শিমলা

শিমলা (Shimla) উত্তর ভারতের হিমাচল প্রদেশের রাজধানী। উত্তরে মান্ডি এবং কুল্লু জেলা, পূর্বে কিন্নুর, দক্ষিণ-পশ্চিমে উত্তরখান্ড এবং সোলান-সিমুর জেলা দ্বারা পরিবেষ্টিত। ইংরেজ শাসনামলে শিমলাকে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৮৭১ সাল থেকে শিমলা পাঞ্জাবের রাজধানী ছিল, পরে ১৯৭১ সালে হিমাচলের রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হয়। মাত্র দুই লক্ষ লোকের আবাস এই শিমলায়, যা ভারতের সবচেয়ে কম জনসংখ্যার প্রাদেশিক রাজধানীও বটে।

শিমলা এর দর্শনীয় স্থানগুলো

জাখু মন্দির

জাখু পাহাড় হল শিমলার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এবং পারিপার্শ্বিক ভূ-প্রকৃতির এক অত্যাশ্চর্য নিদারুণ দৃ্শ্য পরিদর্শনেরও প্রস্তাব দেয়। পাহাড়ের চূড়ায় স্থিত জাখু মন্দির প্রভু হনুমানের প্রতি উৎসর্গীকৃত। স্থানীয় কিংবদন্তিদের অনুমান অনুযায়ী, সঞ্জীবনী ঔষধি বিদ্যমান এই পাহাড়টিকে তুলে নিয়ে আসার সময় প্রভু হনুমান এখানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এর ফলস্বরূপ, এই স্থানটি একইভাবে ভক্ত এবং ভ্রমণকারীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

ভ্যাইসরিগেল লজ

অবসারভেটারী পাহাড়ের উপর অবস্থিত ভ্যাইসরিগেল লজ। ১৮৯৮ সালে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি ভারতের ভাইসরয়, লর্ড ডাফরিনের সরকারি বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হত। বর্তমানে এই স্থানটি হল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ আ্যডভান্স স্টাডিজ। লজটি শুধুমাত্র ভারতে ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে একটি অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে না, বরঞ্চ সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের এক অত্যাশ্চর্য দৃ্শ্য পরিদর্শনেরও প্রস্তাব দেয়।

সামার হিল

বাণিজ্যিক সিমলার শত ব্যস্ততা থেকে দূরে কোনও স্থান অন্বেষণকারী পর্যটকদের মধ্যে সামার হিল হল খুবই জনপ্রিয়। এর পথের চারপাশে ওক, সেডার, রডোডেনড্রন এবং আরোও অনেক গাছপালা বেড়ে উঠেছে। এখানে অবস্থিত ম্যানরভিল্যে ম্যানশন হল এই এলাকার সবচেয়ে বিখ্যাত ভবন, কারণ এটিই সেই জায়গা যেখানে মহাত্মা গান্ধী শিমলা ভ্রমণের সময় ছিলেন।

দ্যা রিজ্

রিজ একটি উন্মুক্ত স্থান, যেটি শিমলার সবচেয়ে বেশি কার্যকলাপ কেন্দ্র রূপে পরিচিত। দ্য রিজ্ বা শৈলশ্রেণীতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ল্যান্ডমার্ক আছে এবং বেশ কিছু কার্যক্রম আয়োজনের পাশাপাশি এখান থেকে পার্শ্ববর্তী পর্বতগুলির এক সুন্দর দৃশ্য পরির্শনেরও প্রস্তাব দেয়। শহরের এই অংশটি শিমলার জনজীবনের জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটির নীচের জলাশয় শহরের একটি প্রধান অংশে জল সরবরাহের দায়ভারে রয়েছে।

ম্যাল রোড

শিমলার বিপূল সংখ্যক ল্যান্ডমার্ক এখানে অবস্থিত হওয়ায়, ম্যাল রোড পর্যটকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। এছাড়াও এখানে বেশ কিছু রেস্তোঁরা, ক্লাব, বার ও দোকান অবস্থিত হওয়ায় এটি শিমলার বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল হিসাবেও বিবেচিত হয়। যেকোনও ক্রেতাদের জন্য ম্যাল রোড স্বর্গোদ্যানের ন্যায়।

