আজ তোমার মেঘে মেঘে রং (মেঘালয় ভ্রমণ)

Not all classroom has four walls.

জাফলং,বিছানাকান্দি ঘুরতে যাওয়ার সময় ঐ পাশের পাহাড়,ঝরনাগুলা দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতাম আর মনে মনে ভাবতাম ইশ! ঐ পাহাড়গুলোয় যদি যেতে পারতাম। মেঘ যদি ছুঁতে পারতাম। “Die with your memories not dreams” এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আমরা ৮ জন আমাদের যাত্রা শুরু করলাম মেঘালয়ের দিকে। কোন এক ঘোর বর্ষার দিনে। আমাদের গ্রুপটা ছিলো হ-য-ব-র-ল। এক এক জন এক এক জায়গা থেকে রওনা হচ্ছি। রিতুন ভাই ঢাকা থেকে কলকাতা হয়ে শিলং আসবে। বাবু ভাই আর রাসেল আসবে আগরতলা থেকে গোহাটি হয়ে। কাউছার, মাসুদ কুমিল্লা থেকে সিলেটে। আমি ঢাকা থেকে গিয়ে তাদের সাথে জয়েন করব। আর দুইজনের একজন তো তখনোও ভিসাই পায় নাই। হায় খোদা! এ কেমন টিম নিয়া বের হইলাম। 😛

রাত ১২ টার সময় শিলং এর পথে পথে ঘুরি।হোটেল পাই না।

৮ জুলাই,রাত ১০.৪০। আমি ঢাকা থেকে একাই রওনা হই। বাসে উঠে কানে হেড ফোন লাগিয়ে মার্ক নফলার ছাড়লাম। যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন প্রায় ভোর।বাস হবিগঞ্জ। জানালা দিয়ে ভোর দেখতে দেখতে যাচ্ছি। মাত্রই বৃষ্টি শেষ হলো। অবারিত সবুজে ভোরের আলো দেখে জীবননান্দের কবিতার লাইন মনে পড়লো, “ভোর,আকাশের রঙ ঘাসফড়িং এর দেহের মত কোমল!”

সিলেট গিয়ে কাউছার আর মাসুদের সাথে জুড়ি। “ভোজন বাড়িতে” তে গরুর নেহারী দিয়ে পরোটা খেয়ে রওনা হই তামাবিলের উদ্দেশ্য। বর্ডারে ঐদিন মোটামুটি ভালোই ভিড় ছিলো। ইমিগ্রেশন থেকে জানতে পারলাম আগেরদিন রেকর্ড সংখ্যক প্রায় ১০০০ মানুষ তামাবিল হয়ে বর্ডার পার হয়েছে। সবই ভিসা ক্যাম্পের কেরামতি। ইমিগ্রেশনের সব ফর্মালিটিস শেষ করতে করতে ১ ঘন্টা লেগে গেলো। ডাউকি থেকে শিলং এর উদ্দেশ্য রওনা হই দুপুর ১টায়। শিলং নামি বিকাল চারটায়।রাত এগারোটায়ও আমরা কোন থাকার জায়গা ম্যানেজ করতে পারি নাই। আমরা ও আমাদের স্থানীয় বন্ধুরা এমন কোন হোটেল-মোটেল বাকি রাখি নাই। ফাইভ স্টার থেকে জিরো স্টার কোন খানে জায়গা নাই। আমাদের হাতে তখন তিনটা অপশন। স্থানীয় থানায় সিকিউরিটি সিক করা, মসজিদে রাত্রি যাপন আর একটা মুসলিম বোডিং এ রাত্রি যাপন। বোডিং এর অবস্থা তথৈঃ বচঃ। নোংরা আর ছারপোকায় ভরা। একসাথে অনেকজনকে থাকতে হবে। কোন উপায় না পেয়ে আমরা ওখানেই গেলাম। রাত বারোটার দিকে ম্যানেজার সাথে আমাদের কথা কাটাকাটি হলে আমরা বোডিং থেকে বের হয়ে আসি। ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে রাত সাড়ে বারোটায় আমরা শিলং পয়েন্টে। রাতের শিলং দেখি। মাতাল নারী-পুরুষ, প্রমদবালা, হকাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে রঙ্গিন আলোর নিচে। খুব ক্লান্ত আমরা সবাই। শিলং এর বন্ধুকে ফোন করে বললাম যে আমরা এখনও থাকার জায়গা পাই নি। সে বললো,তোমরা যেখানে আছো সেখানে থাকো আমি গ্রেগকে নিয়ে আসছি। এর মধ্যে পুলিশের বাগড়া। অবশেষে রাত একটার দিকে তারা আমাদের শিলং পয়েন্ট থেকে পিক করে। তারা আমাদের কিছু তাবু ম্যানেজ করে দেয়। গ্রেগের বাসার পাশে আমরা তাবু গেড়ে ঐ রাতটা পার করি। ঘুম ভাঙ্গলে দেখি কি চমৎকার শিলং শহর। পাহাড়ের ভাজে ভাজে ঘর বাড়ি। ছোট ছোট বাড়িগুলা ফুল দিয়ে কি সুন্দরভাবেই না সাজানো। তাদের সৌন্দর্যবোধ খুব টনটনে। এটা তাদের ঘরবাড়ি,শহর দেখলেই টের পাওয়া যায়। বাসার সামনের নাশপাতি গাছটা ফলে ভর্তি। গ্রেগ আমাকে কয়েকটা কুড়িয়ে দিয়ে বললো,খেয়ে দেখো। তারা আমাদের জন্য চা নাস্তারও ব্যবস্থা করলো। তারপর আমরা বেরিয়ে পরলাম।

