তিনচুলে ভ্রমণ

সকালে স্নান করে ব্রেকফাস্ট সারলাম অসাধারণ মোমো দিয়ে। আমাদের ড্রাইভার কুঙ্গা মশাই ঠিক ১০ টায় এসে হাজির। তিনি লামাহাট্টা লজের কর্তার আত্মীয়। পথে আমরা একটা দুটো ভিউ পয়েন্ট দেখে নেব এমনটাই ঠিক ছিল। আগেই শুনেছিলাম যে কিছুটা পথ খারাপ রাস্তা দিয়েই যেতে হবে। কুঙ্গাজী বললেন লামাহাট্টা থেকে তিনচুলে আধঘন্টা খানেকের কিছু বেশী লাগবে। পথেই পাবো পেশক চা বাগান এবং 360° view point। উনি আমাদের অনুমতি নিয়ে স্থানীয় এক বন্ধুকে তুললেন কিছু দূর এসে। একটু ভয় ভয়ই লাগছিল, আজকাল বিশ্বাস করাটা মুশকিল। আমার পতিদেব এসব চিন্তার ধারপাশ দিয়ে না গিয়ে দিব্যি একবার ডানদিক, একবার বামদিক আর কখনও সামনের কাঁচে ফোকাস নিয়ে বসে আছে। আমরা বেশ অনেক খানি রাস্তা জুড়ে পেশকের চা বাগান দেখলাম। তবে তা সাজানো নয় বন্ধ (সাময়িক ভাবে) ওনারাই বললেন মালিক এবং শ্রমিক পক্ষের ঝামেলা। আগাছাময় বাগানের পাশ দিয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল, এক সময় কতনা যত্নে চা চাষ হত। কত পরিবারের রুজি ছিল, একসময় মেয়ে-পুরুষেরা হয়তো নিপুন হাতে চা সংগ্রহে ব্যস্ত থাকত। এখন বেড়ার বাইরে মুখ বাড়িয়ে গাছগুলি অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে শুধু।

রাস্তা বেশ সরু আর জিলিপির মত প্যাঁচানো। সামনে দিয়ে গাড়ি আসলে থামিয়ে তাকে জায়গা করে দিতে হয়। আমরা গাড়ি থেকে নামলাম 360° view point (গুম্বাদারা ভিউ পয়েন্ট) এর সামনে। খাদের ওপারে দার্জিলিং সিকিম এবং পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জ। এটি সানরাইজ বা সানসেট দেখার জন্য আদর্শ স্থান। আমরা অবশ্য অসময়ে এসে পড়েছি। তার মধ্যে ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ। মাঝে মাঝে মেঘ সরে গিয়ে পরিষ্কার হচ্ছে। এরই মধ্যে আমাদের ড্রাইভার ভাই আর তার সঙ্গীটি ঝোপ থেকে একটা বুনো ফল পেড়ে খেতে লাগল। ছোট ছোট গোল গোল রাস্তার ধারেই গাছ ভরে হয়ে রয়েছে। ওরা টপাটপ খেয়ে যাচ্ছে আমাদেরও খেতে বলল। আমার কর্তা মশাই না খেলেও আমার বেশ ইচ্ছে হল। একটা মুখে পুরেই দিলাম। টক মিষ্টি স্বাদ, ভালোই লাগল। ইচ্ছে থাকলেও দ্বিধায় একটার বেশি খেলাম না। ওরা একটা গাছ থেকে কিছু পাতা ছিড়ে এনে হাতে দিয়ে বলল ব্লাড প্রেশার কন্ট্রোল করার অব্যর্থ ওষুধ এটি। কিছুটা তুলে ব্যাগে রেখে দিলাম, কোলকাতা অবধি পৌঁছাবে কিনা জানিনা, তবে ব্লাড প্রেশার না কন্ট্রোল হলেও স্মৃতি রোমন্থনে এটি বিশেষ কাজে দেবে। মিনিট ২০ থেকে আমরা রওনা দিলাম তিনচুলে (Tinchuley) / তিঞ্চুলে যার আরেক নাম “The small Hamlet in Himalayas” এর দিকে।

