দিগন্ত রেখায় কালাপাহাড়

ডিসেম্বরের ২২ তারিখ প্লান ছিলো ক্রিস তং সামিট করার, ২৫ তারিখ সেন্ট মার্টিন আর ৩০ তারিখ দার্জিলিংভুটান। বাসের টিকেট কনফার্ম। ২২ তারিখ দুপুর থেকেই জ্বর। রাতে বাসের জন্য বের হয়েও ফিরে এলাম। রাতে জ্বর চরমে। ডাক্তার ঘোষণা করল টাইফয়েড। এক এক করে সব ট্যুর ক্যান্সেল। টাইফয়েড থেকে সেরে উঠেছি মাস পার হয়ে গেছে কিন্তু নিউরনগুলো এখনও দপদপ করছে। পাহাড় আর অরণ্যের ডাক শুনছি মনে মননজুড়ে। চির পরিচিত ঢাকার পিচঢালা রাস্তাগুলো কেমন যেন অপিরিচিত মনে হচ্ছে।

হঠাৎ একদিন ফেসবুকে চোখে পড়ল ১২০০ টাকায় কালাপাহাড় ভ্রমন। গুগল করে জানা হয়ে গেলো কালাপাহাড় সিলেটের সর্বোচ্চ বিন্দু। উচ্চতা মাত্র(!) ১০৯৮ ফিট। কিন্তু ছবি দেখে মোটামুটি তব্দা খেয়ে গেছি। ইভেন্টের ট্যুরে গিয়ে কখনও শান্তি পাইনি। তাই ওই ইভেন্টে যাওয়ার প্রশ্নই নেই। এদিকে সেমিস্টার শুরু হয়ে গেছে। এখন কাউকে পাওয়াও যাবে না। অন্য কোন উপায় না পেয়ে ৬ তারিখ “টব-হেল্পলাইন”-এ পোষ্ট দিলাম একা গেলে কোন সমস্যা আছে কিনা জানতে চেয়ে। কেউ কোন পরামর্শ না দিলেও পরিচিত ৩ জন যাওয়ার জন্য আগ্রহ দেখালো। মঈন বললো ওর সাথে আরও একজন(রায়হান) যাবে। আর তমাল জানালো ও আর রাহুলও যাবে। আর ইমরান। গ্রুপ হয়ে গেলো ৬ জনের। যাত্রার তারিখ ঠিক করা হলো ৯ ফেব্রুয়ারী।

৭ তারিখ ছুটলাম ট্রেনের টিকেট করতে। কিন্তু বিধিবাম। সব টিকেট সোল্ড আউট। ভরসা বাস। একরকম বাধ্য হয়েই এনা’র টিকেট করে ফেললাম। ৯ তারিখ রাত ১২টা ১০-এ বাস।

মহাখালী বাসস্ট্যাড যখন পৌছাই তখন রাত ১১ টা। মঈন জানালো ওরা ২ জন উঠবে আব্দুল্লাহপুর থেকে। জীবনে এই প্রথমবার ঠিক টাইমে বাস ছাড়লো। ঠিক ১২ টা ১০। বাস যখন আব্দুল্লাহপুর তখন মঈন ফোন দিয়ে বলল ওরা উত্তরা কাউন্টারে। সমস্যার শুরু। সুপারভাইজারকে বলে টঙ্গী বাস দাঁড় করিয়ে রাখলাম ২০ মিনিট। এরপর রাতে আর কোন ঝামেলা ছাড়াই কুলাউড়া পৌছে গেলাম।

যখন কুলাউড়া নামি তখন ভোর সাড়ে ৫ টা। আলো ফোটেনি এখনও। আমাদের উদ্দেশ্য আজগরাবাদ টি স্টেট। কিন্তু আলো ফোটার আগে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। সেই ফাকে ঘুরে এলাম পাশেই কুলাঊড়া স্টেশনে।