প্রথম রাতে আমাদের থাকার এই বন্দোবস্ত ছিলো। আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিং এ তাবু বিছিয়ে।

প্রথম দিনের প্রথমই আমরা সুইট ফলস এ গেলাম। সুইট ফলসে যাওয়ার রাস্তাটা বেশ সুন্দর ছিলো। আমরা নিচে নামি নি। তবে এখানে একটা ট্রেইল আছে। আপনি চাইলে ট্রেইল ধরে একদম ফলস এর গোড়ায় নামতে পারবেন।

সুইট ফলস।
পাহাড়ের গন্ধ আমার নাকে মুখে।ব্র্যন্ডির নেশায় আজ তোমার দু চোখ লাল।

সুইট ফলস থেকে আমরা গেলাম লাইটলুম ক্যানিয়ন। পথে মাছ, স্মোকড বিফ, সবজি, ডাল দিয়ে লাঞ্চ করে নিলাম। লাইটলুমে দুপুরের দিকে বা শেষ দুপুরে যাওয়া ভালো। বিকেলের দিকে মেঘে ঢেকে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। অসম্ভব সুন্দর জায়গা।ক্ষনে ক্ষনে রঙ বদলায় জায়গাটা। এই রোদ উঠে তীব্র সবুজে ছেয়ে ফেলে। নিচের ক্যানিয়নটা তখন খুব স্পষ্ট দেখা যায়।আবার পরক্ষনই মেঘ। সবুজের যে কত রঙ হতে পারে লাইটলুমে গেলে বোঝা যায়। রোদ,মেঘ,ঠান্ডা বাতাস গায়ে মেখে আমরা লাইটলুম থেকে বের হয়ে আসি।

আজ তোমার মেঘে মেঘে রঙ।
লাইটলুম,শিলং।

লাইটলুম থেকে ফেরার পথে আমরা যাই লুয়াই ফলস। অনেক বড় একটা ফলস। খুবই সুন্দর। পানি খুব নীল ছিলো ঝরনার নিচে। সবাই বলছিল বর্ষা বলেই লুয়াই ফলস তার সমস্ত সৌন্দর্য নিঙরে দিচ্ছে। লুয়াই ফলস শেষে আমরা শিলং এ ফিরে যাচ্ছিলাম। যাবার পথে জেরাল্ড বললো আমাদের কিন্তু কিং আছে! তার একটা প্যালেস ও আছে। আমি বললাম,তাই নাকি! দেখতে চাই। সে আমাদের তাদের কিংস প্যালেসে নিয়ে গেলো। পুরা ইউরোপের মত গুছানো জায়গাটা। ছিমছাম বিরাট একটা কাঠের বাড়ি তাদের রাজার।

তোমার ঐ ঝরনা তলার নির্জনে! লুয়াই ফলস
কিংস প্যালেস

কিংস প্যালেস দেখে আমরা উমিয়াম লেকে। ওখানে সুর্যাস্ত দেখলাম।

উমিয়াম লেক

শিলং এ ফিরে এলাম। শিলং এ কি একটা ফেস্টিভাল হচ্ছিলো আর ইদের ছুটির চাপে রুম পাওয়া খুব কষ্টকর ছিলো। আমরা ঐ দিন কংগ্রেস পার্টির গেস্ট হাউজে। ছিমছাম,গুছানো আর পরিপাটি ছিলো রুম দুইটা। প্রতি রুমে ২টা খাট। একটা ডাবল আরেকটা সিঙ্গেল।বাথরুমে গিজারও ছিল। না রেখে উপায় নাই। ওখানে রাতে বেশ ঠান্ডা পরে। কম খরচে পেয়ে গেলাম। আসলে আমাদের ট্যুর অপারেটররাই আমাদের এটা ম্যানেজ করে দিয়েছে। গা এলিয়ে ঘুম দিলাম।অনেকদিন প্রান ভরে ঘুমাই না! “গভীর ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত।আমাকে জাগাতে চাও কেন”। আবার জীবনানন্দ মারলাম।

পরদিন একটু দেরী করেই ঘুম থেকে উঠি। গাড়ি আমাদের নিতে আসে আরও দেরী করে। রাস্তায় রচুর ট্রাফিক ছিলো। শিলং এর ট্রাফিক জ্যাম আসলেই বিরক্তিকর। আমরাও আসার সময় টের পেয়েছি। শিলং বের হলে আপনাকে অবশ্যই পিক-অফপিক মাথায় রেখে বের হতে হবে। নইলে সময় নস্ট হবে। যাই হোক,আমাদের আজকের গন্তব্য নংরিয়াত গ্রামে। ওখানে ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ দেখবো। মেঘালয়ে আপনি অনেক রুট ব্রিজ দেখতে পাবেন। বট গাছের শেকড় দিয়ে প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে উঠে এই রুট ব্রিজ। কোন কোন রুট ব্রিজ হতে সময় লাগে ৫০-১০০ বছর। নংরিয়াতের এই ব্রিজটা ডাবল ডেকার হওয়ার কারন অন্য সব গুলা থেকে আলাদা। আমরা গাড়ি পার্ক করে ব্রিজের দিকে হাটা ধরলাম।