ক্রাইস্ট চার্চ

ক্রাইস্ট চার্চটি ১৮৪৪ সালে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি উত্তর ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম গির্জা। ক্রাইস্ট চার্চটি রিজ্-এ অবস্থিত এবং এটি তার এলিজাবেথীয় স্থাপত্য ও তার নকশায়িত কাঁচের জানলার জন্য পর্যটকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। এছাড়াও গির্জাটিতে একটি পাইপ অর্গান রয়েছে, যেটি দেশের সবচেয়ে এক অন্যতম বৃহৎ হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি তাদের জন্যই আদর্শ যারা আধ্যাত্মিকতার সাথে সাথে ইতিহাসের এক নিদর্শনকে খুঁজে চলেছে।

সেন্ট মাইকেল ক্যাথিড্রাল

সেন্ট মাইকেল চার্চ ১৮৫০ সালে নির্মিত হয়েছিল। এটা শিমলার প্রথম ক্যাথলিক গির্জা। এটিতে পাঁচটি মার্বেলের বেদী আছে যেগুলি ১৮৫৫ সালে ইতালি থেকে আনা হয়েছিল। এছাড়াও গির্জাটিতে সুন্দর নকশায়িত কাঁচের জানলা রয়েছে, যেগুলি চোখদুটিকে উচ্ছাসিত করে তোলে।

গেইটি থিয়েটার

গেইটি থিয়েটার বা নাট্যমঞ্চটি, শিমলায় ব্রিটিশ বাসিন্দাদের বিনোদনের সুযোগ প্রদানের জন্য ১৮৮৭ সালে নির্মিত হয়েছিল। ভবনটির নব্য-গোথিক স্থাপত্য লালিত নেত্রের জন্য এক সুন্দর দৃশ্য। এখানে একটি প্রদর্শনী সভা, একটি আ্যম্ফিথিয়েটার ও অন্যান্য বহু সুযোগ-সুবিধা সহ একটি শৈল্পিক গ্যালারি রয়েছে। যেকোনও সূক্ষ শিল্পপ্রেমীদের জন্য এটি একটি অবশ্যই দর্শনীয় স্থান।

তত্তপানি

শিমলা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে তত্তপানিতে অবস্থিত সালফিউরাস উষ্ণ প্রসবণ অনেকের মতে ভেষজ উপকারিতা হিসাবে বিবেচিত হয় এবং সেই কারণেই চিকিৎসক পর্যটকদের জন্য তত্তপানি একটি খুবই জনপ্রিয় স্থান। উষ্ণ প্রসবণের পাশাপাশি, শতদ্রু নদীর ঠান্ডা জল রিভার র্যাফটিং-এর সুযোগ প্রদান করে।

কোটগড়

কোটগড়, শিমলা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে, প্রাচীন হিন্দুস্তান-তিব্বত সড়কের উপর অবস্থিত এবং এটি আপেল বাগানের জন্যও প্রসিদ্ধ। এটি এমন একটি স্থান যেখানে ১৯১৪ সালে হিমাচল প্রদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম বাণিজ্যিক ফলের বাগান স্থাপিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে, কোটগড় প্রকৃতপক্ষে হিমাচল প্রদেশের এক অন্যতম প্রধান আপেল রপ্তানীকারক স্থান হয়ে ওঠে।

শিমলা জল-অববাহিকা অভয়ারণ্য

১০.২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই অভয়ারণ্যটি সরলবর্গীয় অরণ্য, খাড়াই ভূখণ্ড এবং ক্ষু্দ্র প্রবাহের গৃহস্থল। শিমলার ১২ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত এই স্থানটি হল বাদামী ভালুক, কৃষ্ণকায় হরিণ, ভারতীয় লাল শেয়াল ও ডোরা-কাটা হায়নার নিরাপদ আশ্রয়স্থল।

