আবার বিশ্রাম, আবার বিরামহীন হাটা।

ব্যাথার ও প্রয়োজনীয় ঔষধ ব্যাগে আছে। দীর্ঘদিনের পায়ের গোড়ালীর ব্যাথার কথা ভুলেই গেছি৷ ঘেমে ঘেমে এখন আর শরীরের ঘাম বের হয়না৷ রাতেও চৈত্রের ভাপ রয়েছে, বাতাস নেই তেমন, বতলের পানিও শেষ৷ অনেক দুর আসার পর ঝিরি-পাহাড়ী ঝর্না পেয়ে স্বস্তি পেলাম। প্রকৃতির আপন খেয়ালে সাজানো কোনো কোনো জায়গায় দু’পাশের পাহাড় খাড়া হয়ে উপর দিকে এমনভাবে কাত হয়েছে যে আকাশ পর্যন্ত ঢেকে গেছে। দুপাশে বড় বড় পাহাড়। ঝিরির কাছে হওয়ায় বড় বড় গাছপালা বেশী পাহাড় ও গাছের ছায়ায় অন্ধকার বেশী৷ চারিদিকের নিরব নিস্তদ্ধতা ভেঙ্গে হটাৎ জন্তু জানোয়ারের আক্রোমানর্তক শব্দে ভয় পেয়ে গেলাম সবাই৷ হাতের লাঠিটা শক্ত করে ধরলাম, আবার মনে হল অজানা অচেনা দূর্গম পাহাড়ী পথে রাতে আসার দুঃসহস করাটা ঠিক হয়নি৷ তালেব আর নুরু আলো নিয়ে এগিয়ে গেল, ফিরে এসে বল্ল বুনো শুয়র৷ তৃষ্ণা মিটিয়ে পাহাড়ী ঝর্ণার পানি পেট ভরে খেয়ে খালি বতল গুলো ঝিরির পানি ভরে নিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বিশাল সাইজের পাথরের উপর হাত-পা ছেড়ে বসে পড়লাম৷ ঝর্না ঝিরির পানি পিওর মিনারেল, প্রচুর প্রান শক্তি রয়েছে, আল্লাহতায়ালার বিশেষ নেয়ামত।

গাইড নুরু পাহাড়ী ঝর্ণায় জমে থাকা পানিতে চিংড়ি মাছ ধরা শুরু করলো মোবাইল, এলইডির আলো দিয়ে। আমরাও ক্লান্তি ভুলে মাছ শিকারে লেগে গেলাম। মাছ শিকারের আনন্দে ক্লান্তি ভুলে ৫/৬ টা চিংড়ি ধরা হল। এবার বারবিকিউ৷ চারি দিক শুধু ঝিঝি পোকার শব্দ, সরু পাহাড়ী ঝর্ণার পানির শব্দ, পিচ্ছিল বড় বড় পাথর৷ আশে পাশের থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করা হলো, মধ্যে রাত ঘুটঘুটে অন্ধকার নিরব নিস্তব্ধ দুর্গম পাহাড়ী ঝর্ণার পাশে একদল দুষ্ট ছেলে আগুন জ্বালিয়ে চারদিক আলোকিত করে দিলো৷

