কম খরচে আমার ভারত ভ্রমণ ( সিমলা প্রথম পর্ব )

আগের পর্ব

ট্রেন ঘুরে ঘুরে শেষ পর্যন্ত যখন সিমলা স্টেশনে আসলো তখন সন্ধ্যা সাড়ে ছটা বেজে গেছে। ৭,১০০ ফূট উঁচু খুবই সুন্দর পাহাড়ি এক রেল স্টেশন সিমলা। স্টেশনে লাল পোশাকের কুলি আর হোটেলের দালাল ঘুরঘুর করছে। সেসবকে পাশ কাটিয়ে পঙ্কজদার পিছু আমরা বাইরে বের হয়ে এলাম। পাহাড়ি হলেও স্টেশনটি বেশ বড়। এক জায়গায় দেখি ‘রেল মোটর’ ট্রেনটি ঘোরানোর ব্যাবস্থা রয়েছে।

স্টেশনের বাইরে অনেকগুলি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। সেসবকে পাশ কাটিয়ে আমরা পঙ্কজদার পিছু পিছু হেঁটে রাস্তা দিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগলাম। একটা শহর যে এতো সুন্দর হতে পারে তা সিমলায় না আসলে আমি জানতাম না। এটার কাছে দার্জিলিং কিছু না।

কিছুদূর চলার পর একটা সুদৃশ্য ভবন দেখিয়ে পঙ্কজদা বললেন এটা নাকি হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা ভবন। ব্যাপারটিতো আমার কাছে বিশ্বাসই হতে চায়নি। কারন আমি ভবনটির চারপাশে কোন নিরাপত্তাকর্মীতো দূরে থাকুক একটা ট্রেফিক পুলিশও খুঁজে পায়নি। আর আমাদের সংসদ ভবনের দু’কিলোমিটারের মধ্যে প্রবেশ নিষেধ!

বিধানসভা ভবনটিকে পাশ কাটিয়ে আমরা আরো উপরের দিকে হেঁটে উঠলাম। তারপর কয়েকটা সিড়ি নেমে এক সাইবার ক্যাফের পাশ কাটিয়ে চিপা একটা গলির মধ্যে দিয়ে গন্তব্যে পৌছালাম। এটি পঙ্কজদার পরিচিত এক হোটেল। হোটেলটির নাম হচ্ছে HOTEL DUKE. দুটো ডাবল বেডের বিশাল রুমটির ভাড়া ৬০০রুপি, গরম পানি সহ এটাচট বাথরুম। সেতু পঙ্কজদাকে অনুরোধ করলো ভাড়া আরো ১০০রুপি কমানোর জন্য। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি এর চাইতে কম কিভাবে হতে পারে। তবে সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। নাম এন্ট্রি করার সময় হোটেলের লোক জানালো যে তাদের হোটেলে বিদেশী গেস্ট রাখার অনুমতি নেই। সকালে পুলিশ এসে চেক করে বিদেশী অতিথি পেলে হোটেলের লাইসেন্স বাতিল করে দেবে। তখন আমরা পঙ্কজদার আত্নীয় হিসাবে তার নাম ঠিকানা ব্যাবহার করে হোটেলের খাতায় নাম এন্ট্রি করলাম।

রুমে ব্যাগ রেখে পঙ্কজদাকে নিয়ে বের হলাম খাওয়া দাওয়া করার জন্য। বের হবার সময় সবার জন্য হোটেলের কার্ড চেয়ে নিয়েছি। সিমলা কালিবাড়িকে পাশ কাটিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম সামনের দিকে।

