সাজেক ভ্রমণ – রুইলুই পাড়ায় ৩ দিন

সৌন্দর্যকে লিখে বা ছবি দেখিয়ে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমাদেরকে দেওয়া হয়নি। আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হবার ক্ষমতা, বিস্মিত হবার ক্ষমতা। সাজেকের সকাল আমাদের বিস্মিত করে, মুগ্ধতার শেষ বিন্দু পর্যন্ত নিয়ে যায়।

৭ অক্টোবর। সাজেক এ প্রথম সকাল এবং দ্বিতীয় দিন। ভোর সোয়া পাঁচটায় ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম ভাঙ্গা মাত্রই কাল বিলম্ব না করে সোজা বারান্দায় চলে যাই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এতোদিন শুনেছি সাজেক এর ভোর নাকি অপার্থিব হয়? এবং সত্যিই তাই! অপার্থিব! রাতের বেলা দেখেছিলাম উপত্যকায় মেঘ জমতে আর সকালে একি দেখছি! ডানে আর বামে দৃষ্টি কে যতদূর মেলে দেওয়া যায় শুধু মেঘ আর মেঘ। পুরো উপত্যকা শুভ্র মেঘে ঢেকে আছে। এ যেন শান্ত, ঢেউহীন স্থির এক পাহাড়ি নদী। মেঘের নদী। মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই বুঝলাম শীত লাগছে। একটু পর রুম থেকে কম্বলটা এনে গায়ে জড়িয়ে আবার বসে রইলাম। বাকরুদ্ধ, স্থির; সৌন্দর্যের দংশনে বিষধর সাপে কাটা মৃত মানুষের মত।

লুসাই পাহাড়ের মাথায় তখন লম্বাটে করে লালচে আলোর রেখা। আর তার একটু উপরে শুকতারা একাই তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। চোখের সামনে মেঘের নদী নিয়ে আমি বসে ছিলাম পাহাড়ের ঐ পাড় থেকে সূর্যটা কখন উঁকি দেবে! এক সময় পাহাড় ডিঙ্গিয়ে সূর্যটার দেখা মিলল। গোলাকার, লালচে জ্বলন্ত অগ্নিপিন্ড একটা। ধীরে ধীরে পাহাড়ের বলয় থেকে নিজের দেহটাকে পুরো পুরো বের করে নিয়ে আসল। ধবল মেঘের উপর বিছিয়ে দিল হলদে নরম আলো। এবার শান্ত মেঘের নদী তার সর্বোচ্চ সৌন্দর্যটুকু মেলে ধরল চর্ম চোক্ষে। প্রকৃতির এমন দৃশ্য মানব-মানবীকে হাত ধরাধরি করে দেখতে হয়। প্রবল মুগ্ধতার মাঝে থেকেও আমি একটা হাতের শূন্যতা তীব্রভাবে অনুভব করতে লাগলাম!

সেই ভোর ৫ টা থেকে ৭ টা পর্যন্ত বারান্দায় বসে রইলাম। সৌন্দর্যকে দুটো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। Aggressive Beauty এবং Soft BeautyAggressive Beauty‘র দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না, Soft Beauty ঠিক তার উল্টো। সাজেকের এ সৌন্দর্য হল সফট বিউটি। ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকলেও ক্লান্তি আসবে না।

সাড়ে ৭ টায় রুম থেকে বের হলাম, হেঁটে হেঁটে একদম কংলাক পাড়া যাব বলে। প্রায় ২০০০ ফুট উঁচু কংলাক পাড়াকে বলা হয় রাঙ্গামাটির ছাদ। আমার গন্তব্য সে ছাদে। রুইলুই পাড়া থেকে কংলাক পাড়ার দিকে হাঁটা ধরলাম একা একা। পাহাড়ের দু’ধারের উপত্যকা দুধ সাদা মেঘে ঢেকে আছে। হাতের ডানে যদি মেঘের নদী হয় তো বামে মেঘের সমুদ্র! সে সমুদ্রে কয়েকটা পাহাড় চূড়া দ্বীপের মত জেগে আছে। কিন্তু এমন দৃশ্য দেখায় বার বার বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা মাত্রাতিরিক্ত রিসোর্ট বা কটেজ। এরা যেন সাজেকের কলংক! এ কলংক থেকে মুক্তি মেলে হ্যালিপ্যাড-১ এ এসে।

হ্যালিপ্যাড থেকে দুই চোখ ভর্তি করে মুগ্ধতা নিয়ে হাঁটা ধরলাম কংলাকের উদ্দেশ্যে। ছোট্ট, সহজ একটা ট্রেকিং রুট। একটাই পথ একদম কংলাকের চূড়ায় পৌছে দেবে। একা এমন পথে ট্রেকিং করার মজাই আলাদা। একটু ব্যতিক্রমী ট্রেকিং ছিল এটা। কাঁধে ব্যাগ নেই, হাতে পানির বোতল নেই। ট্রেকার না হয়ে যেন কবি বনে গেলাম পুরো পথে! গায়ে নীল পাঞ্জাবী, হাতে হূমায়ুন এবং সুনীলের দুটো উপন্যাস। মোবাইলে মৃদু শব্দে রবীন্দ্রসংগীত বাজছিল। আর পথের দুপাশেই মেঘের ভেলা।

কংলাক পাহাড়ের মাথায় কংলাক পাড়া। পাথরের খাঁজ কাটা পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে পাড়ায় পা রাখতেই চোখে পড়বে বেশ কিছু মেমোরিয়ালস! পাথুরে পাহাড়ে পাথুরে স্মৃতিফলক। কংলাকে স্বাগত জানায় মৃতরা! কংলাক পাড়াটা সুন্দর। এখানে সেখানে নানা রকম ফুল গাছে ভরা। বেশির ভাগেই হলুদ এক ধরনের ফুল ফুটে আছে। এ যেন Flower Mountain!