এটাকে ন্যাচরাল সুইমিং পুল বলা হয়।কিন্তু ঐদিন পানির স্রোত এত বেশি ছিলো তাই কেউ নামিনি।
নংরিয়াত
ডাবল ডেকার রুট ব্রিজের সাথেই এই ঝরনাটা।
এই সেই ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ।প্রায় ৩০০০ সিড়ি বেঁয়ে আপনাকে এখানে উঠতে হবে।
রেইনবো ফলস।রোদ উঠলে এখানে শত শত রংধনু তৈরী হয়।

নামছি তো নামছিই।পথ আর শেষ হয় না। সিড়ি নামতে নামতে এক সময় খেয়াল করলাম আমাদের পা অটমেটিক কাপা শুরু করছে। যাই হোক প্রায় ৩০০০ সিড়ি,দুই দুইটা ঝুলন্ত ব্রিজ আর একটা রুট ব্রিজ বেঁয়ে নেমে আমরা ডাবল ডেকার রুট ব্রিজের নিচে এসে পৌছালাম।তখন বিকেল। আমরা ডাবল ডেকার রুট ব্রিজের সাথেই একটা ঘর নিলাম থাকার জন্য। প্রতিজন ১০০ টাকা। ডবল ডেকার রুট ব্রিজের নিচে একটা ঝরনাও আছে। ঝরনায় গোসল করতে করতে ঝুম বৃষ্টি। পাশের চা দোকানে চা-নাস্তা খেয়ে আমরা সন্ধ্যের পর পরই আমাদের কুড়ে ঘরে ফিরে আসলাম।

জামা কাপড় চেঞ্জ করে বারান্দায় এসে বসলাম। সামনে বিশাল পাহাড়ের সাড়ি।সাদা মেঘ এসে ভিজিয়ে যাচ্ছে বাড়ির উঠান,বারান্দা,আমাদের চুল,ক্লান্ত মলিন মুখ। আমি বারান্দায় পা ছেড়ে বসলাম। আমাদের গাইড বাঞ্জপ তাদের ভাষায় গান ধরেছে। পাশ দিয়ে বয়ে চলা ঝরনার ঝরঝর শব্দ হচ্ছে। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ছে।বৃষ্টি আর ঝরনার শব্দ মিলে এক অদ্ভুদ সুর। একই বুঝি বলে জলের গান। বিস্তৃত শুন্যতায় কি বিপুল হাহাকার। আমি পকেট থেকে বের করে একটা সিগারেট ধরালাম।

আমাদের সাথে ওইদিন আমাদের আরোও দুইজন মেম্বার জয়েন করার কথা। আমরা তাদের জন্য খুব চিন্তিত ছিলাম। যদিও তাদের সাথে একজন গাইড থাকবে। তারপরেও। তারা আসলে আমরা ডিনার করতে যাবো। অবশেষে রাত ৮.৩০টায় ক্লান্ত-শ্রান্ত-ভারাক্লান্ত আমাদের বাকি দুইজন মেম্বার রনি ও উজ্জ্বল আমাদের মাঝে এসে পৌঁছল। রাতের খাবার খেয়ে চলল আড্ডা,গান। রাত বেশি জাগি নাই। শরীরে বেশ ধকল গেছে। তাই শুয়ে পড়লাম।

পরিদিন খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠি। ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ পার হয়ে হাটতে থাকি। গন্তব্য রেইন বো ফলস।প্রায় এক ঘন্টা হেঁটে আরোও একটা রুট ব্রিজ ও ঝুলন্ত ব্রিজ পার হয়ে আমরা রেইন বো ফলসে পৌছাই। উফ! সে কি পাগলা ফলস। শো শো আওয়াজে চারপাশ কাপছে। অনেক উপর থেকে পানি পড়ছে একটা বড় পাথরে। তাই অনেক দূর পর্যন্ত পানির ঝাটা ছড়িয়ে পড়ে।শীতকালে আসলে নাকি এই ঝরনায় একই সাথে কয়েকশ রেইন বো দেখা যায়। এই থেকেই এর নাম রেইন বো ফলস। তবে আমরা যা দেখেছি তাতে রেইন বো না দেখতে পাওয়ার আফসুস নাই।

পানির নিচে ।
ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ পার হয়ে আরো হাটলে আপনি এই ব্রিজটার দেখা পাবেন।সত্যি বলতে কি এটা ডাবল ডেকার রুট ব্রিজ থেকে বেশি সুন্দর।