রাস্তায় দেখি বিভিন্ন সাইজের বানর মারামারি করছে। লোয়ার বাজারের রাস্তায় এক ভেজ রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলাম। পঙ্কজদা আমাদেরকে বসিয়ে রেখেই বিদায় নিলেন। কাল সকালে আবার আসবেন কথা দিলেন। বেচারাকে এখন বাসে করে অনেকদূর ফেরত যেতে হবে। শুধুমাত্র আমাদের জন্যই নিজের স্টেশনে না থেমে তিনি আমাদের সাথে সিমলা পর্যন্ত এসেছেন। যে ইন্ডিয়ানরা সহযাত্রীদের সাথে কথা পর্যন্ত বলে না সেখানে সেতুর জাদুতে পঙ্কজদা আমাদের জন্য কতো কিই না করলো।

খাইলাম পেট ভরে। সেতু তার স্বভাবমতো এটা ওটার অর্ডার দিয়ে যাচ্ছে আর আমরাও সেগুলোর স্বদগতি করে চলেছি। রেস্তোরাটির পাশেই সাইবাবার ধর্মাবলম্বীদের উপসনা গৃহ। খাওয়ার ফাকে ফাকে তাদের উপসনা উপভোগ করে চলেছি। ভেজ খাবার সত্যিই খুব মুখরোচক। খাবারের অর্ডার দিলে সঙ্গে সঙ্গে তা রান্না করে গরম গরম হাজির করে। সারাদিন পর গরম ভাত খেয়ে কি যে তৃপ্তি পেলাম তা বলার মতো না। ভোজন শেষে ভাগাভাগি করে বিল চুকিয়ে বের হয়ে এলাম। সেতু আর নিয়ন নাকি খুব ক্লান্ত। তারা চললো হোটেলের দিকে। আর আমি আগের রাতে না ঘুমিয়ে সারাদিন দাঁড়িয়ে ট্রেন জার্নি করেও ততোটা ক্লান্ত নয়। আমি চললাম ম্যালের দিকে।

ম্যাল রোড থেকে রাতের সিমলা

রাত প্রায় নটা বাজে। জায়গাটা একদম ফাঁকা।

আমি ঘুরে ঘুরে ইংরেজ স্থাপনা দেখছি। আলো ঝলমলে এসব ভবন দেখতে খুবই ভালো লাগছে। বেশ ঠান্ডা পড়েছে।

হাটতে হাটতে চার্চ পর্যন্ত গেলাম। হলুদ রঙের ভবনটিতে হলুদ আলো পড়েছে, দেখতে খুব সুন্দর ।

পাশেই রয়েছে সিমলার পাবলিক লাইব্রেরি। এসব দেখতে দেখতেই একটা সমস্যা হয়ে গেল। ঠান্ডা আবহাওয়া আমার পেটে একেবারেই সহ্য হয়না। পেটে এমন চাপ অনুভব করলাম যে হেঁটে হোটেলে ফিরবো সে সাহস করলাম না। প্রায় দৌড়ে চললাম। পথ যেন ফুরাচ্ছে না। অবশেষে হোটেলে পৌছাতে পারলাম। প্যান্টের বেল্ট খুলতে খুলতে রুমে ঢুকলাম। কিন্তু বিধি বাম! সেতু রয়েছে টয়লেটে। আমার কাতর কন্ঠে অনুনয় বিনয় শুনে বের হয়ে এলো ও। কিন্তু বের হলো একেবেরে দিগম্বর হয়ে, শুধু প্যান্টটা সামনে ধরে রেখে। মনে হলো অর দুগালে দুটো চুমু দিই, কারন প্যান্ট পড়তে গিয়ে ও যদি আর ৫সেকেন্ডও সময় নিতো তাহলে আমার ভয়াবহ সর্বনাশ হয়ে যেত। কোন রকমে ভেতরে ঢুকলাম অকে টপকে। আহ কি শান্তি!
সারাদিনের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলার জন্য ভাবলাম গোসল করে ফেলি। গিজার না চালিয়ে দুমগ পানি গায়ে ঢেলে দেখি যে ভয়াবহ ঠান্ডা। গোসল করা বাদ দিয়ে কোন রকমে গা মুছে বের হলাম। কাপড় বদলে সোজা কম্বলের তলায়। আমি এবার এসে কোন মোবাইল সিম কিনিনি, খামাখা পয়সা খরচ। তাছাড়া ফোনে টাকা থাকলে শুধু মনে হয় দেশের এই দোস্তকে জানায় আমি এখন এখানে, ওই দোস্তকে জানায় আমি এখন ওখানে।কি দরকার! তবে সেতুরা সিম কিনেছে। ওদের ফোন থেকে আমার বাবার সাথে কথা বললাম। জানালাম আমি ভালো আছি। তারপর কম্বল মুড়ি দিয়ে চোখ বুজলাম।

