আমার থাইল্যান্ড ভ্রমণ ও ইতি-বৃত্তান্ত

চট্টগ্রাম থেকে আমি রিজেন্টের টিকেট করলাম নভেম্বরের ৩ তারিখে, ২৭,০০৩ টাকা দিয়ে। সাথে ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই তানজিদ, সে যাবে ঢাকা থেকে। একই ফ্লাইটে। টিকেটের দাম ঢাকা থেকে ২৩,৮৮৩ টাকা। এই ফ্লাইট ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম আসে। চট্টগ্রাম থেকে ব্যাংকক। সপ্তাহে মনে হয় ৪ দিন। রবি, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র। খাওয়া ভালই দেয়। চিকেন উইথ রাইস, বিস্কিট, মিষ্টি, কোল্ড ড্রিংক, চা।

সুবর্ণভুমি এয়ারপোর্টে নেমে বিশাল পথ পাড়ি দিয়ে ইমিগ্রেশন। নাম জিজ্ঞাসা করলো, কি করি জিজ্ঞাসা করলো, কেন আসছি জিজ্ঞাসা করলো। থাই এয়ারপোর্টে এরাইভ্যাল কার্ড আর ডিপারচার কার্ড এক সাথে দেওয়া থাকে, একই সিরিয়াল। ওরা এরাইভ্যাল ছিঁড়ে নিল, ডিপারচার কার্ড পিন করে পাসপোর্টেই লাগাই দিল। ততক্ষণে বেল্টে লাগেজ চলে এসেছে। যাওয়ার সময় ওই ডিপারচার কার্ড ওরা নিয়ে নিবে।

লাগেজ নিয়ে এবার অপারেশন ডলার একচেঞ্জ ও সিম কেনা। তানজিদ যাওয়ার সময় কিছু বাথ নিয়েছে, কাজেই এখন ডলার একচেঞ্জ না করলেও হবে। লাগবে সিম কেনা। সিম কিনতে গেলাম। ডিটেক সিম আছে একটা। টেলিনর কোম্পানির। ডিটেক হ্যাপি টুরিস্ট সিম। এদের ৭ দিনের একটা টুরিস্ট সিম প্যাকেজ আচ্ছে, ২৯৯ বাথে ১০০ বাথ কল আর আনলিমিটেড ইন্টারনেট। আমরা থাকবো ৯ দিন। বাধ্য হয়ে ১০ দিনের প্যাকেজের সিম নিলাম। ৯৪ বাথ কল আর আনলিমিটেড ইন্টারনেট। সিম কেটে কুটে ওরাই একটিভ করে দিল। আমরা খালি মোবাইল দিলাম। দাম রাখলো ৪৪৯ বাথ। বাই দ্যা ওয়ে, তানজিদ দেশ থেকে বাথ নিয়ে গিয়েছিল, ১ বাথ= ২.৫০ টাকা করে।

সিম কেনা শেষে এয়ারপোর্টের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে একদম নিচে চলে আসলাম। এখান থেকে পাতায়ার বাস ছাড়ে। ১২০ বাথ করে। থাইল্যান্ডে যারা ঘুরতে আসে, সবাই সাধারণত এয়ারপোর্টে নেমেই পাতায়া চলে যায়। আমাদেরও প্ল্যান সেরকমই ছিল। ভাগ্যও ভাল ছিল, আমরা ৪৫ মিনিট পরের টিকেট পেয়ে গিয়েছিলাম। রাত ৮ টার বাস। ৩ মিনিট পরেই ওই বাসের টিকেট শেষ। সকাল থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত পাতায়া এর বাস থাকে এয়ারপোর্ট থেকে।

আমরা পাতায়া টার্মিনালে নামলাম ১০ টায়। এইবার মেজাজ খারাপ। এতো পথ পাড়ি দিলাম ১২০ বাথ দিয়ে, আর এইখান থেকে পাতায়া বিচ রোড যেটে টুকটুকে জনপ্রতি ১০০ বাথ চায়। দুইজনে ৩০০ বাথে একটা ট্যাক্সি নিলাম। আমাদের হোটেল কিন্তু বুকিং নাই। এই গ্রুপের একজনের পোস্টে পোস্ট অফিস গেস্ট হাউজ নামের একটা হোটেলের নাম জেনেছি, স্বল্পদামে। আপাতত সেখানেই যাবো এরকম প্ল্যান। ট্যাক্সিকে বললাম। সে জায়গামত নামায়ে দিল। এরপর দেখি হোটেল বন্ধ। মেজাজ খারাপ করে আশে পাশে দেখতে থাকলাম। মোটামুটি ঘন্টাখানেক খোঁজাখুঁজির পর একটা হোটেল পেলাম। “রেড লঙ্কা হোস্টেল এন্ড রেস্টুরেন্ট”। তুশারা বা রেড, মালিকের নাম। বিচ রোডেই, ম্যাকডোনাল্ডসের পাশে। এখানে ৪০০, ৫০০, ৬০০ বাথের রুম আছে। ৪০০ বাথের নিচে পুরো পাতায়াতে মনে হয় রুম নাই। ৬০০ বাথের রুম যথেষ্ট ভাল। অনেক রাত হয়েছে, আপাতত খোঁজাখুঁজি না করে এটাতেই উঠে পরলাম।

