ঘুরে এলাম মেঘালয়ের রাজধানী শিলং ও চেরাপুঞ্জি

ঘুরে এলাম মেঘালয়ের রাজধানি শিলং ও চেরাপুঞ্জি থেকে। এ যেন ভিন্ন ব্যাঞ্জনা। জীবন চলার পথে নিত্য নতুন পথ চলা। আমার ভ্রমন পিপাসু মন ও মননে নতুন স্মৃতি জাগানিয়া জীবন অনুপ্রাস।

যাত্রার শুরুর কথা, আমি আর শিল্পি ইকবাল সাই। আম্বরখানা থেকে শিবগঞ্জ আসি ঘড়িতে তখন সকাল সাতটা। আমরা শিবগঞ্জ এক রেস্তুরায় পরটা ভাজি দিয়ে নাস্তা করে তামাবিল – সিলেট রাস্তায় এসে গাড়ির অপেক্ষা দাড়িয়ে রইলাম এখান থেকে বিরতিহীন মিনি বাস যায় জাফলং (Jaflong)। এরমধ্যে গাড়ি আসলে আমরা ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠে বসি। গাড়ি চলতে লাগল, তামাবিল নেমে আমরা বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে এসে দেখি কর্মকর্তাগন সবেমাত্র অফিসে আসলেন আমরাই প্রথম যাত্রী, আমাদের পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম। তারা কাজ শুরু করলেনন, কুড়ি মিনিটেই কাজ শেষ করে চায়ের টাকা চাইলো। কি আর করার আমি টাকা দিয়ে পাসপোর্ট নিলাম। বেশ কয়েকবার যাওয়া আসার কারনে কাস্টমের প্রায় সকলেই আমার পুর্ব পরিচিত এবার কাস্টম অফিসার ব্যাগ দেখে নিলেন। কাজ শেষ করে পাসপোর্ট দিয়ে বললেন কোনও মালপত্র আনলে যেনো রশিদ আনি চায়ের টাকা না চাওয়ায় খুশি মনে আমরা ঠিক আছে বলে বিদায় নিলাম।

মেঘালয় ভ্রমনকালে লেখক

সীমান্ত পেরিয়ে হাটা পথে ভারতের কাস্টমস অফিসে হাজির হলে খাসিয়া অফিসার এম্বার্কেশন কার্ড ধরিয়ে দিলে আমরা পুরন করে দিলাম। ইতি মধ্যে আরো বাংলাদেশি টুরিস্ট আসলেন। একটা পরিবার ঢাকা থেকে আরো দুই যুবক তারাও বেড়াতে যাবেন ইমিগ্রেশন শেষ হলে পাসপোর্ট নিয়ে। আমরা বেড়িয়ে পড়লাম এখান থেকে আধা মাইল ডাউকি বাজার, রাস্তা ভালো না তাই হেটেই যাবো সিদ্ধান্ত নিলাম। কয়লা ও পাথরবাহী ট্রাকের জ্যামে পড়লে এক ঘন্টা ও লাগতে পারে।

ঢাকার দূই যুবক সাথে পান্তুমাই এর একজন। ইমিগ্রেশনে তাদের সাথে পরিচয় হয়েছিল, আমাদের সাথে যোগ দিলে আমরা পাঁচ জন সুমু জিপে করে যাত্রা শুরূ করলাম মেঘের দেশ মেঘালয়ের রাজধানী শিলং

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে উটতে লাগলো আমাদের সুমু জিপ আর আমরা পাঁচ যুবক মোবাইলে কথা বলে নিচ্ছি নেট থাকা অবধি। ডাউকি থেকে শিলং এর দুরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। ছয় হাজার ফুট উচ্চতায় শিলং হিল শহর,আমরা ঝুলন্ত ব্রিজ পার হচ্ছি আর পাখির চোখে বাংলাদেশকে দেখছি। মনে পড়ছে কতবার জাফলং থেকে এই ব্রিজ দেখেছি, গাড়ি এগিয়ে চলছে রাস্তায় দর্শনীয় স্থানে অনেক টুরিস্ট গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলছেন। সামনের স্পট দেখিয়ে গাড়ি থামাতে বললাম। গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন খাটো খাসিয়া ড্রাইভার আর পান চিবুচ্ছেন মাঝেমাঝে গুল পুরে নিচ্ছেন । গাড়ি থামলে একে একে নেমে এলাম আমরা। অপূর্ব দৃশ্য অবলোকন করতে পঁচিশ টাকা দিয়ে টিকেট নিয়ে ভিতরে এলে সবাই ছবি তুলে নিলাম মেঘ পাহাড়ের ঢেউ খেলানো অপরূপ দৃশ্যের ভেতর। ক্যামেরা বন্ধির কাজ শেষ করে আমরা পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম। ড্রাইভার জানালেন সামনে ডেনজার জোন আছে, আমরা এগুতে থাকি আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে। ডাউকি থেকে শিলং এর পথ পর্যটকের জন্য আকর্ষণীয় সবসময়। মনের অজান্তেই কেউ গান ধরে….. এই পথ যদি শেষ না হয় …

