ডুয়ার্স এর দিনগুলোতে

সমরেশ মজুমদার এর কালবেলা উপন্যাসের মাধ্যমে ডুয়ার্স (Dooars) এর সাথে পরিচয়। উত্তরের এই চা বাগান ও পাহাড়ি অঞ্চল সম্পর্কে ছিল আগ্রহ।  ঈদের ছুটিতে যখন এখানে যাবার প্রস্তাব আসে, উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম। নিরিবিলি ও সবুজে ঘেরা যাদের পছন্দ তাদের এই অঞ্চল ভালো লাগবে। 

ডুয়ার্স অঞ্চল অনেক বিস্তৃত ও ঘুরবার পয়েন্ট গুলো ধরে প্রচুর রিসোর্ট ও হোমস্টে আছে। কোলকাতা সহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে রিজার্ভ ফরেস্টে বন্য প্রাণী দেখতে প্রচুর লোকজন এখানে আসেন। 

আমরা ভ্রমণ সঙ্গী ছিলাম পাঁচ জন। কলকাতা থেকে পারমিতা দিদি, শুভদীপ দাদা, তাদের মেয়ে রাই ঢাকা থেকে আমি আর রিতা। পারমিতা’দির পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছিল ডুয়ার্সে ঘুরতে যাবার। শুভদিপ দা ট্রেভেল এজেন্সির মাধ্যমে চার রাত পাঁচ দিন এর প্যাকেজ নিয়েছিলেন। প্যাকেজের মধ্যে সার্বক্ষনিক গাড়ির সুবিধা থাকায় আলাদা করে ভাবতে হয়নি অন্য কোন কিছু। 

১৪ এপ্রিল ২০২৪, আমরা চ্যাংরাবান্ধা বর্ডার দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। প্রথম দিন ছিল লাঞ্চের পর বিকেলে গরুমারা সাফারি পার্কে জঙ্গল সাফারি। বর্ডারে দেরি লাগায় আমরা সন্ধ্যা নাগাদ আমাদের জন্য নির্ধারিত রিসোর্টে পৌঁছাই। সেদিনের নির্ধারিত জঙ্গল সাফারি আমরা মিস করি। চ্যাংরাবান্ধা থেকে ভাড়া করা গাড়িতে সরাসরি আমরা পারমিতা রিসোর্টে পৌঁছাই। পারমিতা রিসোর্ট ছিমছাম, গোছানো সুন্দর রিসোর্ট, সেখানকার খাবারও খুব ভালো। আমরা উপভোগ করেছি সেখানে অবস্থান।

পরদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে রিসোর্ট এর অপজিটে  মুর্তি নদীতে ঘুরতে যাই। চারপাশে চা বাগান, বাগনের মধ্যে দিয়ে যেতে চমৎকার সব পাখির ডাক শুনছিলাম। সেখানে শিমুল তুলার গাছ। রাস্তার ধারে তুলো পরে সাদা হয়ে ছিল। এই সময়টায় মুর্তি নদীতে পানি ছিল না। বর্ষায় পানিতে নিশ্চয়ই খুবি সুন্দর হবে এর রূপ। নদীর অপর পাশেই বন। নদীতে খুব ক্ষীণ ধারায় জল বইছিল। নদীর পাশে দায়িত্বরত নিরাপত্তা কর্মী আমাদেরকে নদীর পানির কাছে যেতে বাঁধা দেয় কারণ নদীতে বন্য প্রাণীরা পানি খেতে আসে যার জন্য নিরাপদ নয় সেখানে যাওয়া। 