২২শে সেপ্টেম্বর’১৫

আমার বরাবরই খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস। সিমলাতেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। বাইরে প্রচন্ড ঠান্ডা। আবার কম্বলের তলায় ঢুকে গেলাম। ঘন্টা দেড়েক পর উঠে গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। দেখি নিয়নও উঠে পড়েছে। রুমের ভিতরে আমরা কিছুক্ষণ ফটোসেশন করলাম। তারপর লাথি ঘুসি মেরে সেতুকে ঘুম থেকে ওঠানো হলো। ঘুম থেকে উঠেই সে নিয়নকে হুকুম করলো হোটেলের কাউন্টারে গিয়ে গিজার চালিয়ে দেবার কথা বলে আসবার জন্য। আর আমি বের হলাম ওদের গোছগাছ করার ফাকে আশপাশ একটু ঘুরে দেখার জন্য।

বাইরে বের হয়েই চোখ ধাধিয়ে গেল। সকাল সাড়ে আটটা, আশপাশ মেঘাচ্ছন্ন, বেশ ঠান্ডা আর এরই মাঝ দিয়ে দলে দলে সুন্দরী মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। সুন্দরীদের ইউনিফর্মের ফ্রকের শেষাংশ হাঁটুর উপরে আর তাদের উন্মুক্ত পা থেকে যেন আগুন ঝলসাচ্ছে। শরীরগুলি এতোই সুগঠিত যে প্রতিটি মেয়ের একেকটি পায়ের দিকে তাকিয়ে অনায়াসে দু’ঘন্টা কাটিয়ে দেয়া যায়। স্কুল আওয়ার শুরু হওয়া পর্যন্ত মেয়েদের আনাগোনা চলতেই থাকলো আর আমিও সেসকল দেবীদের পদযুগল দর্শন করিতে লাগিলাম। হায় আফসোস, একটা ছবি তোলার দুঃসাহস সংগ্রহ করে উঠতে পারি নাই!

আশপাশ দেখায় মন দিলাম। সিমলার বাড়ি ঘর দেখতে খুব সুন্দর।

তবে দার্জিলিং বাসীরা যেমন ফুল আর কুকুর ভালোবাসে সিমলাবাসীদের মধ্যে এই ব্যাপারটা একটু কম মনে হলো। কিন্তু দার্জিলিং এর চাইতে সিমলা অনেক গুন বেশী সুন্দর শহর। চারপাশে এতো সবুজ গাছপালা যে চিন্তায় করা যায়না। সিমলাকে পাইন গাছের শহর বললেই যেন বেশী মানায়।

আধা ঘন্টারও বেশি সময় পর হোটেলের রুমে ফিরে দেখি সেতু আর নিয়নের এখনো গোছানো হয়নি। আবার আমি বের হলাম। এবার গেলাম কালীবাড়িতে। সিমলা কালীবাড়ির ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ। আমি শুনেছিলাম কালীবাড়িতে খুব কমে ভালো নাস্তা আর খাবার পাওয়া যায়। খুঁজে খুঁজে জলখাবারের রুমটি বের করে নাস্তার অর্ডার দিলাম। ছোট্ট একটা রান্নাঘর যেখানে তিন চারজন দাঁড়িয়ে গল্প করছে। আমার অর্ডার শুনে চুলো জ্বালিয়ে তেল গরম করতে দিল। তারপর খামি করে রাখা ময়দা বেলে লুচি বেলে ভাজতে দিল। আর তারপর গরম প্রেসার কুকার থেকে ডালের তরকারি বেড়ে আমাকে খেতে দিলো। চারটে বড়বড় লুচি আর ছোলার ডালের তরকারি। দাম নিল ২০ রুপি। খেতে খুবই মজাদার।

