ভুটান ভ্রমণ – হিমালয়ের আনন্দলোক

০৭ এপ্রিল, ২০১৬ (থিম্পু)

“And when you come home, home may still be the same, & yes, you may go back to the same old job, but something in your mind will have changed. And trust me, that changes everything”

দ্রুক এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফটটি তখন ভুটান আকাশ সীমার কাছাকাছি। হঠাৎ যাত্রীদের মাঝে একটু চাঞ্চল্য, সবাই যেদিকে তাকিয়ে আছে সেদিকে চোখ মেলে দেখি প্লেনের জানালা দিয়ে তুষারে ঢাকা বিশাল হিমালয় পর্বতশ্রেনী! নয়নাভিরাম এই সৌন্দর্য দিয়ে শুরু হলো ভুটান যাত্রা।

ভুটান একটি আশ্চর্য দেশ! এই দেশ সম্পর্কে অনেক ভালো ভালো লেখা পড়ে ভুটান গিয়েছিলাম। গিয়ে মনে হলো, দেশটি তার চেয়েও বেশী কিছু, যা কোন লেখা, ভাষা অথবা ছবিতে বোঝানো যায়না। সেটা শুধুমাত্র উপলব্ধির ব্যাপার।

দেশটিতে দেখার কি আছে? বিশাল হিমালয় পর্বতশ্রেণী আছে, পাহাড়ী খরস্রোতা নদী আছে, কয়েক শতাব্দী আগের তৈরি কাঠের, আয়রনের ব্রিজ আছে, আছে প্রাচীন সব টেম্পল, সেখানে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য, সমাহিত পরিবেশ। তারও বেশী কিছু আছে। এই ২০১৬ সালেও পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে একটি দেশ আছে যারা জাগতিক উন্নতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে-গ্লোবালাইজেশন আর টেকনোলজির যাঁতাকলে নিজেদেরকে পিষে ফেলেনি। এরা জিডিপির বদলে জিএনএইচ (গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) কে নিজেদের উন্নয়নের মানদন্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এবং এটি শুধু আইডিয়াই নয়, পুরো ভুটান একে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে! এদের কন্সটিট্যুশনে দেশের ৬০% বনভূমি রাখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং দেশটি বর্তমানে তার ৭২% বনভূমি হিসেবে রক্ষা করছে। এদেশের রাস্তার ধারে, মিউজিয়ামে, বোটানিক্যাল গার্ডেনে, চিড়িয়াখানায় পরিবেশ এবং ওয়াল্ডলাইফ রক্ষার জন্য আকুল আর্তি চোখে পড়ে। এরা সত্যিই ‘living in harmony with nature’ এই আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করে। এখানে মানুষ বিনয়ী, বিশ্বাসী, সহানুভূতিশীল এবং নিঃস্বার্থভাবে অন্যকে সাহায্য করে। একটা পুরো জাতি কিভাবে এত ভালো হয় সেটা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয়না।

এইবার আমাদের ভ্রমণের একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেই। আমাদের ট্যুরটা ছিল পাঁচ দিনের। প্রথম দিন আমরা ঢাকা থেকে পারো পৌঁছলাম সকাল সাড়ে ন’টায়। পারো থেকে সরাসরি চলে গেলাম থিম্পু। থিম্পু গিয়ে হোটেল Amodhara তে চেক ইন করলাম। ততক্ষণে আমাদের গাইড আমাদের পাসপোর্টগুলো নিয়ে গেলো আমাদের পরদিনের গন্তব্য পুনাখা (Punakha) তে প্রবেশ করার পারমিট আনতে। সেদিন আমরা মোট তিনটি গন্তব্যে গেলামঃ

Changangkha Lhakhang:

‘Lhakhang’ শব্দটি তিব্বত থেকে এসেছে, এর অর্থ টেম্পল। ১২ শতকে তিব্বত থেকে একজন লামা এসে এই টেম্পল প্রতিষ্ঠা করেন। স্থানীয় লোকজন নবজাতক শিশুদের মঙ্গলের জন্য এখানে আসে। এমনিতেও প্রচুর ভক্ত বুদ্ধিস্ট চোখে পড়ে। ভেতরে বুদ্ধমূর্তি এবং ট্র্যাডিশনাল চিত্রাঙ্কন।

Changangkha Lhakhang

Motithang Takin Preserve:

