নাগাল্যান্ড কথন || গৌহাটি টু কোহিমা যাত্রা

খিলখিল হাসির শব্দে হঠাৎ এসে যাওয়া তন্দ্রাভাবটাও কেটে গেলো!

শিলং থেকে গোহাটি পৌঁছে দেরি না করে ডিমাপুরের ট্রেন নাগাল্যান্ড এক্সপ্রেসে উঠে পড়েছি। রাত ১১ঃ৩৫ এ ট্রেন ছাড়ার পর একটু ঘুমিয়ে নিয়ে চাঙ্গা হবো ভেবেছিলাম। কিন্তু সারাদিনের সব সুখস্মৃতিগুলো নিউরনের মধ্যে হুটোপুটি করছিলো। অগত্যা ফোন বের করে সারাদিনের তোলা ছবিগুলো এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে তন্দ্রাভাব চলে আসছিলো, টের পাইনি! কিন্তু তন্দ্রাভাবটাকে আরেকধাপ এগিয়ে কুম্ভকর্ণের ঘুমে রূপ দেওয়ার আগেই খিলখিল হাসির শব্দে সচকিত হয়ে উঠলাম। চারপাশে নিকশ অন্ধকার। আমাদের দেশের ট্রেনের মতো কম্পার্টমেন্টের ভেতর সারারাত লাইট জ্বালানো থাকে না এদেশে। ব্যাপারটা একদিক দিয়ে ভালো। শান্তিতে ঘুমানো যায়। ট্রেন দুলকিচালে ছুটে চলছে আপন গতিতে। মাথার উপরের বার্থে অনিন্দ্য আর তার পাশের দুই আপার বার্থে রেজা আর তাসিক তো দিব্যি নাক ডাকাচ্ছে!

নাগাল্যান্ড প্রবেশ গেট

তাহলে হেসে উঠলো কে একটু আগে?
কর্ণগহ্বরের পর্দায় এরকম কম্পন সৃষ্টি করা মিষ্টি হাসির উৎস কি তাহলে?
কোনো অশরীরী? আত্না?
নাকি আমার তন্দ্রাভাবের সুযোগ নিয়ে হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে থাকা কোনো রমণী ঠাট্টাচ্ছলে একটু উঁকি দিয়ে গেলো!?

হঠাৎই ট্রেনের মধ্যে এক চিলতে আলো এসে পড়লো ঠিক অপর পাশের লোয়ার বার্থ দুটোয়। স্ট্রীট লাইটের আলো ট্রেনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে। তাতে আলো আধারির সৃষ্টি হয়েছে। আলো আধারির খেলায় ঠিক সামনের লোয়ার বার্থে হঠাৎ যাকে দেখলাম তাকে অশরীরী ভেবে চিৎকার দিয়ে উঠলেও ঘরঘর কিছু অদ্ভুদ আওয়াজ ছাড়া আর কিছু বের হলো না গলা দিয়ে। পরমুহূর্তেই ভুল ভেঙ্গে গেলো! আরে এ যে একেবারে রক্তমাংসে গড়া মনুষ্য প্রজাতি! অশরীরী আর কোথায়! কালো জিন্স আর ততোধিক কালো একটা টপস পড়েছে। জানালা দিয়ে আপন মনে বাইরে তাকিয়ে আছে। আর থেকে থেকে একলা একলাই হেসে উঠছে খিলখিল করে! মুক্তোর মতো আলো ঠিকরে পড়ছে যেন হাসির সাথে সাথে। রাতের স্নিগ্ধ বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকে তার চুল উড়িয়ে দিয়ে আমার সামনে এসে ব্যঙ্গাত্মক ভাব নিয়ে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। তার রূপের বর্ণনা দেওয়া আমার সাধ্যির বাইরে। এই জীবনে এত এত জার্নি করলাম কিন্তু পাশের সীটে গতকাল অব্দি বুড়ো-বুড়ি-কাচ্চা-বাচ্চা থেকে শুরু করে আরো কত কি বসেছে কিন্তু কই কখনো কোনো রমনী তো জোটেনি এই পোড়া কপালে! এমনকি একবার লোকাল বাসে রাজশাহী থেকে চাপাই যাওয়ার সময় সহযাত্রীর মুরগীও পাশের সিটে বসেছিলো! কিন্তু রমনী? উঁহু না! কক্ষনো পড়েনি! আর সুন্দরী রমণী তো আরও দূর কি বাত! আজ জীবনের তেইশটা বসন্ত বাদে এরকম এক রোমান্টিক পরিবেশে এরকম এক পরীর মতো রূপসী নাগা রমণীকে সামনের বার্থে একা পেয়ে যাবো কস্মিনকালেও তো ভাবতে পারিনি! নাহ, এ নেহাত কর্তা উপর থেকে নিজ হাতে ঢেলে দিয়েছে! মুগ্ধতা নিয়ে কতক্ষণ চেয়ে ছিলুম জানিনা। সতবিৎ ফিরে পেলাম মেয়েটার আমার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিতে হেসে আর তারচেয়েও অদ্ভুত দুর্বোধ্য ভাষায় কি যেনো বললো, সেটা শুনতে পেয়ে!

