কম খরচে আমার ভারত ভ্রমণ ( সিমলা দ্বিতীয় পর্ব )

আগের পর্ব

ঘন্টা দেড়েক পর অনেক খুঁজে খুঁজে সেতুদের খুঁজে বের করলাম। দেখি পঙ্কজদা চলে এসেছেন।তিনি আমাদের প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ছোট ভাই রোহিতকেও নিয়ে এসেছেন। আর তারা সবাই মিলে এ ব্যাংক সে ব্যাংক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখনো সেতুরা ডলার ভাঙ্গাতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত আরো প্রায় ঘন্টা খানেক পর লাঞ্চের টাইমে ডলার ভাঙ্গানো গেল। প্রথম যে ব্যাংককে যাওয়া হয়েছিল সেখান থেকেই ডলার ভাঙ্গানো হলো, মাঝখান থেকে কয়েকঘন্টা সময় নষ্ট। তারমানে এই নয় যে সিমলাতে ডলার ভাঙানোর জায়গার খুব অভাব, সমস্যা হচ্ছে কোন ব্যাংকের ডলারের রেটই সেতুদের পছন্দ হয়না।

এইসব কাজ করতে করতে দুপুর প্রায় দুটো বেজে গেছে। এবার আমরা দুপুরের খাবার খেতে চললাম। আপার বাজারের দিকে জাঁকজমক একটা রেষ্টোরেন্ট।

ভেজ খাবারের অর্ডার দেয়া হলো। অনেকে ভেজ খাবার খেতে চায়না। কিন্তু সিমলার ভেজ খাবার আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। সেতু তার স্বভাব মতো এটা-ওটার অর্ডার দিয়েই চলেছে, আর আমরা সেগুলোর স্বদগতি করেই চলেছি। খাওয়া দাওয়ার ফাকে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছে।

সিমলার সবথেকে ভয়ঙ্কর বানরগুলো থাকে নাকি জাখু টেম্পলে যাবার জঙ্গলে। জাখু টেম্পল হচ্ছে বিরাট হনুমানের মূর্তিওয়ালা মন্দিরটি। এই মন্দিরটি সিমলা শহরের সবথেকে উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত। আশেপাশের কয়েক মাইল দুর থেকে হনুমানের মূর্তিটি দেখা যায়। রাতে আবার আলো দিয়ে উজ্জ্বল করা হয়। তখন আরো দূর থেকে মূর্তিটি দেখা যায়। তো মন্দিরে যাবার পথে জঙ্গলের বানরগুলিই নাকি উৎপাত করে। এরা নাকি দর্শনার্থীদের উপর হামলা করে পকেট আর ব্যাগ হাতড়ে জিনিসপত্র নিয়ে দৌড় দেয়। আকারেও এরা বিশাল সাইজ। আর এদের নখের সামান্য ছোয়া লাগলেই আধাঘন্টার ভিতরে নাকি ইঞ্জেকশন দিতে হয়। এক কোর্সে ৭টা ইঞ্জেকশন। পঙ্কজদার নাকি একবার এই কোর্স কমপ্লিট করতে হয়েছে। মন্দিরের পথে যাবার আগে নাকি ১০ রুপি দিয়ে লাঠি ভাড়া করতে হয় বানর খেদানোর জন্য।
ভরপেট খাওয়া শেষে ৫ জনের বিল এলো ৮৬০রুপি। যেহেতু আমরা পঙ্কজদা আর রোহিতকে খাওয়াচ্ছি এজন্য আমার ভাগে বিল এলো ২৯০রুপি। বেয়ারাকে বকশিষ দেবার এতো চেষ্টা করা হলো সে কিছুতেই সেটা নিলো না। রেষ্ট্ররেন্ট থেকে বের হয়ে আমরা এবার ম্যালের দিকে গেলাম।