রেইনবো ফলস থেকে ফিরে এসে আমরা আমাদের লাঞ্চ সারলাম।গাইড জেরাল্ডের ভাষায় “ব্রাঞ্চ”। মানে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ একসাথে। খেয়ে দেয়ে আমরা আমাদের যাত্রা শুরু করলাম।আগেরদিন তো তিন হাজার সিঁড়ি নেমেছি এবার তিন হাজার সিড়ি উঠতে হবে। উঠছি তো উঠছিই! আমাদের জিহবা বের হয়ে গেছে কিন্তু সিড়ি শেষ হয় না।আমার সামনের পঞ্চাশ উর্ধ এক ব্যাক্তিকে দেখে মনে মনে সাহস সঞ্চার করলাম। পথে অনেক লটকন গাছ ছিলো। আমরা কুড়িয়ে লটকন খেলাম। টক জিনিস ক্লান্তি দূর করে। তারপর আবার হাটা। কখনও রোদ বাড়ছে।কখনোও বৃষ্টি। কখনোও জঙ্গল থেকে মেঘালয়ের পাহাড় আর বিশাল বিশাল ঝরনা দেখতে দেখতে আমরা হেঁটে চলছি। আমাদের গাইড আমাদের বিভিন্ন লতা-পাতা ছিড়ে খেতে দিচ্ছে।তারপর বলেও দিচ্ছে কোনটার কি উপকার। তবে কিছু কিছু জায়গায় তারা আমাদের সাবধান করে দিলো। যেন আমরা একটা পাতাও না ছিড়ি। খুব সাবধানে পথ চলি। এই জায়গা গুলোকে তারা বলে “স্যাক্রার্ড গ্রুভ”। তারা বিশ্বাষ করে এই জায়গার লতা পাতা ছিড়লে অমঙ্গল হয়। গাছ বা প্রানীর কোন ক্ষতি যদি কেউ করে তাহলে তার বড় রকমের ক্ষতি হবে,অমঙ্গল হবে। আসলে এভাবেই আমাদের পুর্বপুরুষরা গাছ,প্রান,প্রকৃতি রক্ষা করেছেন। প্রকৃতিও তাদের রক্ষা করেছেন বিভিন্ন বিপদ থেকে। লোভ, কর্পোরেশন, মুনাফার ফাঁদে পড়ে এখন আমরা প্রান-প্রকৃতি নষ্ট করছি। জেমস ক্যামেরুন তার এভাটার মুভিতে দেখিয়েছেন কিভাবে মানুষ ও প্রকৃতি মিলে মিশে থাকে,না থাকলে কি হয়। আমরা আজ বিদ্যুতের জন্য সুন্দরবন ধ্বংস করছি। সুন্দরবন কি এর প্রতিশোধ নিবে? নিবে! নেওয়ার কথা! সুন্দরবনকে কি আমরা “স্যাক্রার্ড গ্রুভ” হিসেবে ঘোষণা করতে পারি না? আমরা বোধে-মননে হয়তো ঐ জঙ্গলের অধিবাসীদের থেকে উন্নত হতে পারি নাই।

প্রায় দুই ঘন্টা হেঁটে আমরা আমাদের গাড়ির কাছে পৌছলাম। চা খেয়ে রওনা দিলাম আমরা আমাদের নেক্সট গন্ত্যব্যে। আমরা যাচ্ছি চেরাপুঞ্জির দিকে।চেরাপুঞ্জির আরেক নাম সোহরা। পথে আমরা একটা গুহা দেখি। টুরিস্ট স্পট।টুরিস্ট স্পটে আমার আগ্রহ বরাবরই কম। তারপরেও গুহাটা সুন্দর ছিলো। আদিম আদিম একটা ভাল আছে।গুহার ভিতরে লাইট দেওয়া ছিলো। এটা আমার পছন্দ হয় নি। আলুটিলার মত মশাল নিয়ে ঢুকতেই আমার বেশি পছন্দ।

গুহা, চেরাপুঞ্জিতে

যাই হোক গুহা থেকে বের হয়ে আমরা রওনা হলাম নোয়াকালকাই ফলসের দিকে। এই ফলসের অদ্ভুদ সুন্দর একটা কাহিনি আছে। এখন বলছি না এটা। 😛 একটু এগুতেই রাস্তায় পচন্ড মেঘ।আস্তে আস্তে গাড়ি চালাতে হচ্ছে। নোয়াকালকাইর কাছাকাছি যেতেই কিছু দেখা যাচ্ছিল না। বাঞ্জপকে বললাম, দেখতে পাবো তো? সে মাথা নাড়লো। বললো,তোমাদের ব্যাড লাক। গাড়ি ঘুরাতে বললাম। যে মেঘ নোয়াকালকাই গিয়ে কিছু দেখতে পারবো না। ১০-১৫ হাত দুরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সময় নষ্ট না করে আমরা গেলাম ড্যান্থালিন ফলস এ। ড্যান্থালিন ফলস টা ছিলো অসাধারন। এই প্রথম আমরা কোন ফলস দেখি উপর থেকে। মানে উৎসমুখ থেকে। অন্য ফলসগুলা নিচ থেকে দেখতে হয়েছে। ড্যান্থালিন ফলসে যখন যাই তখন প্রচন্ড মেঘ আর ঠান্ডা। তার উপর ঝিরঝির বৃষ্টি।কি যে চমৎকার একটা পরিবেশ ছিলো! ড্যান্থ্যালিন ফলস ছিলো প্রচন্ড উন্মুত্ত। স্রোতের কারনে সামনে যাওয়া যাচ্ছিলো না। এমনকি ভিউ পয়েন্টেও যাওয়াও কষ্ট হয়ে যাচ্ছিলো।

