শৈল শহরের রানী নামে পরিচিত দার্জিলিং (Darjeeling) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। দার্জিলিং তার ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চা ও দার্জিলিং হিমালয় রেলওয়ের জন্য বিখ্যাত। দার্জিলিং এর জনপ্রিয়তা ব্রিটিশ রাজের সময় থেকেই বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে এটি যখন তাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসাবে গড়ে উঠেছিল। পূর্বে দার্জিলিং ছিল প্রাচীন গোর্খা রাজধানী। পরে সিকিমের মহারাজা ব্রিটিশদের দার্জিলিং উপহার করেন। দার্জিলিং তার অনাবিল সৌন্দর্য এবং মনোরম জলবায়ুর কারণে ভারতের একটি জনপ্রিয় ছুটির গন্তব্য হয়ে আসছে। পর্যটন ছাড়াও, দার্জিলিং তার বিভিন্ন ব্রিটিশ শৈলীযুক্ত বেসরকারি বিদ্যালয় গুলির জন্য জনপ্রিয়, যা ভারত জুড়ে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলি থেকেও ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ করে।
দার্জিলিং এর স্থানীয় মানুষেরা গোমাংস এবং মসুর দিয়ে ভাত খেতে পছন্দ করেন। অন্যান্য জনপ্রিয় স্থানীয় খাবার হল মম (মাংস বা সবজি দিয়ে পিঠার মত খাবার), থুপকা (মাংস এবং নুডলস দিয়ে তৈরি একটি ঘন স্যুপ), গানড্রাক (গাঁজানো সরিষা পাতা) এবং চ্যাং (স্থানীযবিয়ার)।
দার্জিলিং পরিভ্রমণের সেরা সময় হল বসন্ত ও শরৎকাল। দার্জিলিং-এ বসন্তকাল মার্চ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিরাজ করে, অন্যদিকে শরৎকাল সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত স্থিত হয়।
ছোট বড় মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রায় ১৭টি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে দার্জিলিং জুড়ে।
সাধারণত তিনরাত্রি থেকে দার্জিলিং সম্পূর্ণ ঘুরতে পারেন। তবে এই পাহাড়ের রাণীর মোহময়ী সৌন্দর্য্য আর মায়াবী আকর্ষণের সম্পূর্ণ স্বাদ পেতে হলে থেকে যেতে হবে কমপক্ষে একসপ্তাহ। চাইলে তো seven point sightseening একদিনেই দেখে নিতে পারেন, একরাত্রে ম্যালে শপিং করে পরের দিন এনজেপি অথবা শিলিগুড়ি ফিরে আসতে পারেন। কিন্তু এই মায়াবী শহরের নেশা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মজাই আলাদা। কোনো এক মেঘমুক্ত ভোরে পৌঁছে গেলেন টাইগার হিল এ সূর্যের সোনালী আলোতে মাখা কাঙ্চনজঙ্ঘা দেখতে অথবা Keventers এ বসে english breakfast আর chocolate coffee order করে বন্ধুদের সঙ্গে জমাটি আড্ডায় মেতে উঠতে পারেন। টয় ট্রেনে চড়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন পাহাড়ী রাস্তা ধরে অথবা কোনো চা বাগান বা মোনাস্ট্রি ঘুরেও কাটিয়ে দিতে পারেন সারাটাদিন। কোনো এক অলস বিকালে ব্যালকনিতে বসে finest darjeeling tea তে চুমুক দিতে দিতে উপভোগ করতে পারেন পাহাড়ের কোলে অস্তমিত সূর্যের রূপ অথবা ম্যাল এর গা ঘেষে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যেতে পারেন glenary’s এ, বাহারী স্বাদের পেস্ট্রি খেতে।