মাঝে মাঝে মনে হয় কোথায় যাচ্ছি? আদো যেতে পারবো কিনা, অন্য কোন দেশে নাকি পৃথিবীর ঐপ্রান্তে চলে যাচ্ছি। অন্ধকারে আধফালি চাঁদের আলো যা কিনা আমাদের কোন কাজে আসছে না। একটার পর একটা, এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়, দূর্গম পাহাড়ী পথ হাটছি আর হাটছি, যাচ্ছি আর যাচ্ছি। আবারো বিশ্রামে, খাড়া ঢাল বেয়ে নিচে নামার মানসিক প্রস্তুতির জন্য। তিনটা পাহাড়ে পায়ে হাটারও পথ ছিলনা। খাড়া সাকো দেখেই মনে হয়েছিল নামতে যেয়ে পড়ে যাব অথবা নামতে পারবোনা। নামার পথ যেন মৃত্যুকূপ। বিধিবাম কিচ্ছু করার নেই, নামতেই হবে। একজন গাইড উপর থেকে আরেক জন নীচ থেকে লাইট ধরেছে আমাদের নিয়ত্রনহীন শরীরটা খুব সাবধানে নামতে হয়েছে তিনটা পাহাড়ে ২০, ৩০, ৪০ ফিটের খাড়া গাছের সাকো বেয়ে। বরাবরের মতো এবারেও পার পেলাম। সত্যি বলতে কি সকলের আন্তরিক সহযোগিতার কারণেই আমার পক্ষে এমন দুর্গম পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব হচ্ছে। অবশ্য সবাই নেমেছিল কোনো সমস্যা ছাড়াই, আল্লাহর রহমতে কেউ অসুস্থ হয়নি। আসার পথে দেখেছি কয়েকটা পাহাড় কেটে পায়ে হাটার পথ এতটা সরু যে একজনের বেশী হাটা যায়না এবং পাহাড়ের এত উপরে যে নীচটা দেখা যায়না খালি চোখে। পা পিছলে পড়লেই কয়েকশ ফুট নিচে, সেখানে কোনো গাছও ছিল না যে আঁকড়ে ধরবে। দিনে বেলায় হলে হয়তো ২/১ জন ভয়ে ফিরে যেত। ভয়ঙ্কর দূর্গম পাহাড়ী পথে রাতের অন্ধকারে একটার পর একটা পাহাড় পাড়ি দিচ্ছি গন্তব্যে ঠিক রাখা এক অযানা গন্তব্যে।

ইসতিয়াকের আমার চেয়ে খারাপ অবস্থা তাকে সহযোগিতা করছে গাইড নুরু, আরেক গাইড বন্ধু তালেবের সঙ্গে আছি  যদি কখনো সহযোগিতা লাগে। আর দুইটা পাহাড় পেরোলেই পৌছে যাবো, আর একটা পাহাড় পেরোলেই পৌছে যাবো এভাবেই কয়েকটা পাহাড় পার হয়ে অনেকটা আশার আলোর মত অনেক দুর থেকেই ৩/৪ ঘন্টা পর আলোর দেখা পেলাম। দুর থেকে গানের শব্দও ভেসে আসছে, মানুষজনের অস্তিত্ব টের পেলাম। আরো একটা পাহাড় ডিঙ্গিয়ে পাড়ার পৌছানোর আগেই মুড়ংদের সাপ্তাহিক প্রার্থনা ও পাড়ার অনুষ্ঠান শেষে মাইকের আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। নিজেদের বিশ্রামের জন্য অথবা টুরিষ্টদের জন্য বানিয়ে রাখা বাশেঁর মাচাং ছাউনিতে এসে সবাই শুয়ে পড়লাম শরীরের যে অবস্থা শুয়ে পরা ছাড়া আর কোন উপায় নাই। আমাদের কোন আওয়াজ নাই মনে হলো সবাই কি ঘুমিয়ে পড়েছে। কিছুক্ষন পর পায়ের আওয়াজ টের পেলাম, চোখ খুলে দেখি দুজন পাহাড়ী মুড়ং যুবক দাড়িয়ে আছে। এবার বুজলাম আমরা মুড়ং জাতীদের বোডিং পাড়ায়। আমাদের গাইড পাহাড়ী ভাষায় আলাপ সেরে আমাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলো। কিছুটা ক্লান্তি শেষে সঙ্গে নিয়ে আশা শুকনো খাবারের সাথে মুড়ং যুবকদের সঙ্গে নিয়ে তারেক আজিজের কবিতা আবৃতি, আড্ডা আর গল্প হলো প্রানবন্ত। বোডিং পাড়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দুর পাহাড়ের ঝর্না থেকে বহমান পানির ধারা দেখে বুজা যায় বর্ষায় থাকে নদীর মত। সবাই ঝর্নার বহমান ধারার নির্দিষ্ট যায়গা থেকে প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করে নিলাম।

আধ ফালি চাঁদ কিন্তু আমাদের সঙ্গে রয়েছে আরো রয়েছে অসংখ্য আকাশ ভরা তাঁরা। আমরা ক্লান্ত হলেও ওরা দিচ্ছে তাড়া। আবার রওনা দিলাম। ক্লান্ত, সামান্য বিশ্রাম, হাটা আর হাটা। আর দুইটা পাহাড়, আর একটা, আর একটা পাহাড় পেরোলেই পৌছে যাবো। শেষদিকে সবাই একটু অধৈর্যই হয়ে পড়েছিলাম। ক্লান্তিতে মাখামাখি হয়ে যখন এই ক্লান্ত দেহের ভার নির্যাতিত পা দুটো যখন বহন করতে আর পারছিলনা তখন অনেকটা আশার আলোর মত অনেক দুর থেকেই আলোর দেখা পেলাম। আমাদের গাইড দুজন আগেই পৌছে গেল আমরা পিছনে তাদের দেখানো পথে।