সিমলা ম্যালের এই রাস্তাটির নিচেই রয়েছে বড় বড় পানির ট্যাঙ্ক। এখান থেকেই পুরো সিমলার পানি সরবরাহ করা হয়। এখানে পঙ্কজদার কিছু বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ তাদের সাথে আড্ডা চললো। তারপর পঙ্কজদা কি একটা জরুরি কাজে ঘন্টা দুয়েকের জন্য চলে গেলেন। রোহিত থাকলো আমাদের সাথে। সে আমাদের নিয়ে চললো লক্কার বাজার। লক্কার বাজার হচ্ছে কাঠের তৈরি জিনিসপত্র বিক্রির বাজার। সেতু সেখানে কিছু দোকানদারদেরকে বিরক্ত করলো।

তারপর আমরা একটা ভবনের দোতালায় উঠলাম স্কেটিং দেখার জন্য। একটা বিশাল ঘরের মধ্যে ছেলেমেয়েরা স্কেটিং করছে। এটি রোহিতের খুব প্রিয় একটা জায়গা। কিছুক্ষণ স্কেটিং দেখার পর সেতুর আবার পিপাসা পেয়ে গেল। নিচে নেমে নিয়ন একটা ঠান্ডা কিনলো। সুন্দর একটা ভিউ পয়ন্টে দাঁড়িয়ে বোতল খালি করার পর আমরা আবার ম্যালে ফেরত এলাম।

এবার আমরা টাউন হল ভবনের সামনে বসলাম। সবাই মিলে মেয়ে দেখা শুরু হলো। ততোক্ষণে বিকাল হয়ে গেছে। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে আসছে ম্যালে বেড়াতে। সবাই খুব সুন্দর, স্মার্ট আর পরিপাটি পোশাকের। জোড়ায় জোড়ায় অথবা কতগুলি বন্ধু-বান্ধব একজোট হয়ে আসছে।

কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে এই মিলনক্ষেত্রটি কেমন যেন প্রাণহীন। এরা খুব আস্তে আস্তে নিজেদের মধ্যে টুকতাক কথাবার্তা বলছে। কোথাও কোন হইচই নেই। ব্যাপারটা জানি কেমন যেন! যদিও আমি ধূমপান পছন্দ করি না তবুও আমার মনে হয়েছে এই বয়সী ছেলেমেয়েরা সিগারেট খাবে, সবাই মিলে চিৎকার করবে, হাসাহাসি করবে, গল্প করবে, গিটার বাজিয়ে গান করবে, হল্লা করবে তবেই না তারুণ্য! কিন্তু এখানে এসে আমার মনে হচ্ছে আমরা বুঝি কোন চিত্রকলা প্রদর্শনীতে এসেছি যেখানে কোন রকম শব্দ করা নিষিদ্ধ।

এতো লোকের মাঝে আমি, নিয়ন আর সেতু এই তিনজনই উচ্চস্বরে গল্প করে যাচ্ছি। আমাদের মাঝে রোহিত খুব আস্তে আস্তে কথা বলছে। ভারতের লোকেরা নাকি সাধারণত অপরিচিত লোকের সাথে আলাপ করে না। কিন্তু রোহিত অথবা পঙ্কজদার সাথে আমাদের কতো ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। তবে রোহিতকে আমি হাজার চেষ্টা করেও বোঝাতে পারিনি যে সেতু আর নিয়নের সাথে আমার মাত্র দুদিন ধরে পরিচয়। সে ভেবেছে আমরা বুঝি সম্পর্কে কাজিন হই। আমাদের দেশের লোকেরা যে খুব দ্রুত বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলতে পারে তা রোহিতের কাছে বিস্ময়কর। তবে এখানকার মেয়েরা অনেক স্মার্ট আর স্বাধীনচেতা। কোন ছেলে অপরিচিত মেয়ের সাথে সহজেই কথা বলতে পারে। কিন্তু সেটি হতে হবে খুব মাপা ভদ্রতায়।