দার্জিলিং এর অন্যতম আকর্ষণ হল ‘toy train’ তথা ‘Darjeeling Himalayan Railway’ যা ১৯৯৯ সাল থেকেই UNESCO World Heritage Site রূপে আক্ষাপ্রাপ্ত হয়। সরাসরি Irctc এর ওয়েবসাইট থেকে বুকিং করা যেতে পারে। সকাল ৯টায় শিলিগুড়ি থেকে পাড়ি দিয়ে বেলা তিনটে নাগাদ দার্জিলিং এসে পৌঁছতে পারেন আবার দার্জিলিং থেকে ঘুম স্টেশন অব্দিও ঘুরে আসতে পারেন। বর্তমানে অধিকাংশই ডিজেল ইঞ্জিন তবে কিছু পুরোনো স্টীম ইজ্ঞিনের ট্রেনও চলে, যাতে চেপে মেঘের চাদর সরাতে সরাতে পাড়ি দিতে পারেন খাদের গা ঘেষে এক ঐতিহ্যময়ী যাত্রায়।
এছাড়া রোপওয়েতে চেপে পুরো শহরের এরিয়াল ভিউও উপভোগ করতে পারেন। এখানকার আরও একটি প্রধান আকর্ষণ হল “Padmaja Naidu Himalayan Zoological Park”. এই চিড়িয়াখানাটির বৈশিষ্ট্য হল এখানে বহু হিমালয়ান প্রজাতির দেখা মিলবে। এটি বিশ্বের একমাত্র চিড়িয়াখানা যেখানে ‘রেড পান্ডা’ এর সংরক্ষণ ও প্রজনন করানো হয়। এই আন্তর্জাতিক মানের চিড়িয়াখানাতে অতি সুপরিকল্পিতভাবে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে প্রাণীদের খাঁচাগুলি তৈরী হয়। কখনো মাথা তুলে দেখলেন একটা লোমষ কালো ভাল্লুক পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচে নেমে আসছে আপনাকে ‘hug’ করতে, আবার নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একটা জিরাফ গলা বাড়িয়ে আপনার আদর খেতে চাইছে। এছাড়াও snow leopard, tibetian wolf, black panther, himalayan tahr প্রভৃতি দুর্লভ প্রাণীরও দেখা মিলবে এখানে।
সাইট সিইং গুলির মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ও অন্যতম জায়গাটি দার্জিলিং থেকে ১০কিমি নীচে পাহাড়ী ঝর্ণা ও রংবেরঙের ফুলে সজ্জিত পাহাড়ের ঢালে তৈরী বাগান রক গার্ডেন। এখানে পৌঁছাবার পাহাড়ী রাস্তা খুবই ভয়াবহ কারণ রাস্তার টার্নগুলো খুবই ভায়াবহ। কিন্তু দুপাশের অপরূপ সৌন্দর্য্য আপনার সব ভয় গায়েব করে দেবে। গাঢ় সবুজ পাহাড়ের কোলে ছোটো ছোটো জোনাকির মত বাড়ি, পাহাড়ের ঢালে জমে থাকা পেঁজা তুলোর মত মেঘ আপনাকে মনে করিয়ে দেবে Belva Plain নামক american কবির সেই উক্তি — “danger hides in beauty and beauty hides in danger”.
দার্জিলিং একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য হওয়ায়, এটি দেশের অন্যান্য অংশ গুলির সাথে ভাল ভাবে সংযুক্ত। এখানে দার্জিলিং যাওয়ার উপায় বলা হয়েছে।
ট্রেনে বা রেলপথে
দার্জিলিং-এ পৌঁছানোর নিকটবর্তী রেলওয়ে স্টেশন নিউ-জলপাইগুড়িতে অবস্থিত এবং এটি দার্জিলিং থেকে 88 কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। স্টেশন থেকে দার্জিলিং-এ গাড়ির মাধ্যমে গেলে প্রায় ১ ঘন্টা ৪০ মিনিট সময় লাগে। ভারত জুড়ে সব ট্রেনগুলি এই স্টেশনে পৌঁছায়। ভারতের কলকাতা ও দিল্লী থেকে এই স্টেশনে পৌঁছানোর ট্রেনগুলির একটি তালিকা হল –
দিল্লী থেকে
কলকাতা থেকে
বাই রোডে বা সড়কপথে