পরদিনের প্ল্যান ঠিক করলাম। পাতায়া থেকে বাসে ফুকেট চলে যাবো। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাস কাউন্টারে যাওয়ার জন্য বের হলাম দুইজন। এক লোক কোহ লার্ন আইল্যান্ডে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। তাকে আমরা বললাম, আমরা ফুকেট যাবো, আগে টিকেট কেটে আসি, এরপর যাবো। সে বলে, টিকেট তুমি যে কোন সময় পাবা, বাস রাত ৮ টায়। তুমি এখন কোহ লান আইল্যান্ডে চলে যাও। আমি ওইদিকের ছেলে, আমি জানি, তুমি বাস পাবা।

ওর কথা বিশ্বাস করে আমরা স্পিড বোটে উঠি। জনপ্রতি ৫০০ বাথ, শেয়ারে। ফেরিতে নাকি আরও কম খরচে যাওয়া যায়, তবে আমরা সময় বাঁচাতে স্পিড বোটেই গেলাম। ওই আইল্যান্ডেই নাস্তা করলাম। এদেরকে বলে দিতে হয় হালাল খাবার। নাহলে কোনখানে কি মেশায় দিবে ঠিক নাই। নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে একটা বাইক নিলাম। ঘণ্টা ৪০০ বাথ। পুরো আইল্যান্ড ঘুরিয়ে আনবে। আমরা বাইক চালাতে পারলে ৩০০ বাথ নিত। যেহেতু আমরা অধম, সেইজন্য ড্রাইভার সহ ভাড়া করা লাগছে। এই এক ঘন্টা অসাধারণ একটা সময় কেটেছে। খালি মনে হচ্ছিল, আরেকটু যদি সময় পেতাম!!

আমাদের আগে থেকে ঠিক করা ছিল, ফিরবো ৩ টায়। আধঘণ্টা দেরি করলো স্পিডবোট, আমরা ফিরতে ফিরতে ৪ টা। ফিরেই তানজিদ দৌড় দিল ফুকেটের টিকেট কাটতে। পৌঁছেই আমাকে ফোন দিল। ফুকেটের বাস ৫ টায় পাতায়া থেকে ছেঁড়ে যাবে। আমাদের হাতে ৬০ মিনিট সময়। যাওয়া সম্ভব না। বাদ দিলাম। তখনই ডিসিশান নিলাম দুইজনে ব্যাকংকে চলে যাবো।

বলে রাখা ভাল, হোটেলের চেক আউট ছিল ১২ টায়। ওকে বলেছিলাম আমরা ৭-৮ টা পর্যন্ত থাকতে পারি, ব্যবস্থা করতে পারবে কিনা। ওরা অতিরিক্ত ৩০০ বাথ নিল এজন্য। আমরা ৬ টার দিকে পাতায়া টার্মিনাল গেলাম, সেখান থেকে বাসে ব্যাংকক। আগেই প্ল্যান ছিল Sukumvit Soi 3 তেই থাকবো, কারণ এখানেই হোটেল মোটামুটি সস্তা। বারমুনগ্রাদ হসপিটাল এর পাশেই একটা বাংলাদেশী হোটেল আছে। “মনিকা’স কিচেন”। সেখানেই নামলাম। ওইখানে একজন বাংলাদেশী ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি পাশের একটা গেস্ট হাউজের ঠিকানা দিলেন। “রানা ইন”। ৭০০ বাথ করে। ওইরাত ওইখানেই থাকলাম।