সবচেয়ে মজা পেয়েছি কলকাতার ট্যুরিস্টদের দেখে। খুবই সস্তা ধরণের ফ্যাশান। কে কে কলকাতার ট্যুরিস্ট আমাকে তা বলতে দেখে রোহিত খুবই অবাক হয়েছিল। তাকে বুঝিয়েছিলাম যে কলকাতার লোকেরা মাঙ্কি টুপি পড়ে বলে খুব সহজেই এদের আলাদা করে চেনা যায়। আর কাছে গেলেই দেখা যায় এরা একজন আরেকজনকে অদ্ভুত বাংলা উচ্চারণে জ্ঞান দান করছে।

ঘন্টা খানেক পর পঙ্কজদা এলেন। তার সাথে আবার টুকটাক হাঁটাহাঁটি শুরু করলাম। এসময় পঙ্কজদার কাছে ফোন এলো। আলাপে যা বুঝলাম ফোন করেছে তার বোন, মানে আমাদের প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। সে বাস থেকে নেমেছে এবং এখন এদিকেই আসছে। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত তার এ আসাটা সম্পূর্ণ সেতুর জন্যই। পঙ্কজদাও মনে হয় ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। কারণ তিনি দেখি প্রিয়াঙ্কাকে এদিকে আসতে নিষেধ করছেন। আমি একটা জিনিস বুঝিনা, সেতুর চাইতে নিয়ন দেখতে অনেক সুন্দর, অনেক স্মার্ট আর ব্যাক্তিত্বসম্পন্ন। তবু সেতু বলতে সবাই একেবারে পাগল।

যাই হোক, ফোনের ব্যাপারটি সেতু বা নিয়ন কেউই খেয়াল করেনি। তারা তখন চা-ওয়ালা অথবা ফটোগ্রাফারওয়ালাদের নিয়ে ব্যাস্ত। ফটোগ্রাফারওয়ালা হচ্ছে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো কিছু লোকজন যারা ম্যালে বেড়াতে আসা ট্যুরিস্টদের খুব সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে ওয়াশ করে দিচ্ছে কিছু রুপির বিনিময়ে।

কিছুক্ষণ পর আমি পুরোপুরি অস্থির হয়ে গেলাম। সেতু আর নিয়নের পাল্লায় পড়ে সেই সকাল থেকে এই সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরোটা সময় এই ম্যালের আশেপাশেই রয়েছি। আর কোথো ঘোরা হয়নি। আমার ঘোরাঘুরির একটা বিশেষত্ব আছে। কোথাও বেড়াতে গেলে সবাই যেমন গাড়ি ভাড়া করে সাইট সিয়িং করে আমি তেমন করি না। কারণ আমি দেখেছি জ্ঞাড়িতে করে সাইট সিয়িং করার চেয়ে পায়ে হেঁটে অথবা লোকাল ট্রান্সপোর্টে ঘুরে বেড়ানো অনেক মজার।

কিন্তু সেতু আর নিয়নের পাল্লায় পড়ে আমার কিছুই দেখা হয়নি। এরা এমন ধ্যাতলা যে শীতের কাপড় ছাড়া সিমলায় এসেছে, সকাল থেকে শুনছি শীতের পোশাক কিনবে। এখন সন্ধ্যা, ঠান্ডায় কাঁপছে অথচ এখনো শীতপোশাক কেনার সময় করে উঠতে পারেনি। সেতু তো আমার কাছ থেকে একটা জ্যাকেট ধার নিয়েছে কিন্তু নিয়ন ঠান্ডায় মাঝে মাঝে হি হি করছে।

ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চললাম লোকাল বাস স্ট্যান্ডের দিকে। যাবার সময় কতগুলি স্কুল আর চার্চের ছবি তুললাম।

