কালিম্পং

দার্জিলিং এর ৫০ কিলোমিটার পূর্বে কালিম্পং (Kalimpong) ছোট একটি শহর। এটি ১২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। একসময় এই শহর দিয়েই ভারত-তিব্বতের মধ্যে বাণিজ্য চলত। কালিম্পং শব্দের মধ্যেই এর ইতিহাস লুকিয়ে আছে। এই শহরে এক সময় ভূটানের রাজ্যপালের কেন্দ্রীয় দফতর ছিল। ‘কালিম’ শব্দের অর্থ ‘রাজার মন্ত্রী’ এবং ‘পং’ শব্দের অর্থ ‘ক্ষমতার কেন্দ্র’। শৈবালদামের ওপর পা ফেলে সোনালি ওক গাছের ঘন অরণ্যের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাওয়া কালিম্পং-এর অন্যতম আকর্ষণ। কালিম্পং এর চমৎকার আবহাওয়া এবং এর কাছাকাছি অঞ্চলে আরও বেশ কিছু পর্যটন কেন্দ্র থাকায় ভ্রমণপিপাসু মানুষের অন্যতম ঠিকানা হয়ে উঠেছে এই শহর।

কালিম্পং এর দর্শনীয় স্থানসমূহ

গৌরিপুর হাউস

শহর থেকে চার কি:মি: দক্ষিণ পূর্বদিকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদচিহ্নকে ধারণ করে আছে বিখ্যাত গৌরিপুর হাউস। স্থানীয়ভাবে ‘চিত্রাভানু’ নামে পরিচিত। মংপু যাওয়া-আসার পথে রবীন্দ্রনাথ প্রায়ই এখানে অবকাশ যাপন করতেন। পাহাড়ী টিলায় অবস্থিত এই শান্ত নির্জন পরিবেশে এসে রবীন্দ্রনাথের ‘চির আমি’ কবিতার সেই বিখ্যাত লাইন মনে পড়ে যাবে “তখন কে বলে গো, সেই প্রভাতে নেই আমি? সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি” মনে হবে যেন আপনি রবীন্দ্রনাথের হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছেন।

রিশপ-রিম্বিক

কালিম্পং অঞ্চলের সেরা পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে মানা হয় রিশপ-রিম্বিককে। এটি লাভা থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে এবং কালিম্পং থেকে ২৮ কিলোমিটার দূরে ৮২৫০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। লাভা থেকে পাহাড়ি পথে ট্রেকিং করে পৌঁছনো যায় ‘পাহাড়ের মাথায় একলা গাছে’ (‘রিশপ’ শব্দের অর্থ)। অবশ্য লাভা থেকে রিশপ পর্যন্ত জিপ চলার পথও আছে। রিশপের রাস্তা এখনও কাঁচা। বিদ্যুৎ এখনও না পৌঁছনোয়, এখানে থাকার মধ্যে একটা মধ্যযুগীয় অনুভূতির মজা আছে। অপার সৌন্দর্যের আধার রিশপ। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন হাতের কাছে। স্থানীয় শেরপা ও লেপচারা কটেজের মতো বেশ কিছু পর্যটকদের থাকার জায়গা বানিয়েছেন। নাথুলা পাস, তিন সীমানা, গ্যাংটক, তিব্বতের পাহাড়গুলি সহ এখান থেকে হিমালয়ের অসাধারণ দৃশ্য চোখ পড়ে।

লোলেগাঁও

কালিম্পং-এর একটি ছোট্ট, শান্ত গ্রাম হল লোলেগাঁও। এটি অপূর্ব সুন্দর । ঘন সবুজ অরণ্য এবং শান্ত উপত্যকার লোলেগাঁওকে প্রকৃতি অকৃপণ হাতে দান করেছে। ভোরের কুয়াশায় মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। কালিম্পং ও লাভা থেকে পাইনের জঙ্গলে ঘেরা আঁকাবাঁকা পথ ধরে লোলেগাঁও যেতে এক ঘণ্টা সময় লাগে। বনবাংলোর বারান্দায় বসে অদূরের কালিম্পং শহর দেখো। সন্ধ্যে নামলে এ যেন এক অপরূপ দৃশ্য। মনে হয় অগুনতি জোনাকি দীপ জ্বালিয়ে রেখেছে পাহাড়চুড়োয়। এখানে বসে বসেই সময় কাটিয়ে দেওয়া যায়।

ডেলো পাহাড়

ডেলো পাহাড়টি কালিম্পংয়ের সবচেয়ে উঁচু পয়েন্ট। এখান থেকে কালিম্পং শহরটির শোভা সবচেয়ে ভালো দেখা যায়।

কালিম্পং আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্ট সেন্টার

কালিম্পংয়ের কালিম্পং আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্ট সেন্টারে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নানা ঐতিহাসিক সামগ্রী রয়েছে।

তিস্তা বাজার

কালিম্পংয়ে এলে প্রায় সব পর্যটকই এই বাজারে আসেন। সস্তায় নানা সামগ্রী পাওয়া যায় এখানে।