এটি একটি ছোটখাট চিড়িয়াখানা, প্রধানত ভুটানের জাতীয় প্রাণী Takin দের প্রিজার্ভ এরিয়া। সাথে দু’একটি হরিণ জাতীয় প্রাণীও চোখে পড়লো। Takin প্রাণীটি অদ্ভুত। এরা ঘন্টার পর ঘন্টা একভাবে স্থির থাকতে পারে। দূর থেকে মনে হয় কোন স্ট্যাচু বুঝি! এদেরকে বলা হয় এক ধরণের goat-antelope, সাধারণত হিমালয়ের পুর্বাঞ্চলে দেখা যায়।

তাকিন

Tashichho Dzong:

১২ শতাব্দীতে নির্মিত এই ভবনটি থিম্পুর Wang Chu নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত। একই সঙ্গে একটি টেম্পল এবং ভুটানের সিভিল গভর্নমেন্টের চীফ Druk Desi বা ধর্ম রাজার অফিস। ভবনটির গঠনশৈলী অপূর্ব!

Tashichho Dzong

০৮ এপ্রিল, ২০১৬ (পুনাখা)

“You cannot travel the path until you have become the path itself.”- Buddha

দ্বিতীয় দিন আমরা থিম্পু থেকে পুনাখা গেলাম। পুনাখার টেম্পারেচার কিছুটা বেশী, আমাদের কাছে বেশ আরামদায়ক লাগলো। সেখানে যেই হোটেলে আমরা ছিলাম তার নাম Hotel Lobesa. কাঠের তৈরী এই হোটেলটির রুমগুলো বিশাল এবং রুমের ব্যালকনি থেকে ভিউ অসাধারণ। হোটেলের কর্মচারীরা অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। এক পর্যায়ে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম, কোন হোটেলে থাকতে এসেছি নাকি নানাবাড়ি বেড়াতে এসেছি! এতটাই আন্তরিকতা নিয়ে তারা আমাদেরকে খাবার পরিবেশন করতে লাগলো। বলে রাখি, ভুটানের মেয়েরা অত্যন্ত সুন্দরী। এই সুন্দর কমবয়সী মেয়েগুলো আমাদের জন্য এত খাটাখাটনি করছে ভেবে একটু অস্বস্তিই লাগলো। সকালের নাস্তায় তারা আমাদেরকে একটা বাটিতে করে নিজেদের তৈরী একটা জ্যাম খেতে দিলো, অমৃতের মতো স্বাদ। সেখানে দুপুরে আমরা লাঞ্চ করেছিলাম যে হোটেলে তার নামও চমকপ্রদ-’Yak herder’s camp’.

The junction of Pho Chu (R) and Mo Chu (L) rivers

Dochu-la pass:

এটি পর্বত শ্রেণীর মধ্য দিয়ে যাওয়া একটি ‘পাস’, থিম্পু থেকে পুনাখা যাওয়ার পথে ৩,০৮৮ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। চারপাশে সুউচ্চ পর্বতমালা আর ঝকঝকে আকাশের নীচে এখানে আছে Druk wangyal chorten নামের একটি টেম্পল এবং ১০৮ টি memorial chortens বা স্তুপা। ২০০৩ সালে তখনকার রাণী মাতা Dorji Wangmo এই স্থাপনাগুলো প্রতিষ্ঠা করেন।

Dochu-la pass

Punakha Dzong:

Pho Chu এবং Mo Chu এই দুই নদীর ধারে আবস্থিত এই টেম্পলটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং দ্বিতীয় প্রাচীন টেম্পল। ষোড়শ শতাব্দীতে নির্মিত এই টেম্পল তিব্বতের বৌদ্ধ আদর্শের দীক্ষা দেয়া ছাড়াও পুনাখার প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

Punakha Dzong

Chimi Lhakhang:

পাহাড়ের উপর নির্মিত এই টেম্পলটিতে যেতে একটা ছোট খাট হাইকিং দরকার হয়। ১৪৯৯ সালে এই টেম্পল যে স্থানে নির্মিত হয়, কথিত আছে সেই জায়গাটি ‘Divine Madman’ নামে খ্যাত পাগলা সন্যাসী Drukpa Kunley এর আশীর্বাদপুষ্ট।

Chimi Lhakhang

০৯ এপ্রিল, ২০১৬ (থিম্পু)

“One’s destination is never a place, but a new way of seeing things.” – Henry Miller

আবার আমরা পুনাখা থেকে থিম্পু ফিরে আসলাম, আরো তিনটি গন্তব্যের উদ্দ্যেশ্যে।

Royal Biotical Park (Lamperi):

