গোচেলা/গোয়েচালা ট্রেক ২০২২

বিগত দুবছর অতিমারীর জন্য কোনো বড় Trek এ যাওয়া হয়ে ওঠেনি তাই দুমাস আগে যখন জানতে পেলাম এপ্রিলে গোচেলা ট্রেক (Goechala Trek) হচ্ছে আর ঘরে থাকতে পারলাম না বিশেষ করে এটা ভেবে যে এখনতো রডোডেনড্রন ফুলের সময় আর যদি ভাগ্য ভালো থাকে তাহলে একটি দুটি লাল পাণ্ডাও দেখা যেতে পারে। তাই ব্যাগ গুছিয়ে রাতের উত্তর বঙ্গের ট্রেনে চেপে পড়লাম, ট্রেনে দেখা হয়ে গেলো বাকি টিমের সঙ্গে। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখলাম ট্রেনটা ছুটে চলেছে চা বাগান আর আনারসের বাগানের মধ্যে দিয়ে। নতুন জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছে সকালের খাবার সেরে চেপে পড়লাম গাড়িতে, গন্তব্য ইয়াকসাম। ইয়াকসাম হল পাহাড়ের কোলে একটি ছোট্ট শহর, শুনলাম আগে নাকি এটি সিকিমের রাজধানী ছিল। ভারী সুন্দর জায়গা চারিদিকে ফুল গাছ আর তার উপর উড়ে বেড়াচ্ছে নানা পাহাড়ি অজানা পাখির দল।

প্রথম দিন

সকালে উঠে ব্যাগ গুছিয়ে খাবার খেয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম আমাদের প্রথম ক্যাম্প সাচেনের উদ্দেশ্য। পাহাড়ি রাস্তা উচু নিচু আর অসংখ্য ছোটো জলাধার, অজানা ফুল, গুল্ম লতা, প্রজাপতি দেখতে দেখতে চলতে লাগলাম। রাস্তায় প্রেকচু নদীর উপর তিনটি সেতু পেরিয়ে পৌঁছলাম সাচেনে। সাচেনে এক অদ্ভুত সুন্দর জায়গা চারিদিকে বড় বড় গাছের ছায়া ঘেরা, ছোট্টো এক সমতল জায়গায় আমাদের তাঁবু কাটানো হল রাত কাটানোর জন্য। বিকেল থেকে ঝড় ঝড় করে বৃষ্টি পড়া শুরু হল সন্ধ্যা অবধি চলল। সারাক্ষণ তাস খেলা আর গল্পতে সময়ে কাটতে লাগলো আর সময়ে সময়ে চা আসতে লাগলো। আমরা এর মাঝে হল এক সমস্যা, জুতোর সোলটি আলাদা হয়ে যাচ্ছে তাই পরের দিন কিটো পরে চালাতে হল।

দ্বিতীয় দিন

সকাল উঠে আকাশ পরিষ্কার তাই চটজলদি বেরিয়ে পড়লাম সোখার উদ্দেশ্যে। পরনে কিটো তাই চলতে একটু কষ্ট ও চিন্তাও হচ্ছিলো তাই কিংশুক দার কাছ থেকে ওয়াকিং স্টিক টা নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। চতুর্থ সেতু পেরিয়ে পৌঁছলাম বাখিমএ রাস্তা একটু একটু করে রডোডেনড্রন ও ম্যাগনোলিয়া ফুলের দেখা পেতে শুরু হল। এখানে বলে রাখি যে চতুর্থ সেতুটি হল সবথেকে সুন্দরতম। রাস্তায় চারিদিকে বিভিন্ন রঙের রডোডেনড্রন ফুলের পাপড়ি পরে থাকতে দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো কোনো স্বপ্নের রাস্তায় হাঁটছি, হাঁটার কষ্টটা বুঝতেই পারছিলাম না। সোখাতে পৌঁছতেই দেখতে পেলাম বরফে ঢাকা পাহাড়ের চুড়া আর গাছের ভরিয়ে ফুটে আছে লাল গোলাপি সাদা রডোডেনড্রন ফুল। পরের দিন অনেকটা রাস্তা তাই তারা তারি শুয়ে পড়লাম।