২০(বিশ) কিঃমিঃ হেটে ৮(আট) ঘন্টা পর রাত দুইটার দিকে আমরা পৌছালাম বোম জাতীদের শেরকড় পাড়ায়। আহ কি শান্তি। এত ক্লান্ত যে ঘরে ডুকে আমার মত সবাই শুয়ে পড়লো বাঁশের বিছানায়, শরীরের যে অবস্থা দাড়িয়ে থাকার মত অবস্থা নেই। ৫ থেকে ১০ জন ঘুমানোর মত যায়গা আছে এই রুমে। একটা ঘরে দুইটি রুম, একটিতে বয়োজ্যেষ্ঠ বাড়িওয়ালা, আরেকটি ছেড়ে দিয়েছে আমাদের থাকার জন্য। বাঁশের মাচাং ঘর পুরো বাড়ী বাঁশের তৈরী রুমের ভিতরে এক কোনায় কিছুটা যায়গায় মাটির বিছানা তার উপরে মাটির চুলায় চা জাল হয়ে গেছে, এত রাতে এক কাপ গরম চা, আহ। সৌর বিদ্যুৎ লাইনে মোবাইল চার্জ দিয়ে গোসলের প্রস্তুতি নিলাম । দুর পাহারের কোন এক ঝিরি(ঝর্না) থেকে পাইপ দিয়ে বাড়ী বাড়ী পানির সংযোগ দেয়া আছে। পানি পড়ছে বিরামহীন গা বিজতেই মনে হল স্বর্গীয় পানি। এতটা পথ চলার ক্লান্তি, কষ্ট, পায়ের ব্যাথা, শরীর ব্যাথা মনে হলো পানির সাথে ঝরে পড়ে গেল। এত রাতে রান্না করা, খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করা, খাওয়ার কোন ইচ্চা নেই কারো ৷ সঙ্গে নিয়ে আসা শুকনো খাবার খেয়ে সবাই শুয়ে পড়লাম ৷ রাজ্যের সব ঘুম, ঘুম আর ঘুম, শুধুই ঘুম, ঘুম . . .। ১ ২ ৩ ঘুম।

২৪-০১-২০১৮ (শনিবার) তাজিংডং বিজয়

হতভম্ব! চোখ মেলে যা কিছু দেখছি হতভম্ব! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছি। এ আমি কোথায় আসলাম। যে দিকে যত দুর চোখ যায় মেঘে ঘেরা পাহাড় আর পাহাড়ের অপুরূপ মিলনমেলা। যেদিকে তাকাই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি, অবাক হয়ে যাচ্ছি বর্ণনায় ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা। আল্লাহতায়ালার কি আশ্চর্যজনক, বিস্ময়কর, অপূর্ব, অপরূপ সৃষ্টি ৷ সমুদ্রপিষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৩০০ ফিট উপরে মেঘের ভিতরে তাজিংডং এর কাছাকাছি পাহাড়ের উপরে কোন এক অচেনা অজানা গ্রামে শেরকড় পাড়ায়।

তালেব আর নুরু সকালে উঠে পাড়া থেকে বড় একটি পাহাড়ী বন মোরগ পাহাড়ী কচুর সঙ্গে রান্না শেষে এখন পাহাড়ী জুম চালের ভাত রান্না করছে। আমি সব শেষে ঘুম থেকে উঠলাম। মনে হল একটু আগে ঘুমুতে যেয়ে এখন উঠলাম। বাঁশের বিছানায় শুয়ে প্রার্থনালয় থেকে মাইকে বাজানো পাহাড়ী ধর্মীয় সংগীত শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বার্থরুম নিয়ে তারেক আজিজ ও ইসতিয়াকের কথোপকথন সবার জন্য বাড়তি আনন্দ যোগ করলো । আলসেমি নিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে বসলাম। জুম চালের আঠালো ভাত, ঝাল বন মোরগের মাংস, খুদা এবং রান্না ভাল হওয়াতে ডাবল খেয়ে পাড়া বেড়াতে গেলাম।

