কম খরচে আমার ভারত ভ্রমণ ( টয় ট্রেন পর্ব )

আগের পর্ব

কালকা স্টেশনে ট্রেন পৌছালো সকাল আটটার দিকে। ট্রেন থেকে নেমেই আমি দৌড় দিলাম। আমার এই ট্যুরের মূল উদ্দেশ্যটা ছিলো কালকা থেকে সিমলা যাবার টয় ট্রেনটা ঘিরে। এমনিতেই ট্রেনের প্রতি আমার একধরনের দুর্বলতা আছে। আমি চেয়েছিলাম ঘুরে ঘুরে পাহাড়ে ওঠা ছোট ছোট বগির এই খেলনা ট্রেনটি উপভোগ করতে।

ব্রডগেজ ট্রেন থেকে নেমে কিছুটা হেটে ন্যারো গেজের এই স্টেশনটাতে যেতে হয়। কিছুদূর দৌড়ে যাবার পর সন্দেহ হতে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার পিছনে সেতু আর নিয়ন নেই। তারা তখন ট্রেন থেকে নেমে ফটোসেশনে ব্যাস্ত। থাকুক তারা তাদের মতো! এগিয়ে গেলাম আমি সামনের দিকে। ন্যারো গেজের স্টেশনে পৌছে দেখি বেশ কয়েকটি টয় ট্রেন দাড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একটি কালকা মেইল ট্রেনটির সাথে সংযুক্ত। অর্থাৎ কালকা মেল ট্রেনটি পৌছালে এই টয় ট্রেনটি সিমলার উদ্দ্যেশে ছেড়ে যাবে। যেহেতু এই সংযুক্ত টয় ট্রেনটির সবগুলি আসন চেয়ার, এজন্য আমি এই ট্রেনটির টিকিট কাটিনি। কারণ আমি বেঞ্চওয়ালা কোন সিটে যেতে চেয়েছিলাম। যাই হোক, ঘুরে ঘুরে সব দেখতে লাগলাম।

এর আগে আমি দার্জিলিঙের টয় ট্রেনে চড়েছি। দার্জিলিঙের টয় ট্রেন ছিল নীল রঙের। কিন্তু সিমলা যাবার টয় ট্রেনগুলি হলুদ আর লালে মেশানো। ১১০ বছরেরও বেশি পুরানো এই রেলপথে কালকা থেকে সিমলা পর্যন্ত পাহাড়ি ৯৬ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিতে সময় লাগে ৫ঘন্টা। মাত্র ২ ফুট ৬ ইঞ্চি চওড়া রাস্তায় চলাচলকারি ট্রেনগুলিও খুব ছোটছোট। এই ৯৬ কিঃমিঃ যাত্রাকালে টয়ট্রেন ৮৬৪ টি ব্রীজ আর ১০২ টি সুড়ঙ্গ পাড়ি দেয়। ব্রীজগুলি খুব সুন্দর সুন্দর ঢেউ খেলানো খিলান দিয়ে তৈরি। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে এর যাত্রাপথ। তার বর্ণনা একটু পরে দিচ্ছি।

স্টেশনে দাঁড়ানো অবস্থায় ‘রেল মটর’ টয় ট্রেনটি দেখলাম। ট্রাকের মতো দেখতে একবগির ছোট্ট একটি ট্রেন এটি। এই ট্রেনে মোট সিটের সংখ্যা ১৪টি। খুব ইচ্ছা ছিল এই টয় ট্রেনটিতে চড়ার। কিন্তু এটার টিকিট নাকি অনেকদিন আগে কাটতে হয়। ‘রেল মটর’ ট্রেনে চেপেই নাকি ব্রিটিশ আমলে বড়লাট আর ছোটলাট ভারতের তৎকালীন গ্রীষ্মকালিন রাজধানী সিমলাতে যাতায়াত করতো। ইন্দিরা গান্ধীও নাকি বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধানদের নিয়ে এই ট্রেনে চড়েছে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন। চারপাশের দৃশ্য উপভোগ করার জন্য ছোট্ট এই ট্রেনটিতে বড়বড় জানালা রয়েছে। এমনকি এই ট্রেনের ছাদটিও কাঁচের তৈরি।