কুফরি

কুফরি হিমাচল প্রদেশের শিমলা জেলার একটি ছোট্ট হিল ষ্টেশন। শিমলা শহর থেকে ন্যাশনাল হাইওয়ে ২২ এর দিকে ১৩ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত এই শহরটি। ‘কুফরি’ শব্দটি স্থানীয় শব্দ ‘কুফ্র’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘লেক’। এখানে রয়েছে ‘হিমালায়ান ওয়াইল্ড লাইফ জু’। মজার ব্যাপার ১৮১৯ সালের আগে এই এলাকা মানুষের অজানা ছিল, মাত্র দুইশত বছর আগেও!!! একদল ইংরেজ পর্যটক বনের ভেতর দিয়ে ট্র্যাভেল করতে গিয়ে আবিস্কার করেন এই অপার সৌন্দর্যের জায়গাটি। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে হিমাচল ট্যুরিজম এর উদ্যোগে এখানে উইন্টার স্পোর্টস ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হয় যেখানে দেশ বিদেশ হতে হাজারো পর্যটক ভিড় করে।

ফাগু

ফাগু কুফরি থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে প্রায় ২৫০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। ফাগুতে শীতে স্কিয়িং আর উইন্টার স্পোর্টস এর জন্য দেশ-বিদেশ এর পর্যটকদের কাছে এবং গ্রীষ্মে স্থানীয়দের জন্য পিকনিক স্পট হিসেবে খুব জনপ্রিয়। এখানকার চুড়ো থেকে ‘গিরি উপত্যকা’র অসাম ভিউ দেখতে পাওয়া যায়। বরফ দেখতে চাইলে এর থেকে ভালো কোন অপশন পাবেন না শিমলাতে।

নালদেহরা

হাতে সময় থাকলে সিমলা থেকে গাড়িতে ঘুরে আসতে পারেন গল্ফ কোর্স, ভ্যালি, পাহাড়ী ভিউ এলাকা নালদেহরা।

কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে প্রথমেই কলকাতা। এটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই, কমবেশী সবাই জানেন। ৭০০-৬,০০০ টাকার মধ্যে বাই রোড, বাই ট্রেন অথবা বাই এয়ারে নানানভাবে আপনি পৌঁছে যেতে পারবেন কলকাতা। এরপর কলকাতা থেকে যেতে হবে কালকা। কলকাতা থেকে কলকা যাওয়ার ট্রেনটি হল কলকা মেইল (ট্রেন নাম্বার ১২৩১১), হাওরা থেকে রাত ০৭:৪০ এ ছেড়ে গিয়ে তৃতীয় দিন সকাল ০৪:৩০ নাগাদ কলকা পৌঁছে। স্লিপার ক্লাস ৬৮০ রুপী, এসি থ্রি-টায়ার ১৮৫০ রুপী, এসি টু-টায়ার ২৭০০ রুপী এবং এসি ফার্স্টক্লাস ৪৮০০ রুপী (প্রায়)।

কালকা পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা সেরে নিয়ে টয় ট্রেনের টিকেট করে নিতে হবে। ভালো হয় আগে টিকেট করে রাখতে পারলে। উল্লেখ্য যে, টয় ট্রেন যা ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সিমলাকে, কালকা শহরটির সঙ্গে সংযুক্ত রেখেছে এবং শহরটিতে পৌঁছানোর জন্য সবচেয়ে অন্যতম জনপ্রিয় রাস্তা তবে এটি খুবই ধীর। তবে, পারিপার্শ্বিক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য যে কারোও কাছে এই ৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ট্র্যাকটি খুবই সুন্দর।