কংলাকে নাস্তা করে এদিক সেদিক ঘুরে একটা নির্মানাধীন গির্জা পেলাম। গীর্জায় প্রার্থনা সংগীত চর্চা করছেন দু’জন ভদ্রমহিলা। পাশেই একজন ইন্সট্রুমেন্ট বাজাচ্ছে। চোখের ইশারায় অনুমতি নিয়ে গির্জায় গিয়ে বসলাম। গির্জায় অনেকগুলো লম্বা বেঞ্চ। কোন একটা বেঞ্চে জানালার পাশে বসে রইলাম। জানালার ওপাশে উপত্যকায় শুভ্র মেঘ জমে আছে। মোহনীয় প্রার্থনা সংগীতে জায়গাটাতে স্বর্গীয় একটা আবেশ। আমি হুমায়ূন আহমেদের “নীল অপরাজিতা” নিয়ে জানালার পাশে বইতে ডুবে গেলাম। বই থেকে মুখ উঠিয়ে যখন জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই তখন একটা কথায়ই মাথায় আসে, Heaven is not far away

কংলাক থেকে ফিরে এসে খেয়েই ঘুম দিলাম। এক ঘুমে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। বিকেল হতেই আবার হ্যালিপ্যাডে যাওয়া। হ্যালিপ্যাড থেকে সূর্যাস্তের ভিউটা চমৎকার পাওয়া যায়। পুরো সাজেকের ভ্রমণকারীরা হ্যালিপ্যাডে ভীড় জমিয়েছে। পশ্চিমাকাশে পাহাড়ের মাথায় সূর্যটা তখন লালচে থেকে কিছুটা কালচে হয়ে পাহাড়ের আড়ালে ডুবে যাচ্ছিল। দর্শনার্থীদের বড় একটা অংশ সে দৃশ্যটা চোখের সামনে পেয়েও দেখছে না। তারা ব্যস্ত ক্যামেরার স্ক্রীন নিয়ে। DSLR‘র মত ভারী ভারী যন্ত্রের স্ক্রীনে এ দৃশ্যটা হয়তো আরো বেশি সুন্দর!

এক সময় সাজেক এর আকাশে সন্ধ্যা নামল। কৃষ্ণপক্ষের ২য় রাত। তাই মস্ত বড় চাঁদটা উঠতে বিলম্ব হবে। অন্ধকার জমাট বাঁধতেই আকাশে ফুটতে শুরু করেছে একের পর এক তারা। ডানে-বামে, সামনে-পিছনে নক্ষত্রেরা আস্ত আকাশটাকে ঢেকে দিল।

হ্যালিপ্যাডের পূর্ব দিকের কোনা ঘাসের উপর শুয়ে পড়লাম। মাথার উপর অনন্ত নক্ষত্রবীথি। সকালের সেই তীব্র শূন্যতাটা আবার ফিরে এলো। এমন দৃশ্য যে মানব-মানবীকে হাত ধরাধরি করে দেখতে হয়। পুবাকাশ থেকে পশ্চিমে, সরু, লম্বাটে এক নক্ষত্রের নদী। এর গ্রন্থগত নাম “আকাশগঙ্গা”। যে নদী বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রকে তার বুকে স্থান করে নিয়েছে। শুধু মাত্র তারা দেখার জন্য হলেও মানুষকে কৃষ্ণপক্ষে সাজেক আসা উচিত। আমি ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে আকাশগঙ্গা দেখি। এতো তারা একসাথে আগে কখনো দেখা হয়নি। আর আকাশগঙ্গা এতো স্পষ্ট হতে পারে সাজেক না এলে জানতামই না।

সাজেকে এসেই বলেছিলাম সাজেক আমার ভালো লাগেনি। হয়তো তাই সাজেক একের পর এক সারপ্রাইজ প্যাকেজ নিয়ে আমার সামনে হাজির হয়েছে।

রাতের নক্ষত্র, তুমি বলো দেখি কোন্ পথে যাবো ?
‘তোমারি নিজের ঘরে চ‘লে যাও’- বলিল নক্ষত্র চুপে হেসে,
‘অথবা ঘাসের ‘পরে শুয়ে থাকো আমার মুখের রূপ ঠায় ভালোবেসে’।

অনেকটা সময় তারাদের সাথে কাটিয়ে আবার রুমে ফিরে আসা। রাত একটু বাড়তেই লুসাই পাহাড়ের ঐ পাড় থেকে চাঁদ উঠল। উপত্যকায় কোমল আলো বিছিয়ে দিল। সে আলোর মায়ায় মেঘেরা এসে জমতে থাকে। রাত বাড়ে, মেঘও বাড়ে!! সাজেক এ এটাই আমার ২য় এবং শেষ রাত। সকালে আবার ভোরে উঠতে হবে। সাজেকে ৩য় দিন এবং ২য় সকাল। একটা অপূর্ণতার উৎকন্ঠা নিয়ে ঘুমাতে গিয়েছিলাম। সাজেকে বৃষ্টির দেখা কি পাব না?

Leave a Comment
Share