এটি ভুটানের জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেন। ২৮ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই উদ্যান ভুটানের প্রাকৃতিক বৈচিত্রের একটি সংগ্রহশালা। ভুটানের ৫২ প্রজাতির রডোডেন্ড্রনের মধ্যে প্রায় ২৯ প্রজাতি আছে এই বাগানে। আমরা বসন্তকালে বা তাঁদের flower blooming season এ গিয়েছিলাম বলে তার অনেকগুলোই দেখতে পেলাম। এছাড়াও আছে বনভূমি-ভুটানের যে জায়গাগুলোতেই আমরা গিয়েছি চোখে পড়েছে বিশাল পাইনের বন, এছাড়াও মাঝে মাঝে তাঁদের জাতীয় বৃক্ষ Cypress বা দেবদারু, ফার, বার্চ, ওক ইত্যাদি গাছের সারীও দেখা যায়। বনভূমি জুড়ে পাখিদের অভয়াশ্রম, একটি নির্দিষ্ট জায়গা আবার ব্যালকনির মতো ঘেরা আছে, সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে নানান পাখিদের কল কাকলী শোনা যায়; পাখিদের দেখাও পাওয়া যায়। মাঝে একটি মনোরম লেক আছে যেখানে বোটিংএর ব্যবস্থা আছে। গার্ডেনে প্রবেশ পথের কিছু দূরেই রয়েছে একটি হলঘর, সেখানে পাওয়া যাবে সে দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্রের পূর্ন বিবরণ।

Buddha Statue:

পুরো থিম্পু থেকেই শাক্যমুনি বুদ্ধের* ব্রোঞ্জ নির্মিত ১৬৯ ফিটের এই মূর্তিটি চোখে পড়ে। এর নীচে একটি টেম্পল এবং পুরো এলাকা জুড়ে ছোট ছোট আরো অসংখ্য বুদ্ধমূর্তি রয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য প্রচলিত Deity দের স্ট্যাচুও চারপাশ জুড়ে রয়েছে। পুরো স্থাপনাটির কাজ এখনো চলছে। জায়গাটি পর্বতের উপর এবং সেখানে তীব্র বাতাস বইতে থাকে সারাক্ষণ।

Buddha Statue

*(বৌদ্ধদের বিশ্বাস অনুযায়ী বুদ্ধের তিনটি রূপের কথা জানা যায়- Past Buddha বা দীপঙ্কর বুদ্ধ, Present Buddha বা শাক্যমুনি বুদ্ধ এবং Future Buddha বা মৈত্রেয় বুদ্ধ)

Memorial Chorten:

ভুটানের পঞ্চম রাজা Jigme Dorji Wangchuck চেয়েছিলেন এমন একটা স্তুপা নির্মান করতে যা বুদ্ধের চিন্তাকে প্রতিফলিত করবে। দুঃখজনকভাবে এই কাজ তিনি করে যেতে পারেননি, অকালে প্রয়াত হন। পরবর্তীতে তাঁর স্মৃতির উদ্দ্যেশ্যে তাঁর মা’র পৃষ্ঠপোষকতায় এই মেমোরিয়াল স্তুপাটি গড়ে তোলা হয়। এটিও তিব্বতীয় ধাঁচে ডিজাইন করা।

Memorial Chorten

১০ এপ্রিল, ২০১৬ (পারো)

“Respond to every call that excites your spirit”-Rumi

থিম্পু থেকে এবার পারী দিলাম পারো। পারোতে আমরা উঠেছিলাম হোটেল Base Camp এ। অন্যান্য অনেক কিছুর মতো এই হোটেলটিও দর্শনীয়। শহর থেকে দূরে একপ্রান্তে অবস্থিত এই হোটেলটি দেখতে যেমন মনোরম সেরকম তাঁদের আতিথেয়তা। এই হোটেল থেকেই একটি মাউন্টেইন বাইক নিয়ে আমার ভাই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তায় একটি বাঁকে ছোটখাট এক্সিডেন্ট করে। সে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথেই সামনে এগিয়ে যাওয়া একটি গাড়ি ব্যাক করে আসে এবং তাকে স্থানীয় স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য নিয়ে যায়। সাথে আমাদের গাইডও ছিলো। সে হোটেলে জানাতেই হোটেলের এম ডি তাঁর শিশুপুত্রকে সাথে নিয়ে গাড়ি নিয়ে সেখানে চলে যায়, সে আমাদের সামনে দিয়ে বের হয় কিন্তু আমাদের কাউকে কিছু বুঝতে দেয়নি-পাছে আমরা আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ি!

