সুন্দরবনে হাইকিং জানুয়ারী ২০১৯

জনশ্রুতিতে জানা যায় আজ থেকে সাড়ে তিনশ বছর আগে কিছু পর্তুগীজ বসতি গড়েছিল সুন্দরবন (Sundarbans) এর গহীনে। তারা গড়ে তুলেছিল দুর্গ আর মন্দির – যা আজ ধ্বংসাবশেষ। আমরা ৪৫ জন Travelers of Bangladesh (ToB) এর সুন্দরবন হাইকিং ইভেন্ট এ গিয়েছিলাম সেই মন্দিরের খোজে। নিয়াজ ভাই ইভেন্ট বর্ণনায় লিখেছিলেন “সচরাচর যেসব টুরিস্ট স্পটে সবাই যায় আমরা সেদিকে যাবোই না!” এবং “শুধুমাত্র আগে যারা ২/১ বার সুন্দরবন গেছেন, কটকা করমজল হেটে এসে আর লঞ্চে প্রচুর পরিমান খেয়ে মন ভরে নি! আরেকটু বেশী কিছু এডভেঞ্চার করতে পারলে ভাল লাগত বলে মনে করেন তারা যাওয়ার জন্য বিবেচিত হতে পারেন। “ অতৃপ্তি পূরণের সুযোগ হিসেবে এই সিজনে তৃতীয়বারের মত সুন্দরবন যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। অনেক শর্ত ছিল। আমার অনেক ঘাটতি ছিল। তারপরও ইভেন্ট এডমিন প্যানেল আমাকে সুযোগ দেয়, এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ।

সুন্দরবন এর সকাল

যাত্রার দিন আমরা সায়দাবাদ থেকে রওয়ানা দেই সন্ধ্যা ৬ টার দিকে। গভীর রাত ৩টায় আমরা মংলা পৌছে নির্ধারিত লঞ্চে উঠে পড়ি। সবাই লঞ্চে উঠার পরই আমাদের যাত্রা শুরু হয় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য সুন্দরবনের উদ্দেশ্যে। আমরা যেসব জায়গায় গিয়েছি –

  • গিলার বন (প্রথম দিন)
  • তিন কোনা আইল্যান্ড (দ্বিতীয় দিন)
  • হিরণ পয়েন্ট (দ্বিতীয় দিন)
  • বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড (দ্বিতীয় দিন)
  • শেখেরটেক (তৃতীয় দিন )
বণ্য শুকর

এই ট্রিপে আমি প্রথম বারের মত দেখেছি কুমিড় (৪ টা), বন মোরগ (৮ থেকে ১০ টা), অসংখ্য বন্য শূকর, গিলা গাছ। এছাড়া বানর, হরিণ, বিচিত্র রকমের পাখি, জেলি ফিশ, নানা পদের গাছপালা এসব তো ছিলই। ১ থেকে ৪ নম্বর স্পট ছিল সহজ কিন্তু এডভেঞ্চারাস।

প্রথম দিন গিলার বনে যাওয়ার পথে মাছ ধরার নৌকা থেকে একজন জেলেকে অনুরোধ করে আমাদের ট্রলারে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় পথ চেনার সুবিধার জন্য। বনে আমরা হাইকিং এ নামি। উদ্দেশ্য ছিল প্রায় ১ কিঃমিঃ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত গিলা গাছ খুজে বের করা। প্রথমে খুজে না পেলেও, বনের আরও গহীনে প্রবেশ করে আমরা সেটা বের করতে সক্ষম হই।