বাহ! সেও কি তাহলে আমাকে চায়? যতোই দুর্বোধ্য হোক না কেন, ভাষাগত সমস্যা পৃথিবীর ইতিহাসে কখনোই ভালোবাসার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, এখনও পারবে না। এ বিশ্বাস আমার আছে। আচ্ছা আমিও তার জীবনের জার্নিতে কি প্রথম কোনো পুরুষ? সে যাইহোক ভালোবাসা বারে বারে আসে না। এসেই যখন পড়েছে হেলাফেলা নয়। ভবঘুরে জীবনে থিতু হওয়ার এই তো সুবর্ণ সুযোগ। এসব ভাবতে ভাবতে হাত নেড়ে প্রতিউত্তরে যেই না হাসি দিতে যাবো ঠিক তখনোই পেটে হাত বুলোতে বুলোতে আমার পাশ দিয়েই টাকমাথা, থুতনিতে চার-পাঁচটা দাড়িওয়ালা ত্রিশোর্ধ্ব এক বুড়ো হেলতে দুলতে মেয়েটার পাশে গিয়ে বসলো। বুঝলাম মেয়েটার এরকম হাসি আর দুর্বোধ্য ভাষা আমার উদ্দেশ্যে ছিলো না! লোকটা নিশ্চিত ট্রেনের ওয়াশরুমে গেছিলো, কাজ সেরে এখন ফিরে এসেছে।

ব্যাটা এরকম একটা পরী কিভাবে পেলো!

এই রাত দুপুরে ওদের আলিঙ্গনে কেবিনের চিপায় লুকিয়ে থাকা টিকটিকিটা পর্যন্ত লজ্জা পেয়ে গেলো আমি নিশ্চিত। মনে মনে একশোটা বাংলা গালি আর হাজারটা বদদুয়া দিয়ে ভাঙ্গা মনটাকে “কপালের দোষ” বলে সান্ত্বনা দিয়ে বার্থে আবার গা এলিয়ে দিলাম। ট্রেন ছুটে চলেছে। থামার কোনো নামগন্ধ নেই। আবার কালিগোলা অন্ধকার নেমে এসেছে। চারপাশে ঘন জঙ্গলের মতো মনে হচ্ছে। কর্কশ শব্দে একটা প্যাঁচাও ডেকে উঠলো মনে হলো। হয়তো এই রাত বিরাতে ট্রেনের শব্দ ওর ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। আচ্ছা প্যাঁচারা কি রাতে ঘুমায়? হয়তো আমার মতো অলস টাইপের! রাতেও তাই ঘুমুচ্ছিলো!

ভোর ৫ঃ৩০। ডিমাপুর রেলস্টেশন । ট্রেন থেমে গেছে। সামনের কাপলটা নেমে গেছে। আমার ট্যুরমেটদের ঘুম ভাঙ্গার নাম নেই। নিম্নদেশে দুটো লাত্থি মেরে ঘুম থেকে তুলে স্টেশনে পা দিলাম।

ডিমাপুর রেল স্টেশন

আহ নাগাল্যান্ড! অনেক দিনের লালিত স্বপ্ন! অবশেষে স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে! বিশ্বাসই হচ্ছিলো না নাগাল্যান্ডের আকাশ বাতাস মাটি সব আমার সাম্নে!