আমি ঘুরে ঘুরে ট্রেনগুলি দেখছি এমন সময় সেতু আর নিয়ন হাপাতে হাপাতে সেখানে এলো। তারা খোঁজ খবর নিয়ে এসেছে যে কোথা থেকে টয়ট্রেনের টিকিট কাটতে হবে। আর টিকিট কাটার জন্য আমকেই যেতে হবে। কারন সেখানে কালকা মেইলের যাত্রীদের টিকিট চেক হচ্ছে। সেতু আর নিয়ন যেহেতু দিল্লী থেকে কালকা পর্যন্ত বিনা টিকিটের যাত্রী সেহেতু ওখানে গেলে তাদের খবর আছে। অগত্যা আমিই গেলাম টিকিট কাটতে। অসংরক্ষিত বগির টিকিট জনপ্রতি ৫০ রুপি করে।

টিকিট কেটে নির্দিষ্ট বগি খুঁজে বের করে দেখি বগি পুরো ফুল হয়ে আছে। নিয়ন তারই মধ্যে একটা বসার জায়গা খুঁজে পেল। আমি কোনরকমে আমার ব্যাগটা রাখতে পারলাম। তারপর আমি আর সেতু নামলাম আশপাশ ঘুরে দেখার জন্য। সেতু নাকি মোবাইলে টাকা রিচার্জ করবে। ট্রেন থেকে নেমে সে সোজা হাঁটা শুরু করলো। আমি যতোই বলছি যে এদিক দিয়ে বের হওয়া যায়না, সে আমার কথা না শুনে সেইদিকে গিয়ে ট্রেনের গুদাম ঘরে উপস্থিত হলো। পায়ে কালি মেখে সেখান থেকে বের হবার পর তার আবার প্রসাব পেয়ে গেল।স্টেশনের টয়লেটে যাবার সময় তার আবার একজনের সাথে আলাপ হয়ে গেল। টয়লেটে না গিয়ে সে ততোক্ষণে লোকটির সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে।

লোকটা একজন ভারতীয় বাঙালি আর্মি। ছুটিতে বাড়িতে যাবার জন্য কালকা স্টেশনে এসেছে ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে। সেতুর সাথে তার বিরাট খাতির হয়ে গেল। আমি দাড়িয়ে দাড়িয়ে সব দেখছি। আর্মি লোকটা আমাদের বোঝাচ্ছে যে কেন টয় ট্রেনে সিমলা যাওয়া উচিৎ নয়। বাসে করে গেলে ভাড়া একটু বেশি পড়বে কিন্তু খুব দ্রুত পৌছে যাওয়া যাবে। খামাখা আস্তে আস্তে ট্রেনে যেতে হবে কেন? ট্রেনে যেতে কমপক্ষে ৬ঘন্টা লাগবে। আর বাসে বা জীপ গাড়িতে গেলে খুব আরামে যাওয়া যাবে, আরো ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার লাদাখে যাওয়ার খুব ইচ্ছা, কিভাবে সেখানে যাওয়া যায় জিগ্যেস করাতে সে বললো প্লেন ছাড়া নাকি সেখানে যাবার কোন উপায় নেই। তারপর সে আমাকে বোঝাতে লাগলো কিভাবে প্লেনে যাওয়া যায়। তারপর মানালি কিভাবে যাওয়া যায় তাই বোঝাতে লাগলো। সে যদিও মানালি তো দূরে থাক সে সিমলাতেও কখনো যায়নি তবুও এই এলাকাগুলো সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান। কারণ সে একজন আর্মি।

সেতু দেখি আর্মি ব্যাটার পরামর্শে প্রভাবিত হয়ে আমার উপর ঝাড়ি দেয়া শুরু করলো। কেন আমরা বাসে না গিয়ে টয় ট্রেনে যাচ্ছি? তো আমি তখন তাকে বোঝালাম যে, আসলেই বাসে যাওয়া বেশি লাভজনক।সেতুরা যেন টয় ট্রেনের টিকিট ফেরত দিয়ে বাসে করে আগে আগে সিমলা চলে যায়। আমি টয়ট্রেনে করেই ধীরে ধীরেই সিমলা যাবো। কারন সেটাতে চড়ার জন্যই আমি কলকাতা থেকে কালকা পর্যন্ত ৩৮ ঘন্টা জার্নি করে এসেছি। আমাদের দুজনের এসব কথার মধ্যেই আর্মি ব্যাটা শুনলো যে আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তার চেহারা একেবারে বদলে গেল। সে ভেবেছিল আমরা বুঝি কলকাতা থেকে এসেছি। কিন্তু বাংলাদেশী শুনে কেমন যেন রুক্ষ আর কঠোরভাবে দুয়েকটি কথা বলে মালপত্র উঠিয়ে আমাদের পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে চলে গেল, যেন আমরা খুব অচ্ছুৎ কোন প্রাণী। শালা বাঞ্চোত ইন্ডিয়ান আর্মি! আর্মি ব্যাটার হঠাৎ এরুপ আচরণে সেতু কিছুটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল। সে তখন আমার পিছু পিছু টয়ট্রেনে গিয়ে উঠলো। তারপর নিয়নের সিটে গিয়ে একটু জায়গা বের করে গাদাগাদি করে বসলো। আর আমি গিয়ে দাড়ালাম ট্রেনের দরজায়।