সকাল ৭ টায় স্টেশনের পাশেই একটা রেস্টুরেন্ট থেকে সকালের নাস্তা ও দুপুরের জন্য শুকনো খাবার কিনে রওনা হলাম। সিএনজি রিজার্ভ করলাম আজগরাবাদের। একই সিএনজিতে ৬ জন। সিএনজি ঠিক করতে একটু বিড়াম্বনায় পড়তে হয়েছিলো। বেশীরভাগ সিএনজিওয়ালাই দেখি আজগরাবাদ চিনে না। শেষমেশ একটা রিজার্ভ করলাম ২৫০ টাকা। লোকালও যাওয়া যায়। কুলাউড়া থেকে রবির বাজার জনপ্রতি ৪০ টাকা আর রবির বাজার থেকে আজগরাবাদ জনপ্রতি ১৫ টাকা।

আজগরাবাদ পৌছালাম সকাল ৮ টায়। পাশের একটা দোকানের সামনেই কয়েকজনকে পেয়ে যাই যারা পুঞ্জিতেই থাকে। দোকান থেকে পানির বোতল কিনে তাদের সাথে রওনা দিলাম বেগুনছড়া পুঞ্জির দিকে। আহামরি কিছু না। কিন্তু খানিক সামনে এগোতেই পাহাড়ের সম্মোহনী শক্তি গ্রাস করছিলো আমাদের। খানিক পর পর উচু টিলা আর বাশের নড়বড়ে সাঁকো। আর সেইসব টিলার গায়ে লেগে আছে নাম না জানা বুনোফুল। এ যেন এক ঘোর। গুনে গুনে ৯ টা সাঁকো পার হওয়ার পর দেখা মিললো বিশাল এক ফুটবল মাঠের। এটাই পুঞ্জির ছেলেদের খেলার মাধ্যম। এতএব  দীর্ঘ ৪০ মিনিট হাটার পরে আমরা পুঞ্জিতে পৌছে গেছি। পুঞ্জিটা খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কিন্তু একটা বিষয় খটকা লাগলো। এই এতদুরের পথে ইট বালু এনে বিল্ডিং করল কিভাবে। যদিও উত্তরটা পেয়েছিলাম আমাদের গাইডের কাছে। মেইন রোড থেকে কাঁধে করে ইট বয়ে আনে এখানকার মানুষ। প্রতিবারে ২০ খানা ইট আনতে পারে। এজন্য প্রতিবারে ১৪০ টাকা করে পায়। একটা প্রাইমারী স্কুল আছে এখানে। এরপর পড়াশুনার জন্য তাদের ভরসা রবির বাজারের হাইস্কুল আর কলেজ।

আমরা যেতে দেরী করে ফেলেছিলাম একটু বোধহয়। পুঞ্জির মানুষজন কাজে বেড়িয়ে গিয়েছে। আমাদের আগে আরও একটা দল এসে বসে আছে। গাইড না পাওয়াতে যেতে পারছে না। সমস্যার সমাধান করে দিলো পুঞ্জির মন্ত্রী লেম্বু দা। আমাদেরকে  যে দুইজন চিনিয়ে নিয়ে এসেছিলো তাদেরকেই আমাদের গাইড করে দিলেন। আনুমানিক ৯ টার দিকে গাইড মোখলেছ আর জলিল কে নিয়ে আমরা যাত্র শুরু করলাম।