Rhododendron petals on the way to Dzongri

তৃতীয় দিন

সকালে যাত্রা শুরু হল সোখা ঝিলের পাশ দিয়ে রডোডেনড্রন ফুলে ভরা ঘন জঙ্গল দিয়ে। আজকের ট্রেকটা হয়তো করতেই পাড়তাম না যদি না রিত ভাই একটা এক্সট্রা বুট জুতো আনত। ভাইয়ের অতিরিক্ত ওয়াকিং স্টিক টাও আমার খুব কাজে লেগে গেল। আজকের গন্তব্যে জোংরি। উচ্চতা বাড়বে 3330 ফুট। উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের গাছ পালা তেও ভালো পরিবর্তন নজর এলো, এখানের গাছ আর অত সবুজ নয় আর গাছে কাটা ভর্তি, এখানের রডোডেনড্রন গাছ গুলো অপেক্ষাকৃত ছোটো। বিকেল গন্তব্যে পৌঁছতেই বুঝলাম একটু মাথা ব্যথা করছে অর্থাৎ উচ্চতার সমস্যায় পড়েছি (altitude sikness)। এখানে খুব হাওয়া চলার জন্য আমরা ঘরেই থাকব বলে রুম বুক করে ছিলাম। পরের দিন জোংরি টপ আমদের এই ট্রেকের প্রথম ভিউ পয়েন্ট।

চতুর্থ দিন

ভোর পাচ টাই উঠে বাইরে আসতেই গায়ে ঠান্ডা হাওয়া লাগতেই কেঁপে উঠলো শরীর টা তখন 0৹ হবে তাপমাত্রা কিন্তু হাওয়া জন্য সেটা-5৹ মনে হচ্ছিলো। তখনও পশ্চিম আকাশে চাঁদ বিদ্যমান, সকালে একটা হালকা ব্যাগে জলের বোতল নিয়ে হাতে টর্চ বাতি নিয়ে চলতে শুরু করলাম সবাই মিলে কারণ সূর্যদয়ের আগে জোংরি টপ পৌঁছাতে হবে। সকালে পান্ডিম, কাঞ্চনজঙ্ঘা পাহাড়ের উপর সূর্যের প্রথম কিরণের সোনালী ছটা দেখে মন ভরে গেল।

From Phedang

পৃথিবীর এই দুর্লভ দুর্গম অসাধারণ দৃশ্য দেখে আপন অজান্তেই জোর হাত করে প্রণাম করে নিচের দিকে হাঁটতে লাগলাম। নিচে এসে ব্যাগ নিয়ে আবার রওনা দিলাম আমাদের আজকের গন্তব্যে থ্যাংশিং। প্রথমটা সমতল রাস্তা হলেও তারপর শুরু হল নামা, প্রায় 900 ফুট নেমে পৌঁছলাম প্রেক চু নদীর পাড়ে কোকচুরাং নামের একটি জায়গায়। ভারী সুন্দর জায়গা যেনো একটা সুন্দর চিত্রের মধ্যে রয়েছি আমরা, কাঠের বাড়ি পাশে সুন্দর কল কল করে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী প্রেক। এরপর শুরু হল আবার 900 ফুট ওঠা এবার আবহাওয়া পরিবর্তনও হল খুবই, যেমন হটাৎ করে মেঘ ঢুকে গেলো আরো চললো শিলা বৃষ্টি। যদিও আমরা আর আধ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছলাম থ্যানশিং। এখানে যথারীতি ঘরেই থাকতে হল আমাদের।

পঞ্চম দিন

সারা সন্ধ্যা খারাপ আবহাওয়া থাকার পর সকাল হতেই ঝকঝকে রোদস্নাত দিন শুরু হল আজকের গন্তব্যে লামুনে। রাস্তা খুবই সুন্দর যেনো এক শিল্পীর আঁকা চিত্র, দুদিকে খাড়া তুষার ঢাকা পাহাড় মাঝখানে রাস্তা। খুবই কম দূরত্ব কিন্তু রাস্তা দুর্গম করে তুললো হঠাৎ করে হয়ে যাওয়া বাজে আবহাওয়া। প্রায় পুরো রাস্তাই ঝড়, শিলা বৃষ্টি আর তুষারপাত যদিও দের ঘন্টার মধ্যে পৌঁছলাম গন্তব্যে। তারাতারি পৌঁছলাম আর তারাতারি শুলাম কারণ কাল যেতে হবে আমাদের এই ট্রেকের সর্বোচ্চ পয়েন্টে গোছালা ভিউ পয়েন্টে 1 এবং রাস্তাই পড়বে সমিতি লেক যেখান থেকে পাহাড়ি নদী প্রেক চুর উৎস।