ড্যান্থালিন ফলস
উমদিকাইন ফলস

ততক্ষনে প্রায় সন্ধ্যা। আমাদের গাইড আমাদের খুব তাড়া দিচ্ছিলো। এখান থেকে আমরা মাউলিংবানা যাবো। এটা বেশ দূর। সন্ধ্যা যখন ছুঁই ছুঁই তখন আমরা মাউলিংবানা গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হই। রাস্তায় প্রচন্ড কুয়াশা।কিছু দেখা যাচ্ছে না। সময় যত যাচ্ছে তত ঘন হচ্ছে। ২ হাত দূরে কিছু দেখা যাচ্ছে না। আমাদের গাইড ১৫-২০ কিঃমিঃ গতিতে চলছিলো। খুব সাবধানে ড্রাইভ করতে হচ্ছিলো। মাঝে মাঝে থেমে আমরা মুত্র বিসর্জন করছিলাম। কি যে সুন্দর লাগছিলো তখন চারপাশ। সুনসান নিরবতা। দূরে কোথাও কোন জংলি পোকা ডেকে যাচ্ছে। এর মধ্যেই আমরা আমাদের ডিনার সেরে নিলাম। স্মোকড বিফ,বিফ ফ্রাই,চিকেন,ডাল,বাশের আচার,সব্জি,সালাদ,শাক এত কিছু দিয়ে খেয়েও আমাদের ১০ জনের বিল আসলো ৯৬০ রুপি। ভদ্র মহিলা খুম আমুদে। হাসিখুশি। আমাদের উনি ফ্রি চা খাওয়ালেন। এই নিয়ে উনার দোকানে দুই বার খেলাম।আগেরদিন সকালে নাস্তা খেতে গিয়ে খাবারে টান পরাইয়া ফেলছিলাম। আমাদের খানা দেখে তারা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। 😛

গাড়ি ছুটছে। কোথাও ঝুম বৃষ্টি। কোথাও ঘন কুয়াশা।পাহাড়,ঝরনা,বন,নদী পেরিয়ে গাড়ি ছুটে চলছে।আমরা প্রচন্ড ক্লান্ত। আমি পিছনে ফিরে দেখি সবাই অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ৩ হাজার সিড়ি বেঁয়ে উঠলে এমনিতেই ক্লান্তি ভর করার কথা। জেরাল্ড আমাকে বললো,মোহাম্মদ,তুমি রেস্ট নেও একটু।মাথা ফেলো। আমি বললাম,আই জাস্ট ডোন্ট ওয়ান্না মিস এ সিঙ্গেল মোমেন্ট,আ সেকেন্ড। সে হেসে বললো,এঞ্জয় ইট। জেরাল্ডের সাথে গল্প করছি-দেশ,রাজনীতি,অপনীতি,ধর্ম,দর্শন নিয়ে। কত কথা। সে জানালো তার মা খাসি,তার বাবা উত্তর প্রদেশের।বাবা সাইন্টটিস্ট। মা ক্রিশ্চিয়ান,বাবা হিন্দু। আমি বললাম,তুমি?সে জানালো,সে বুঝ হওয়ার পর ক্রিশ্চিয়ানিটি বেছে নি্যেছে। তবে তার হিন্দু ধর্মের দর্শন বেশ ভালো লাগে। সে বললো,ধর্ম তার কাছে খুব গুরুত্বপুর্ন বিষয় না। তার কাছে হিউমিনিটিটাই আসল। তাবৎ দুনিয়ায় যে ধর্ম,জাত-পাত,জাতীয়তা নিয়ে এত এত খুন,হত্যা এগুলো তাকে বিচলিত করে। আমি তাকে লালনের দর্শনের কথা বললাম। সে খুব আগ্রহ নিয়ে শুনলো। তাকে আমি কিছু লালনের গানের কথা বললাম। আমাদের মধ্যে শিল্প,সাহিত্য,মিউজিক,সিনেমা নিয়ে কথা হলো।তাকে বললাম রবীন্দ্রনাথের “শেষের কবিতার” কথা।যার পটভূমি শিলং। সে জানালো সে এটা জানতো না।জেনে খুব খুশি হয়েছে। লিটারেচারে তার অত আগ্রহ নেই।