পাহাড়ীদের জীবনযাত্রা দেখে কৌতুহলি হয়ে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করা শুরু করলাম। গাইড নুরু অনুবাদ করে দিচ্ছে ৷ পরিস্কার পরিছন্ন ১২/১৪ টা বাঁশের মাচাং ঘর দেখতে সব এক রকম। ছোট্র গ্রামটায় ঘন্টা খানিক এলোমেলো ঘুরাঘুরি করলাম সবাই মিলে। পাহারের উপরে পাহাড়ীদের জীবন যাত্রা দেখে আমরা অবাক। আমাদের সঙ্গি তারেক আজিজ ও ইসতিয়াকের অবস্থা মাইলস ব্যান্ডের গানের মতো –

পাথুরে নদীর জলে পাহাড়ী মেয়ে নামে,
ভেজা তার তনু মন ধরা দেয়না,
কি স্বপন এক দিল বলা যায় না,
স্বপ্ন চোখের মাঝে সবুজ বনাণী তাতে,
ছায়া ফেলে এই জল ঝর্ণা,
অধীর ঢেউ এর দোলা দিয়ে যায় আনমোনা,
দিকে দিকে শুধু যন্ত্রণা,
পাহুরে নদীর জলে পাহাড়ী মেয়ে নামে,
বাতাস আকুল হয়ে জলের ছন্দ নিয়ে,
পাহাড়ী মেয়ে সেতো চেয়ে দেখেনা,
পাখি ডাকে অচেনা বয়ে যায় ভাবনা
স্বজন বুজি ফিরে এলো না!!

সমুদ্রপিষ্ঠ থেকে প্রায় ৪৩০০ ফিট উপরে মেঘের ভিতরে বর্তমানে বাংলাদেশের সর্বউচ্চ পাহাড় “তাজিংডং” এর চুড়ার আহরনের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পানির বতল শুকনো খাবার নিয়ে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। শরীরে হালকা কাপড় হাতে পানির বোতল মাথায় গামছা বেধে রওনা দিলাম সবাই মিলে। দুইটা পাহাড় পার হয়েই অনেক দুর থেকে কাঙ্খিত “তাজিংডং” এর চুড়া দেখা গেল সেকি আনন্দ সকলের। অন্য সব পাহাড় আকাবাকা হলেও দুর থেকে তাজিংডং এর চুড়া গোল ও দেখতে অনেক সুন্দর। গতি বাড়িয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি কয়েকটি পাহাড় ডিঙিয়ে তাজিংডং এর দিকে।

পাহাড়েও দুষ্ট লোক আছে অথবা জুম চাষের জন্য কিছু কিছু যায়গায় পাহাড়ী  জঙ্গল বড় বড় গাছ পুড়ে ছাই। পাড়াতে  আম, বেল, তেতুল ও কলা গাছ ছাড়া অন্য কোন ফলের গাছ দেখিনি। পাহাড়ী পথে বাশেঁর জঙ্গল ও বনে  আমরা ছাড়া আর কোন মানূষজন নেই, ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ বিরামহীন রাতদিন, মৌমাছি ছাড়া কোন পোকা মাকড়ের দেখা পেলামনা। মাঝে মাঝে অচেনা পাখির বেসুরা গান পাহাড়ে পাহাড়ে বারি খেয়ে আবার ফিরে আসে,  এ পাহাড় ও পাহাড় এত দুর থেকে ভেসে আসা শেরকড় পাড়া প্রার্থনালয় থেকে মাইকে বাজানো পাহাড়ী  ধর্মীয় সংগীত শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এত সুন্দর যায়গায় মোবাইল ক্যামেরা ব্যাস্ত থাকায় দলছুট হয়ে যাচ্ছি জঙ্গলের আড়ালে পাহারের আড়ালে। আবার খুজে পেতে তেমন সমস্যা হচ্ছেনা গলা ছেড়ে জোরে নাম ধরে ডাক দিলে এপাহাড় ওপাহাড় বাড়ী খেয়ে পৌছে যায় আওয়াজ। “তাজিংডং”এর যতই কাছে যাচ্ছি ততই শিহরিত, রোমাঁচিত। মাঝ দুপরে সেই কাঙ্খীত তাজিংডং এর চুড়া উঠলাম। স্বাধীনতার মাসে তাজিংডং বিজয়। বিস্ময়কর, অপূর্ব, অদ্ভুত, চমত্কার, বিচিত্র, অপরূপ আনন্দে আত্মহারা।