নাগাল্যান্ড ভারতের উত্তর-পূর্বের অন্যতম সুন্দর এবং বিস্ময়কর রাজ্য। আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা, মনিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল কে একসাথে ‘সেভেন সিস্টারস’ নামে অভিহিত করা হয়। “সেভেন সিস্টার্সের” অন্যতম সদস্য নাগাল্যান্ডের সুউচ্চ পাহাড়ের পরতে পরতে যেন ছড়িয়ে আছে সবুজ গালিচা। এখানকার বিস্ময়, অ্যাডভেঞ্চার আর উপজাতীয় সংস্কৃতি পুরো পৃথিবীর পর্যটকদেরই হাতছানি দিয়ে ডাকে। দুর্গম পাহাড়ি পথ আর ততোধিক দুর্বোধ্য অধিবাসীরা সবসময়ই বিস্ময় জাগায় এই অঞ্চল সম্পর্কে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন উপরওয়ালা নিজ হাতে এখানে ঢেলে দিয়েছেন।

ডিমাপুর নাগাল্যান্ডের অন্যতম বড় শহর। এন্ট্রি শহরও বলা যায়। মানে বাস, ট্রেন, বিমান যেভাবেই আসেন না কেন, ডিমাপুর দিয়েই নাগাল্যান্ডে এন্ট্রি নিতে হবে। কারণ এয়ারপোর্টও ডিমাপুরেই। তবে মনিপুর দিয়ে বাইরোডে আসলে অবশ্য ডিরেক্ট রাজধানী শহরে পৌঁছে যাবেন।

কোহিমা হলো নাগাল্যান্ডের রাজধানী। হিমালয়ের পাদদেশে উপজাতীয় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে সুউচ্চ ঘন সবুজ পাহাড়ের গায়ে গড়ে ওঠা এ শহর ভারতের অন্যতম বড় আর সুন্দর পাহাড়ি শহর। পাহাড়ের বুকে বৃটিশ স্টাইলে গড়ে ওঠা শহরের কিছু কিছু বাড়িঘর দেখলে এ শহরের সাথে বৃটিশদের ইতিহাস মনে পড়ে যায়।

কোহিমা সিটি

তৎকালীন উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রেক্ষাপটে নাগাল্যান্ডের মানুষজন বিদ্রোহ করে বসে। ভারতবর্ষের বিভক্তির সময় ভারতের সাথে অঙ্গীভূত হতে অস্বীকার করে ১৯৪৭ সালেই তারা নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ভারত সরকার এ দাবি মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং পরবর্তীতে অনেক রাজনৈতিক উত্তানপতনের ভেতর দিয়েই আজকের এই নাগাল্যান্ড।

বৃটিশ শাসনামলে নাগা জাতির মানুষজনকে সরকারি আমলা পর্যায়ে ভালোই দেখা যেতো। কারণ তারা খৃষ্টান মিশনারিদের সংস্পর্শে এসে ইংরেজি শিক্ষায় অনেক এগিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু তারপরও গোটা দুনিয়ার কাছে এরা রহস্যময় হিসেবে পরিচিত কারণ এরা নিজ এলাকার গন্ডির বাইরে খুব কমই যেতো। এমনও জানা যায়, সরকারী চাকরিতে নাগাল্যান্ডের বাইরে বদলী করে দিলে তারা চাকরী ছেড়ে দিতো তাও নিজ এলাকা ছেড়ে যেতো না। এজন্যই উপমহাদেশের অন্যান্য জাতির মতো সারা পৃথিবীতে এদের খুব কমই দেখা যায়। ছড়িয়ে পড়তে পারেনি এরা এদের চিরায়ত সমাজের প্রেক্ষাপট ভেঙ্গে। সেই সাথে বাইরের মানুষজনকেও এরা সহজে আপন করে নিতে পারে না। এসব কারণে বাইরের মানুষের কাছে এরা বিস্ময়ের চাদরে ঢাকা এক আশ্চর্য জাতিসত্তা। তবে এ ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটছে ইদানীংকাল। গুটিকয়েক দেশের নাগরিকদের জন্য আগে নাগাল্যান্ড ভ্রমণের পারমিশন থাকলেও, এখন অনেক দেশের নাগরিকদের জন্য তা উন্মুক্ত। বাংলাদেশীদের জন্য আগে থেকে এখন আর কোনো পার্মিশন জোগাড় করতে হয় না। লোকাল থানায় গিয়ে এন্ট্রি করে নিতে হয় শুধু। যদিও ইন্ডিয়ানদের জন্য ইনার লাইন পারমিট (ILP) নিতে হয় ভ্রমণের আগেই।