রাই রিসোর্ট থেকে ভিউ

দূর থেকে তিনচুলের “তিনটে চুলা” দর্শন করে ১টা নাগাদ আমাদের গাড়ি ঢুকল রাই রেসর্টে। ছবির মত সুন্দর সাজানো গোছানো। সব ফর্মালিটিস সেরে ঘরের চাবি পেলাম। দোতলায় আমাদের ঘর। নিচে ডাইনিং এবং আরো এক্সটেনশন এর কাজ চলছে। আমাদের কেয়ারটেকার দিলীপ বাবু আমাদের ঘরে পৌঁছে দিলেন। আসা মাত্রই আমরা চায়ের অভ্যর্থনা পেলাম। সুন্দর চায়ের সেটে সাজানো। ঘরও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, সামনে খোলা অর্ধেক ছাদ পাহাড়ে মেঘে মাখামাখি করে আছে। প্রকৃতি বিরূপ, নয়তো পরিষ্কার আকাশে কাঞ্চনজঙ্ঘাও দেখা যেত। আমরা বারান্দায় বসে চা খেয়ে দিলীপ বাবুর কাছে জেনে নিলাম লাঞ্চে কি আছে এবং কাছাকাছি কোথায় ঘোরা যায়। সামনে একটা বৌদ্ধ মোনাসট্রি পায়ে হেঁটে দেখা যায়। বিকালে ওখানেই যাব ঠিক করলাম। ওনার থেকে শুনেই রিসোর্টের ওপরে একটা পার্ক মত জায়গায় গেলাম। পাহাড়ের ওপরে বাচ্চাদের খেলার জিনিস দিয়ে সাজানো। সামনে পাহাড়ের দৃশ্য যেমন সুন্দর, উল্টোদিকে গভীর খাদ তেমনই রোমাঞ্চ জাগায়। বেশকিছুক্ষন সেখানে থাকলাম। সমস্যা বলতে একটাই পোকামাকড়ের উৎপাত। নিচে নেমে এসে লাঞ্চ সারলাম ডাল, ভাত, আলুভাজা, সব্জি, চিকেন আর চাটনি দিয়ে। পুরো বাঙালি খাবার এবং এত ভালো রান্না যে কি বলব। দিলীপ বাবুর হাসি মুখে একা হাতে অতিথি দের দেখাশুনা, রান্না, খেতে দেওয়া সত্যি মুগ্ধ করে।

Rai Resort Terrace Park

বিকেলের স্ন্যাক্স এ চা আর পাকোড়া বরং মোনাসট্রি ঘুরে এসেই খাওয়া যাবে। আমি আর সে বেরুতেই আমাদের পিছু নিল লজের দুজন সারমেয়। ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা ক্রমশ মেঘ যেন নেমে আসছে, ধোঁয়া ধোঁয়া চারপাশ। আমাদের বেশ ভয়ই লাগছিল। তবু এগোলাম বলে দেওয়া রাস্তায়। সারাটা রাস্তা আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ছিল ওরা দুজন। একজায়গায় মোনেস্ট্রীর গেট দেখতে পেলাম। দুজন লোক সামনে দাঁড়িয়ে সেটাই সাজাচ্ছে, একজনের কপালে চোট লেগে, হাতে আবার ছুরি! রাস্তায় জনমানব নেই। আমার তো ভীষণ ভয় করতে লাগল। আমার সঙ্গী মশাই তাদেরকে গিয়েই জিজ্ঞাসা করলেন আর কতটা যা জানলাম নিচে বেশকিছুটা নেমে তবেই পৌঁছাব। আমরা নিচে নামতে থাকলাম। লজের কুকুর দুটিও এল পিছু পিছু, বলাই বাহুল্য ওরাই সাহস দিচ্ছে আমাদের। নিচ থেকে ভেসে আসছে একটা করুন সুর (Buddhist Chant)। সরু আগাছাময় সরু রাস্তা ধরে প্রায় মিনিট পাঁচেক নামার পর বুঝলাম আরো অনেকটা দূর, মেঘ করে আসছে এবার দূর থেকেই মনেস্ট্রীকে বিদায় জানিয়ে ওপরদিকে উঠতে থাকলাম। সত্যি দলে অনেক লোক থাকলে রিস্কটা নেওয়া যায়। ওপরে এসে সেই দুজন যারা সাজাচ্ছিলেন তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল দু একদিনের মধ্যেই উৎসব আছে তখন এখানে অনেক ভিড় হবে, তারা স্থানীয় সেই উৎসবের তোড়জোড়ে ব্যস্ত। অন্ধকার হওয়ার আগে আমরা ফিরতে লাগলাম, যেতে আসতে কারোরই দেখা পেলামনা। আমরা পথে দাঁড়িয়ে কিছু দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করছিলাম, আমাদের পাহারা দিয়ে যারা নিয়ে যাচ্ছিল তারাও অদ্ভুত ভাবে আমাদের সাথেই থেমে যাচ্ছিল, লজের মুখে এসে তবেই আমাদের ছাড়ল। ওদের জন্য সামনের একটা দোকান থেকে বিস্কুট কিনে দিলাম। এসে চা আর পাকোড়া র সাথে পাহাড়ে চোখ মেলে কিছুটা সময় কাটল। পরের দিনের ট্যুর প্ল্যান টা করার জন্য ম্যানেজারের দ্বারস্থ হলাম। পরদিনের জন্য একটা গাড়ি ঠিক করা হল। ঠিক হল হ্যাঙ্গিং ব্রিজ, রংলি টি গার্ডেন, অর্কিড সেন্টার, তাকদা ব্রিটিশ বাংলো, দূরফিনদারা ভিউ পয়েন্ট দেখে আমাদের নেক্সট ডেস্টিনেশন বরামাঙ্গওয়া (Bara Mangwa) যাবো।