রোমান ক্যাথলিক চার্চ

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে এখানে রোমান ক্যাথলিক চার্চ গড়ে ওঠে।

জাং ঢোক পালরি ফোডাং

কালিম্পংয়ে অনেক বৌদ্ধ মনাস্ট্রি রয়েছে। এর মধ্যে জাং ঢোক পালরি ফোডাং মনাস্ট্রিটি বিখ্যাত।

ম্যাক ফারলেন চার্চ

স্কটিশ মিশনারিরা ১৮৯১ সালে এই চার্চটি তৈরি করেন।

মর্গ্যান হাউস

ব্রিটিশ আমলে তৈরি কালিম্পংয়ের অন্যতম পুরনো বাংলো এটি।

সায়েন্স সিটি

সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত এই সায়েন্স সিটিতি ডেলো থেকে এক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত। পাহাড়ের কোলে এই জায়গাটি বাচ্চাদের অন্যতম পছন্দের জায়গা।

টসোঙ্গাঁ গুম্ফা

দার্জিলিং জেলার সবচেয়ে পুরানো ভুটানি আশ্রম এটি যা ভুটানীদের কালিম্পং দখলের সাক্ষ্য বহন করছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে এই আশ্রমটি ১৬০০ সালের দিকে স্থাপিত। সার্জন রেনে এই মঠটিকে ‘টুসো চিম্পা’ নামে অভিহিত করেছেন।

জ্যাং ঢোগ পালরী ফোডাং

শহর থেকে তিন কি:মি: দক্ষিণ পূর্ব দিকে ডুরপিন পাহাড়ের চূড়ায় ১৩৭২ মিটার উচ্চতায় এটি অবস্থিত। ডুরপিন মনাষ্ট্রি নামেও এটি পরিচিত। কালিম্পং এর সবচেয়ে বড় এই মনাষ্ট্রিকে ১৯৭৬ সালে বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু দালাইলামার নামে উৎসর্গ করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরুদের গেরুয়া বসন, মন্ত্রোচ্চারণের মন্দ্র সুর, ঘন্টাধ্বনি, ধূপের ধোঁয়া এবং গোধূলির মায়াবী আলো প্রতিদিন বিকালে এখানে এক অতিন্দ্রিয় পরিবেশের সৃষ্টি করে। মন চাইলে আপনিও এই প্রার্থনা সভায় যোগদান করতে পারেন।

লেপচা মিউজিয়াম

ইতিহাস মনস্ক পর্যটকদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্রস্টব্য। লেপচাদের জীবন জগত ও সংস্কৃতির নানা ধরনের লিখিত নিদর্শন ও লেপচা বাদ্যযন্ত্রের সমাহার রয়েছে এখানে। শহর থেকে এক কি:মি: দূরত্বে অবস্থিত।

পাইনভিউ নার্সারী

এটি ক্যাকটাস নার্সারী নামেও পরিচিত। কালিম্পং এর পর্যটক আকর্ষণের অন্যতম জনপ্রিয় কেন্দ্র এটি। শহরতলীতে অবস্থিত এই নার্সারীতে বিশ রুপি দর্শনীর বিনিময়ে আপনি প্রায় পনের’শ ধরনের বিরল প্রজাতির অপূর্ব সব ক্যাকটাসের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। ক্যাকটাস সংগ্রহের দিক থেকে এটি এশিয়াতে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে।

হনুমান মন্দির

পাহাড়ের শীর্ষে স্থাপিত পঁচিশ থেকে ত্রিশ ফুট উঁচু ধাতব কাঠামোর লাল রংয়ের হনুমান দেবতার জন্য বিখ্যাত স্থানটি। এখান থেকে যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই হিমালয়ের অপরূপ সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। হনুমান দেবতার স্থাপনার ঠিক সম্মুখে ডান দিকে দেবী দূর্গার একটি ছোট্ট মন্দির রয়েছে। পর্বতের শান্ত পরিবেশ, পাইন বনের মৌনতা আর ভক্তদের আনাগোনা আপনাকে জগতের সৃষ্টি রহস্য ও পার্থিব জীবনের অসারতা সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করবে।

কালিম্পং ভ্রমণের সময়

সারা বৎসর মোটামুটি আরামদায়ক জলবায়ু থাকে। তবু কালিম্পং ভ্রমণের উপযুক্ত সময় মার্চ থেকে জুন এবং সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্র“য়ারী মাস পর্যন্ত। গ্রীষ্মের মৃদুভাবাপন্ন আবহাওয়া ও পাহাড়ের গাছে গাছে নতুন কুড়ির সজ্জা এবং শরৎ ও শীতের রৌদ্রকরোজ্জল আবহাওয়া, স্বচ্ছ নীলাকাশ ও হিমালয়ের তুষারশৃঙ্গের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য স্বততই পর্যটকদের আবাহন জানায়।