দুর্ধর্ষ এই নাগা জাতির ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হয়ে আছে এদের “হেড-হান্টিং” পরিচিতি। বেশিদিন আগে নয়, এরা মানুষের মাথা শিকার করে নিয়ে গিয়ে বীরত্বের নিদর্শন হিসেবে টাঙ্গিয়ে রাখতো। “ট্রফি” হিসেবে সাজিয়ে রাখা এসব খণ্ডিত মস্তকের রেওয়াজ বেড়ে গিয়ে অনেক ভয়াবহ ও ব্যাপক আকার ধারণ করলে তারা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই দুর্গ টাইপের দুর্ভেদ্য আবাস গড়ে তোলে। এর ফলে কালেক্রমে বিচ্ছিন্নতা তাদের গ্রাস করে নেয়। জন্ম নেয় একাধিক গোত্রের।

নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা

নাগা উপজাতির অন্তত ১৬ টি প্রধান সম্প্রদায় বসবাস করে পুরো নাগাল্যান্ড জুড়ে। এদের মধ্যে সুমি, আঙ্গামি, কোনিয়াক, আও, চাকেসাং, কুকি, কাচারি, চাং, প্রচুরি, লোথা এসব উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি উপজাতির আবার নিজেদের ভাষা, ইতিহাস-ঐতিহ্য, উৎসব রয়েছে। তাদের এসব উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর প্রধান প্রধান উৎসবকে একই সময়ে একই জায়গায় অনুষ্ঠিত করার জন্য নাগাল্যান্ড সরকার প্রতি বছর ১লা ডিসেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোহিমাতে আয়োজন করে হর্ণবিল উৎসবের যার ইংরেজি নাম Hornbill Festival. রাজধানী কোহিমা থেকে অল্প দূরত্বেই কিসামা হেরিটেজ ভিলেজে অনুষ্ঠিত এই হর্ণবিল উৎসবে নাগাল্যান্ডের প্রধান প্রধান জনগোষ্ঠীগুলোর কৃষ্টি, ঐতিহ্য, আচার, ইতিহাস, গান, যুদ্ধ, খেলা, লোককাহিনী এসবের উপর উপস্থাপনা আর অনুষ্ঠান দেখানো হয় নানা রংবেরঙের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত অবস্থায়।

শামুক। এটা কিভাবে রান্না করে জিজ্ঞাস করা হয় নাই!

সারা পৃথিবীর পর্যটকদের কাছেই এই উৎসবের আবেদন অন্য পর্যায়ের আর তাই অনেক বেশি পর্যটকের সমাগম ঘটে ওই সময়টায়। হোটেলে রুম সব বুকড হয়ে থাকে দু’মাস আগে থেকেই। তাই কেউ যেতে চাইলে আগস্টের মাঝামাঝি থেকেই হোটেল আর গাড়ির বুকিং শুরু করা উচিত। নভেম্বর মাসের পর আর কিছু খালি পাওয়া যায় না। কালেভদ্রে দু’একটা রুম মিললেও খরচা পড়ে যাবে কয়েকগুণ!