নটার দিকে ট্রেনটা ছেড়ে দিলো। আর তক্ষুণি ঘন সবুজ জঙ্গলে হারিয়ে গেল এটি। একে বেঁকে পাহাড়ি পথ দিয়ে ঘুরে ঘুরে ট্রেনটি উঠছে। দুপাশের দৃশ্য এতো মনোরম যে বলার মতো না। প্রথম দিকে দুধারে কিছু ছোট ছোট পাহাড়ি বাড়ি ঘর ছিল। কিন্তু কিছুদূর পর সেগুলো উধাও হয়ে গেল। কখনো একপাশে উচু পাহাড় আর অন্যপাশে গভীর খাদ। আবার কখনো ছোট ছোট ঝরণা। আবার কখনো গিরিখাদের মধ্য দিয়ে ট্রেনটি খুব আস্তে ছুটে চলেছে। কিছুক্ষণ পর ট্রেনটি এতো উপরে উঠে এলো যে নিচের বাড়িঘর আর গাড়িগুলোকে খেলনার মতো দেখাচ্ছে। আমি আবার ট্রেনের দরজার পাদানিতে বসতে গেলাম। ট্রেনের গার্ড বিকট শব্দে হুইসেল বাজিয়ে সকল যাত্রীকে সচকিত করে আমাকে সেখান থেকে উঠিয়ে দিলো। যাই হোক, ট্রেন রাস্তাটি সাপের মতো পেচিয়ে পেচিয়ে উঠছে। ফেলে আসা পথটিকে পায়ের নিচে দেখতে পাচ্ছি। আমার এখনো পর্যন্ত চড়া সবচেয়ে আকর্ষণীয় রেলপথ এটি। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে দার্জিলিঙের টয় ট্রেন পথটি এর কাছে কিছুই না। আমি পুরোপুরি মুগ্ধ।

কিছুক্ষণ পর থেকে সুড়ঙ্গগুলি শুরু হলো। ট্রেন যখন অন্ধকার সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে তখন ট্রেনের মধ্যে লাইট জ্বলে ওঠে। আসলে লাইট সবসময়ই জ্বলে, কিন্তু অন্ধকার সুড়ঙ্গে না ঢুকলে তার অস্তিত্ব প্রকাশ পায় না। তবে যখনই ট্রেন কোন সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে তখন সব যাত্রী আনন্দে একসাথে চিৎকার শুরু করে দেয়। তাদের এই আনন্দধ্বনি দেড় থেকে দু মিনিট ধরে চলে। কারণ একেকটি সুড়ঙ্গ পার হতে সেরকম সময়ই লাগে।

দার্জিলিং এর টয় ট্রেনটি ১০ কিঃমিঃ বেগে চললেও সিমলার ট্রেনটির গতি ঘন্টায় প্রায় ২০ কিঃমিঃ। মাঝে মাঝে খুব সুন্দর ছোট ছোট স্টেশন। সেসব স্টেশনে মুখরোচক খাবার বিক্রি হচ্ছে। আমি তাই কিনে খাওয়া শুরু করলাম। একেকটি স্টেশনে ট্রেন থামে আর আমি টুকটাক এটা-ওটা কিনে খায়। প্রতিটি স্টেশনে খাবার পানির ব্যাবস্থাও আছে। কিন্তু সেগুলো হাতে ছোয়া যাচ্ছে না,কারণ সেগুলো সব বরফ গলা জল।

ট্রেনটি ছুটে চলার ফাকেই জংলি গাছপালা ছাড়িয়ে পাইন বন শুরু হলো। রাস্তার দু’ধারের ঝোপঝাড়ে রঙ-বেরঙের ফুল ফুটে আছে। আমার তো মনে হচ্ছে একটি পুষ্পক রথ আমাকে নিয়ে স্বর্গের পানে ধেয়ে চলেছে।

