চারদিনের আকাঙ্খিত সিলেট সুনামগন্জ ভ্রমন

পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ২ তারিখ। তাই আগে ভাগে ৬ তারিখের উদয়নের টিকেট (চট্টগ্রাম টু সিলেট) করে রেখেছিলাম । বিপত্তি বাধলো যখন শিক্ষামন্ত্রী সাহেব ২ তারিখ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে দিলেন। পরীক্ষা পিছিয়ে গেলো ৭ তারিখে। তারপর আবার ৭ তারিখ গিয়ে কাটলাম ৮ তারিখের টিকেট। ৮ তারিখ ৯.৪৫ এ ট্রেন,সেদিন সন্ধ্যা ৬ টায় শুনি সিলেটের সাথে সারা দেশের রেলযোগাযোগ বন্ধ,সিলেট স্টেশানের ৬০ কি.মি আগে রেলের বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। তারপরো ঠিক টাইমে রেল স্টেশান ত্যাগ করেছিলো যদিও। আমরা চট্টগ্রাম থেকে ছিলাম ৯ জন, ঢাকা থেকে এসেছিলো আরো ২ জন। শুরু হলো আকাঙ্ক্ষিত সিলেটসুনামগন্জ ট্যুর…

পরদিন সকাল ৬.৩০ এ যখন স্টেশান পৌঁছালাম তখন সিলেটে তুমুল বৃষ্টি, ঢাকার বন্ধুগুলোও পৌঁছালো প্রায় একই সময়ে। মনে মনে ভাবলাম এরকম বৃষ্টি থাকলে সিলেট ট্যুর মাঠে মারা যাবে। যাই হোক স্টেশানের বাইরে থেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে সিএনজি নিয়ে চলে আসলাম আম্বরখানা পয়েন্টে, হোটেলের খোঁজে। কয়েকটা হোটেল খুঁজে দামদরে সুবিধা হওয়ায় উঠে গেলাম ‘হোটেল পলাশ’ এ। ছিমছাম, পরিপাটি হোটেল। সবাই ফ্রেশ হয়ে, আম্বরখানা নাস্তা করে উঠে গেলাম লেগুনাতে। রুট ছিলো জাফলং, লালাখাল, সাস্ট (SUST), রাস্তার বাজে অবস্থা আর লেগুনার ধীরগতি আমাদের জাফলং পৌঁছায় প্রায় ১ টার দিকে। জাফলং পৌঁছে নৌকা ভাড়া করে চলে গেলাম সংগ্রামপুন্জি ঝর্ণায়।

সংগ্রামপুন্জি ঝর্ণা, জাফলং

জাফলং এর সাদা পানি, ঝর্ণার পানিশূন্যতা, রাস্তার বাজে অবস্থা আমাদের জাফলং সম্পর্কে বিরুপ মনোভাব 🙁 দিয়ে দিয়েছিলো। পাথর তোলা আর মানুষর পরিবেশ সম্পর্কে উদাসিনতার জন্যই এই অবস্থা। দুইবছর আগেও জাফলং গিয়েছিলাম একবার, রাস্তা তখনো খারাপ ছিলো কিন্তু জাফলং এর পানিশূন্যতার এই নির্মম দিক দেখিনাই তখন। জাফলং ছেড়ে চলে আসলাম সারিঘাট। উদ্দেশ্য লালাখাল দেখা। সাড়ে তিনটার দিকে লাঞ্চ করে নৌকা ভাড়া করা হলো। লালাখালও হতাশ করলো। যতটুকু সৌন্দর্য্যের আশা নিয়ে এসেছিলাম ততটুকু সুন্দর ছিলো না। হয়তো বৃষ্টির কারণে পানির ফিরোজা রং সাদা হয়ে গিয়েছিলো। অদেখাই থাকলো চীনামাটির উপরের ফিরোজা রং এর লালাখাল।

সেদিন সাস্ট দেখা হয় নাই, রাতে রুমে পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে ডিনার করলাম পানসিতে। অল্প দামে কয়েকপদের ভর্তা, ঝাল ফ্রাই আর তাদের অসাধারণ লাচ্চির কথা কখনো ভুলবো না। খেয়ে চলে গেলাম শাহজালাল মাজার এ।