যাইহোক অনেকই তো ইতিহাস কপচানো হলো, এবার মূল ভ্রমণে ফেরা যাক! পাথরের চাদর বিছানো ছিমছাম শৈলরাজ্য কোহিমা শহরে আমাদের পৌঁছতে বেশ বেগ পেতে হলো। কারণ হলো ডিমাপুর থেকে কোহিমা পর্যন্ত রাস্তার অবস্থা এতটাই খারাপ যে তা আমাদের যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার নির্মাণকালীন শনির আখড়া টু টিকাটুলীর রাস্তাকেও হার মানিয়ে দিবে! যদিও পাহাড় কেটে ফোরলেন করার কাজ দেখলাম বেশ দ্রুত গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছে। এ রাস্তাটাই আসাম থেকে নাগাল্যান্ড হয়ে মনিপুরের ইম্ফাল পর্যন্ত ন্যাশনাল হাইওয়ে নাম নিয়েছে। হয়তো রাস্তাটা একদম আইজল পর্যন্তও চলে যাবে।

এই জিনিসের স্যুপ রান্না করে খায় নিশ্চিত!

ডিমাপুর স্টেশনের বাইরেই ট্যাক্সি, অল্টো, সুমো মিলে। সেখান থেকে কিঞ্চিত দামাদামি করে একটা ফোর সীটার অল্টোতে চড়ে বসেছিলাম। ডিমাপুরের সমতল ছাড়িয়ে ওয়েলকাম টু নাগাল্যান্ড লেখা সুন্দর এক গেট দিয়ে পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশ করতে গেলেই চেকপোস্টে আটকে দিলো!
“কাঁহা সে আয়া? ILP দিখাও!”
বললাম বাংলাদেশ থেকে আসছি, ILP নাই। উহু সে মানবেনা। ILP ছাড়া ঢুকা যাবেনা। এরপর তাকে ভুলভাল হিন্দিতে খুলে বললাম, “হামলোগ বাংলাদেশ সে আয়া। উহাপে পৌঁছনেকে বাদ লোকাল পুলিশ স্টেশন মে এন্ট্রি কারুঙ্গা!”
শুনে আর কাহিনি-কাবজাব না করে ছেড়ে দিলো।

প্রায় ৪ ঘন্টা পর ধুলো দিয়ে গোসল করে কোহিমা এসে পৌঁছলাম যখন, ঘড়ির কাটা তখন দুপুর ১২ টার ঘরে টিকটিক করছে। ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে নেমে ভাড়া চুকিয়ে আধঘণ্টা এদিক সেদিক ঢু মেরে তেমন কোনো বাজেট হোটেল না মিলায় শেষ পর্যন্ত ট্যাক্সিস্ট্যান্ডের পাশেই হোটেল গ্যালাক্সিতে রুম নিলাম। বাজেট ট্রাভেলার্সদের জন্য এই হোটেলটা রিকমেন্ডেড। ব্যাকপ্যাক রেখে একটা শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে পেটে ছুচোর দৌঁড়াদৌড়ি থামাতে ছুটলাম। আশেপাশে প্রায় দশ বারোটা হোটেল আর রেস্ট্যুরেন্টে ঢু মেরে মেন্যু দেখে খানিকটা অবাক আর কিছুটা হতাশই হতে হলো। প্রায় সব জায়গায়ই মেন্যুতে কুকুর, শূকর আর হাবিজাবি কি কি যেনো আছে। হালাল খাবারের জন্য ইন্ডিয়ায় ঢোকার পর থেকে ভেজ দিয়েই পেটপুজো করতেছি। কিন্তু কোহিমা এসে ভেজ খুঁজে পাওয়াই দায় হয়ে উঠলো। টিপিক্যাল নাগারা বিফ আর পর্ক খেতে খুব ভালোবাসে। ভাতের সাথে মাছ, সবজি আর এক প্রকারের টক-ঝাল চাটনি খায় এরা। কুকুর, ব্যাঙ, শামুক আর ইরিপোকা নামের এক বিশেষ ধরণের পোকাও এরা খায়। আমাদের তো আর এসবে চলবে না বিধায় সামনের ট্রাফিক মোড়ে ব্যাঙ-শামুক-ইরিপোকা বিক্রেতা এক নাগা আপুর কাছে আশেপাশে কোনো বাঙ্গালী রেস্তোরাঁ আছে কিনা জিজ্ঞেস করায় উনি দিব্যি হাত তুলে সামনের একটা রেস্তোরাঁ দেখিয়ে দিলো। ধন্যবাদ দিয়ে ছুটলাম সেদিকে। আর. কে. হোটেলে বসে খাওয়াদাওয়ার ফাঁকে জমিয়ে আড্ডাও হলো রেস্তোরাঁয় থাকা ত্রিপুরার এক বাঙ্গালী ছেলের সাথে। তার কাছেই জানলাম নাগাল্যান্ডে প্রচুর বাঙ্গালী মানুষজনের বসবাস আছে!