রাত ১২ টায় আমরা মাউলিংবানা পৌছি। ২ ঘন্টার জার্নি আমাদের লাগলো ৫ ঘন্টা। ঘন মেঘ আর বৃষ্টির কারনে।রাস্তা নষ্ট থাকায় গাড়ি ভিতরে ঢুকাতে পারছিলো না। আমরা গাড়ী রাস্তায় রেখে আবার পাহাড় বাইতে শুরু করলাম। ১০-১৫ মিনিট পর আমরা আমাদের রিসোর্ট এ পৌছি। একটা মিস কমিউনিকেশনের কারনে আমরা ঐদিন গেস্ট হাউসে রুম পাইনি। তারা আমাদের কনফার্মেশনের জন্য ফোন দিয়েছিল। তখন আমরা নংরিয়াতে।ঐ খানে নেটওয়ার্ক না থাকার কারনে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে নি। ফলে তারা রুম অন্যদের ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। তবে তারা আমাদের কিছু তাবু ম্যানেজ করে দিয়েছে। আমরা বললাম এটাই সই। খরচও রুম থেকে কম।সবাই ই খুশি।রাত এক টায় আ্মরা তাবু ফেলি। আমার মনে হলো সারাদিন গোসল করি নাই। রাত ২ টার সময় আমি বালতি-মগ নিয়ে গোসল করতে ছুটলাম। তখন প্রচন্ড ঠান্ডা আর বাতাস। সবাই আমাকে নিষেধ করছিলো। বললো ঠান্ডা লাগবে,জ্বর আসবে।বললাম,কিচ্ছু হবে না। প্রকৃতি কখনও আমার সাথে বেইমানি করে নাই।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি চারপাশ সাদা। কিছু দেখা যায় না। আগের দিনের ওয়েদার এখনোও আছে! রিসোর্ট থেকেই আমাদের নাস্তা সার্ভ করলো। সকালের নাস্তা ছিলো ব্রেড,অমলেট,বাটার,চিনি আর চা।খেয়ে দেয়ে আমরা আমাদের কটেজে ব্যাগ রেখে বেরিয়ে পড়ি। প্রায় ১ ঘন্টা হাটার পর আমরা দেখা পাই উমদিকাইন ফলসের। পথে জোক আমাদের বেশ জ্বালাইছে। জোকের জ্বালায় পড়ে আমাদের কিছু মেম্বারও আমাদের জ্বালাইছে। 😛 এই ফলসটায় আমরা প্রথম বাংলাদেশি টিম যাদের পা পড়লো। এই ফলসটার ছবি আমি আগেই দেখেছিলাম ইন্টারনেটে।তখনই নিয়ত করেছিলাম আর কিছু দেখি না দেখি এটাতে যেতেই হবে। এই ফলসে যাওয়ার জন্য আমাদের অনেক জায়গা স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে। তারপর শুরু হলো আমাদের আসল ট্রেইল। আমাদের সাথে আরোও দুইজন গাইড আসলো। তারা স্থানীয়। তারা না আসলে আমরা এই ট্রেইল কিভাবে যে পার হতাম আল্লাহ মালুম। আমরা আগেই লাইফ জ্যাকেট পরে এসেছিলাম। না পড়ে উপায় নাই। আপনি যতই সাতার পারেন। কারন ঐ ট্রেইলে প্রচুর গর্ত। আমাদের দেশে এগুলাকে “খুম” বলে। রিসোর্ট থেকেই লাইফজ্যাকেট প্রোভাইড করেছে আমাদের। সারা পথ জুড়ে ছোট ছোট ক্যাস্কেড,খুম,ঝরনা। কোথাও আমাদের শরীর ছেড়ে দিয়ে পিছলে পড়ে নামতে হয়েছে।পরে পিছনে হাত দিয়ে দেখি প্যান্টের অবস্থা বারোটা। কোথাও আমাদের ২০ ফুট উপর থেকে লাফ দিতে হয়েছে। এই জায়গাটা সবচেয়ে এডভেঞ্চারাস ছিলো। এক এক জন লাফ দিচ্ছে আর আমরা হাত তালি দিচ্ছি। উৎসাহ দিচ্ছি,সাহস দিচ্ছি। লাফ জোরে না দিলে আপনি পাথরে গিয়ে পরবেন যেটা কিনা মারাত্বক হতো। যদিও আমরা লাফ না দিয়ে বিকল্প রাস্তা খুজেছি। কিন্তু পাই নি। জাম্প মাস্ট। অবশেষে ট্রেইল শেষ হতে দেখি আমরা একটা ছোট খাট নদীতে গেয়ে পড়েছি। সাঁতরে নদী পার হয়েছি। কি সুন্দর নদীটা! এক আশে কিছু মানুষ ছিপ-বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে। বড় বড় পাথর আর গাছ! ঐখানে আমরা কায়াকিং করি। এটা আমার প্রথম কায়াকিং ছিলো। খুব এনজয় করেছি ব্যাপারটা। পরিবেশটাও সুন্দর ছিল। শেষ দুপুরের আলো নদীতে এসে পরছে। নদীর পানি চিক চিক করছে রুপার মত।

কায়াকিং

কায়াকিং করে আমরা গেলাম “স্পিল্ট রক” দেখতে। দুইটা বিরাট বড় পাথরের মাঝে দুই ফুট পরিমান ফাঁক। পাথর দুইটা ৮০-১০০ ফুট হবে।উপর থেকে কথা বললে কি ভয়ংকর প্রতিধ্বনি হয়! বট গাছের শেকর বাকড় দিয়ে ভরা জায়গাটা। স্যাতস্যাতে আর ভেজা জায়গাটা দেখতে ভয়ংকর ছিলো। এর নিচে নামতে হবে আপনাকে খুব ছোট একটা পথ দিয়ে।এটা একটা গর্ত মতন। আপনি যদি খুব মোটা হন তাহলে এই চেষ্টা না করাই ভালো। তাহলে দেখবেন মাথা ঢুকাতে পেরেছেন কিন্তু পেট ঢুকে না।পেট ঢুকলে কোমর ঢুকে না। সেখান থেকে বের হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা। ওপারে বাংলাদেশের নিম্নভুমি। সূর্যের লাল আলো আমার দেশে পরছে। কি সুন্দর দেখাচ্ছে বাংলাদেশ! কি সুন্দর!