লোয়ার বাজারের কাছেই হচ্ছে সিমলা ওল্ড বাস স্ট্যান্ড। এখান থেকে বিভিন্ন দিকের বাস ছেড়ে যাচ্ছে। এই বাস স্ট্যান্ডটি রেল স্টেশনের সাথে লাগোয়া। এখান থেকে নিউ বাস স্ট্যান্ড গামী বাসে উঠলাম। সবাই ওঠার পর কন্টাকটার বাসের দরজা আটকিয়ে বাঁশি বাজালো আর তারপর ড্রাইভার বাস চালানো শুরু করলো। মাঝপথে যখন কোন যাত্রীর ওঠা বা নামার প্রয়োজন হচ্ছে তখন কন্ট্রাকটার বাঁশি বাজিয়ে বাস থামাচ্ছে। যাত্রীরা নেমে বা উঠে নিজ দায়িত্বে দরজা বন্ধ করছে। কোথাও কোন হৈ হল্লা বা গালাগাল বা বাস থাবড়ানো নেই।

সিমলা নিউ বাস স্ট্যান্ডের ভাড়া নিল ৭রুপি। সেখানে যখন আমি নামলাম সত্যিই আমি চমকে উঠলাম। কমপক্ষে চার তলা বাস স্ট্যান্ড। যেখানে উপর তলায়ও বাস উঠে যাচ্ছে। নিচ থেকে উপরে ওঠার জন্য অনেকগুলি লিফট আছে। প্রতি তলায় খাবার হোটেল আছে। টয়লেট গোসলখানা পানি খাবার সুব্যাবস্থা। লাগেজ জমা রাখার জন্য ক্লক রুম। এমনকি রাত্রে ঘুমানোর জন্য হোটেলও আছে।

ইনফরমেশন ডেক্সে গেলাম মানালি যাবার কোন বাস আছে কিনা জানার জন্য। সেখান থেকে জানালো রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত দুটো বাস আছে। ভাড়া চারশো রুপির মধ্যেই। ভাবলাম শেষ বাসটায় যাবো। সেতুরা যাবে কিনা জানার জন্য ফোন করতে হবে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও ফোনের দোকান খুঁজে পেলাম না। একজন ড্রাইভারকে আশেপাশে কোথাও ফোনের দোকান আছে কিনা জানতে চাইতেই সে তার নিজের মোবাইল এগিয়ে দিলো আমার দিকে।

ফোন দিলাম সেতুকে। সে দেখি হিন্দি বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে এয়া উয়ু করছে। শেষ পর্যন্ত বোঝাতে পারলাম আমি রাজ। মানালি যাবার রাতের বাসে তাদের জন্যও টিকিট কাটবো কিনা। কিন্তু সে নিষেধ করলো। এমনকি আমাকেও অনুনয় করে অনুরোধ করলো যেন আমি আজ না যায়। কথা বলা শেষ করে ফোন ফেরত দিয়ে লোকটাকে টাকা দিতে চাইলাম। কিন্তু লোকটা আমাকে বোঝালো যে আমি হচ্ছি তাদের অতিথি। আর অতিথির কাছ থেকে সে সামান্য ফোন কলের টাকা নিতে পারবে না। হিমাচল প্রদেশের সামান্য এক লোকাল বাস ড্রাইভারের এমন রুচি বোধের প্রকাশে আমি সত্যিই খুব অবাক হয়েছিলাম।

লোকাল বাসে চড়ে আবার ওল্ড বাস স্ট্যান্ডে ফেরত এলাম। তারপর সেখান থেকে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাটা শুরু করলাম। তখনই একটা মজার জিনিস খেয়াল করলাম। সিমলা একটি পাহাড়ি শহর হওয়ায় এর রাস্তাঘাট খুবই সরু। পাশাপাশি দুটো গাড়ি কোনরকমে যাওয়া আসা করতে পারে। তারপরও এই শহরে ফুটপাত আছে। রাস্তার ধার দিয়ে যেদিকে গভীর খাদ তার উপরে লোহা আর কাঠের কার্নিশ বানিয়ে ঝুলন্ত ফুটপাত তৈরী করা হয়েছে। সবাই সেই ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। আমিও নামলাম সেখানে। ফুটপাতটি দেখে একই সাথে বিস্ময় আর শ্রদ্ধা জাগলো। আর একই সাথে দুঃখ লাগলো প্রিয় শহর ঢাকার ফুটপাতের কথা ভেবে।