ইরিপোকা। ভেজে মচমচ করে খায় ওরা!

কোহিমাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক বড়সড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। শহরের মধ্যেই যুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে সাক্ষী হয়ে আছে ওয়ার সিমেট্রি। বিশ্বযুদ্ধের এ কবরস্থান আমাদের দেশের কুমিল্লা আর চট্টগ্রামের ওয়ার সিমেট্রির মতোই। বিকেলটা ওখানে আর শহরের আনাচে-কানাচে একটু ঢু মেরে ডিনার সেরে রুমে ফিরে আসলাম। সন্ধ্যা ছ’টার মধ্যেই সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায় এ শহরে। তাই আগেভাগেই ডিনার সেরে নিতে হলো। রুমে এসে ওয়ার্ল্ডকাপে ব্রাজিলের ম্যাচটা দেখে, পরদিনের জ্যুকো ভ্যালী ট্রেকের মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে, দেশ থেকে প্রায় হাজার কিলো দূরে, বিস্ময়নগরী কোহিমার ক্ষুদ্র এক হোটেলের বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম!

আর কে হোটেলের ভেজ থালি

নাগাল্যান্ডে আরও ঘুরতে পারেন ওয়্যার সিমেট্রি, কিসামা হেরিটেজ ভিলেজ, খোনোমা গেট, নাগাল্যান্ড মিউজিয়াম। দূরবর্তী জেলাগুলোতে আরও কিছু ট্যুরিস্ট প্লেস আছে। মোককচং জেলার চাংতংগ্যা অভয়ারন্য, কোহিমা থেকে অল্প দূরত্বের জাপফু চূড়া এসব বেশ জনপ্রিয়।

নাগাল্যান্ডে এসে স্থানীয় থানায় এন্ট্রি করে নিবেন পাসপোর্ট দিয়ে। না করলেও খুব বিশেষ কিছু হয় না। তবে নিয়ম মেনে করে নেওয়াই উচিত। বাংলাদেশীদের জন্য এটাই যথেষ্ট বা এটাই নিয়ম। যদিও আমরা ৩ দিন ছিলাম কোনো প্রকার এন্ট্রি না করেই!

খরচার খাতা থেকে

  • গোহাটি টু ডিমাপুর স্লীপার ক্লাস ট্রেন ৬৬০ রুপি(৪ জন)
  • ডিমাপুর টু কোহিমা অল্টো রিজার্ভ ১১০০ রুপি। লোকাল সুমো আছে ২৫০ রুপি করে।
  • হোটেল গ্যালাক্সি (ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের পাশেই – রিসেপশনের ছেলেটা অনেক মিশুক আর হেল্পফুল, বাঙ্গালী। আমাদের অনেক ভালো লাগছে ওকে। রেকমেন্ডেড) ৪ জনের রুম ১০০০ রুপি/নাইট
  • লাঞ্চ/ডিনার ১০০ রুপির মধ্যে ভালোভাবে হয়ে যাবে।

হ্যাপী ট্রাভেলিং ❤

নাগাল্যান্ড নিয়ে আমার আরেকটি লেখা – জ্যুকো ভ্যালী – দ্য ভ্যালী অব ফ্লাওয়ারস || নাগাল্যান্ড

Leave a Comment
Share