হামতা পাস ট্রেক

ফিরে এলাম হামতা পাস (Hampta Pass) থেকে। কুলু আর লাহুল – স্পিতি উপত্যকাকে বিভাজিত করে রেখেছে হিমাদ্রি হিমালয়ের যে পর্বতরাজি – সেই পর্বতশ্রেণীর নিম্নতম অংশ হলো এই হামতা পাস। এর উচ্চতা প্রায় ১৪০০০ ফুট। যুগ যুগ ধরে, এই পাস অতিক্রম করে গ্রীষ্ম আর বর্ষাকালে স্থানীয় মেষপালকেরা এক উপত্যকা থেকে আরেক উপত্যকায় তাদের ভেড়াদের ঘাস খাওয়াতে নিয়ে আসে, পাহাড়ী খচ্চরে মাল বয়ে চলে বেওসায়ির দল। দুই উপত্যকার মানুষদের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটে।

করোনার দাপটে দু-দুটি বছর পরে আমরা ট্রেক করতে বেরিয়ে অপেক্ষাকৃত কম সময়ের এই ট্রেকটা বেছে নিলাম তার একটা বড় কারণ হিমাচল প্রদেশ সরকার টুরিস্টদের প্রতি এখনো অনেক সদয়। আর অন্যটা হল এটা ছোট হলেও বৈচিত্র্যপূর্ণ!

এবার ট্রেক করলাম পাঁচ জনে। ক্যাপ্টেন দিদি, আমার ছেলে আর আমি ছাড়া এবার আমাদের দলে ছিলেন ক্যাপ্টেন দিদির দিদি Ajanta Dey (আমাদের দিদাই) এবং তাঁর মেয়ে রুশতি দে (আমার ছেলের গুড্ডি দিদি)। এঁদের সঙ্গেই আমাদের ট্রেকের হাতে খড়ি কিংবা পায়ের তলায় সর্ষে। অনেকদিন পর একসঙ্গে ট্রেক হলো। তবে ছেলের পরীক্ষার জন্য এবার বড্ড তাড়াহুড়ো করে ঘোরা হলো।

২০২১ সালের আগস্টের ৪ তারিখ রওনা হয়ে ওইদিন দুপুরে পৌঁছলাম চন্ডিগড় বিমানবন্দরে। ওই রাতে ভলভো বাস ধরে পরদিন সকালে মানালি। ৫ ই অগাস্ট ট্রেক শুরু। রানী নদীর উপত্যকা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আর মাঝে মাঝে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগুতে লাগলাম।

১ম দিন হাঁটলাম জোবরা থেকে চিকা/সিকা অবধি প্রায় সাড়ে তিন কিমি। প্রচন্ড ক্লান্ত ছিলাম। ওইটুকু রাস্তা যেতেই বেশ কাহিল হয়ে পড়লাম। আগের দিন রাতে বাসে ঘুম হয়নি। প্রায় বছর দুই পরে ট্রেক করতে বেরিয়ে একটা অনুভূতি হচ্ছিল যেটা ছোটবেলায় হত লম্বা ছুটির পরে নরেন্দ্রপুরের হোস্টেলে ফেরার প্রথম দিন।

পরদিনও নদী উপত্যকা ধরে হেঁটে চলা। পথে বড়ো বড়ো বোল্ডার আর মোটামুটি চড়াই। কিলোমিটার পাঁচেক হেঁটে দ্বিতীয় দিনের ক্যাম্পসাইট বালু কা ঘেরা।

৭ই আগস্ট হামতা পাস পেরোলাম। এদিন ৮ ঘণ্টার ওপর হাঁটলাম। শুরুতে পথ কুসুমাস্তীর্ণ। একদম আক্ষরিক অর্থে পা ফেলার জায়গাই নেই। রানী নালা বয়ে চলেছে আর তার দুই কূল ফুলে ফুলে ভরে আছে। ফুলে ভরা এই উপত্যকা ধরে কিছুটা যাবার পর শুধু চড়াই। উপত্যকা ক্রমে সঙ্কীর্ণ হয়ে আসছে। প্রথম দিকে রোদ থাকলেও যত বেলা যাচ্ছে মেঘ বাড়ছে, আর আমরা ক্রমেই ওপরে উঠছি। এক একটা প্রাণান্তকর চড়াই ভাঙছি আর যেটাকে আমরা উচ্চতম অংশ বলে ভাবছিলাম সেখান থেকে আরো উঁচু অংশ দেখা যাচ্ছে। মেঘের মধ্যে দিয়ে উঠে চলেছি। ঠান্ডাও কনকনে। বোল্ডার ভরা চড়াই শেষ হলো তো এবার শুরু হলো গ্লেসিয়ার এর উপর দিয়ে উঠে চলা।

সব দুঃখের ই শেষ হয়, আমাদের চড়াই ও একসময় শেষ হলো। ওপর থেকে লাহুল – স্পিতি উপত্যকার অনুপম সৌন্দর্য চোখ জুড়ালো। পাস এর ওপর থেকে ইন্দ্রাসন বা দেওটিব্বার দেখা মিলল না। আমাদের ‘পাস ‘ ভাগ্য খারাপ। বালি পাস, কুয়ারি পাস, হাম্পতা পাস কোনো পাস থেকেই ঝকঝকে শৃঙ্গ দেখার অভিজ্ঞতা হয়নি। সে যাই হোক এবার নামার পালা। এ রাস্তায় নামা বোধ হয় ওঠার থেকেও শক্ত। বিশেষ করে ক্যাপ্টেন দিদির আবার হাল্কা ভার্টিগো আছে। তাঁকে সঙ্গ দিয়ে নামিয়ে আনা হলো। এদিনের ক্যাম্পসাইট সিয়াগোরু। ইনিও এক ঝোরার ধারে। স্থানীয় ভাষায় সিয়া হলো ঠান্ডা। গোরু র অর্থ ঝোরা। এই দিনের ক্যাম্পের সৌন্দর্য আমার ব্যক্তিগত মতে সবচেয়ে সুন্দর আর সুন্দর পরদিনের হাঁটার রাস্তা। লাল, নীল, বেগুনি ফুলে এই রাস্তাও ভরে আছে। লাহুল – স্পিতির উপত্যকা বৃষ্টিচ্ছায় অঞ্চলে তাই অপেক্ষাকৃত শুকনো আর পাথুরে। আর ঝোরা যেখানে বয়ে যাচ্ছে সেখানটায় সবুজ, লাল, নীলের খেলা। যেন শ্যামল আঁচল কে বিছিয়ে রেখেছে।

আর বলবো না এবার ছবি দেখুন। ৮ই আগস্ট ছাত্রু ক্যাম্পে নেমে আমরা গেলাম চন্দ্রতাল দেখতে। সে আরেক সুন্দর অভিজ্ঞতা।

Leave a Comment
Share