হাটতে হাটতে অনেকদূর চলে আসার পর সামনে দেখি লিফট। সিমলা পাহাড়ি শহর আর যেসব রাস্তায় পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চলাচল করে সেখান থেকে ম্যাল বা রীজ অনেক উপরে। ম্যাল বা রীজে পুলিশ ফায়ার ব্রিগেড বা এ্যাম্বুলেন্স ছাড়া অন্য কোন গাড়ি প্রবেশ নিষেধ। এজন্য মানুষ বাস থেকে নেমে লিফটে করে উপরে ম্যাল বা রীজে পৌছায়। ১০রুপির টিকিট কেটে আমিও লিফটে উঠে পড়লাম। একটা নির্দিষ্ট জায়গা পর্যন্ত ওঠার পর লিফট বদলে কিছুদূর হেঁটে আবার আরেকটি লিফটে উঠতে হয়। দ্বিতীয় লিফট থেকে নেমে কিছুদূর হাটলেই চার্চ।

পুরো ম্যাল ফাঁকা। চার্চের বাম পাশ দিয়ে দেখি একটা রাস্তা চলে গেছে। সেখানকার সাইনবোর্ডে লেখা দেখে বুঝতে পারলাম এটাই জাখু টেম্পলে যাবার রাস্তা। সেখানে আরো লেখা আছে যদি কেউ ৩০মিনিটে মন্দিরে পৌছাতে পারে তবে সে নাকি অতিরিক্ত ফিট। আচ্ছা এই তাহলে হনুমানের মন্দিরে যাবার রাস্তা! যেখানে যাবার পথে গাদা গাদা বানর পড়ে। সেতু আর নিয়নের সাথে থেকে আমার সারাটা দিন নষ্ট হয়েছে, কিছুই দেখা হয়নি। আর কাল সকালে যদি মানালির বাসে উঠে পড়ি তবে সিমলার আর কিছুই দেখা হবে না। তাহলে ব্যাপারটা এই দাড়াচ্ছে যে মন্দিরটা দেখতে হলে এটায় আমার শেষ সুযোগ।

হায় তখন যদি আমার এই দুর্বুদ্ধি না হতো! বিসমিল্লাহ্‌ বলে পা বাড়ালাম। রাত তখন সাড়ে আটটার কাছাকাছি। কোথাও লোকজন নেই। পুরো ম্যাল একেবারে খাঁখাঁ করছে। খুবই খাড়া একটা পথ। কিছুদূর এগিয়েই জেলা প্রশাসকের বাংলো। এখানে দু’চারজন লোক দেখে ভাবলাম যে যাক মন্দিরে যাবার সঙ্গি পাওয়া গেল। কিন্তু ভুল ভাঙল একটু পরেই। এ পথে টুকটাক যে কয়টা বাড়ি পড়লো লোকগুলো সেখানে ঢুকে গেল।

পথটা ক্রমশ আরো উঁচু হয়েছে। রাস্তার একপাশে দেখি সিঁড়ি করে দেয়া আছে। কিছুক্ষণ সিঁড়ি ভাঙার পর বুঝলাম এর চাইতে ঢালু পথ বেয়ে ওঠা বেশি সহজ। উঠছি যতোটা তার চাইতে হাপাচ্ছি বেশী। কিছুক্ষন বিশ্রাম নিই তারপর আবার হাটি। তাজিংডং পাহাড়ে ওঠার সময়ও আমার এতোটা কষ্ট হয়নি। একজায়গায় দাঁড়িয়ে হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছি একটা লোককে এগিয়ে আসতে দেখলাম। মন্দিরে যাবার সঙ্গি পাওয়া গেছে ভেবে এগিয়ে গেলাম তার দিকে।