পরবর্তীতে তাঁকে নিয়ে আমরা পারো হাসপাতালের একজন ডেন্টিস্টের কাছে যাই, সে তাঁর দাঁতগুলো ফিক্স করে দেয়। হাসপাতালে যাওয়ার সময় আমরা নিজেদের কাছে যেসব ডলার আর গুলট্রাম ছিলো সব নিয়ে যাই। কিন্তু হাসপাতালে ট্রিটমেন্ট, টিটি ইঞ্জেকশন এবং যাবতীয় ওষুধপত্র সহ কোনকিছুর জন্যই তাদেরকে কোন টাকা দিতে পারি নি। চিকিৎসা নাকি একেবারে ফ্রি! হোটেলে এসে এম ডি’র বাইকের হেলমেটের ক্ষতিপূরণ বাবদও কিছু দিতে চেষ্টা করি, কিছুতেই তাঁরা নিতে রাজী হলো না। তাঁদের ভদ্রতাবোধে আঘাত লাগতে পারে ভেবে বেশী জোড়াজুড়িও করিনি। শুধু তাই না, সেই হোটেল খুব যত্ন করে আমার ভাইয়ের জন্য নরম খাবারের ব্যবস্থা করে দেয় এবং প্রতিটি স্টাফ এসে আমাদের খোঁজ নিয়ে যায়। শেষদিন আমাদের ফ্লাইট ছিলো ভোরে, সেদিন স্বাভাবিক ডিউটি টাইমের আগেই তাঁদের কর্মচারীরা উঠে আমাদের ব্রেকফাস্ট রেডি করে, আমার ভাইকে রুমের মধ্যে ব্রেকফাস্ট দিয়ে যায় এবং আমাদের গাড়িতে স্যান্ডুইচ, ফলমূল এবং জুসের প্যাকেট রেডি করে রেখে যায়। এমন আন্তরিকতায় আমরা মোটামুটি কৃতজ্ঞতায় মাটির সাথে মিশে যাই।

যাহোক পারোতে প্রথম দিনটিতে আমরা বেশ কিছু স্পটে যাই।

Tachogang Lhakhang Bridge:

পারো উপত্যকায় Paro Chu বা পারো নদীর উপর অবস্থিত এই আয়রন ব্রিজটি ১৩ শতাব্দীতে Thangtong Gyalpo নামে একজন কিংবদন্তীতুল্য তিব্বতীয় আর্কিটেক্ট, ডাক্তার, কর্মকার এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের তৈরী। কথিত আছে যে তিনি তিব্বত থেকে ভুটান পর্যন্ত মোট ১০৮ টি আয়রন ব্রিজ নির্মাণ করেন। পুরো ব্রিজটিই মানুষের হাতে তৈরী-কোনরকম যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়াই। এই ব্রিজ পার হওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার এবং একটি মনে রাখার মতো অভিজ্ঞতা।

Tachogang Lhakhang Bridge

Paro River Side:

ব্রিজ দেখা শেষে গেলাম পারো নদী দেখতে। নদীটি খরস্রোতা, পানি অসম্ভব ঠান্ডা। নদীর তীর জুড়ে ছোট বড় অসংখ্য পাথর ছড়িয়ে আছে। নদী পারাপারের জন্য একটা রোপওয়েও দেখলাম।

Paro Dzong:

পারো নদীর কাছে অবস্থিত এই টেম্পলটিতে যেতে হলে একটা ঐতিহ্যবাহী কাঠের ব্রিজ পার হয়ে যেতে হয়। পনেরো শতকে নির্মিত এই টেম্পলটি ও পারো ডিসট্রিক্টের প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

Paro Dzong

National Museum:

দিনের শেষ গন্তব্য ছিলো মিউজিয়াম। সেখানে ছবি তোলা নিষেধ হওয়াতে কোন ছবি দিতে পারলাম না। মিউজিয়ামটি শুরু হয় ভুটানের ঐতিহ্যবাহী মুখোশ এবং মুখোশ পরিহিত নৃত্য প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। এগুলো নিছকই বিনোদনের অংশ নয়, এদের পেছনে আছে সুপ্রাচীন ইতিহাস এবং অর্থপূর্ণ বার্তা। তারপরের অংশে আছে বিভিন্ন স্ট্যাচুর প্রদর্শনী। একদম শেষ অংশে ভুটানের প্রাণ বৈচিত্রের ভান্ডার। এই অংশে এসে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এত চমৎকার প্রেজেন্টেশন এবং এত সমৃদ্ধ সংগ্রহ দেখে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়।

১১ এপ্রিল, ২০১৬ (পারো)