চিত্রা হরিণ, সুন্দরবন

দ্বিতীয় দিন ভোরে তিন কোনা আইল্যান্ড এ যাওয়ার পথে লঞ্চ থেকে দেখতে পাই নদীর পাড়ে একটা কুমির সকালের মিষ্টি রোদ পোহাচ্ছে। লঞ্চের ভটভট শব্দে একটা সময় সে স্লাইড করে নেমে যায় পানিতে। পরে আরো দুইটা কুমিড় দেখি লঞ্চ থেকেই। তিন কোনা আইল্যান্ডে আমরা বোটে করে ক্যানেল ক্রুজিং করি। দেখা পাই হরিণ, বন্য শুকর, বানর আর বিচিত্র রকমের পাখির। একটা দ্বীপে নেমেছিলামও। হরিণের পানি পান করার জন্য খোড়া ছোট পুকুর পর্যন্ত হেঁটে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে লঞ্চে ফিরে চলে যাই হিরণ পয়েন্ট। হিরণ পয়েন্টেও চলে ক্যানেল ক্রুজিং। দেখা পাই বেশ কয়েকটি বন মোরগ, বন্য শুকর আর আরো একটা কুমিরের। এছাড়া হরিণ বানর পাখি এসব তো ছিলই। সবচেয়ে মজার দৃশ্য ছিল একটি বন মোরগের চওড়া খালের এপার থেকে ওপারে উড়ে যাওয়ার দৃশ্য। এই দৃশ্যটি ক্যামেরা বন্দী করেন আমাদের ট্রিপ সঙ্গী রকিব ভাই।

হিরণ পয়েন্টের ওয়াচ টাওয়ার, কাঠের ট্রেইল পুরোটা হেঁটে নদীর পাড়ে আসি আমরা। ওপারেই ছিল অফিস পাড়া, টাওয়ার আর বিশ্ব ঐতিহ্য মনুমেন্ট। এ জায়গায় যে কোন সাধারণ সুন্দরবন ইভেন্টে যাওয়া যায়। তাই ওদিকে না যেয়ে আমরা চলে যাই সরাসরি বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড। কি আছে এখানে? আছে নরম বালির বিচ, পাখি, লাল কাঁকরা, হরিণ, গাছপালা আর ছনবন। দ্বীপটির বেশীরভাগ অংশই আমরা হাইক করি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সময় ঘন ছন বনের ভিতর দিয়ে হেঁটে আসার সময় ভয় পেয়েছিলাম! হরিণ যেহেতু আছে বাঘও থাকতে পারে!

বঙ্গবন্ধু আইল্যান্ড

না, ট্রিপে বাঘ মামার দেখা আমরা পাইনি। তবে তার আস্তানা ঘুরে এসেছি। তৃতীয় দিন ভোরে আমরা যে জায়গায় গিয়েছিলাম তা ছিল পর্তুগীজদের প্রাচীন বসতির ধ্বংসাবশেষ। এখানে সেখানে ছড়ানো ছিটানো ইট আর ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনা দেখে বুঝা যায় একসময় মানুষের পদচারনা ছিল। চারদিকের পরিবেশই বলে দেয় এই জায়গা এখন বাঘ মামার আস্তানা। বোট থেকে জঙ্গলে নেমেই নিরাপত্তা রক্ষীরা অনেকগুলো পটকা ফুটায় যাতে বাঘ মামা একটু দূরেই থাকে। ইভেন্টই লেখা ছিল “বাঘ দেখাটা লঞ্চ থেকে দেখা সৌভাগ্য হতে পারে, সামনা সামনি দেখাটা চরম দূর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই না!” ব্যাপারটা আমরা পরে বুঝতে পেরেছি। আমরা তাকে না দেখলেও সে কিন্তু আমাদের ঠিকই দেখেছে! সার্বিক নিরাপত্তার কথা ভেবে বাঘকে দূরে রাখতে বন রক্ষীরা কিছুক্ষণ পর পরই পটকা ফুটাচ্ছিল। বাঘ মামা দূরে থাকলেও রেখে গেছে তার পায়ের তাজা ছাপ। তাতে ভয় শিহরণ আর বিস্ময়ের সাথে ছিল হাজারো ক্লিক!