ঐদিন কটেজে ফিরে রাতে আড্ডা,গান,হইচই করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম সবাই। ঘুম ভাঙ্গে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে।সবাই তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নেই। ওইদিনও আমরা “ব্রাঞ্চ” নেই সকালে। ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ একসাথে আর কি! সকালেই হেভি ফুড খেয়ে বের হয়ে যাই। আজকে আমরা যাচ্ছি নংস্টেইন। এটা ওয়েস্ট খাসি হিলসে।মেঘালয়ের আরেকটি জেলা। ঐখানে আমাদের কটেজ বুকা করা ছিল। মাওলিংবানা থেকে নংস্টেইন যাওয়ার রাস্তাটা যে কি সুন্দর ছিলো। কি চমৎকার গ্রাসল্যান্ড, সারি সারি পাইন গাছ। জায়গা গুলা দেখতে পুরা ইউরোপের মত।আমার বন্ধু বললো,আর শুধু বরফ পড়লেই হতো। তাইলে আর কাশ্মীর দেখা লাগতো না। প্রায় পাঁচ ঘন্টা জার্নি শেষে আমরা গিয়ে পৌছলাম নংখুম রিভার আইল্যান্ডে। এটা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম রিভার আইল্যান্ড। তার কাছেই ছিলো থুম ফলস। থুম ফলসে নামতে আমাদের বেশ প্যারা নিতে হয়েছে! খুব খাড়া রাস্তা! ঘাসের মুঠি ধরে আস্তে আস্তে সবাই নিচে নামি! খুব সুন্দর জায়গাগুলা প্রকৃতি বোধ হয় ইচ্ছ করেই দূর্গম করে রাখে। আমি গরীব মানুষ,তাই বোধ হয় আমার কাছে ধুম ফলসকেই নায়াগ্রা মনে হয়েছে। বুনো পাথরের মাঝে পানির স্রোত আর গতি আপনাকে অন্য একটা জগতে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশ হইলে ঐ জায়গায় আমি তাবু নিয়ে এক রাত থেকে আসতাম। ওখান থেকে আমরা আমাদের কটেজে রওনা হয়। পথে লোকাল ফল কিনি অনেক। আনারস, প্লাম আর পিয়ার। মেঘালয়ে গিয়ে আপনি ওখানকার আনারস চেখে দেখবেনই। অসাধারন জুসি আর মিষ্টি।গড ইজ দ্যা বেস্ট কুক। রাতে কটেজে যেতে যেতে শীত জেঁকে বসেছে।

মাউলিংবানা এই রিসোর্টে ছিলাম আমরা।
স্টেনিন রোড
থুম ফলস।

গোসল করে সবাই ডিনারে গেলাম।ডিনারের জায়গাটা খুব সুন্দর ছিল। ঠান্ডার জন্য তারা আমাদের একটা পাত্রে কয়লা এনে দিলো। ভ্রাম্যমান ফায়ার প্লেস। 😛 পরদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেখি কুয়াশা চারপাশ ঢাকা। এবার আমাদের ভাগ্য খারাপ ছিলো। কুয়াশা না থাকলে আমরা খুব সুন্দর কিছু দৃশ্য দেখতে পেতাম। মাওফংলর গ্রামটা ছোট ছোট পাহাড়েরে মাঝে চমৎকার চমৎকার লেক দিয়ে ঘেরা। সাথে এখানে সেখানে পাথর আর বুনো ফুল। আমরা ১১টা পর্যন্ত ওয়েট করেছিলাম কুয়াশা কাটিয়ে উঠার জন্য। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হই রওনা হতে। পথে আমরা স্টেনিন রোড নামে একটা রোডে নামি। এখানে একটা পুরাতন ঝুলন্ত ব্রিজ আছে। একটা ঝরনা আছে যেটার পানি কিনা রাস্তার উপরে এসে পরেছে। আর ঐ জায়গাটার ভিউটাও চমতকার। সব মিলিয়ে জায়গাটা সারপ্রাইজড বোনাস হিসেবে পেয়ে গিয়েছিলাম।

এলিফ্যান্ট ফলস। এটা দেখার পর সবাই আমাকে গালি দিছে।
আমাদের গাইড জেরাল্ডের বার্থ ডে।