“You were born with wings, why prefer to crawl through life?”-Rumi

আমাদের ভুটান ভ্রমণের পঞ্চম এবং শেষ দিনে ছিলো সবচেয়ে এ্যাডভেঞ্চারাস অংশটুকু-টাইগার্স নেস্টে ট্রেকিং।

Tiger’s Nest/Taktsang Monastery:

অষ্টম শতাব্দীতে তিব্বতে ছিলেন এক সন্যাসী যার নাম গুরু পদ্মসম্ভাব (Padmasambhava)। সেই গুরু একদিন একটি বাঘের পিঠে চেপে তিব্বত থেকে পারী জমালেন ভুটানের উদ্দ্যশ্যে। ভুটানে যে স্থানে তিনি অবতীর্ন হলেন সেটা পারো উপত্যকায়, পর্বতগাত্রে একটি গুহায় যা প্রচলিত হয় বাঘের গুহা বা Tiger’s Nest বা তিব্বতী ভাষায় Taktsang নামে। কথিত আছে সে গুহাতে গুরু পদ্মসম্ভাব তিন বছর, তিন মাস, তিন সপ্তাহ, তিন দিন এবং তিন ঘন্টা ধ্যান করেন।
পরবর্তীতে ১৬৯২ সালে গুরু পদ্মসম্ভাবের সম্মানে এই স্থানে Taktsang Monastery গড়ে তোলা হয়।

টাইগার নেস্ট

এই তো গেলো পরিচয় পর্ব। এবার আমাদের মত সমতলভূমির মানুষের সেই ৩,১২০ মিটার উচ্চতায় উত্থান পর্ব। তবে এটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা; পারো উপত্যকা থেকে এর উচ্চতা ৯০০ মিটার। কিছুদূর আমরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে উঠেছি। নাহয় পুরোটা ওঠার এনার্জি পেতাম না। তারপর শুরু হলো হাইকিং। হাই অল্টিচ্যুডে কিছুদূর উঠলেই শ্বাসকষ্ট হতে থাকে, তাই ধীরে ধীরে উঠতে লাগলাম। মাঝখানে একটা ক্যাফেটেরিয়া আছে, সেখানে লাঞ্চ সেরে নিলাম। টাইগার্স নেস্ট দুপুর একটা থেকে দুইটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। কাজেই আমরা একটু রেস্ট নিয়ে আবার উঠতে থাকলাম। একদম শেষদিকে যেখানে পর্বতের গা সবচেয়ে খাড়া সেখানে পাথর কেটে সিঁড়ি বানিয়ে পাশে রেলিং দিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে একসময় মনে হতে লাগলো এর কোন শুরু বা শেষ নেই, যেন অনন্তকাল ধরে আমরা এই সিঁড়ি বেয়ে উঠছি আর উঠছি! তবে এই কষ্ট মোটেও গায়ে লাগে না চারপাশের অসাধারণ সৌন্দর্যের কারণে।

Taktsang Monastery টি বেশ বড়, সেখানে বেশ কয়েকটি ভবন আছে। একদম প্রধান যে রুমটিতে গুরু পদ্মসম্ভাবের মূর্তি সেখানে একদিকে সীল গালা করে রাখা একটা বন্ধ গুহামুখ আছে, সেখানেই গুরু ধ্যান করতেন। ভেতর দিকে দুইটি ভবনের মাঝখানে দেখলাম একটা সত্যিকারের গুহা আছে সেখানে তীর চিহ্ন দিয়ে ‘Tiger’s Nest’ লেখা। এটা তাহলে সত্যিই বাঘের গুহা-ভাবতেই গায়ে একটু কাঁটা দিয়ে উঠলো!

সবশেষে আবার সেই পর্বতগাত্র বেয়ে নেমে আসা। ক্লান্ত দেহে যুদ্ধবিজয়ের আনন্দ নিয়ে ফিরে আসলাম। পরদিন ভোরে ফ্লাইট কাজেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলাম। খুব ভোরে চলে আসার স্মৃতিটা ঠিকভাবে মনে পড়েনা-আধো ঘুমে অস্পষ্ট ছবির মতো লাগে। প্লেনে উঠে আরেকবার তুষারে আবৃত সেই বিরাট মহান পর্বতমালার দিকে তাকিয়ে মনে হলো, চলে যাচ্ছি এই হিমালয়ের দেশ থেকে!

এখানে যেই তথ্যগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তা লেখিকার গাইডের কাছ থেকে জানা এবং উইকিপিডিয়া থেকে ভেরিফাই করে নেয়া। ছবিগুলো সব লেখিকার তোলা।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ bhutanstorytourtravel