১৫ এপ্রিল ২০২৪, সকালে নাস্তা করে নির্ধারিত জিপে আমরা ঝালং এর দিকে যাই। পথে রাস্তার ধারে চা বাগানে নেমে ফটোসেশন চলে। ঝালং যাবার আকাঁবাকা পাহাড়ি পথ খুব সুন্দর। রাস্তার সংস্কার কাজের জন্য কিছু জায়গায় এবড়োখেবড়ো পথ পারি দিতে হয়। ঝালং ভিউ পয়েন্ট এর নিচেই জলঢাকা নদী, সামনে পাহাড়টাই ভুটানের। পাহাড়ের কোলে সব বাড়ীর সামনে টবে চমৎকার সব রঙিন ফুলের টব। চমৎকার এসব বাহারি ফুল চোখে দারুন স্বস্তি দিয়েছে। আমাদের দেশের পার্বত্য অঞ্চলের বাড়ীগুলোতেও এমন চমৎকার ফুল বাগান দেখতে পাওয়া যায়। ভিউপয়েন্টে চমৎকার মোমো খাওয়া হয়। ঝালং থেকে পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে আমরা চলে যাই, ভারতের শেষ সীমান্ত বিন্দুতে। বিন্দুতে মূলত জলবিদ্যুৎ বেরেজ। সেখানে বেশ কিছু দোকান আছে। বিন্দুতে পাথরে বসে জলঢাকা নদীর ঠান্ডা জলে পা ভিজিয়ে গল্প গুজব চলে। স্থানীয় দোকান থেকে কিছু কেনাকাটা করে আমরা রকি আইল্যান্ডের দিকে যাই। পথে রাস্তার পাশে একটি জায়গায় রিসোর্ট থেকে নিয়ে আসা বিরিয়ানি ও চিকেন দিয়ে লাঞ্চ সারি। নামার পর জায়গাটির নাম লিখা আছে দেখতে পারি ‘টাইটানিক প্লেস’। রকি আইল্যান্ড মূলত মূর্তি নদীর কোলে পাথুরে স্পট। শুকনো মওসুম হওয়ায় এখানে অল্প ধারায় জল বইছে। সেখানেও ঠান্ডা জলে পা ভিজিয়ে সময় কাটানো হয়। তারপর আমরা চলে যাই সামসিং এর দিকে। পথে চা বাগানে দেখতে পাই সব গাছেই অর্কিড ফুল আছে, ফেরার পথে নিচু গাছ থেকে আমরা অর্কিড ফুল নিয়ে আসি। চা বাগানে ময়ূর দেখা মেলে আমাদের। সামসিং গিয়ে আরো একপ্রস্ত মোমো নেয় রিতা। আমি আর শুভদীপ দা নেই দুই ক্যান ঠান্ডা বিয়ার। মোমোর প্রতি রিতার এই প্রেম দেখে রাই রিতার নাম করন করে মোমোআপা বলে। সামসিং থেকে সন্ধ্যা নাগাদ আমরা রিসোর্টে ফিরি পথে স্থানীয় বাজার থেকে লুডু কিনে নেই আমরা। রাতে জমজমাট লুডু খেলা চলে আমাদের। বাকি অন্য সময় রাই তার চমৎকার গানে মুগ্ধ রাখে আমাদেরকে।

এই সময়টা ভারতের লোকসভা নির্বাচন হচ্ছে। যে দূর দূর পাহাড়ে গেলাম সেখান বিজিপি ও তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা চোখে পড়লো। বামফ্রন্টের কোন পতাকা চোখে পরেনি আমার। বিজেপির এই উত্থানে মন খারাপ হয়েছে কিছুটা। আমাদের দেশে যে রকম ইসলামি মৌলবাদের উত্থান হচ্ছে ভারতেও, যে রাজ্যগুলোতে বিজেপির অস্থিত্বই ছিল না সেখানে তাদের প্রসার হচ্ছে।