Dzongri Top

ষষ্ঠ দিন

যদিও স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেড়াতে মন চাইছিল না, তাও মনের জোরে বেরিয়ে এসেই থমকে যাই বাইরেটা দেখে, সারা সন্ধ্যা তুষারপাত হবার পর চারিদিকে 6 ইঞ্চির পুরু বরফের চাদরে ঢেকে দিয়েছে আর তার উপর চাদের আলো যেনো এক মায়াবী রূপ দিয়েছে এই জায়গাটাকে। রাত তিন টায় আমরা চাঁদের আলোয় ভিজে আজকের ট্রেকের জন্য যাত্রা শুরু করি হালকা একটা ব্যাগে জলের বোতল আর রেন জ্যাকেট নিয়ে। টর্চের আলোয় কাঁপতে কাঁপতে 4:30 তে পৌঁছলাম সমিতি লেকে। তখন পবিত্র লেকে শুধু আকাশের তারা আর চাঁদের প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছে। তার পর আরো দের ঘন্টা যাত্রার পর জাস্ট সূর্যদয় হবার মুহূর্তে পৌঁছাই গোছালা ভিউ পয়েন্টে 1 এ।

Just before reaching Goechala View Point 1

কি অসাধারণ কি অপূর্ব শব্দে বোঝানো যায়না যাকে, দমবন্ধ রুদ্ধ শ্বাস হয়ে দেখলাম সেই সূর্যদয়ের মুহূর্তটাকে। চারিদিকে শুধু সাদা বরফের আর তার উপর মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে পৃথিবীর উচ্চতম পাহাড় গুলি কাঞ্চনজঙ্ঘা, পান্ডিম, কাব্রু,কাব্রু ডোম, কাব্রু সাউথ আরো কত কি। এখানে আমরা একটি হিমবাহ ও তার ফলে সৃষ্ট জেমথাং লেকও দেখলাম এটা উপরি পাওনা। এবার ফিরে এলাম সমিতি লেকে, এখন সমিতি লেক এক অন্যরকম রুপে সেজে উঠেছে, এখন এখানের স্বচ্ছ সবুজ জলে দেখা যাচ্ছে পাশের তুষার আবৃত্ত পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি। সবাই এখানে গ্রুপ ফটো তুলে রওনা দিলাম লামুনেতে। সকালের খাবার সেরে নেমে এলাম কোকচুরাংয়ের ওই কাঠের বাড়িতে। আমাদের সাথে আরো কয়েকটি বাঙালি গ্রুপ ছিল ওই বাড়িতে তাই কিছু লোকজনকে বাইরে তবু খাটিয়ে থাকতে হল।

সপ্তম দিন

সকালে উঠে কোকচুরাংয়ের অসাধারণ সৌন্দর্য দেখে নেমে এলাম সোখায়। এখানে এবার শেষ বারের মতো তবুতে থাকা হল, গোছালা ট্রেক শেষ করার জন্য মিষ্টি মুখও সারা হল এখানেই, সারা রাত ধরে চললো গল্প আর তাস খেলা।

অষ্টম দিন

সকালে উঠে শেষ বারের মতো বরফের চূড়া গুলোকে বিদায় জানিয়ে নেমে এলাম ইয়াকসামে। আজ রাতেও খুব হৈ হুল্লোর হল, এই নিয়েই বেশ কেটে গেলো রাতটা।

পরের দিন সকালে উঠে ফেরার পালা। যথারীতি গাড়ি এসে গেলো হোটেলের সামনে, সুন্দর সব স্মৃতি গুলো মনে জড়িয়ে ধরে একটু ভারাক্রান্ত মনে চেপে পড়লাম গাড়িতে। জলপাইগুড়ির গরমে ঘুম ভাঙল আর আবার একবার পাহাড়ে যাবার অপেক্ষায় দিন গুনতে শুরু করলাম। ধন্যবাদ দলের সকল সদস্যকে খুব ভালো দলে ছিল তাই এই ট্রেকটা এত সুন্দর হল।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ goechalaTrekking