অঞ্জলিতে গাড়ি থামলে ভাড়া মিটিয়ে আমরা চললাম জি এস রোড বাবা ট্যুরিস্ট লজ এ হাঁটা পথ, বাবা লজ রিসিপশনে আলাপকালে এক মধ্য বয়সি সুপুরুষ জানালেন রুম খালি নেই। আমরা সিলেট থেকে এসেছি জেনে অন্য কোথাও খবর নিয়ে বললেন উনিও সিলেটী । ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ আগে বাবার সাথে এসেছিলেন আরও জানালেন দুই ব্লক পরেই হোটেল রেইনবোতে রুম খালি আছে। বিদায় নিয়ে আমরা রেইনবোর দিকে পা বাড়ালাম। রেইনবোর দু তলায় রিসিপশনে দাঁড়ানো লোকটি হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা জানালে আমি বাবা লজের কথা বললাম, বেশ পরিপাটি হোটেল। দুইটা চাবি দিয়ে ওয়েটার কে বললেন রুম দেখাতে, দেখে ভাল লাগলো। ডাবল রুম এক হাজার তিন ব্যাড রুম বারশত রুপি ঠিক হলে কাউন্টারে পাসপোর্ট জমা দিয়ে রুমে গেলাম। হাল্কা ঠাণ্ডায় আরাম লাগছিল।

শিলংয়ের তাপমত্রা আজ ১৫ ডিঘ্রি সেলসিয়াস, ব্যাগ রেখে হাত মুখ দুয়ে বেড়িয়ে পড়লাম ডলার আকচেঞ্জ করতে পুলিশ বাজার সেন্টার পয়েন্টে। সেন্টার পয়েন্ট দেখা হলো ঢাকা থেকে আসা পরিবার প্রধানের সাথে কোন হোটেলে উটছেন জানতে চাইলে জানালেন হোটেল পাননি আমরা হোটেল রেইনবোতে উটেছি জানালাম থাকেও রেইনবো খুজ নিতে বলে বিদায় নিলাম আমরা। এগিয়ে চললাম সিটি হার্ট দাবা অভিজাত রেস্টুরেন্ট সেন্টার পয়েন্ট থেকে মিনিট দুই লাগে। অভিজাত রেস্টুরেন্ট অর্ডার করলে ওয়েটার ১০ মিনিট সময় চেয়ে নিলেন। পেটে বেশ ক্ষুধা নিয়ে খাবারের অপেক্ষা করছি আর আগামী কাল শিলং কিভাবে ঘোরা যায় সেই আলাপ চলতে থাকলো। টিক হলো মারুতি কার নিয়ে এর মধ্যে খাবার চলে এলো আমরা দুই জন বেশ আরাম করেই খেলাম।

খাবার শেষে বেরিয়ে এসে দেখি বৃষ্টি হচ্চে, ঝির ঝির বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাটতে থাকি গাছের পাতা ভেজা, রাস্তা ভেজা। কিছুক্ষন হাটার পর আবার রোদ উটেছে , শিলং এরকমই এই রোদ এই বৃষ্টি। বৃষ্টি বৃষ্টি খেলা চলতে থাকে …

আমরা হোটেলে রিসিপশনে খোঁজ নিলাম। আমাদের বাকি তিন জনের মধ্যে কেউ আসে নি আমরা রুমে এলাম একটু বিশ্রাম দরকার। বিকালে বের হলাম জেল রোড এ রাজ্য পর্যটন দফতরে চেরাপুঞ্জি বাসের অগ্রিম সিট বুকিং করতে। ভিন্ন আঙ্গিকে গোছানো ছোট অফিস। অনেক ভিড় মাত্র দুই জন খাসিয়া মহিলা অফিসের কাজ করছেন দ্রুতলয়ে, পরিচয় হলো কলকাতা থেকে আসা এক দম্পতির সাথে। কাউন্টারে গিয়ে চেরাপুঞ্জির টিকেট নিলাম, জন প্রতি তিন শত রুপিতে গাইড সহ যাতায়াতের ব্যবস্থা।