সেখান থেকে ফিরে দুপুরে না খেয়েই চলে যাই কাছাকাছি আরেকটা দ্বিপে হাইকিং এ। এটা যে এত এক্সট্রিম মাত্রার হবে তা আগে বুঝি নি! অনেক জায়গায় ঘন জঙ্গলে গাছের ডাল কেটে পথ তৈরী করে নিতে হয়েছে, নামতে হয়েছে কোমড় পর্যন্ত ডুবা কাঁদায়, পথ হারিয়ে ঘুরপাক খেতে হয়েছে একই জায়গায়। এরপর একটা আগ্রবর্তী টিম সবাইকে বিশ্রামে রেখে এগিয়ে যায় মন্দিরে খোজে। মন্দির শেষ পর্যন্ত খুজে পাওয়া যায় নি। তবে আমরা খুব কাছাকাছি গিয়েছিলাম। পরে শুনেছি আর ১০ মিনিট পশ্চিমে গেলেই দেখা মিলত কাঙ্ক্ষিত মন্দিরের। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের ফিরে আসতে হয় বোটে। কিছুটা অতৃপ্তি রয়েই গেল। এই অতৃপ্তিই নেশা ধরিয়ে দিয়েছে আবার যাওয়ার!

বাঘের পায়ের ছাপ

চতুর্থ দিন শুধুই ফেরার পালা। প্রথমে সুন্দরবন থেকে খুলনা, তারপর রাতের ট্রেনে ঢাকা। ফেরার পথেও ছিল সারপ্রাইজ। খুলনার দাকোপের একটি গ্রামে আমাদের নামিয়ে দেয়া হয় (কাতিয়ানাংলা বাজার)। সেখান থেকে বাটিয়াঘাটা বাজার পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলো পাঁকা রাস্তা পায়ে হেঁটে এসেছি। এক কথায় বলতে গেলে ট্রিপটা ছিল এডভেঞ্চার আর সারপ্রাইজে ভরপুর।

এরকম একটি এক্সট্রিম লেভেলের হাইকিং এর আইডিয়া ও প্লানিং এর জন্য তালাশ ভাই এবং নিয়াজ ভাইকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ। আরো ধন্যবাদ জানাচ্ছি যারা নেপথ্যে থেকে এই ইভেন্ট সফল করার জন্য কাজ করেছেন। এই ট্রিপে ৪৫ জন সমমনা ট্রিপমেট বন্ধু পেয়েছি। অনেকেই প্রয়োজনে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অনেকের সাথেই হয়তো ঠিকমত পরিচয়ই হয়নি, কিন্তু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে রেখেছেন সবসময়। ট্রিপমেট সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। অরেকজন হচ্ছেন রকি ভা্‌ই, Mehdi Tourism আর Katka Express জাহাজের মালিক। তার সহযোগিতার কারণেই আমরা ইভেন্টটি সফল ভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হই। এছাড়া বন রক্ষীবৃন্দ এবং লঞ্চের সকল স্টাফদের কথা না বললেই নয়। তারা আমাদের ট্রিপটাকে আনন্দময়, ঝামেলামুক্ত ও বিপদমুক্ত রাখার জন্য সব সময় তৎপর ছিলেন। তাদের সবাইকে ধন্যবাদ।

কুমির

অনেক তৃপ্তি আর কিছুটা অতৃপ্তি নিয়ে ফিরে এসেছি শহরে। কিন্তু নেশা ধরে গেছে! এই ট্রিপে অংশগ্রহণের কারণে পরবর্তী সুন্দরবন হাইকিং এর ফিট লিস্টে আমি নিশ্চয়ই এগিয়ে থাকব!

বিঃদ্রঃ আমরা যেসব স্পটে গিয়েছিলাম, খুব কম লোকই সেসব জায়গায় যায়। তাই স্পটগুলোর কোথাও কোন ময়লা ছিল না। আমরাও ফেলি নাই। কেউ ভুল করে ফেললেও পেছনের জন তা তুলে নিয়ে এসেছে। বেড়াতে গিয়ে ময়লা ফেলে আমরা পরিবেশ দূষণ না করি।
Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ hikingsundarbansundarbans