মেঘ পাহাড়ের দেশ – দার্জিলিং ভ্রমণ (প্রথম পর্ব)

অনেক দিন থেকেই প্ল্যান করছি ইন্ডিয়া ঘুরতে যাব কিন্তু ভিসা নেয়ার এত ঝামেলা সহ্য করতে মন চাইত না। অবশেষে গত জানুয়ারী তে ঠিক করে ফেললাম যে এবার যাবই।

প্রথম ধাপঃ ভিসা প্রাপ্তি এবং ভোগান্তি 🙁

এই ভ্রমনের শুরুতে দুই জন কনফার্ম – আমি এবং আমার বউ। কিন্তু প্রথমবার দেশের বাইরে যাচ্ছি তাই আরও সঙ্গী খুঁজলাম, দোস্ত সোহাগ ইউএসএ থেকে এসে এনএসইউ তে জয়েন করেছে। রাজি হয়ে গেল। সৌরভ ওরফে ব্লুটো প্রথমে যাব বলেও পরে না করে দিল। পরে খোকন এসে জয়েন করতে ইচ্ছে পোষণ করল। এবার শুরু হল মহান ই-টোকেন এর ঘটনা, সোহাগ, আমি আর আমার বউ ই- টোকেন পেয়ে ভিসাও পেয়ে গেলাম কিন্তু খোকন আর ই-টোকেন পায়না। বেচারা শেষ পর্যন্ত এক মাস চেষ্টার পর ই-টোকেন পেতে সফল হলেও আমাদের দাদারা কোনও এক রহস্যময় কারনে খোকন কে ভিসা দিল না। বেচারার ৪০০০ টাকার বেশি জলে গেল।

শ্যামলী বিআরটিসি পরিবহন

এখন যাওয়ার প্ল্যান ঠিক করা। আমার সময় হলে বউ এর সময় হয় না, আবার বউ এর সময় যখন হয় তখন আবার সোহাগ এর সময় হয় না। এভাবে প্রায় এক মাস পার হওয়ার পর আমরা ২৫ এপ্রিল রাত এর শ্যামলী বাস এর শিলিগুড়ি পর্যন্ত তিনটা টিকেট কাটলাম। টিকেট শিলিগুড়ি পর্যন্ত জনপ্রতি ১৫০০ টাকা। ২৫ তারিখ সকাল বেলা সোনালি ব্যাংক এ গিয়ে তিন জনের ট্রাভেল ট্যাক্স জন প্রতি ৫০০ টাকা করে পরিশোধ করে আসলাম ( অবশ্য সবাই বর্ডার এ শ্যামলী এর মাধ্যমে এই ট্রাভেল ট্যাক্স ৫০০ টাকা পরিশোধ করতে পারবেন। তাই নো চিন্তা। অবশ্য আমি মনে করি সুযোগ থাকলে আগে থেকে দিয়ে যাওয়াই ভালো) তবে শুরুতে যখন ঝামেলা লেগেছে এত তাড়াতাড়ি কি আর ঝামেলা আমাদের ছাড়ে। সোহাগ সকাল থেকে তার পাসপোর্ট খুজে পাচ্ছিল না। এক সময় ভেবেছিলাম তাহলে টিকেট ক্যানসেল করে দিয়ে আসি। অনেক খোঁজার পর বিকাল বেলা স্যার এর পাসপোর্ট খুঁজে পাওয়া যায়। এদিকে আমরা বাসা থেকে বের হয়ে আরামবাগ এ গিয়ে কোস্টার ধরে কল্যাণপুর যাওয়ার কথা কিন্তু সেদিন এমন জ্যাম পড়েছে যে দৌড়াইতে দৌড়াইতে কোনও মতে এক মিনিটের জন্য কোস্টার পাইছিলাম। অবশেষে রাত ৯ টার সময় কল্যাণপুর থেকে আমাদের বাস শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল।