১৬ এপ্রিল ২০২৪, সকালের নাস্তা শেষে আমরা পারমিতা রিসোর্ট চেক আউট করি জয়ন্তী উদ্দেশ্য। আমাদের আগামী দুই রাত এর অবস্থান হবে জয়ন্তী নদীর তীরে বক্সা বনাঞ্চল এরিয়াতে। এ পথে তোর্শা নদী সহ বেশ কিছু ছোট বড় নদী অতিক্রম করি আমরা। পথে মধ্য প্রথমে আমরা যাত্রা বিরতি করি দক্ষিণ খয়ের বাড়ী নেচার পার্কে। জঙ্গলের মধ্যে পার্ক এরিয়া ইলেকট্রিক তাঁরে ঘেরা আছে বন্যপ্রাণী থেকে সুরক্ষার জন্য। এখানে খাঁচা বন্দি বেশ কিছু বাঘ আছে যেগুলো বনে বিভিন্ন সময় আহত হয়েছিল বা মানুষের হাতে আটক হয়েছিল। বাঘের সাথে ছবি টবি তুলে আমরা যাই রাজাভাতখাওয়া মিউজিয়ামে। সেখানে বন্য প্রাণীর মৃতদেহ সংরক্ষণ ও নানা প্রাণীর প্রাণীর পরিচিত আছে। পাশেই অর্কিড নার্সারি আছে সেখান বিক্রি, দেয়ার কোন সিস্টেম না থাকায় আমরা সবাই ছোট ছোট অর্কিড চারা চুরি করি। তারপর সেখান থেকে জয়ন্তী।  যেতে রাস্তায় আমরা রাস্তার পাশে হাতির দেখা পাই। মিউজিয়াম থাকতে শুনতে পেরেছিলাম একটু আগে নাকি হাতির পাল দেখা গিয়েছে। তবে আমরা রাস্তার পাশে একটি হাতি দেখেই সন্তুষ্ট থাকি। দুপুরের মধ্য আমরা পৌঁছে যাই জয়ন্তী নদীর ধারে ‘মোহন চূড়া’ রিসোর্টে। সেখানে ফ্রেশ হয়ে আমরা দুপুরের খাবার খাই। রিসোর্টটি একেবারে নদীর ধারে নদীর অপর পাশেই গভীর বন। তবে নদীতে জল না থাকায় আমাদেরকে শুধু নদীতে পাথর দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। বিকেলে আমরা নদীর মাঝখানে যে অল্প ধারায় জল বইছে সেদিকটাই যাই এবং নদীর জলে পা ভিজিয়ে সন্ধ্যা অব্ধি ফিরে স্থানীয় গ্রাম ঘুরি। 

রাস্তায় হাতির দেখা

১৭ এপ্রিল, ২০২৪ আমাদের প্রধান আকর্ষণ ছিল ভোর ছয়টায় বক্সা-জয়ন্তী জঙ্গলে সাফারি। সাফারি জন্য নির্ধারিত গাড়ি আছে এবং গাইড নিতে হয়। সেই সাথে আগে থেকে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে অনুমতি নিতে হয়। আমরা সবাই ছয়টার আগেই প্রস্তুত হয়ে গেলাম। ভোর ছয়টায় নির্দিষ্ট গাড়ি চলে আসলো, জঙ্গলের কোর এরিয়ায় সাফারির উদ্দেশ্য। বক্সার জঙ্গলে এর আগে বাঘ দেখতে পাওয়া গিয়েছে। ধারণা করা হয় ভুটান এর গহীন জঙ্গল থেকে বাঘ এসেছে হয়তো। প্রশাসন এই বনে বাঘ ছাড়বার সীদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই জয়ন্তী নদী সংলগ্ন যে গ্রামটিতে আমরা থাকলাম সেই গ্রাম সহ পার্শ্ববর্তী আরেকটি গ্রাম স্থানান্তর করা হবে। ছয়টা থেকে পরবর্তী ২ ঘন্টা আমরা জঙ্গলের গভীরে ছাদ খোলা জিপে ঘুরলাম। সাফারিতে হরিন, ময়ূর এগুলো চোখে পরেছে। অন্য কোন জন্তু আমাদের চোখে পরেনি। শুভদিপ দা একটু মন খারাপই করছিল জংলী প্রাণী দেখতে না পাওয়ায়। আর পারমিতা দি মজা করছিল এই বলে যে দাদা হয়তো প্রত্যাশা করেছিলেন ভয়ংকর প্রাণীরা তার সামনে এসে ছবি তোলার জন্য পোজ দিবে। 

সকাল আটটার দিকে রিসোর্টে ফিরে আমরা সকালের নাস্তা করে, বিশ্রাম নিয়ে, ফ্রেশ হয়ে বের হই বক্সা দূর্গ এর দিকে। যাওয়ার পথে রাস্তায় ঘটলো একটা দারুণ বিষয়। একটি বিশাল হাতি রাস্তার এপাশ জঙ্গল থেকে অপর পাশের জঙ্গলে যাওয়া খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করলাম। এত বড় পাহাড়ি হাতি কাছ থেকে দেখে, সকালের সাফারিতে তেমন কিছু দেখতে না পাওয়ার দুঃখ কিছুটা ঘুচলো। 