চারপাশের ঘন গাছের সারি আর তার মাঝ দিয়েই শুকনো পাতায় ঢেকে দেয়া রাস্তা। ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ লাগিয়ে হাটতে হাটতে প্রথম ঢালেই হোচট খেয়ে পড়ে হাটুর দফারফা করে ফেললাম। উঠে মাথায় গামছা পায়ে বেধে শুরু করলাম হাটা। হাটছি তো হাটছিই। কোথাও কালা পাহাড় বাজাজির দেখা নেই। শুধু গাছ আর শুকনো পাতা। আর মাঝে মাঝে হাতীর মল। প্রায় ১৫-২০ মিনিট হাটার পর অরণ্যের বুক চিরে দেখা দিলেন কালা পাহাড় মশাই। দেখে চিৎকার দিতেই ভুলে গেলাম। এ কি দেখছি আমি! দেখে মনে হচ্ছে সামনে বিশাল এক সবুজের দেয়াল। আর সেখানেই পৃথিবী শেষ। চোখ নাড়াতে পারছি না, পলক ফেলতেও ভুলে গিয়েছি। শুধু হা করে তাকিয়ে আছি। কিন্তু থেমে থাকলে তো চলবে না। রীতিমত দৌড়াতে শুরু করলাম। কিন্তু প্রকৃতির সাথে শক্তি দেখাতে নেই প্রমাণ করে হাঁপিয়ে গেলাম।

হাতীর মল দেখে ধারণা করলাম হাতীর দেখা পেলেও পেতে পারি। কিন্তু না! দেখা পাওয়া গেলো না পুরো পথে। তবে বানরের দেখা মিলেছে ফেরার পথে। যেহেতু এখানে পর্যটকের আনাগোনা কম তাই রাস্তাও তেমন সুবিধার না। খানা খন্দে ভরা। অন্য গ্রুপের ২-৩ জন পাহাড়ের চৌদ্দগোষ্ঠীকে উদ্ধার করলেও আমার আনন্দ আর ধরে না। যতই সামনে আগাচ্ছি ততই মনে হচ্ছে এইতো চাই। কোথাও ৬০-৮০ ডিগ্রী খাড়া। যখনই কোন খোলা যায়গা পাচ্ছি সামনে দিগন্তে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর নীল। শিরোনামহীনের লিরিক্স গুলিয়ে গাইতে শুরু করলাম, “এক প্রান্তে সবুজ আর একপ্রান্তে নীল। আমার বাংলাদেশ……”

সবাইকে পেছনে ফেলে আমরা ৬ জন যখন সামিট করি তখন সকাল ১০ টা ৩১। সাথে নেয়া ফ্লাগটা পুতে দিলাম মাটিতে। আমাদের পরবর্তী দল এসে পৌছালো আরও ১৫-২০মিনিট পরে। সাথে করে নিয়ে যাওয়া খাবার সাবাড় করে ব্যস্ত সবাই ছবি তোলাতে। কেটে গেলো দেড় ঘন্টার মতো। এবার ফেলার পালা। গাইডকে বললাম অন্য একটা ট্রেইল আছে নাকি ৪ ঘন্টার সেই পথ দিয়ে নিয়ে যেতে। গাইড জানালো সেই পথ দিয়ে যাওয়া যাবে না। সেই পথ দিয়ে গেলে অন্য একটা পুঞ্জি পড়ে যাদের সাথে কিছুদিন আগে তাদের পুঞ্জির ঝামেলা হয়েছে যায়গা দখল নিয়ে। একজন খুনও হয়েছে। তবে অন্য একটা পথ দিয়ে নিয়ে যাবে। যাওয়া পথে ঝিরি পড়বে। শীতকাল তাই পানি কম। তাও ভালো। কিছু একটা তো জুটলো।

ফেরার পথে সবার গা ছাড়া ভাব। হাটু যেন আর সায় দিচ্ছে না। তার উপরে আমার কাধে বোঝা বেশি। নিজের ব্যাগ, ক্যামেরার ব্যাগ, সবার ফেলে আসা ময়লার ব্যাগ। আবার জখম হাটু। যাওয়ার থেকে ফেরার পথ যেন আরও রোমাঞ্চকর। প্রতিটা বাঁকেই নতুন কিছু পাচ্ছি। নতুন রূপ। নতুন অ্যাডভেঞ্চার। ঝিরিতে নামার পর মনে হল আর এক বিন্দু শক্তিও অবশিষ্ট নেই। শীতল পানির ছোয়ার পুরো শরীর যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তখনও গাইড বাবাজি বলছে এখনও দেড় ঘন্টার পথ বাকি। যতই সামনে এগোচ্ছি জংগল ততই ঘন হচ্ছে। হঠাৎ করেই একটা খাড়া ঢাল বেয়ে উপরে উঠে দেখি পুঞ্জির যেখান থেকে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম সেখানে পৌছে গেছি।