দ্বিতীয় দিনের প্ল্যান ছিলো শ্রীমঙ্গল যাবো। পরদিন শুক্রবার হওয়াতে রাতে বাজেটের মধ্যে গাড়ি পাচ্ছিলাম না। অগত্যা শ্রীমঙ্গল বাদ দিয়ে রুট প্ল্যান করা হলো বিছানাকান্দি, পান্থুমাই, রাতারগুল আর শাহপরান মাজার

সকাল সাতটায় বের হয়ে লেগুনায় নয়টায় পৌছলাম বিছানাকান্দি যাওয়ার ঘাটে। এদিকের রাস্তাটা গতদিনের চেয়ে কম ভাঙ্গা। ঘাট থেকে বোট ভাড়া করে চলে গেলাম বিছানাকান্দি। প্রকৃতি তার সবটুকু সৌন্দর্য্য ঢেলে দিয়েছে বিছানাকান্দিকে। বড়-ছোট বিভিন্ন আকৃতির পাথর, পেছনে মেঘালয়ের পাহাড়,পিয়াইন নদীর স্বচ্ছ পানি মন ভোলাবে যেকোন পর্যটকের। বিছানাকান্দি শেষ করে বোট চললো পান্থুমাই ঝর্ণার দিকে। দুইপাশের গ্রামের মানুষের জীবন,পেছনে সুউচ্চ পাহাড়,পাহাড়ে মেঘের দৌড়াদৌড়ি – আহা!

পিয়াইন নদীর শেষ সীমানায় গিয়ে পান্থুমাই দেখেই চোখ ছানাবড়া। এত বড় আর সুন্দর ঝর্ণা!! ভেবেছিলাম গিয়ে লাফঝাপ করবো ঝর্ণায়। পরে শুনলাম ওটা দাদাদের, ওখানে যাওয়ার অনুমতি নেই বিএসেফের। “দূর হতে তোমারেই দেখেছি আর মুগ্ধ হয়ে চোখে চেয়ে থেকেছি ” হেমন্ত সাহেব পান্থুমাই দেখার পরই এই গানটা লিখেছিলেন বোধহয়। যাই হোক,ঝর্ণা দেখে পিয়াইন নদীতেই লাফ ঝাপ করলাম। ঝর্ণার স্বাদ নদীতে মেটালাম। পিয়াইন নদীর পানিও একদম স্বচ্ছ আর ঠান্ডা।

পান্থুমাই

পান্থুমাই দেখে ঘাটে ফিরে রাতারগুল চলে গেলাম। রাতারগুলও সুন্দর, আগে গিয়েছিলাম তাই কোন থ্রিল ছিলো না। বোট ভাড়া করে, ওয়াচ টাওয়ার আর সুটিং স্পট ঘুড়ে চলে আসলাম মালিনিছড়া চা বাগানে। রুমে ঢুকতে ঢুকতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো তাই শাহ পরাণ রাতে গিয়েছিলাম। রাতে খেলাম পাঁচভাই এ। এটাও ভালো ছিলো…

তৃতীয়দিনের যাত্রা সুনামগঞ্জ এর উদ্দ্যশ্যে টাঙ্গুয়ার হাওর, লাকমাছড়া, বারিক্কা টিলা, শিমুল বাগান, জাদুকাটা নদী, নীলাদ্রি লেক দেখবো বলে। সিলেট থেকে সকাল নয়টার দিকে গাড়িতে উঠে ১১ টার দিকে পৌঁছলাম সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ থেকে আবার সিএনজি নিয়ে চলে গেলাম তাহিরপুর। তাহিরপুর ডাকবাংলোতে দুইটা রুম নিয়ে ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে বড়সড় একটা নৌকায় উঠলাম দুপুর দুইটার পর। বাজার থেকে নিলাম লাইফজ্যাকেট, দুপুরের খাবার, পানি এসব। উঠেই নৌকায় অনেকে ঘুম দিয়ে দিলাম।