টিকেট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সন্ধায় যেদিকে মন চায় সেদিকে ঘুরবো কোনো তাড়া নেই কোথাও যাবার নেই কোথাও যেতে বাধাও নেই এরকম সন্ধা জীবনে কমই আসবে, সন্ধার শিলং আরেক অনন্য রুপে ধরা দেয় পর্যটকের চোখে, প্রাচ্যের ভেতর প্রাশ্চ্যাত্য নগরী। আমরা এলো মেলো পথে হাঁটতে থাকি। অনেক লোক রাস্তায় কিন্তু হই হল্লা নেই। যে যার মতো প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিচ্ছে, অনেকেই প্রাণ খোলে আড্ডায় ব্যাস্ত। বেশিরভাগ দোকানি মহিলা নিজের উত্তপাদিত ফসল নিজেই বিক্রি করে থাকেন।

সেন্টার পয়েন্টে ছোট একটি দুকানে ভিড় লেগেই থাকে ফাস্টফুডের দোকান আমি তাদের নিয়মিত খরিদার তাদের এগরুল সিলং এ বিখ্যাত । আমি দুইটা এগরোল কিনলাম এবং ইকবাল সাইকে নিয়ে খেতে শুরু করলাম, এগরোল খেতে কি যে সুস্বাদু না খেয়ে বুঝা যাবে না। রাতের খাবার খেলাম সুরুচি রেস্টুরেন্টে এ এখানে বাঙালি সব খাবারই পাওয়া যায়। দামেও সস্তা আমরা দুই জনে খেলাম আলু ভাজি পাকুড়া ও রুই মাছ,বাবা টুরিস্ট লজ রেস্টুরেন্টও বাঙালি খাবার পাওয়া যায়, এ যেন এপার বাংলা ওপার বাংলার ভোজনরাজ্যের অন্তরের মিল।

পরের দিন সকাল ৭টা ১৫মিনিটে বের হলাম… এত সকাল নাস্তা করবো রেস্টুরেন্ট খোলা থাকে না। পথের পাশে পরটা ভাজি ডিম বিক্রি হচ্ছে আমরাও এগিয়ে গেলাম পুলিশ বাজার পয়েন্টে প্রচুরসংখ্যক ট্যুরিস্ট । আমি খিচুড়ি খেলাম সাথে এক পিছ মাংস ও এক কাপ চা বেস মজাদার খিচুড়ি খাসিয়া মাত্রিপ্রধান পরিবার সিলং এ যেদিকে থাকাবেন মহিলাদের উপস্তিতি লক্ষ করবেন।

আজ আমরা শিলং এর দর্শনীয় স্থান সমুহ ঘুরবো ট্যাক্সি টিক করলাম ড্রাইভারই আমাদের গাইড। দর্শনীয় স্থানের এক টা তালিকা দিলে আমি চোখ বোলাচ্ছি পেছন থেকে ইকবাল সাই বললেন পিছনের সিটে তিন জন হবে না ড্রাইভার। ড্রাইভার কাম গাইড প্রতি উত্তরে একটু টান দিলেই হবে… সবাই আচমকা হেসে উঠলো, গাড়িও চলতে লাগলো। আমরা প্রথমে শিলং পিক দেখতে গেলাম সেখান থেকে দেখা য়ায় কুয়াশার উড়ো হাওয়ার মতো মেঘে ঢাকা শিলং (Shillong) শহর, এরপর লেডি হায়দরি পার্ক, এলিফেন্ট ফলস, গলফকোর্ট, ডনভাস্কো মিউজিয়াম ঘুরে অনেকটুকু সময় অতিবাহিত করলাম। অবশেষে ওয়ার্ডসলেকে আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে বিদায় বিদায় ড্রাইভার।

আমাদের দেখিয়ে দিলেন ওয়ার্ডসলেকের সেই গেইট যা অতিক্রম করে কিছু সময় হাটলেই সেন্টার পয়েন্টে যাওয়া যায়।