পথে এলিফেন্ট ফলস এ নামলাম। ফলস দেখে আসার পর সাবাই আমাকে সেই পরিমান গালি! এটা কি দেখাইছস! এইটা একটা ফলস হইলো? পোলাপানের চোখ বড় হয়ে গেলে যা হয়! নরেন্দ্র দমাদম মোদি যে ফলস দেখে যায় এই ফলস আমাদের ভাল লাগে না। 😛 কই যাইতাম! রনি বললো, পয়সা উসুল হইছে কারন ওখানে গিয়ে সুন্দর সুন্দর মেয়ে দেখেছি ছোট ছোট জামা পরা। শিলং নামি দুপুর ৩ টায়।একটা ডর্ম এ উঠি।আজই আমাদের শেষ দিন শিলং এ। বিকেলের দিকে সবাই শপিং এ বের হই। আজকে রাতে গ্র্যান্ড পার্টি থ্রু করা হয়েছে।আমাদের গাইড জেরাল্ডের জন্মদিন ছিল সেদিন। আমরা শিলং পয়েন্ট থেকে কেক কিনি। আমাদের গাইড সবাইকে ইনভাইড করি।রাত ১১ টায় তারা-গ্রেগ,জেরাল্ড আর বাঞ্জপ আসে। আমরা কেক কাকি। তাদের প্রত্যেকে টুকিটাকি গিফট দেই। জেরাল্ড গিটার নিয়ে এসে আমাদের গান গেয়ে শোনায়। আমাদের মধ্যে থেকে উজ্জ্বল লাললের গান গেয়ে শোনায় তাদের।এক সাথে চিয়ার্স করে,হই হুল্লোর ,নাচানাচি করে আমাদের পার্টি শেষ হয়। রাতে ঘুমোতে গেলে মনটা খারাপ হয়ে যায়। চোখের পলকে এত গুলা দিন শেষ হয়ে গেলো।পাহাড়,নদী,মেঘে তো ভালোই কাটছিলো দিনগুলা। শিলং বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। সবাই বেশ সু-শৃংখল। রাস্তায় কেউ একটা হর্ন দেয় না। খুব দরিদ্র কারুর বাসার সামনে আপনি ফুল গাছ পাবেন। তারা মিউজিক, ফুল আর ফটোগ্রাফি ভালোবাসে। এমন শহর ছেড়ে কে যেতে চায়! আবার ঢাকার জন্যও মন কাদে। ঢাকার মত এত প্রান আর কোন শহরে আছে শুনি! ঢাকার তুলনায় শিলং তো সন্ধ্যায়ই ঘুমিয়ে যায়। নিস্তেজ হয়ে পড়ে!

মেঘালয় যাওয়ার সময় ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। সেখানে বলেছিলাম, শিলং-দ্যা স্কটল্যান্ড অভ ইস্ট। ছোট ভাই জিজ্ঞেস করেছিলো আসলেই এটা ইস্টের স্কটল্যান্ড কিনা? আমি তাচ্ছিল্যভরে বলেছিলাম এগুলা ব্রিটিশদের দেওয়া নাম। তারা নানা জায়গায় নিয়া নানা ব্যাপারে তোষামোদ করেছে। কিন্তু আমার ধারনা ভুল। শিলং কে স্কটল্যান্ড অভ ইস্ট বলা যায়। নিঃসন্দেহে বলা যায়।

আমাদের আরও কিছু ছবি এখানেঃ

যেভাবে যাবেনঃ

ডাউকি দিয়ে ভিসা লাগালে আপনার মেঘালয়ে ভ্রমণে সুবিধা হবে। ডাউকি বর্ডার থেকে ১০-১৫ রুপি দিয়ে ডাউকি বাজার যাবেন। ঐখান থেকে শিলং এর ভাড়া ১২০ রুপি।

আমরা শিলং এ ঘুরার জন্য গাইড নিয়েছিলাম। আমরা ৮ জন দুইটা কার নিয়েছিলাম। সাথে দুইজন গাইড। ২টা কার প্রতিটা ২০০০ রুপি করে মোট ৪০০০ রুপি। আর গাইড দুইজন ১০০০ রুপি।তারাই গাড়ি ড্রাইভ করেছে। গাড়ি গাইড বাবদ আমাদের প্রতিদিন খরচ হয়েছিল ৫০০০ রুপি। গাড়ি,গাইড আপনি চাইলে ২৪ ঘন্টাই আপনার সাথে থাকবে। সস্তা খাবার, দামি খাবার,ঐতিহ্যবাহী খাবার সব খাবার খেতে গাইডরা আপনাকে হেল্প করবে। হোটেলের বাজেট বলে দিলে তারা আপনাকে এই খরচে হোটেল ম্যানেজ করে দেওয়ার চেষ্টা করবে। তবে আপনি করতে চাইলেও কোন সমস্যা নাই।

শিলং এ গাইড নেওয়ার সুবিধা অনেক। আপনি সব জায়গায় যেতে পারবেন।তারা আপনাকে নিজে থেকে ভালো জায়গা ঘুরানোর চেষ্টা করবে। তারা শিক্ষিত হওয়ায় তাদের সাথে বিভিন্ন ব্যাপারে কথা বলা যায়। অনেক কিছু জানা যায়,শেখা যায়।ট্যাক্সি ড্রাইভাররা আপনাকে কমন জায়গা গুলা ঘুরাবে। রাস্তা একটু খারাপ হলে যেতে চাউবে না। বলবে একটা ঘুরার পর চার্জ করবে আরেকটা। আমাদের যে গ্রুপটা গাইড করেছিল তারা বেশ ইয়াং, এনারজেটিক। আমরা খুবই সন্তুষ্ট ছিলাম তাদের সার্ভিসে।

আমাদের ৮ জনের ৮ দিনের ট্যুরে খরচ হয়েছে মোট ৮৫০০ রুপি। এমনিতে ৮০০০ রুপি ই খরচ হত। আমরা শেষের দিন পার্টি থ্রু করাতে খরচ বেড়েছে। গাইডের সাথে যোগাযোগ করতে ফেসবুকে আমাকে নক করতে পারেন। আমি নাম-নাম্বার দিয়ে দিবো।

Leave a Comment
Share