বাসে দিল্লী থেকে শিমলা

এছাড়া কলকাতা থেকে দিল্লী হয়ে বাই রোডে সিমলা (Shimla) আসা যায়। HPTDC এর বাস ভাড়া এসি ভলভো ৯০০ রুপী আর নন-এসি ভলভো ৫৫০ রুপী। আরও বেশ কিছু বেসরকারী বাস এই রুটে চলাচল করে, ভাড়া ৮০০-১৫০০ রুপীর মধ্যে (বাস)। আপনি চাইলে ট্যাক্সি অথবা প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করে আসতে পারেন সিমলা, খরচ পড়বে ৬,০০০ রুপী থেকে শুরু কর গাড়ীর ধরন এবং ধারন ক্ষমতার উপর।

শিমলা টয় ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়া

কলকা থেকে মোট পাঁচটি টয়ট্রেন ছেড়ে যায় সিমলা’র উদ্দেশ্যে। এগুলো হলঃ

  • Kalka Shimla NG Passengers (Train No. 52457) Dep: 04:00 Arrv: 09:20
  • Kalka Shimla Rail Motor (Tran No. 72451) Dep: 05:10 Arrv: 09:50
  • Shivalik Delux Express (Train No. 52451) Dep: 05:30 Arrv: 10:15
  • Kalka Shimla NG Express (Train No. 52453) Dep: 06:00 Arrv: 11:05
  • Himalyan Queen (Train No. 52455) Dep: 12:10 Arrv: 17:20

ভাড়া অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেনী ১০০ রুপী’র মধ্যে আর প্রথম শ্রেনী ২৫০-৩৫০ রুপী’র মধ্যে। টয় ট্রেনগুলো ১০৩ টি সুড়ঙ্গপথ ও ৮০৬ টি সেতু অতিক্রম করে শিমলা পৌছে।

কোথায় থাকবেন

সিমলা শহরে থাকার হোটেলের অভাব নেই। তবে পিক সিজনে হোটেলের বিশাল ডিমান্ড। এপ্রিল মে মাস পিক টাইম। ওদিকে পূজার সময় অক্টোবর মাসেও ভালো ভিড় হয়। এইসময় হোটেল বুক করেই আসা ভালো। মিনিমাম স্ট্যান্ডার্ড হোটেল ভাড়া ১৫০০ টাকা। বাকি সময় অফ টাইমে অনেক কম ভাড়ায় স্পট বুকিংয়ে হোটেল পাওয়া যায়। গুগল ওয়েবসাইট সার্চ করলেই হোটেলের নিজস্ব ওয়েবসাইট এড্ড্রেস পাওয়া যাবে। এছাড়া অনেক হলিডে হোম ও আছে।

এছাড়া শিমলা মল রোডে এসে নিজের পছন্দ মত একটা হোটেল খুঁজে নিয়ে উঠে পড়ুন। ভাড়া ৫০০ রুপী থেকে শুরু, তবে পিক সিজন শীতে ভাড়া একটু বেশি থাকে। এভারেজ বাজেট ১,০০০ রুপী থেকে ধরে রাখতে পারেন। চাইলে আগে থেকে অনলাইনে বুকিং দিয়ে রাখতে পারেন। এজন্য ঢুঁ মারুন booking.com, agoda, makemytrip এসব সাইটে।

এছাড়া যারা সিমলাতে বাঙ্গালী পরিবেশে থাকতে এবং খেতে চান, তাদের জন্যে আছে সিমলা কালীবাড়ি। রুমের ভাড়া সাধ্যের মধ্যেই। ই-মেইলঃ simla-kalibari.1823@gmail.com ফোন নাম্বার – 2652964, 2657073

সিমলার এস টি ডি কোডঃ ০১৭৭।

কোথায় খাবেন

এখানে বাঙালির প্রথম পছন্দ শিমলা কালীবাড়ি।

হিমাচল প্রদেশ যে সার্কিটেই ট্রিপ করা হোক না কেনো ৭/১০ দিন পুরো ট্রিপের জন্য স্টেশন থেকে স্টেশন গাড়ী বুক করে নেওয়া ভালো। দিন প্রতি ৩০০০-৩৩০০ টাকা হিসাবে গাড়ি ভাড়া পাবেন বর্তমান রেটে।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ himachalindiakufrishimla