একজন স্থানীয় ভদ্রলোক। তার বাড়ি এই পাহাড়েই। আজকে তার ফিরতে দেরি হয়ে গেছে। কাউকে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত সাহস করে সে একাই রওনা দিয়েছে। তার এ বক্তব্য শুনে আমি খুবই ভয় পেয়ে গেলাম। যেখানে স্থানীয় লোকেরাই বানরের ভয়ে তটস্থ থাকে সেখানে এতো রাতে আমার একা একা এভাবে চলে আসা উচিৎ হয়নি। আমি একজন বিদেশি তারপরও মুসলমান একজন লোক হয়ে এতো রাত্রে বানরের এই ভয়ঙ্কর জঙ্গল মাড়িয়ে হনুমানের মন্দিরে যাচ্ছি শুনে ভদ্রলোক যারপরনাই অবাক হলেন।

কিছুদূর এগোলাম তার সাথে। জোরে জোরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে দেখে সে বললো যে কিছুক্ষনের মধ্যেই জোরে বৃষ্টি শুরু হবে। আমি এখন মন্দিরে গিয়েও নাকি কিছু দেখতে পারবো না, কারণ মন্দির নাকি রাত সাড়ে আটটায় বন্ধ হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে সতর্ক করলো জঙ্গলের ভয়ঙ্কর বানর সম্পর্কে। সেগুলির স্বভাব চরিত্র নাকি খুবই বীভৎস। তারপর লোকটার বাড়ি এসে পড়ায় সে ঢুকে পড়লো তার বাড়িতে, আর আমিও খুব ভয়ে ভয়ে সামনে এগিয়ে যেতে লাগলাম।

পথটা এখানে আরো দুর্গম হয়েছে।আর দুপাশে শুরু হয়েছে ঘন জঙ্গল। সেই জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে বানরদের অমানুষিক চিৎকার। ঠিক এ সময়ই রাস্তার পাশের লাইটপোষ্টে যে আলো জ্বলছিল তা নিভে গেল। এমনিতেই ভয়ে অস্থির হয়ে ছিলাম আর এখন আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়লাম। নিজের বোকামিতে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে যে কেন আসতে গেলাম। আর এ সময় জোরে বাতাস শুরু হলো। আমার অবস্থা আরো টাইট। তবে এসময় বিদ্যুৎ চমকের আলোয় সামনে যা দেখলাম তা আগের সব অবস্থাকে ছাড়িয়ে গেল। দেখলাম একগাদা বানর দাঁত মুখ ভেংচে কিলবিল করছে। আমি তো জানতাম শুধু সাপের কিলবিল করে, কিন্তু একগাদা বানরও যে কিলবিল করতে পারে তা এই প্রথম দেখলাম! আমি না পারছি সামনে যেতে না পারছি পিছিয়ে আসতে। জায়গায় দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলাম।

আল্লাহর বিশেষ রহমতে একটা দুটো করে বানর কমা শুরু করলো। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর তার সাথে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতো আছেই। শেষ পর্যন্ত সবগুলো বানর যখন সরে পড়লো তখন পথের পাশের রেলিং ধরে আস্তে আস্তে সামনে এগোতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি আরো কয়েকটা জলজ্যান্ত মূর্তিমান বিভীষিকা পথের পাশে বসে আছে। দাঁড়িয়ে আবার আয়াতুল কুরসি পড়া শুরু করলাম। সেগুলো সরে গেলে আবার সামনে আগানো শুরু করলাম। একটু পরে দেখি কিছুটা দূরে মন্দিরের আলো দেখা যাচ্ছে। জানে কিছুটা পানি এলো।

শেষের পথটুকু কিভাবে যে পার হলাম তা আল্লাহই জানে! তবে মন্দিরের দরজায় দাড়িয়েই আমি আবার ভয়াবহ চমকে উঠলাম। আসলে হয়েছে কি দরজার দুপাশে দুটো মূর্তি, বিদ্যুৎ চমকে আমি মনে করেছিলাম বিশাল সাইজের মানুষ নড়াচড়া করছে।

যাই হোক সেগুলো পার হয়ে আমি মন্দিরের সিঁড়ি বেয়ে আরো উপরের দিকে উঠে চললাম।আশেপাশে কোন মানুষের সাড়াশব্দ নেই। সিঁড়ি বেয়ে একদম উপরে উঠে দাড়ালাম হনুমানের মূর্তির পায়ের কাছে। ৮,১০০ফুট উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত ১০৮ফুট উঁচু এই মূর্তিটি নাকি পৃথিবীর সুবচেয়ে উঁচু মূর্তি।