দার্জিলিং এর প্রতিবেশী শহরগুলির সাথে নিয়মিত বাস দ্বারা ভালো ভাবে সংযুক্ত, যেমন – শিলিগুড়ি, কার্শিয়াং, গ্যাংটক, কালিম্পং। শিলিগুড়ি থেকে রিজার্ভ বা শেয়ারড জীপে ১ ঘন্টা ৪০ মিনিটের মত সময় লাগে দার্জিলিং পৌঁছাতে।
বাই এয়ারে বা বিমানপথে
শিলিগুড়ির কাছাকাছি বাগডোগরা হল দার্জিলিং-এর নিকটতম বিমানবন্দর, যা দার্জিলিং থেকে ৬৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। এই বিমানবন্দর দিল্লী, কলকাতা ও গুয়াহাটি থেকে নিয়মিত বিমান দ্বারা সংযুক্ত।
দার্জিলিং-এ পছন্দসই প্রচুর হোটেল দেখা যায়। শীর্ষ ঋতু গুলিতে হোটেলের মূল্য খুব বেড়ে যাওয়ার দরুন অগ্রিম একটি হোটেল বুক করে নেওয়ার পরামর্শ সর্বত্রই দেওয়া হয়।
দার্জিলিং এর বাজেট হোটেল
দার্জিলিং-এ মাঝারি মানের হোটেল
দার্জিলিং-এর শীর্ষ হোটেল
দার্জিলিং শহরের লাডেন-লা রোডের কোল ঘেঁষে রয়েছে অসংখ্য ছোট-বড় মার্কেট। দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহার্য প্রায় সব জিনিসই আপনি পেয়ে যাবেন আপনার ক্রয়- ক্ষমতার মধ্যে। সবচেয়ে ভালো পাবেন শীতের পোশাক। হাতমোজা, কানটুপি, মাফলার, সোয়েটারসহ যে কোন প্রকারের লেদার জ্যাকেট পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দমতো মূল্যে। তাছাড়া ১০০ থেকে ৫০০ রুপির মধ্যে পেয়ে যাবেন অসাধারণ কাজ করা নেপালি শাল এবং শাড়ি যা আপনার পছন্দ হতে বাধ্য। প্রিয়জনকে উপহার দিতে সর্বনিম্ন ২০ রুপি থেকে ২৫০ রুপির মধ্যে পেয়ে যাবেন বিভিন্ন অ্যান্টিক্স ও নানাবিধ গিফট আইটেম, যা আপনার প্রিয়জনের ভালোবাসা কেড়ে নিতে সক্ষম। তাছাড়া আকর্ষণীয় লেদার সু আর বাহারি সানগ্লাস তো আছেই। কেনাকাটা করতে গিয়ে প্রতারিত হওয়ার আশংকা একেবারেই নেই। তবে হোটেলগুলোতে কিছু নেপালি তরুণ-তরুণী ভ্রাম্যমাণ ফেরি করে শাল, শাড়ি বিক্রয় করে থাকে। তাদের কাছ থেকে না কেনাটাই উত্তম।
দার্জিলিং-এ থাকাকালীন, বিভিন্ন সুস্বাদু স্থানীয় খাবার চেখে দেখতে ভুলবেন না, এখানে কয়েকটি রেস্টুরেন্ট আছে যেখানে আপনি কিছু স্থানীয় খাবার ও তার পাশাপাশি অন্যান্য আকর্ষণীয় খাবার উপভোগ করতে পারেন।
দার্জিলিং এ এমন অনেক দোকান রয়েছে যেখান থেকে আপনি দার্জিলিং এর অথেনটিক চা কিনতে পারবেন। নিম্নে তেমন কিছু জায়গার খোঁজ দেয়া হলো –
১. চৌরাস্তা ম্যালের কাছে অবস্থিত নাথমুলস টি স্টোর এবং সানসেট লাউঞ্জ
২.চৌরাস্তায় অবস্থিত গোল্ডেন টিপস টি লাউঞ্জ
৩. নেহেরু রোডে অবস্থিত টি হাউজ
৪. হ্যাপি ভ্যালি টি এস্টেটের সামনে অবস্থিত হ্যাপি গোল্ডেন ক্যাফে
দার্জিলিং-এ ভোজনরসিকদের জন্য প্রচুর অপশন রয়েছে – ট্রেডিশন্যাল তিব্বতি এবং সিকিমিজ খাবার থেকে শুরু করে সুস্বাদু থাই খাবার সব কিছুর দেখা পাবেন এখানে। মূলত এখানকার খাবারে বাঙালি, নেপালি এবং তিব্বতি উপাদান, শৈলী এবং খাবারের আলাদা আলাদা চিহ্ন রয়েছে। আপনি দার্জিলিং এর জনপ্রিয় যেসব খাবার ট্রাই করে দেখতে পারেন তার মধ্যে রয়েছে – মোমোস, থুকপা, আলু দম, সেল রোটি, নাগা থালা, নেপালি থালি, টংবা, চ্যাং সহ আরো অনেক।
Leave a Comment