সাড়ে তিনটার দিকে পৌঁছলাম টাঙ্গুয়ার হাওর। টাঙ্গুয়ার হাওরের স্বচ্ছ পানিতে কিছুক্ষণ ঝাপাঝাপি করে, ছবি তুলে চলে গেলাম টেকেরঘাট। আমরা হাওরে বেশি সময় নিয়েছিলাম তাই টেকের হাট পৌঁছাতে একটু দেরী হয়ে গিয়েছিলো আমাদের, প্রায় ছয়টার কাছাকাছি। ওইদিন নীলাদ্রি লেক আর লাকমাছড়া ছাড়া আর কিছুই দেখা হয়নি সন্ধ্যা হয়ে যাওয়াতে। দুইটা স্পটই অনেক জোস। যেহেতু বাকি সব স্পট বাইক নিয়েই দেখতে হবে তাই ভাবলাম পরদিন সকালে দেখবো আর রাতটা নৌকায়ই কাটিয়ে দিবো, তাই থানায় এন্ট্রি করা হলো।

টাঙ্গুয়ার হাওর

রাতে নয়নাভিরাম নীলাদ্রী লেকের পাড়ে আড্ডা দিয়ে, রাতের খাবার খেয়ে নৌকায় উঠলাম রাত সাড়ে দশটার দিকে। নৌকা ঘাট থেকে সড়িয়ে হাওরে নোঙ্গর ফেলা হলো। রাতে আড্ডা দিয়ে, কার্ড খেলে, ঘুমিয়ে সকালে উঠে দেখি বৃষ্টি। তাও বের হয়ে গেলাম আগের দিনের ঠিক করে রাখা পাঁচটা বাইক নিয়ে।

চতুর্থদিনের প্রথমেই দেখলাম শিমুলবাগান। শিমুল বাগান শীতকালেই নাকি বেশি সুন্দর, তাও বৃষ্টিতে খারাপ লাগেনি। তারপর জাদুকাটা নদী আর বারিক্কাটিলা দেখতে গেলাম। একপাশে পাহাড়ে মেঘের ভেলা তার নিচে নদী, চোখে প্রশান্তি চলে এলো। মনে হলো সাজেক এ আছি। বৃষ্টি হওয়ার কারণেই এরকম মেঘ,পাহাড় নদী হয়তো একসাথে দেখলাম। বৃষ্টিদেবতাকে একটা ধন্যবাদ দেয়াই যায়…

বারিক্কাটিলা

তারপর টেকেরঘাট বাজারে নাস্তা করে আবার হাউরের সৌন্দর্য্য দেখতে দেখতে চলে আসলাম তাহিরপুর। ওখানে ডাকবাংলো থেকে ব্যাগ গুছিয়ে, ফ্রেশ হয়ে সিএনজি করে আবার সুনামগঞ্জ। ডাকবাংলোর দুইটা রুমের ভাড়া ১০০০ টাকা পুরোটাই লস, ওখানে আমাদের ব্যাগগুলো ছিলো শুধু একরাত…

সুনামগন্জ লাঞ্চ করে দেখে আসলাম হাসন রাজার মিউজিয়ামে, অনেক কিছু দেখলাম, জানলাম, শুনলাম। এরপর সুনামগন্জ থেকে সন্ধ্যা সাতটার বাসে (সৌদিয়া) পরদিন সকালে এসে নামলাম চট্টগ্রাম। শেষ হলো স্বপ্নময় চারটা দিন…

খরচ

এবার আসি খরচের দিকে। বাস আর ট্রেনভাড়া বাদ দিয়ে আমাদের জনপ্রতি খরচ হয়েছে ৩৮০০ টাকার মত, পার্সোনাল খরচ বাদে। সিলেটে প্রথম দুই দিন হোটেল ভাড়া ছিলো তিন রুম ৩০০০ টাকা। আর প্রথমদিন লেগুনা নিয়েছিলো ২৫৫০; দ্বিতীয় দিন ২৯৫০ টাকা। প্রথমদিন জাফলং এ বোট ভাড়া ছিলো ৫৫০, লালাখালে বোট ভাড়া ছিলো ১২৫০ ; দ্বিতীয়দিন বিছানাকান্দি,পান্থুমাই বোট ভাড়া ছিলো ১৮০০ টাকা, তৃতীয়-চতুর্থ দিন টাঙ্গুয়ার হাউরের বোটভাড়া ছিলো ৪৫০০ টাকা (একদিনের জন্য ভাড়া করেছিলাম ২৫০০ দিয়ে,পরে রাত কাটানোর জন্য টাকার পরিমান বাড়াতে হয়েছে) + মাঝিদের রাতের ডিনার খরচ, সন্ধ্যা-সকালের নাস্তা খরচ; বাইক ভাড়া প্রতি বাইক ২০০ টাকা।

Leave a Comment
Share