গদা হাতে দাঁড়ানো হনুমানের বিরাট এবং বিকট এই মূর্তিটি আমার স্নায়ুর উপর প্রচন্ড চাপ ফেলছে। আসলে পরিবেশটায় অন্যরকম। আশেপাশে কোন মানুষ নেই, কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর জোরে জোরে মেঘ ডাকছে, আর জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে বিশাল বিশাল বানরের তীক্ষ্ণ চিৎকার। যখন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তখন আমার মনে হচ্ছে হনুমানের বিশাল এই মূর্তিটি নড়ে চড়ে উঠছে। যেন যেকোন সময় এই ১২তলা উঁচু এই হনুমান তার বিশাল গদাখানি আমার মাথায় ধমাস করে বসিয়ে দেবে। আমি বুঝতে পারছি দিনের বেলায় আসলে ব্যাপারটি খুবই হাস্যকর হতো, কিন্তু এই রাত নটার দিকে এই জনমানবশূন্য ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক পরিবেশ আমাকে পরচন্ড নার্ভাস করে তুলেছে। বিশেষ করে যখন জঙ্গল থেকে বানরের রক্ত হীম করা উল্লাস ধ্বনি ভেসে আসছে। আমি আর সেখানে দাড়ানোর সাহস পেলাম না।

কিন্তু আবার এই পথে ফেরত যেতে হবে ভেবে মনটা দমে গেল। অথচ এছাড়া আর কোন উপায় নেই। ততোক্ষণে বৃষ্টির জোর কিছুটা বেড়েছে। অবশ্য খুব জোরে না, কেমন যেন কুয়াশা কুয়াশা টাইপ বৃষ্টি। কিন্তু যে আকারে মেঘ ডাকছে যদি আরো জোরে বৃষ্টি শুরু হয় তাহলে আমি এখানে আটকে যেতে পারি। আর সারা রাত এখানে থাকতে হলে আমি নির্ঘাত মারা যাবো। মাথায় হুডি তুলে বিসমিল্লাহ্‌ বলে নামা শুরু করলাম। সুখের কথা এই যে ল্যাম্পপোস্টের লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে।

তবু খুব ভয়ে ভয়ে নামতে লাগলাম। তবে নামার পথে আর কোন বানর চোখে পড়ছে না। উপরে উঠার চাইতে ভেজা পিচ্ছিল পথে নিচে নামাটা বেশী কঠিন। আশেপাশে যখন দুয়েকটা বাড়ির আলো চোখে পড়লো তখন কিছুটা সুস্থির হলাম। আস্তে আস্তে নেমে এলাম চার্চের সামনে। চোখ ধাঁধানো আলো ঝলমলে জায়গাটায় এসে যখন পৌছালাম তখন তো বিশ্বাসই হতে চাচ্ছিল না যে ঘন্টা খানেক ধরে আমার উপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে গেছে।

ইন্ডিয়ায় পাহাড়ি শহরগুলোতে দোকান পাট খুব দ্রুত বন্ধ হয়ে যায়। রাত প্রায় সাড়ে নটা বাজে। দুয়েকটি দোকান দেখলাম বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটা দোকানে বাইরে ঝোলানো একটা কুর্তা দেখে মায়ের জন্য খুব পছন্দ হলো। দোকানটির ভিতরে ঢুকে সেটার কথা বলতেই দোকানি আরো একগাদা জামা নামিয়ে আনলো। দোকানদার ব্যাটা চালাক আছে। সবগুলো জামা খুব সুন্দর। মনে হচ্ছে সবগুলো কিনে নিই।

