বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমাদের প্রতিদিন কোন না কোন একাডেমিক ব্যস্ততা লেগেই থাকে। তবে সব ব্যস্ততাকে পেছনে ফেলে কিছুটা আনন্দ খুঁজে পেতে সবাই মিলে ঝর্না ভ্রমণের প্ল্যান করি। আমরা সবাই চট্টগ্রামের পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষার্থী। আমাদের বিভাগের ফেসবুক গ্রুপে প্রথমে একটা পোস্ট করি এরপর এডভেঞ্চার প্রিয়রা ব্যপকভাবে সাড়া দেয়। আমরা ৩২ জন মিলে মিরসরাইয়ের পাহাড়ে অবস্থিত নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা দেখার সিদ্ধান্ত নেই।
আমাদের বহর বড় হওয়ায় যাতায়াত ঝামেলা এড়াতে একটা বাস ঠিক করে ফেলি। সকাল ৭:৩০ এ সবাইকে আসতে বললেও কেউ কেউ দেরি করায় আমাদের কিছুটা ভোগান্তি হয়েছে তবে সেই ভোগান্তি দূর হয়েছে বাস ছাড়ার পরপরই। বাসে সিনিয়র জুনিয়র সব শিক্ষার্থীর হৈ-হুল্লোড়ে যেন সব ভোগান্তি হাওয়ায় মিশে গেছে। শহরের একে খান মোড় থেকে আমাদের বাস ছাড়ে সকাল ৯ টায়। প্রায় দেড় ঘন্টার জার্নি শেষে আমাদের গন্তব্য মিরসরাইয়ের নয়দুয়ারীবাজারে এসে পৌছে যাই আমরা। এরপর কিছু পথ হেঁটেই দেখা মেলে রেললাইন তার একটু সামনে এগুলে দু-চারটি খাবার হোটেল।আমরা স্থানীয় একটি দোকানে খাবার অর্ডার দিয়ে ব্যাগ সহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রেখে রউনা শুরু করি।
টিকেট সংগ্রহ শেষে আমাদের ট্রেইলের যাত্রা শুরু হয়। চারিপাশে উঁচু উঁচু পাহাড়। এসবের ভেতর দিয়ে ঝিড়িপথ। ঝিরিপথে পানির কলতান যে কাউকে রোমাঞ্চিত করে তুলবে। বলে রাখা ভালো চট্টগ্রামে বেশ কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে আর এতেই ঝর্ণাগুলো যেন তার যৌবন ফিরে পেয়েছে। ঝিরিপথ ধরে দলবেঁধে আমরা সবাই হেঁটে যাচ্ছি নাপিত্তাছড়া ঝর্ণার উদ্দেশ্য, ঝিরিপথে পানির তেমন স্রোত না থাকলেও বিশাল বিশাল পাথরে পা ফেলে পথ পাড়ি দিতে ঝুঁকির পাশাখেলা এডভেঞ্চার বটে। অনিন্দ্য সুন্দর ঝিরিপথের সৌন্দর্যে ততক্ষণে প্রায় সবাই নিজেকে ফ্রেম বন্দি করতে ব্যস্ত৷কেউ আবার আপন মনে গানের সুরে মেতেছে। এ এক অন্যরকম এডভেঞ্চার।
প্রায় ১ ঘন্টা হাঁটার পর আমরা দূর থেকে ঝর্না থেকে নেমে আসা অবিরাম পানির শব্দ শুনতে পাই। এই দৃশ্য দেখার পর আমাদের সবার সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গেছে। মিরসরাইয়ে অবস্থিত এই জলপ্রপাতে মোট ৩ টি ঝর্ণা আছে। এর প্রথমটি কুপিকাটাকুম। তবে কুপিকাটাকুমের আগে অংশটিকে বলা হয় টিপরাখুম। এর মধ্য দিয়ে এই ঝরনায় যেতে হয়। মূলত ত্রিপুরা আদিবাসীরা এখানে থাকে। তাই এর নাম হয় টিপরাখুম। টিপরাখুমের উপরে বেয়ে আমরা যাই কুপিকাটাকুম ঝর্ণায়। তবে এখানকার পাথর প্রচুর পিচ্ছিল আর খুমের গভীরতা বেশি থাকায় আমরা ঝুঁকি এড়াতে কেউ নামিনাই।
কুপিকাটাকুমের পাশেই উঁচু পাহার বেয়ে কিছুদূর গেলেই স্থানীয় একজন লেবুর শরবত বিক্রি করছিল আমরা লেবুর শরবত খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করি। এরপর আবার বিশাল বিশাল পাথর, ঝিরিপথ ধরে হাঁটতে হাটতে হাতের ডানে গিয়ে ১০ মিনিট পরেই দেখা মেলে বান্দর খুম জলপ্রপাত। মূলত এটি নাপিত্তা ছড়া ঝরনা নামে পরিচিত। পাহাড়ের চূরা থেকে সাদা জলরাশি আর পানির কলতানে এই ঝর্ণাটি সবার প্রিয় হয়ে উঠেছে। ঝর্ণায় গা ভেজানোর পাশাপাশি ছবি, ভিডিও ধারণে সবাই ব্যস্ত। এই জলপ্রপাতে আরেকটি ঝর্ণা আছে যার নাম বাঘ বিয়ানী ঝর্ণা। এই ঝর্ণাটির শীতল জল ও পানির প্রবাহ যে কাউকে মুগ্ধ করবে। এখানে কিছুক্ষণ গা ভেজানোর পর আমরা ট্রেইলে বসে বিশ্রাম নিয়ে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নেই।
আমাদের বিকেলের মধ্যেই শহরের উদ্দেশ্য রউনা হতে হবে৷ ঝর্ণা ভ্রমণ শেষে আমরা ফিরে আসি কুপিকাটাকুম ট্রেইলে। সেখানে আমাদের সবার গ্রুপ ছবি ফ্রেমবন্দী করে আমরা আবার ঝিরিতে নেমে আসি। এবার ফেরার পালা। আমাদের ৩ টি ঝর্ণা ঘুরে আসতে আসতে ইতিমধ্যে বিকেল হয়ে গেছে। প্রায় ৪০ মিনিট ঝিরিপথ ধরে হেঁটে আমরা গ্রামীণ পথ ধরে খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্য রওনা দেই। খাবার খাওয়া শেষে এবার ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে খানিক কাঁচা সড়ক হেঁটে আমরা মূল সড়কে আগে থেকে ঠিক করা গাড়িতে চড়ে শহরে ফিরে আসি।
মিরসরাইয়ের জনপ্রিয় এই ট্রেইল ভ্রমণে সর্তক থাকা উচিত। সময় নিয়ে ঝিরিপথ অতিক্রম না করলে বিপদ ঘটতে পারে। এই ট্রেইলে ট্রেকিং স্যান্ডেল নিলে অনেকটাই সুবিধা পাওয়া যায়। বর্ষা থাকতেই নাপিত্তাছড়া ঝর্ণার মায়াবী রূপ দেখতে হলে একবার হলেও সবার ছুটে যাওয়া উচিৎ।
Leave a Comment