মায়াবী লেপচাজগত, আদরিণী করবিয়া ভ্রমণ

সারা রাত ধরে মেঘেরা কেঁদেছে। সে কান্নায় ধুয়ে গেছে লেপচা জগতের মাটিও। কাল যখন আসছি এখানে, তখন থেকেই দেখছি কাজল কালো মেঘেরা ধূসর আঁচলের আড়ালে মুখ ঢেকেছে। আকাশ থেকে চুরি করে রাখা কমলা রঙের সুয্যির টিপটাও কপালে লাগাতে ভুলেছে তারা। ধূপি গাছের উঁচু করে রাখা মাথার মস সবুজ চুলগুলো এলোমোলো করে দেয় যে হাওয়া তারাও দল পাকিয়েছে সেই মেঘেদের সঙ্গে। দুটো ফিঙে ভালোবাসাবাসির আনন্দে মশগুল। মেঘ আর হাওয়ার সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে জঙ্গলের মাঝে লুকোচুরি খেলছে।

সন্ধ্যা যখন আরও একটু গভীর হল, মেঘেরা ঘন হয়ে এল জঙ্গলের কাছে, মুখ রাখল জঙ্গলের বুকে। বহু দিন ধরে নানা অভিজ্ঞতায় একটু একটু করে বড় হয়ে ওঠা জঙ্গুলে গাছগুলো পরম মমতায় আশ্রয় দিল তাদের, পরশে ঋদ্ধ হল মেঘেরা। জঙ্গলের বুকে বেয়ে তাদের সব অভিমান কান্না হয়ে মিশে যেতে থাকল মাটিতে।

বড় আশা নিয়ে এসেছিলাম লেপচাজগত এ এবার, পুজোর আগে, কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখব বলে। কিন্তু বৃষ্টি বাধ সেধেছে। আর কয়েকটা দিন পরে এলেই হত। রবিনের বক্তব্যও তাই। ওর বাড়িতেই আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বৃষ্টি একটু কমতেই আমিও ধরে বসি ওকে — ‘চলো রবিন, তুমহারা ভিউ পয়েন্ট দিখাও’। রাস্তা দেখায় রবিন, ওর বাড়ির পিছন দিয়ে জঙ্গলের মাঝে সরু এক পথ। সে পথ যেয়ে থামে সরু এক ছোট্ট সমতলে, তার পিছন পানে জঙ্গল। সামনে চোখ মেললে দিগন্ত যেখানে আকাশকে ছোঁয়, তার ডান দিক ধরে দার্জিলিং শহর আর বাঁ দিকে কাঞ্চনজঙ্ঘা, যদিও এখনও অবধি তাকে দেখা হয়ে ওঠেনি।

সন্ধ্যার আঁধার ঘনালে এ পথে চিতাবাঘ আর বুনো শুয়োররাও আনাগোনা করে — সাবধানবাণী শোনায় রবিন। লেপচার জঙ্গলে মাঝেমধ্যে রেডপান্ডারও দেখা মেলে, ভাগ্য সহায় হলে। দার্জিলিং চিড়িয়াখানা থেকে দুটো রেডপান্ডা ছাড়া হয়েছিল এ জঙ্গলে। রাতে গল্প করতে করতে গরম রুটি আর মুরগির মাংস কখন যে শেষ হয়ে গেল! ঘরে ফিরে আসি। অজস্র ছোট ছোট মথের দল বাইরের আলোটাকে ঘিরে উড়ছে। ঘরের আলোটা নিভিয়ে কাচের জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি। জঙ্গল থেকে ‘নাইটজার’ এর ডাক ভেসে আসে থমকে থমকে। কখন যে দু’চোখের পাতা এক হয়েছে, জানিই না। পর দিন সকালে ঘুম ভাঙলে দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াই। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়েই চলেছে, আছে মেঘেরাও।

গরম লেবু চায়ের কাপ নিয়ে হাজির অনিল, রবিনের ভাই। এক বার চুমুক দিতেই একদম তাজা! বৃষ্টি সঙ্গী করে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই ‘ঘুম রক’ এর দিকে। সেখানে পৌঁছে নীচে যে দিকে তাকাই শুধু অতলান্ত মেঘ আর মেঘ।