পরদিন উনাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, কেউ আমাদেরকে ফুকেটের এয়ার টিকেট কেটে দিতে পারবে কিনা? তিনি এক ভদ্রলোকের ঠিকানা দিলেন। সেলিম জাহাঙ্গীর, ওইখানেই একটা ট্যুরিস্ট এজেন্ট। উনার কাছে গেলাম। ফুকেটের সব কিছু কথা বার্তা বলে ওইখানেই ঠিক করলাম। বলে রাখা ভাল, উনি যা বলছেন, সাথে সাথে আমরা সবকিছু ক্রস চেক করেছি গুগল, আগোডা, ট্রিপ এডভাইজরে। শেষ পর্যন্ত তার থেকেই আমরা ট্রিপ প্যাকেজ নিলাম। ফুকেটে রাউন্ড এয়ার টিকেট ৩২৭০ বাথ, থাই লাওন এয়ার। সেদিন রাতেই ফ্লাইট। হোটেল, বাকি ট্যুর সব উনার থেকেই নিলাম, সেগুলো নিচে লিখছি। এরপর তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা আন্ডার ওয়ার্ল্ড এক্যুরিয়াম আর মাদাম তুস্যোতে যাবো। তিনি ১১৫০ বাথ করে জনপ্রতি একটি প্যাকেজ দিলেন। এরপর আমরা হেটে নানা বিটিএস স্কাই ট্রেন স্টেশনে গেলাম, সেখান থেকে ২৫ বাথ করে টিকেট নিয়ে সিয়াম স্টেশন। সিয়াম প্যারাগনে হচ্ছে আন্ডার ওয়ার্ল্ড এক্যুরিয়াম। এখানে এসে টিকেট করলে জনপ্রতি ৯৯০ বাথ। শুধু আন্ডার ওয়ার্ল্ড এক্যুরিয়াম এর এন্ট্রি। এরপর সিয়াম ডিস্কোভারিতে গেলাম। সেখানে মাদাম তুস্যো। এখানেও জনপ্রতি এন্ট্রি ৯৯০ বাথ। আর আমরা পুরো প্যাকেজে ১১৫০ বাথ। আসলে এটি পুরো থাইল্যান্ডে সিস্টেম। ট্যুর এজেন্টরা অনেক কম প্রাইজে ট্যুর অফার করে এখানে। যাই হোক, মাদাম তুস্যো শেষ করে একটা ফ্রি ৪ডি মুভি দেখায়। ১০ মিনিট। ওইটাও দেখলাম। আবার একই স্কাই ট্রেনে হোটেল। হোটেল থেকে ব্যাগ নিয়ে মিটারে ট্যাক্সিতে ডন মুয়াং এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে ফুকেটের বিমান।

ফুকেটে নেমে এয়ারপোর্ট থেকে শেয়ারে মিনিবাস যায় শহরে। ১৮০ বাথ করে। আর ট্যাক্সি চায় ৮০০ বাথ। আমরা মিনিবাসেই উঠলাম। আমাদের হোটেল পাতং বিচের কাছাকাছি, সানসেট ম্যানশন, ১২০০ বাথ করে। আমরা দুইরাত থাকবো। আগোডাতে এই হোটেল ১৪০০ বাথ দেখায়। রাতে থাকলাম।

পরদিন সকাল ৭ টা ৪০ মিনিটে জেমস বন্ড আইল্যান্ড বা ফোর আইল্যান্ড ট্যুর। ওদের গাড়ি আসলো। এটাও মিনিবাস টাইপ গাড়ি। ফুকেটে এটা একটা মাস্ট টেইক ট্যুর। আমরা ব্যাট আইল্যান্ডে গেলাম। ক্যানু নিয়ে কেইভে ঢুকলাম। পরে নিজেরাই ক্যানু চালালাম। এই প্যাকেজ ১১০০ বা ১২০০ বাথ করে খুব সম্ভবত। লাঞ্চ ইনক্লুডেড। ওদের বোটেই লাঞ্চ দেয়।

পরদিন ৭ টায় গাড়ি আসলো। আমরা একেবারে হোটেল চেক আউট করে ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। আজ যাবো ফি ফি আইল্যান্ডে। এই প্যাকেজও একই রকম প্রাইজ। ১২০০ কি ১৩০০ বাথ। স্নরকেরলিং করলাম, লাঞ্চ করলাম, বিকেলে ফেরত আসলাম। এই ট্যুর এতো ভাল লাগে নাই। এইটা মনে হইলো হানিমুন ট্যুর। হানিমুনে যারা আসে, তারা একরাত এইখানে থাকলে বেশ ভাল লাগবে। বিকেলে ডাঙ্গায় ফিরে সরাসরি এয়ারপোর্ট। রিটার্ন ফ্লাইটে ব্যাংকক।