২৬/০৪/২০১৬

সকাল সাড়ে ৬ টায় আমরা বুড়িমারী এসে পৌঁছাইলাম। বাস থেকে নামার আগেই বাস এর সুপারভাইজার আমাদের সকলের থেকে পাসপোর্ট , ট্রাভেল ট্যাক্স এর রশিদ এবং বন্দর শুল্ক ৫০ টাকা নিয়ে নেয়। এরপর আমরা বাস থেকে নেমে প্রথমে কিছুক্ষন বিশ্রাম নেই। এখানে বর্ডার খুলবে সকাল ৯ টায়। সেই পর্যন্ত বসে থাকা ছাড়া কোনও কাজ নেই। সকাল ৭ টার দিকে আমরা বুড়ির হোটেল এ সকালের পরোটা সবজি এবং ডিম দিয়ে নাস্তা খেলাম, তিন জনের মোট বিল আসল ১০৫ টাকা। বলে রাখা ভালো বুড়িমারী তে বুড়ির হোটেল এর খাবার এ সব থেকে ভালো।

বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন অফিস

এরপর সকাল ৯ টার একটু আগেই আমরা ইমিগ্রেশন এর দিকে রওনা দিলাম। বলে রাখা ভাল, বাস কাঊনটার থেকে ল্যান্ড পোর্ট ২ মিনিটের হাটার রাস্তা কিন্তু আপনি রিকশা-ভ্যান এ উঠলেই জন প্রতি ১০ টাকা গুনতে হবে 😉 আপনার ব্যাগ নিয়ে টেনশন করার কিছু নাই। শ্যামলীর লোকজন ঠিকঠাক আপনার ব্যাগ বর্ডার এ পৌঁছে দিবে। বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন এ সিরিয়াল ধরে একজন করে নাম ডাকছে আর নাম, বাবার নাম জিজ্ঞেস করে ছবি তুলে যেতে বলছে। আমার পালা আসলো, প্রফেশন জিজ্ঞেস করার পর এন ও সি চাইল। আমি আর আমার বন্ধু আগে থেকেই অফিস থেকে এন ও সি নিয়ে গেছিলাম। ওইটা দিলাম, ওরা রেখে দিল। এজন্য ব্লগ গুলোকে ধন্যবাদ দিতে হয়, কারন আগেই শুনেছিলাম চাকরিজীবী হলে এন ও সি না দিলে ইমিগ্রেশন এ ঝামেলা করে। তাই যারা চাকরি করেন অবশ্যই এন ও সি নিয়ে যাবেন, আর না নিয়ে গেলেও কোনও সমস্যা নাই, সে ক্ষেত্রে আপনাকে ১০০০-১৫০০ টাকা জরিমানা গুনতে হবে 😛

ইমিগ্রেশন থেকে এরপর যেতে হল বাংলাদেশ কাস্টমসে। এখানে শ্যামলীর লোকজন আমাদের পাসপোর্ট নিয়ে রেডি ছিল, যার যার পাসপোর্ট নিয়ে কাস্টমস এ গেলাম। জিজ্ঞেস করল কেন যাচ্ছি, সাথে কত ডলার আছে, বাংলা কত টাকা আছে, সব সত্যি বললাম। আমাদের কাছে ৩৫০ ডলার ছিল আর বাংলা টাকা ছিল ৬০০০ এর মত। কোন চেক করল না, শুধু বলল জনপ্রতি ১০০ টাকা করে দেন। আমি আর আমার বউ ২০০ টাকা দিয়ে বের হয়ে আসলাম।

বাংলাদেশ কাস্টমস অফিস

এইবার ভারতে প্রবেশ করলাম, প্রথমে বিএসএফ পাসপোর্ট এ ভিসা চেক করে নিল। এরপর ইন্ডিয়ান কাস্টমস এ সাথের লাগেজ ব্যাগ খুলতে বলল, খুলে দেখালাম। তারপর ব্যাগ ওইখানে রেখে চলে গেলাম ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনে। এইখানে জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছি, কোন হোটেল এ উঠবো। যেহেতু হোটেল বুকিং দিয়ে যাই নাই তাই বললাম, ওরা যে কোনও হোটেল লিখে দিল ( তবে ফেরার সময় আবার কোন হোটেল এ ছিলাম তার নাম জিজ্ঞেস করে লিখে দিয়েছিল)।

ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিস

এরপর ছবি তুলে ইমিগ্রেশন শেষ করে শ্যামলীর কাঊনটার এ গিয়ে সকল ডলার রুপি তে করে নিলাম, সাথের বাংলাদেশী টাকা থেকে ৪০০০ টাকা ও রুপিতে করে নিলাম। আর ঐখান থেকে একটা এয়ারটেল এর সিম কিনলাম। এখানে শ্যামলীর কাঊনটার এই আপনি সব থেকে ভালো রেট পাবেন। আমরা প্রতি ডলার এ ৬৬ রুপি করে পেয়েছিলাম। সকাল সাড়ে ১০ টার দিকে শ্যামলীর কানেকটিং বাস আসল, এই বাসটার অবস্থা বেশি ভালো না।

আমরা সবাই বাস এ যার যার সিট এ বসে পরলাম, আর মনে করে ঘড়ির সময় আধা ঘণ্টা পিছিয়ে নিলাম। চ্যাংরাবান্ধা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত রাস্তা আমাদের দেশের রাস্তার মতই, তবে মাঝে তিস্তা ব্রিজ পার হতে হয়। এরা তিস্তার পানি যে কি করছে আল্লাহ ই জানে। ঐখানেও পানি নাই। সব থেকে ভালো হয় এই সময় টায় ঘুমিয়ে নিলে।

দুপুর সাড়ে ১২ টায় আমরা শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলাম। নেমে রিটার্ন টিকেট কেটে নিলাম জন প্রতি ১২০০ রুপি করে। তারপর কাঊনটার এর দোতলায় একটা রেস্টুরেন্ট এ দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। তিন জনের মোট খরচ হল ৩৬০ রুপি, তবে খাবার খুব জঘন্য ছিল। ফেরত আসার দিন শ্যামলী বাস কাঊনটার এর রাস্তার উল্টোদিক এ ঢাকা হোটেল নামক একটা রেস্টুরেন্ট এ খাবার খেয়েছিলাম। খাবার খুব ই ভালো ছিল এবং সস্তাও ছিল, খেয়ে দেখতে পারেন।

ঢাকা হোটেল, শিলিগুড়ি

বুড়িমারী বাস থেকে নেমেই পরিচয় হয়েছিল মামুন ভাই আর মুক্তা ভাবির সাথে, তারাও দার্জিলিং যাচ্ছিল। এর মধ্যে আবার মামুন ভাই বাস এর আরও চার জন শুভ, রাফি, ইকবাল ভাই আর সজিব ভাই এর সাথেও ভাব করে ফেলেছিল। ফলে আমরা সব মিলিয়ে ৯ জনের গ্রুপ এ পরিনত হলাম এবং এর মধ্যে শুভ আর রাফি শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই ঘুরে একসাথে ঢাকা এসেছিলাম (সবাই ঘুরতে যায়, তাই আপনাদের গ্রুপ ছোট হলেও বাস এর অন্যদের সাথে মিশে গ্রুপ করে ফেলার চেষ্টা করবেন, এতে খরচ ও বাঁচে, আবার নতুন মানুষের সাথে মেশাও যায়)।

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং শেয়ারড জীপ এর ভাড়া ১৩০ রুপি জন প্রতি এবং এক জীপ এ ১০ জন করে নেয়। সামনে দুইজন , মাঝে চার জন, পিছনে চার জন। আমরা ছিলাম ৯ জন তাই আমরা তিনজন মাঝের চার সিট নিয়ে নিলাম আরাম করে বসার জন্য। মামুন ভাই আবার কোথা থেকে যেন ১২০০ রুপি তে একটা জীপ ঠিক করে নিয়ে আসল এবং আল্লাহ এর অশেষ রহমতে আমরা দুপুর ২ টার দিকে দার্জিলিং এর পথে যাত্রা শুরু করলাম (চলবে)।

ট্যুর এর খরচগুলো এখানে পাবেন

Leave a Comment
Share