দুপুর একটার দিকে ট্রেন একটা পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। কিছুক্ষণ পর জানতে পারলাম ইঞ্জিনের কি যেন সমস্যা হয়েছে। ঠিক করতে সময় লাগবে। অনেকক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে আছি এজন্য সেতু আর নিয়নের কাছে গেলাম বসার জন্য। গিয়ে দেখি তারা দুজনে ততোক্ষণে জমিয়ে ফেলেছে। আশেপাশের ছেলে ছোকড়া মেয়ে বুড়ো সবাই তদের দুজনের বিশেষ করে সেতুর গুনমুগ্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছে। সে দেখি হকারের কাছ থেকে এটা ওটা কিনে সবাইকে খাওয়াচ্ছে, আর মাঝে মাঝে উল্টোপাল্টা হিন্দিতে কি সব বলছে! পুরো বগির লোক হেঁসেই অস্থির।

ট্রেন অনেকক্ষণ থেমে আছে দেখে নিচে নামলাম। আর নামার পর মনে হলো ভাগ্যিস ইঞ্জিন নষ্ট হয়েছিল। রেলপথ ধরে সামনে কিছুদূর হেঁটে গেলাম। পুরো যাত্রাপথের সব জায়গায় দেখেছি, কিছুদূর পরপর কিছু লোক ট্রেন রাস্তা মেরামত করছে। আসলে এই দুর্গম রেলপথটি সবসময় সংস্কারের উপর রাখতে হয়। এখানে একজন রেলপথ মেরামতকারিকে পেলাম।

তাকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে এমন এক জায়গায় গিয়ে দাড়ালাম যেখান থেকে অবারিত দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একপাশে উঁচু পাহাড় আর একপাশে গভীর খাদ। দুপাশেই পাইনের ঘন বন। দূরের উঁচু পাহাড়গুলোকে সাদা মেঘ ঢেকে দিচ্ছে আবার পরক্ষণেই সেগুলিকে উধাও করে দিয়ে সূর্য ঝমকে উঠছে।

ঘন্টা দেড়েক পর আবার ট্রেনে উঠে বসলাম। দেখি আসর ততোক্ষণে জমজমাট। পুরো বগির সব যাত্রী সেতুর মজাদার কথা শোনার জন্য উৎসুক হয়ে আছে। সেতু ভাঙা ভাঙা হিন্দীতে কিসব উল্টোপাল্টা বকছে আর পুরো ট্রেন কেঁপে কেঁপে উঠছে সবার হাঁসির ঠেলায়। ব্যাপারটা না দেখলে ঠিক কল্পনা করা যায় না। পাহাড়ি পথে একটা ট্রেন নষ্ট হয়ে গেছে যেখানে এক বাংলাদেশী পাগলের প্যাচালে পুরো ইন্ডিয়ান যাত্রী মত্তো হয়ে হো হো করছে, যাদের হো হোর ঠেলায় ছোট্ট এই ট্রেনটি যেকোন সময় কাত হয়ে পাহাড় থেকে খাদে পড়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে একটি মেয়ে দেখি সেতুর বিশেষ অনুরক্ত হয়ে গেছে। চেহারার মিল থাকায় আমি তাকে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সম্বোধন করায় সে আরো খুশি হয়ে উঠেছিল। মেয়েটি তার মা, ছোট ভাই রোহিত আর কাজিন পঙ্কজদার সাথে তারা দেবি স্টেশনে যাচ্ছে। সেখানেই তাদের বাড়ি। তারা সবাই সেতুর গুনমুদ্ধ ফ্যান। অন্য একজন যুবক দেখি সেতুকে আওরংজেব আওরংজেব বলে সম্বোধন করছে। আমি ভাবলাম আরে বাবা! এতো ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে যে নাম নিয়েও ঠাট্টা হচ্ছে। পরে শুনি সেতুর ভালো নাম হচ্ছে আওরঙ্গজেব। চুপি চুপি একটা গোপন কথা প্রকাশ করে দিই, এই যুবক কিন্তু পরে(ফেসবুকে) সুদর্শন নিয়নের বিশেষ ভক্ত হিসেবে আত্নপ্রকাশ করেছে।