ট্যুরের এই পর্যায়ে আমাদের সাথে যোগ দিলেন জাহিদ ভাই। ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই। তিনি ব্যাংকক এসেছেন চিকিৎসার কাজে। আমরা একসাথেই থাকবো। ভাই হোটেল নিলেন sukumvit soi 3 তে। পি বি হোটেল। এমনিতে ভাড়া ৮৬০ বাথ। ৩ জনের জন্য ১২৯০ বাথ। একটা এক্সট্রা বেড এরেঞ্জ করে দিল ওরা। ওই রাতে খেয়ে দেয়ে ঘুম। রাতেই সেলিম জাহাঙ্গীর আঙ্কেলকে ফোন দিয়ে রাখলাম, আমরা পরদিন সাফারি ওয়ার্ল্ড ট্রিপে যেতে চাই। পরদিন ৮ টা ৩০ মিনিটে গাড়ি এসে আমাদের পিক করলো। জনপ্রতি ১০৫০ বাথ। রাউন্ড ট্রিপ আর লাঞ্চসহ। এইখানে অন্যরকম এক এক্সপেরিয়েন্স হল সাফারি পার্কে ঘোরা। গাড়িতে ঘুরছি আর জন্তু জানোয়ার খোলা হাটছে।

এর পরদিন আবার প্যাকেজ নিয়ে গেলাম সিয়াম পার্ক সিটিতে। ৭৪০ বাথ করে প্যাকেজ। লাঞ্চ সহ। তবে যেতে হবে নিজেদের। আঙ্কেল আগেই বলে রেখেছিলেন, ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কখনও বলবে না তোমাদের টিকেট আছে। তাহলে ও তোমাদের নিবে না। বলবা, টিকেট নাই। ওইখানে গিয়ে বলবা, তোমাদের ফ্রেন্ড আছে, ও টিকেট এরেঞ্জ করবে। মিটারে ২০০ বাথের মত ভাড়া আসলো। এইখানে লাঞ্চটা অসাধারণ।
ফিরে এসে ওইরাতে আমরা একটা টুকটুক রাইড নিলাম। তানজিদের আবিষ্কার। ৩০০ বাথে ১ ঘন্টা। অনেক রাতে ভালই লাগে।

এর পরদিন, মানে গত বৃহস্পতিবার ছিল শপিং। আর শুক্রবার দেশেই ফিরে আসলাম। শপিং মোস্টলি করেছি এম বি কে থেকে। কিছু সিয়াম প্যারাগন, সেন্ট্রাল ওয়ার্ল্ড, রবিনসন, টার্মিনাল ২১ এসব জায়গা থেকেও। পুরো যাতায়াত ছিল পায়ে হেটে অথবা স্কাই ট্রেনে।

ব্যাংককে প্রচুর ট্র্যাফিক জ্যাম থাকে। কিন্তু এরা কত ভয়ানক রকম ভাবে ট্র্যাফিক রুলস মেনে চলে। এক ড্রাইভার নিজেকে খুব এক্সপার্ট ড্রাইভার বলতেছিল। তানজিদ তো বলেই বসলো, কাম টু মাই কান্ট্রি মাই ফ্রেন্ড। আফটার দেন, উই ক্যান জাজ, হাও গুড ড্রাইভার ইউ আর।

খাবারের সব অপশন আছেই। ব্যাংকক ছাড়া ভাত পাওয়া টাফ, তবে ফ্রাইড রাইস আর স্টিকি রাইস পাওয়া যায়। আর ওদের হালাল বললেই ওরা পর্ক ছাড়া মেন্যু দেখায়ে দেয়। স্ট্রিট ফুড জোস। বেশি জোস। আর সবচেয়ে জোস জুস। আমরা ৮ দিন বলতে গেলে পানির থেকে বেশি জুসই খাইছি।

মোটামুটি সব ইনফো দিলাম। টাকার হিসাবও দিলাম। প্রথমবার হিসেবে এইটাই আমার জানা। আর ১০০ ডলার = ৩৪৭৫ থেকে ৩৪৯০ বাথ পর্যন্ত পেয়েছি।

একটা পরামর্শ, প্রথমবারে আমার অবজারভেশন, হানিমুনে অথবা বউ নিয়ে থাইল্যান্ডে যাওয়া উচিত না। গেলেও ক্রেডিট কার্ড নিয়ে যাওয়া উচিত না। 😛

✍ লেখকঃ সৈয়দ জাহাঙ্গীর

Leave a Comment
Share