কিছুটা সময় কাটিয়ে ফিরছি যখন এক পাইনের জঙ্গল পথ আটকালো। বয়োবৃদ্ধ গাছের দল কাছে ডাকে, ফিসফিসিয়ে। এগিয়ে যাই, এক টুকরো দিনের আলো ওদের মাঝ দিয়ে আমার গায়ে এসে পড়ে। ওম নেই তার, গন্ধ নেই গাছেদের গায়ের, ঠাণ্ডা শরীরগুলোয় হাত বুলিয়ে জীবনের পরশ খুঁজি। তার পর আবারও নেমে আসি পথে। সে পথের দু’ধারে কত নাম না জানা ফুল আলো ঝলমলে। রবিনের বাড়ি, মানে আমার ডেরায় ফিরে গরম গরম আলুর পরোটা আর ওমলেট দিয়ে জলখাবার শেষে আবারও বের হই। এ বার — জোড়পোখরি। পায়ে চলেও আসা যায়, আবার গাড়িতেও। জঙ্গলের মাঝে দুটো পোখরি বা ‘লেক’। শান্ত, নির্জন পরিবেশ। লেকের জলে কিছু রাজহাঁস এলোমেলো ঘুরছে, একধারে বন বিভাগের ‘রিসর্ট’। এ অঞ্চল বিখ্যাত ‘স্যালামান্ডার’ নামে পরিচিত এক ধরনের বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির উভচরের জন্য। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর দেখা মিলল তার। এ বার ফেরার পালা। বিকালে যদি ইচ্ছা করে তবে টুক করে এক ফাঁকে দার্জিলিং ঘুরে নিতে পারেন। বেশি দূর নয়, মাত্র ১৬-১৭ কিমি রাস্তা। রবিনকে বললেই ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চাইলে ‘গ্লেনারি’-র এক কাপ গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বিকেল চারটের টয়ট্রেন ধরে একটা ‘রাইড’ও নিয়ে নিতে পারেন ঘুম পর্যন্ত। জোড়পোখরি থেকে ফিরে আজ চলে যাব কার্শিয়াং এর করবিয়াতে। থাকব সেখানে। তবে যাওয়ার আগে ‘গিদ্ধড় পাহাড়’ এ নেতাজির বাড়ি আর মিউজিয়ামটা দেখতে ভুলি না।

করবিয়াতে আমার থাকার জায়গা নিমেশজির বাড়িতে। অপূর্ব হোমস্টে। যেমন থাকার ব্যবস্থা তেমনই আপ্যায়ন আর খাবার আয়োজন। তবে সব কিছুর থেকে সুন্দর হল নিমেশের ছোট্ট মিষ্টি মেয়ে – আমায়রা। করবিয়ায় আমার ঘরের ব্যালকনি থেকে এক দিকে কার্শিয়াং শহর, পাহাড়ের বুকে ছবির মতো। মেঘ এসে মাঝে মাঝে ঢেকে দিয়ে যাচ্ছে। আকাশ পরিষ্কার থাকলে দুরন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা আর সূর্যাস্ত। ঘরের সামনে বসার জায়গায় জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে ধাপে ধাপে সবুজ চা-বাগান ওপরে উঠে গেছে। আজ পায়ে পায়ে কার্শিয়াং ঘুরে নিই। কাল সকালে যাব তিন কিমি দূরে ‘মকাইবাড়ি’ চা-বাগানে। পাহাড়ি পথ ধরে ফিরছে, চা-বাগানের কাজ শেষে, মেয়ের দল কলকল করতে করতে পাহাড়ি ঝরনার মতো। আমিও তাদের পিছু পিছু পা মেলাই। ডুবতে থাকা সূর্যের নরম কমলা আলো মেঘের পরদা সরিয়ে তখন আদর দিচ্ছে করবিয়াকে। বড্ড মন কাড়া। পর দিন সকালে একটা গাড়িতে সওয়ার হই। ‘মকাইবাড়ি টি এস্টেট’ ঘুরে দেওরালি, তার পর ওল্ড মিলিটারি রোড ধরে চিমনি। সেখান থেকে ‘ডাউহিল স্কুল’ দেখে ‘সেন্ট মেরিজ’ গ্রাম। সে গ্রামের ‘ফরেস্ট রেঞ্জার্স কলেজ’, ‘মিনি জু’ (ডিয়ার পার্ক) আর ‘গ্রোটো’ দেখে ‘ঈগলস ক্রেগ’ হয়ে যখন ঘরে ফিরলাম তখন সূর্য ফেরার পথে পা বাড়াচ্ছে। সামনের পুজোয় আপনিও এক বার ভেবে দেখুন না এ পথের কথা, কিংবা তার একটু পরে শীতের গোড়ার দিকটায়। রোহিণীর তীরে শরতের হাওয়ায় কাশফুলের লুটোপুটি দেখতে দেখতে নীল আকাশকে সঙ্গী করে পৌঁছে যান লেপচাজগত এ।