এই ব্যাপারটা আমি ইন্ডিয়ার সব জায়গায় দেখেছি, বিশেষ করে ঠান্ডা দিককার অঞ্চলে আর ভেজ রেষ্ট্ররেন্টগুলোতে। কেউ যদি কোন খাবারের অর্ডার দেয় তবে তৎক্ষণাৎ তার সামনে সেই খাবারটা রান্না করে গরম গরম হাজির করে। ইন্ডিয়ান খাবারের স্বাদ বাংলাদেশের মতো অতো ভালো না হলেও খাবারের মান খুব ভালো। আমার মনে হয় বাংলাদেশের মতো এতো ভেজাল ইন্ডিয়ান খাবারে ঢোকেনি। এখানকার কোন খাবার খেয়ে আমাকে কখনো পেটের সমস্যায় ভুগতে হয়নি।

নাস্তা শেষে আবার ফেরত এলাম হোটেলে। তখনো নিয়ন আর সেতুর ফটসেশন শেষ হয়নি। হোটেলের রুমের মধ্যে নিজেদের মুখের এতো সেলফি তুলে এরা কি মজা পায় তা কে জানে! তাড়া দিয়ে ওদেরকে বের করলাম। কোনরকমে বাইরে বের হয়ে আবার এরা সেলফি তোলা শুরু করলো।

সিমলার কোন কোন রাস্তায় বিশেষ করে কালীবাড়ির আশেপাশে গাদা গাদা বানর নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ ওদের কসরত দেখলাম। তারপর আরো সামনে এগিয়ে গেলাম। এসময় সেতুর আন্টি আর তার ছেলের সাথে দেখা হলো। এই ছেলেটাই নিয়নের রুপের ‘বিশেষ’ ফ্যান। তারা সিমলা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ তাদের সাথে ছবি তোলা হলো। ট্রেনের হর্ন শুনে তারা তড়াতাড়ি স্টেশনের দিকে হাটা দিলেন।

সেতুদের রুপি শেষ হয়ে গেছে। এইবার তারা ডলার ভাঙানোর জন্য এ ব্যাংক সে ব্যাংক ঘোরাঘুরি শুরু করলো। কিছুক্ষণ তাদের সাথে ছিলাম। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমার মতো ঘোরা শুরু করলাম। ঘন্টা দেড়েক সিমলা ম্যাল, রীজ, স্ক্যান্ডাল পয়েন্ট এইসব জায়গাগুলি ঘুরে দেখলাম।

জায়গাগুলি সত্যিই খুব সুন্দর। সিমলা খুব পরিচ্ছন্ন একটা শহর। এই শহরে যেখানে সেখানে ময়লা ফেলাতো দূরে থাকুক কেউ যদি কোথাও থুতুও ফেলে তবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে জরিমানা দিতে হয়।

এখানকার পুলিশগুলো খুব স্মার্ট। বিশেষ করে চোখা চোখা সৌন্দর্যের মহিলা পুলিশগুলোর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে হয়। সিমলা শহরে পর্যটকদের বসার জন্য সবজায়গাতেই সুদৃশ্য বেঞ্চ পাতা আছে। তাছাড়া কিছুদূর পরপরই পানি খাবার জায়গা। তবে সবথেকে ভালো ব্যাবস্থা টয়লেটের। কিছুদূর পরপর পরিচ্ছন্ন টয়লেট যেখানে প্রসাব করতে পয়সা লাগে না, তবে বড়টার জন্য নামমাত্র মূল্য দিতে হয়।

পরের পর্ব

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ indiashimlatravel