তখন দুপুর দেড়টা। শেষ হয়ে গেলো কালাপাহাড় বিজয়। ক্লান্তিতে লেম্বুদার বাসার সামনে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লাম। পানির তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু পথ এখনও শেষ হয়নি। আরও ৪০ মিনিটের পথ বাকি সিএনজি পর্যন্ত পৌছাতে। লেম্বুদা খুবই ভালো মানুষ। নিজের বাসা থেকে পানি দিলেন আমাদের। ফেরার সময় সিএনজি পাওয়া যায় না। তাই আমাদের কুলাউড়া বাজার থেকে ফোন করে সিএনজি আনিয়ে দিলেন। দুইটার দিকে গাইড আর লেম্বুদাকে বিদায় জানিয়ে এক অদেখা স্বর্গ দেখে ফিরে এলাম। ফিরতি পথে দেখা পেলাম একটা জলাশয়ের। তখনই সবার মনে পড়ল গোসল করা দরকার। মাটিতে শুয়ে থেকে যে অবস্থা হয়েছে সেভাবে আর লোকালয়ে বের হওয়া যায় না। ঝাপিয়ে পড়লাম পানিতে।

গোসল সেরে সিএনজি নিয়ে কুলাউড়া বাস স্টান্ডে এসে পৌছালাম বিকাল তখন ৪ টা। দুপুরের খাবার খেয়ে মনে হল সময় আছে পাশেই মাধবকুন্ড। একবার ঘুরে আসা যাক। মন সায় দিলেও শরীর আর সায় দিচ্ছিলো না সবার। আর এভাবে রাতের বাস/ট্রেন পর্যন্ত অপেক্ষা করার কোন মানে নেই। পাশেই এনার কাউন্টারে খোজ নিয়ে জানতে পারলাম সাড়ে ৫ টায় তাদের বাস আছে। টিকাট করে কাউন্টারে ঘুমিয়ে পড়লাম। ৫ টা ৪৫ এ ডেকে আমাদের বাসে তুলে দিলো। রাত ১২ টায় বাসায়। আর এভাবেই শেষ হয়ে গেলো ২৩ ঘন্টা ৫০ মিনিটের স্বর্গ দেখা।

যাওয়ার উপায়

বাস

এনা মহাখালী থেকে আর শ্যামলী, রূপসী বাংলা ফকিরাপুল থেকে ছাড়ে ১১-১২ টার মাঝে।

ট্রেন

উপবন এক্সপ্রেস কমলাপুর থেকে ৯ টা ৫০ এ। দুইটার ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে কুলাউড়া পৌছে দিবে। ভাড়া বাস ৫০০ আর ট্রেন ৩২০(শোভন চেয়ার)।

কুলাউড়া থেকে আজগরাবাদ সিএনজি। রিজার্ভ ২২০-৩৫০ আর লোকাল জনপ্রতি ৫৫ টাকা। আজগরাবাদ টি স্টেটের গেট থেকে ৪০-৪৫ মিনিট হাটলে বেগুনছড়া পুঞ্জি।  সেখান থেকে গাইড নিয়ে কালাপাহাড়।

আমাদের খরচ

বাস ভাড়াঃ ৩০০০+৩০০০ = ৬০০০/=
সকালের চা নাস্তাঃ ২২৮/=
শুকনো খাবার ও পানিঃ ৯০/=
সিএনজিঃ ২৫০+২৫০=৫০০/=
গাইডঃ ৫০০/=
দুপুরের খাবারঃ ৭৮০/=
জনপ্রতি খরচঃ ৮০৯৮/৬ = ১৩৫০/=

Leave a Comment
Share