এটি বক্সা বনে পাহাড়ের উপর একটি দূর্গ। ব্রিটিশ ভারতের এটি একটি দূর্গম ও কুখ্যাত দূর্গ। ভারতের মুক্তি আন্দোলনের বিপ্লবীদের এখানে বন্দি করে রাখা হয়। নেতাজি সুভাস চন্দ্র বোস এখানে বন্দি ছিলেন। দূর্গটি দেখলাম সংস্কার কাজ করা হয়েছে, প্রস্তুতি দেখে মনে হলো হয়তো কোন মিউজিয়াম করা হবে এখানে। বক্সা দূর্গে যেতে যেতে পাহাড়ে আমাদের ভালো একটি ট্রেকিং হয়ে গেলো। পাহাড়ে উঠতে উঠতে আমরা একাধিকবার চা পান, জল পান, বিশ্রাম করে নিয়েছে। 

বক্সা দুর্গ থেকে ফিরতে ফিরতে দুপুরের খাবার সময় পেরিয়ে গিয়েছিল এবং সবাই কিছুটা ক্লান্ত ছিলাম। ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে আমরা একপ্রস্ত ঘুমিয়ে নিলাম। সন্ধ্যায় স্থানীয় গ্রামে সবাই মিলে হেঁটে বেরোলাম ও চা খেয়ে আড্ডা দিয়ে পরের দিনের প্ল্যান নিয়ে আলোচনা হলো। শুভদিপ দা আমাদের জন্য আলিপুর দুয়ার স্টেশন থেকে NJP স্টেশনের রেলের টিকেট কেটে দিলেন। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে আবারও লুডু খেলা আড্ডায় চমৎকার সময় কাটলো।

জঙ্গল সাফারিতে ময়ুরের দেখা

১৮ এপ্রিল, ২০২৪ আজকে আমাদের পাঁচজনের যৌথ ভ্রমণের শেষ দিন। খুব ভোরে আমি আর রিতা নদীর ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করি। নিউ আলিপুর দুয়ার স্টেশন থেকে পদাতিক ট্রেনে আমি আর রিতা নেমে যাবো NJP স্টেশনে আর পারমিতা দিদি, শুভদীপ দা, রাই যাবে কোলকাতায়। সকালে উঠে পারমিতা দি জানালে শেষ রাতে সে নদীতে বাইসন দেখেছে। রিসোর্টের বারান্দায় অনেকগুলো কুকুর থাকে। তাদের চিৎকারে দিদি বাইরে এসে বাইসন দেখতে পায়।  সকালে নাস্তা শেষ করে আমরা বের হয়ে গেলাম কোচবিহার রাজবাড়ী উদ্দেশ্য। কোচবিহার পৌঁছে প্রথমেই আমরা গেলাম রাজবাড়ি থেকে একটু অদূরে মদনমোহন মন্দিরে। মন্দির থেকে বের হয়ে গেলাম অপজিটে বড় একটি দিঘি আছে সেটার পারে। সাইনবোর্ডে দেখলাম নাম লিখা আছে বৈরাগী দিঘি। দিঘির পারে ঠান্ডা হাওয়ায় গা জুড়িয়ে খেলাম লেবু দেয়া আঁখের শরবত। শরবতের বিষয় উল্লেখ করার কারণ আঁখের সাথে কখন লেবু দিয়ে খাওয়া হয়নি, বেশ ভালো লেগেছিল এই নতুন টেস্ট। তারপর আমরা চলে গেলাম কোচবিহার রাজবাড়ীতে। যেতে যেতে গুগল করে জানলাম এটি তৈরি করেছেন রাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসের আদলে। নিচ তলা, দুই তলা মিলিয়ে কয়েকটি কক্ষে হাতিয়ার, দেব দেবীর মূর্তি, রাজ পরিবারের সদস্যদের ছবি দিয়ে সাজানো তারপর দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা চলে গেলাম নিউ আলিপুর দুয়ার স্টেশনে। স্টেশনে টিকেট করে এসি অপেক্ষাকক্ষে বসার সুযোগ আছে। আমরা রুমে ব্যাগ ট্যাগ রেখে স্টেশনের অপজিটে স্থানীয়  কারুশিল্পের দোকান থেকে বাঁশ কাঠের ঘর সাজানোর উপকরণ নিয়ে স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকলাম। ট্রেনে যেতে যেতে রাই এর লিখা কবিতা পড়ছিলাম আর ওর সাথে কবিতা নিয়ে কথা হচ্ছিল। ট্রেন যত সামনে এগুচ্ছিল মনখারাপ লাগা তত বাড়ছিল, এতদিন একসাথে থাকা মুহূর্ত শেষ হয়ে আসছিল। 

বিদায় মুহুর্ত কেন এত বিষণ্ণ ভরা হয়!

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Dooars