কিন্তু আমি প্রথমটিই বেছে নিলাম। দামও বেশ কম। বাড়িতে আনার পর সবাই সেটা খুব পছন্দ করেছে। এই দোকান থেকে বের হয়ে খাওয়ার জন্য রেস্ট্ররেন্টে গেলাম। রেস্ট্ররেন্টটি তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে আবার খাবার রান্না শুরু করলো। বাইরে তখনো ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে।

খাওয়া দাওয়া শেষে হোটেলে ফিরে দেখি সেতু আর নিয়ন তখনও ফেরেনি। হোটেলের ফোন থেকে তাদের কাছে ফোন দিলাম। তারা তখন স্ক্যান্ডাল পয়েন্টে আছে। বৃষ্টির মধ্যে হাটতে হাটতে তাদের কাছে গেলাম। গিয়ে দেখি শেষ পর্যন্ত তারা শীত পোষাক কিনেছে। আমার কাছে গল্প দিলো সেগুলোর দাম নিয়েছে চার হাজার রুপি। কিন্তু আমার কাছে সেগুলো ২০০রুপির বেশি মনে হয়নি। আবার হাটতে হাটতে হোটেলে ফিরে এলাম।

হোটেলে ফিরে রুমে ঢোকার পর সেতু হোটেলের সব কর্মচারীকে ডেকে পাঠালো। সেতুর নাকি সারারাত ঘুম হয়নি। তাকে নাকি সারারাত ছাড়পোকা আর তেলাপোকা কামড়েছে। এই লেপ তোষক কম্বল বালিশ সব বদলে দিতে হবে। হৈ চৈ শুনে হোটেলের মালিক এসে ঢুকলো। সে প্রথমে সবকিছু মনযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর ঠাণ্ডা ভাবে জানতে চাইলো আমরা কতো রুম ভাড়া দিচ্ছি। মাত্র ৬০০রুপি শুনে সে খুব ভয়ঙ্কর রেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সেতু তখন চিৎকার শুরু করেছে বাথরুমে গরম পানি নেই কেন এজন্য।

আমি তো দেখলাম কাম সারছে! বৃষ্টি হওয়া এই রাত্রে বের করে দিলে কই যাবো! এখনও গরম পানি নেই কেন চিৎকার করতে করতে সেতু হোটেলের কাউন্টারে এগিয়ে গেল। আমি নিশ্চিত সেতু এবার সেখানে মারধোর খাবে। আমি ব্যাগ গুছানো শুরু করলাম। কারণ এতো ঘটনার পর হোটেলের লোকজন যে আমাদের ঘাড় ধরে বের করে দেবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

বেশ অনেকক্ষণ বসে থাকার পর সেতু ফেরত এলো। সেখানে কি কি ঝামেলা হয়াছে জানতে চাওয়ায় সেতু তো অবাক। দেরি হবার কারণ হিসাবে সেতু যা বললো তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম। এতোক্ষণ সে নাকি হোটেল মালিকের সাথে খাওয়া দাওয়া করছিল। আমি তো পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে গেলাম। যে লোকটা সেতুর উপর ওরকম ভয়ঙ্কর রেগে ঘর থেকে বের হয়ে গেল তার সাথে সেতু কি আচরণ করেছে যে লোকটা সেতুকে এতোক্ষণ বসিয়ে বসিয়ে খাওয়ালো! যাকগে আর কথা না বাড়িয়ে বিরাট একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে আমি শুয়ে পড়লাম।

কম খরচে আমার ভারত ভ্রমণ ( সিমলা ) পর্বের মোট খরচ ঃ

১। সকালের খাওয়া=২০রুপি
২। দুপুরের খাওয়া (আমার ভাগের বিল)=২৯০রুপি
৩। রাতের খাওয়া=৬০রুপি
৪। লোকাল বাস ভাড়া=১৪রুপি
৫। লিফট=১০রুপি
৬। আমার ভাগের হোটেল খরচ=২০০রুপি

মোট = ৫৯৪ রুপি।

১০০ টাকায় ৮২ রুপি হিসাবে শপিং বাদে মোট খরচ = ৭২৪ টাকা।

পরের পর্ব

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ expenseindiashimlatravel