আজ সারাদিন চেরাপুঞ্জি ঘুরে দেখার জন্য ভোর ৭ টা ২৫ মিনিটে হাজির হলাম রাজ্য পর্যটন দফতরে। আমাদের টিকেট দেখানোর পর গাড়ি দেখিয়ে দিলেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। গাড়িতে উটলাম আমরাসহ ২৮ জন যাত্রী। কলকাতার তিন জন বাংলাদেশর দুই জন ও ইউরুপিয়ান টুরিস্টদের সাথে প্রথমিক পরিচয় হলো। এসি গাড়ি… ভালই লাগছিল গাইড এসে সবার সাথে পরিচিত হলে। গাড়ি চলতে লাগলো শহর থেকে বেরুনোর সময় বাম পাশে চোখে পড়ে ভারতের ইস্টার্ন কমাণ্ডের সদর দপ্তর। অরে একি ! ডানে বামে ছড়নো ছিটানো অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল,আমাদের দেশের সাধারন শহরের চেয়ে কয়েক গুন বেশি। আমাদের চলতি গাড়ি প্রথমে মকডক থামলো, আমরা নামলাম পাহাড়ের ঢেউ খেলানো রূপ দেখতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম। আহ কী মনোরম দৃশ্য মূহর্তেই মনে ভেসে ভেড়াতে পাহাড়ের ডেউ এ আপনার কাছেও চেনা চেনা লাগতে পারে।

মকডক কে বিদায় জানিয়ে আমরা গাড়িতে উটে বসলাম গাড়ি চলতে লাগলো, মেঘও চলছে আমাদের সাথে হাত দিয়ে মেঘ ছুয়ে অনেকেই উচ্চশিত । ক্ষনিকের জন্য আমরা হলাম মেঘের সহ যাত্রী। গাড়ি থামলো বাংলাদেশ ভিউ পয়েন্ট, দেখলাম সেখানে অনেকে বড় এক কালো পাথরে পূজাকর্ম সম্পাদনে ব্যস্ত। আর পয়েন্ট থেকে দেখা যায় ছাতকের দোয়ারাবাজার এলাকার নিম্ন অঞ্চল। আমাদের সহযাত্রী কয়েকজন আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন এদের পৈতিক বাড়ি ছাতক বলে জানলেন , কেউ কেউ আবার ক্যামেরা বন্দি করলেন মনোরম দৃশ্য।

আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে গাড়ি চলতে লাগলো… সাথে আছে মেঘ তুলো তুলো মেঘ। গাইড জানালেন সামনে থাংকারাং পার্ক , গাড়ি থামার পর সবার সাথে নেমে পড়ি । বেশ পরিপাটি সবুজের সমারোহ হিম শীতল পরিবেশ এ যাত্রা মোহনিয় স্মৃতিময় যাত্রা …
মউসুমাই কেভ, জনশ্র“তি আছে এখানে ডায়নিদের বাস।অশরীরী প্রেতআত্মা ঘুরাফেরা করে, কেউ কেউ বলেন এই সুড়ঙ্গ দিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ যাওয়া যেত। অনেকেই ভিতরে জাবেন না সুড়ঙ্গপখে পা বাড়াবেন না বলে মতামত ব্যক্ত করলেন। কিন্তু আমরা না দেখে চলে যাব এটা কি হয়? কয়েক জন টিকেট নিলাম এবার কিছু দূর গিয়ে ঘেমে অবস্থা খারাপ। এবড়ো তেবড়ো সুরঙ্গ… অনেক জায়গায় পানি আছে ,খুব সাবধানে এগোতে হচ্ছে… অনেক কষ্টে বেরিয়ে এলাম। মনে হল এবার বাঁচা গেল।

নিউকেলিকালফলস এটাই আমাদের এবারের ভ্রমনযাত্রার শেষ স্পট । ঘণ্টা খানিকের মধ্যে আমরা আবার শিলং ফিরে যাবো। এগিয়ে ফলস দেখতে গেলাম। জানাগেল ৩২০ সিঁড়ি নামলেই ঝর্নার অনেক কাছে যাওয়া যায়। দু তিন জনকে পাওয়া গেল ঝর্না দেখে এসে নিজ নিজ গন্তেব্যে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমরাও নামতে থাকি ঝর্ণার রূপ মঞ্জুরি দেখার উদ্দেশ্যে। চলতে চলতে এক সময় ঝর্নার কাছে গিয়ে মনে হলো নতুন ভুবনে যৌবনা তিলোত্তমার দেখো পেলাম। আমরা একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম আর মুগ্ধতায় ভরে উটলো মন।মনে হলো সত্যিই অপূর্ব এই ধরা ….ধরণীর বাক উপবাক।

Leave a Comment
Share