সেতুর এসব হাস্যকর কর্মকাণ্ডে আনন্দিত হয়ে তার সদ্য পরিচিত এক আন্টি আমাদের খাবার খেতে দিলো। পাপড় চাটনি আরো কি কি যেন। এরপর পুরো বগির সব যাত্রীই তাদের দুপুরের খাবার থেকে আমাদের ভাগ দেয়া শুরু করলো। সব ভেজ খাবার। আমরা খেয়ে শেষ করি তারা আবার দেয়, আবার শেষ করি আবার দেয়। তৃপ্তি সহকারে এতো খাবার খাওয়া হলো যে বলার নয়। আমি আমার বেশ কবার ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, আমাদের দেশে আমরা যেমন সহযাত্রীর সাথে বকবক করি এদেশের লোক তেমন করে না। এদেশের লোকজন সাধারণত সহযাত্রীর সাথে পরিচিত হতে অনাগ্রহী বোধ করে। তবে সেতু এমন একটা জিনিস যে সবাইকে আপন করে নিতে বাধ্য করেছে। এমনকি ভারতীয়রা তাদের দুপুরের খাবার থেকে ভাগ পর্যন্ত দিয়েছে। নাহলে আজ দুপুরে আমাদের না খেয়ে থাকতে হতো। আরো একটা কথা চুপি চুপি বলে রাখি,আমাদের প্রিয়াঙ্কা গান্ধী সেতুকে দেশে ফেরত আসার পর এতোটা বিরক্ত করে যে সেতু তাকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য অস্থির হয়ে আছে। যেহেতু তারা আমাদের ভরপেট খাওয়ালো, আমাদেরও উচিৎ তাদেরকে কিছু খাওয়ানো। দেশ থেকে আসার সময়, খিদে লাগলে আমি যেন টুকটাক খেতে পারি এজন্য আমার বাবা আমাকে গাদাখানেক গজা কিনে দিয়েছিল। বগির সবাইকে সেই গজা বিলালাম। কেউ কেউ সেই গজা এতো পছন্দ করলো যে আরো কয়েকবার করে চেয়ে নিলো।

দুপুর তিনটার কিছু পরে পিছন থেকে একটা ইঞ্জিন এসে ট্রেনটাকে টেনে পিছনের স্টেশনে নিয়ে গেল। সেখানে নষ্ট ইঞ্জিনটাকে সরিয়ে ভালো ইঞ্জিনটা জোড়া লাগিয়ে আবার সিমলার দিকে চলা শুরু হলো।চারপাশের দৃশ্য সেইরকম মোহনীয়। মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্টেশনে থামছে। তারপর আবার চলছে। ব্রীজ আর সুড়ঙ্গ পার হচ্ছে সমানতালে। আর সুড়ঙ্গের ভিতরে ট্রেন ধুকলে সবাই আনন্দে সমানে চিৎকার করছে।

বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে ট্রেন হঠাৎ করে আরো উপরে প্রায় খাড়াভাবে ওঠা শুরু করলো। চারপাশ থেকে ছুটে আসা মেঘ ঘিরে ধরা শুরু করেছে। ঠান্ডার পরিমাণ হুট করে বেড়ে গেল। কাল অতো গরম থেকে আজকের এই মনোরম ঠান্ডায় এসে প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেতু আর নিয়নের অবস্থা মোটামুটি কাইত! কারণ কাল সন্ধ্যায় তারা যে পাতলা হাফপ্যান্ট পরেছিল এখনো তাদের পরনে সেই জিনিসই রয়েছে।

হঠাৎ দূর থেকে সিমলা শহরটা দেখতে পেলাম। মেঘাচ্ছন্ন একটা আবহাওয়ায় শহরটিতে শেষ বিকেলের আলো পড়ছে। ব্যাপারটি একই সঙ্গে এতো সুন্দর আর অপার্থিব যে নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না।

কালকা থেকে সিমলা টয় ট্রেন পর্বে মোট খরচঃ

১। কালকা থেকে সিমলা টয় ট্রেন ভাড়া =৫০ রুপি
২। সকালের টুকটাক খাওয়া=৩০ রুপি
৩। দুপুরে ট্রেনের সহযাত্রীরা খাওয়াইছে
৪। রাতের খাওয়া=৮০ রুপি
৫। আমার ভাগের হোটেল ভাড়া=২০০ রুপি

মোট = ৩৬০ রুপি

১০০টাকায় ৮২ রুপি হিসাবে এই পর্বের মোট খরচ = ৪৩৯ টাকা।

পরের পর্ব

Leave a Comment
Share