তিনচুলে মনেস্ট্রীতে যাওয়ার মেঘে ঢাকা রাস্তা

রাতে রুটি, ডাবল ডিম, চিকেন, সবজি, ডাল দিয়ে ডিনার সেরে আমাদের প্রতিবেশী এক দম্পতির সাথে আড্ডা জমালাম। তিনচুলের তিনটি পাহাড় আগে ভালোভাবে দেখা যেত, রোদের আলোয় পাহাড়ের চূড়া গুলো চুলার মত লাগত বলে তিনচুলে নাম। ক্রমাগত ধ্বস নামার জন্য এখন অত ভালো দেখা যায়না যদিও। পরিষ্কার আকাশে পাহাড় গুলো আরও একবার দেখার ইচ্ছে নিয়ে বিছানায় গেলাম। বৃষ্টি বাধসাধল ভোররাতে।

তিনচুলে মনেস্ট্রী

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি জানলার কাঁচ গুলো শিশিরে ঢেকে গেছে, বাইরে বেরিয়ে এক অদ্ভুত দৃশ্য! জলো হওয়া বইছে, সাথে হালকা বৃষ্টি আর মেঘ গুলো যেন বারান্দায় চলে এসেছে, লজের সামনের রাস্তাটাও দেখা যাচ্ছেনা। ধোঁয়ার চাদরে ঢাকা পুরো সাম্রাজ্য। প্রকৃতির এমন রূপ আগে দেখিনি, ভালোও যেমন লাগছে তেমনই আজকের প্ল্যানটার কি হবে ভেবে মনটাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। স্নান করে তৈরি হয়ে বসে রইলাম, আমাদের ড্রাইভারকে ফোন করতে সেও বলল এমন ওয়েদারে যাওয়াটা সুবিধের হবেনা। অগত্যা ব্রেড, টোস্ট, ওমলেট, চা সহযোগে ব্রেকফাস্ট সেরে আমরা লজেই আবহাওয়া ভালো হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। প্রকৃতির ওপর কারো জোড় খাটেনা। অবুঝ মনকে বুঝিয়ে হালকা বৃষ্টির সাথে তিনচুলেকে বিদায় জানালাম। দুপাশে গাছের সারি মাঝে মাঝে অন্ধকার করে আসা গাছ, আর খারাপ রাস্তার সাথে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল বরামাঙ্গওয়ার দিকে।

কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য

  • লামাহাট্টা থেকে তিনচুলে মোটামুটি ৪০ মিনিট থেকে এক ঘন্টার রাস্তা।
  • আমরা গাড়ী লামাহাট্টা লজ থেকে নিয়েছিলাম। ১০০০ রুপী Wagon R.
  • আপনারা যদি NJP থেকে সরাসরি তিনচুলে আসতে চান তবে গাড়ী ভাড়া লামাহাট্টার মতই পরবে (বড় গাড়ী ২৫০০/- আর ছোট গাড়ী ১৮০০/-) তবে এক্ষেত্রে NJP থেকে শেয়ারড ট্যাক্সি না ধরাই ভালো কারন তিস্তা বাজার অবধি যেতে পারলেও ওখান থেকে খুব বেশী লোকাল জীপ তিনচুলের দিকে যায়না।
  • তিনচুলে রাই রিসোর্ট বুক করতে হলে বা অন্যান্য বিস্তারিত জানতে হলে ফোন করুন 9836739437 এই নাম্বারে। নামঃ Runa Saha Chowdhury.
  • খাওয়া দাওয়া মাথা পিছু ৬০০ রুপী এক একজনের ( সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, বিকেলের স্ন্যাক্স, রাতের খাবার এবং চা)
  • তিনচুলে তে যেখানে আমরা ছিলাম অর্থাৎ রাই রিসোর্ট এর লোকেশনটাই একটা ভিউ পয়েন্ট। তবে তিনচুলের তথাকথিত “তিনটি চুলা” দেখতে হলে আপনাকে অনতিদূরের মোনাসট্রির কাছে হেঁটে যেতে হবে। রাই রিসোর্ট থেকে ১৫ মিনিটের পথ।
  • তিনচুলে তে দোকানপাট এবং জনবসতি বেশ কম। অলমোস্ট নেই বললেও চলে, তাই প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আগেই কিনে রাখবেন।
  • থাকার জন্যে আরও আছে গুরং গেস্ট হাউজ (Gurung Guest House). ওয়েবসাইটঃ http://www.tinchuley.com
Leave a Comment
Share