তাজিংডং এর চুড়া থেকে সাকা হাফং পর্বতকে দেখা যায়। সাকা হাফং পাহাড়ের এক অংশ মায়ানমারে আরেক অংশ বাংলাদেশে। সাকা হাফং পর্বতের এর কাছাকাছি একটি উপজাতীয় পল্লী দেখা যায়, বড় বড় গাছে লাল লাল ফুল ফুটে আছে । আর নীচের দিকটা সব মেঘে ডাকা। তাজিংডং এর চুড়া উঠে সব কষ্ট ক্লান্তি ম্লান হয়ে গেল। ছবি তোলা আর ভিডিও নিয়ে ব্যাস্ত আমরা, আর তালেবের শখের যোগান দিচ্ছে নুরু, আশে পাশের থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করা হলো, আগুন জ্বালানো হলো, পাতিলে পানি ডালা হলো, কিছুক্ষনের মধ্যে লুডুস রান্না হয়ে গেল, বাশঁ কেটে চামচ বানিয়ে খাওয়া শুরু হলো।

তাজিংডং এর চুড়ায় সরকার, গাইড ও পহাড়ীদের উদ্যোগে এডভেঞ্চার প্রিয় টুরিষ্টদের জন্য জঙ্গল পরিস্কার করে বিচরন ও বসার যায়গা করা দরকার । অস্তিত্ব টের পাওয়া যায় কোন এক সময়ে এখানে বাশেঁর মাচাং ছাউনি ছিল।

থানচি থেকে তাজিংডং ২৪/২৫ কিঃমিঃ পথে মাত্র তিনটি পাহাড়ে মোবাইল (রবি) নেট পাওয়া যায়। বাশেঁর সঙ্গে হেলান দিয়ে বসার যায়গা খুজে নিলাম। মোবাইলে বাসার সকলের সঙ্গে কথা হলো আমার ফোন পেয়ে তাজিংডং এর বর্ণনা শুনে মনে হলো পরিবারের সবাই আমার চেয়ে বেশী আনন্দিত। ছেলে বলেছে বাবা আমার জন্য মেঘ নিয়ে এসো।

তাজিংডং এর চুড়ায় থেকে খালি বতলে মেঘ নিয়ে ঘন্টা খানিকের বেশী সময় থেকে নেমে আসলাম । এক আশ্চর্যজনক, বিস্ময়কর, অদ্ভুত, চমত্কার, তৃপ্তি নিয়ে ফিরছিলাম।  সেই আকাবাকা পাহাড়ী পথ ধরে হাটা শুরু ফিরে আসার জন্য। আর একটা কথা ভেবে শান্তি পাচ্ছিলাম যে, আমি সকলের সাথে সমান তালে এগিয়ে গিয়েছি। মাঝে মাঝে সবাইকে পিছনে ফেলে আমিই ছিলাম সবার সামনে। কাউকে বিরক্ত করিনি, বিপদেও ফেলিনি সহযোগিতাও লাগেনি তেমন।  পথে এত সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ পাহাড় মেঘ বিশাল বিশাল পাথর ক্যালেন্ডারের মত দৃশ্য ছবি তোলায় ব্যাস্ত হলাম। এত প্রতিবন্ধকতা পিছনে ফেলে তাজিংডং বিজয়ের স্বাদ নিয়ে তবেই আমি বাড়ি ফিরছি!!

যেসব জিনিস মনে রাখতে হবে

  • প্রশাসনের অনুমদোন ও অনুমদিত গাইড এবং প্রয়োজনিয় জিনিসপত্র সঙ্গে নিতে হবে
  • পাহাড়ের নিয়ম-কানুন ও যে কোন পরিস্থিথিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে
  • অনুমতি ছাড়া কোন পাহাড়ীদের ছবি তোলা যাবে না
  • শুকনো খাবার, স্যালাইন, মশা ও জোঁক প্রতিরোধ ক্রিম এবং নামাজ আদায় করার অনুষঙ্গ সঙ্গে নেবেন
  • রাতে ভ্রমন করা যাবেনা। যদিও আমরা গাইড দুজনের জোড়লো চাপে ভুল কাজটি করেছি।
Leave a Comment
Share