নিরিবিলিতে জঙ্গল, আকাশ, পাখির ডাক আর কাঞ্চনজঙ্ঘায় মিশিয়ে দিন নিজেকে। নাই বা হল অনেক দূর, করবিয়া থেকে পায়ে পায়ে এক চক্কর কার্শিয়াং ঘুরে ট্যুরিস্ট লজের ক্যাফেটেরিয়ায় বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে দু’চোখ মেলে দিন বাইরের অন্ধকারে। বাজি রেখে বলতে পারি, এ দু’ জায়গা আপনার জীবনে এক আলাদা প্রাপ্তি হয়ে থাকবে। করবিয়া, কার্শিয়াং হয়ে আবার ফিরেছিলাম লেপচাজগৎ এ। ওকে ছেড়ে যেতে মন চায় না যে! রাত এগারোটায় রবিনের ডাকে বাইরে আসি। আকাশ পরিষ্কার, দূরে ছোট্ট ছোট্ট আলোর বিন্দু নিয়ে দার্জিলিং। বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ঘরে ফিরি। যখন ঘুম ভাঙল, ঘড়ি বলছে ভোর ছ’টা। জানলার পর্দাটা সরাতেই এক টুকরো কাঞ্চনজঙ্ঘা। নিমেষে মন ভাল হয়ে গেল। তাকিয়ে থাকি, শুধুই তাকিয়ে থাকি। কত যে না বলা কথা বিনিময় হয় তার সঙ্গে। সবটুকু বলা হয়ে ওঠে না। ফিরতে হবে যে এ বার।

কিভাবে যাবেন

শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার জীপে ঘুম। ঘুম থেকে আপনাকে লেপচাজগৎ এর হোম স্টে (Home stay) এর গাড়ি তুলে নেবে। অথবা হোম স্টে কে আগে জানিয়ে রাখলে তারাই আপনাকে সোজা এনজেপি কিংবা শিলিগুড়ি থেকে গাড়িতে নিয়ে যাবে লেপচাজগত এ। লেপচাজগত (Lepchajagat) এর গাড়িই আপনাকে পৌঁছে দেবে করবিয়াতে।

কোথায় থাকবেন

দু’ জায়গাতেই হোমস্টে। হোমস্টে-তে থাকাই অপেক্ষাকৃত ভাল। লেপচাজগৎ এর ‘পাখরিন হোমস্টে’ আর করবিয়াতে ‘আমায়রা হোমস্টে’।

কখন যাবেন

অক্টোবর থেকে এপ্রিল সব থেকে ভাল সময়। শীতে কিন্তু ভালই ঠাণ্ডা থাকে।

যোগাযোগ

  • পাখরিন হোমস্টে, লেপচাজগত। রবিন তামাং (ফোন: ০৯৬১৪২৭০০৪৪, ০৮৩৪৮৯২৪৩৫৫)
  • আমায়রা হোমস্টে, করবিয়া, কার্শিয়াং। নিমেশ রাই (ফোন: ০৮১৪৫৭২৮১২৭)।
  • লেপচা জগতে পশ্চিমবঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের বাংলোতেও থাকতে পারেন। যোগাযোগ: কেবি ১৯, সেক্টর ৩, সল্টলেক, কলকাতা-৭০০০৯৮। ফোন: ০৩৩-২৩৩৫-০০৬৪, ২৩৩৫-৮৩২০।
Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ kurseonglepchajagattravel story