কালিম্পং কিভাবে যাবেন

কালিম্পং ভ্রমণের জন্য বাংলাদেশী যাত্রীদের লালমনিরহাটের বুড়িমারী চেকপোষ্ট দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করা শ্রেয়। ভারতীয় অংশের চ্যাংড়াবান্ধা থেকে শিলিগুড়ির দুই ঘন্টার দূরত্ব প্রাইভেট ট্যাক্সি অথবা শেয়ারড ট্যাক্সিতে যেতে পারেন। অতঃপর শিলিগুড়ি থেকে সড়কপথে প্রাইভেট ট্যাক্সি বা বাসযোগে কালিম্পং গমন। সময় লাগবে ২.৩০ মিনিট। ভাড়া ৪০-৬০ রুপি।

কলকাতা হয়েও যেতে পারেন। কলকাতা থেকে কালিম্পং এর দূরত্ব ৬৪৬ কি:মি:। কলকাতার শেয়ালদা থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টায় দার্জিলিং মেইল নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সময় লাগে ১২ ঘন্টা। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে বাস, মিনিবাস অথবা জিপ যোগে কালিম্পং যেতে তিন ঘন্টা সময় লাগবে। কলকাতার উল্টোডাঙ্গা বাস টার্মিনাল থেকেও আপনি ঘইঝঞঈ এর বাসে সরাসরি কালিম্পং যেতে পারেন।

কালিমপং থেকে নিকটবর্তী বিমানবন্দর শিলিগুড়ির নিকট বাগডোগরায় অবস্থিত। বাগডোগরা থেকে কালিমপং প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাংশে অবস্থিত বাগডোগরা হল একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দেশীয় বিমান-বন্দর, যেখানে কলকাতা, দিল্লী থেকে নিয়মিত ভাবে বিমান পরিষেবা চালু রয়েছে।

কোথায় থাকবেন

পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তরের একাধিক টুরিষ্ট লজ রয়েছে এখানে। বাসস্ট্যান্ডের এক কি:মি: দূরে মেইন রোডে মর্গান টুরিষ্ট লজ, দুই কি:মি: দূরে ডুরপিন দাঁড়ার পথে কালিম্পং টুরিষ্ট লজ, এর পাশে তাশি টুরিষ্ট লজ এবং হিলটপ টুরিষ্ট লজ। সামর্থ্য অনুযায়ী বেসরকারী হোটেলের আবাসনও বেছে নিতে পারেন। অপেক্ষাকৃত ভালো মানের হোটেল হচ্ছে- ডেকি লজ, হোটেল সিলভার ওক্স, হিমালয়ান হোটেল, জেপি লজ, কালিম্পং পার্ক হোটেল, হোটেল মাউন্টেন ভিউ প্রভৃতি।

কিছু হোটেলের ফোন নাম্বার দেয়া হলোঃ

  • সিলভার ওকস (স্টার), রিংকিংপং রোড, কালিম্পং। ই-মেইলঃ newelgin@cal.vsnl.net.in ফোনঃ +৯১৩৫৫২ ২৫৫৩৬৮ / ২৫৫৭৬৬ / ২৫৫২৯৬
  • কালিম্পং পার্ক হোটেল, রিংকিংপং রোড, কালিম্পং। ফোনঃ +৯১৩৫৫২ ২৫৬৬৫৬
  • হোটেল হিমালয়া (হ্যারিটেজ), আপার কার্ট রোড, কালিম্পং। ই-মেইলঃ himhot@dte.vsnl.net.in ফোনঃ +৯১৩৫৫২ ২৫৫২৪৮
  • হলুম্বা, কালিম্পং। ফোনঃ +৯১৩৫৫২ ২৫৬৯৩৬
  • ডেলো ট্যুরিস্ট লজ, ডেলো, কালিম্পং। ফোনঃ +৯১৩৫৫২ ২৭৪১০১
  • দূরপীন ট্যুরিস্ট লজ, দূরপীন, কালিম্পং। ফোনঃ +৯১৩৫৫২ ২৮৫৫১৪০
  • আলকানান্দা গেস্ট হাউজ, আপার কার্ট রোড, কালিম্পং। ফোনঃ +৯১৩৫৫২ ২৫৬২৫

কেনাকাটা কোথায় করবেন?

কালিম্পং এ কেনাকাটা একটি দারুণ অভিজ্ঞতা। কাঠখোদাই কারুকার্য এই অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যগত নৈপুণ্য। বিশাল সংখ্যক তিব্বতি মানুষ তাদের হস্তশিল্পের সঙ্গে কালিমপং এর দিকে তাদের মার্গ তৈরি করেছে। কালিমপং এ যে সমস্ত ব্যাক্তি কেনাকাটা করতে যান, তাদের কাছে তিব্বতি পশমী-বস্ত্র, গহনা-অলংকার ও নুডলস অত্যন্ত প্রিয়। আপনি যদি কোনও স্মারক কিনতে চান, তবে কালিমপং এ কেনাকাটা করার সময় ট্যাপেষ্ট্রি ব্যাগ, তাম্রলিপ্ত বস্তু, পার্চমেন্ট ও চিত্রাঙ্কন খুঁজে নিতে পারেন। সতেজ আদা, মধু ও একটি বিশেষ ধরনের শক্ত পনির কালিমপং-এ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। কালিম্পং এ কেনাকাটার জন্য এগুলিও খুবই জনপ্রিয় জিনিষ।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ indiakalimpong