কম খরচে আমার ভারত ভ্রমণ ( কলকাতা পর্ব )

২০১৫’র ১৯শে সেপ্টেম্বর শনিবার সকাল সোয়া সাতটার দিকে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে আমার বাবার সাথে তার মোটরসাইকেলে বেনাপোলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। যশোর থেকে বেনাপোলের রাস্তাটা এতো খারাপ যে বলার মতো নয়।

অবশ্য যশোরের সব রাস্তার একই অবস্থা। বেনাপোলের মাত্র ৩৮ কিঃমিঃ আসতে লাগলো সোয়া এক ঘন্টারও বেশি। ইমিগ্রেশনে আমার পরিচিত এক দালাল আছে। ফোন দিলাম তাকে। সে জানালো যে সে আসতে পারবে না, তার বদলে অন্য একজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কি আর করা যাবে! আসলো সে দালাল। সে আমার পাসপোর্ট নিয়ে ট্রাভেল ট্যাক্স জমা দিলো। এরপর দালালটার কাছে আমার সব টাকা-পয়সা জমা দিয়ে দিলাম। এর ফলে কাস্টমসে চেক করলে আমার কাছে কোন টাকা পাবে না। ইন্ডিয়ায় ঢুকে অন্য দালালের কাছ থেকে রুপি নিয়ে নেব।

ব কাজ শেষ হলে প্রথমে বাংলাদেশ কাস্টমস পার হলাম। তারপর বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পার হয়ে জিরো পয়েন্টে গেলাম। আমার বাবা দেখি বাংলাদেশ সিমান্তে দাঁড়িয়ে আছে, তার উদ্দেশ্যে শেষবারের মতো হাত নেড়ে ঢুকে গেলাম ভারতে।

ইন্ডিয়ান কাস্টমসে বিরাট লম্বা লাইন। তারা প্রথমে সকল যাত্রীর ব্যাগ মেশিন দিয়ে চেক করে তারপর সেই ব্যাগগুলো খুলে সব জিনিস-পত্র নামিয়ে হাতড়ে হাতড়ে চেক করছে। অবশেষে আমার পালা যখন এলো প্রথমেই তারা আমাকে বড়সড় আকারের সন্দেহ করে বসলো। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আমি একজন মানুষ অথচ আমার ব্যাগ এতো মোটা কেন? বাড়ি থেকে বের হবার সময় কৌতুহলবশত ব্যাগটার ওজন মেপে দেখেছিলাম সাড়ে ১৮ কেজি। তো তাদেরকে বোঝালাম যে, আমি দার্জিলিং যাবো তো এজন্য অনেকগুলো সোয়েটার রয়েছে। কারণ দার্জিলিং হচ্ছে ঠান্ডার জায়গা। ব্যাটাকে কাশ্মিরের কথা বললে ভাবতো আমি খুব বড়লোক। তাহলে আমার কাছ থেকে টু-পাইস কামিয়ে নেবার ধান্দা করতে পারত, এজন্য কাশ্মিরের বদলে দার্জিলিংয়ের কথা বলেছিলাম। তো কাস্টমস ব্যাটা দেখি আমার কথা বিশ্বাস করে আমার ব্যাগ না খুলেই ছেড়ে দিলো।

এপাশ থেকে এক কুলি হয়েছে আমার ইন্ডিয়ান পথ প্রদর্শক। কাস্টমস চেকিং শেষে সে আমাকে নিয়ে গেল একটা ফরম পূরণ করতে। সেখানে ১০ টাকা গচ্চা দিতে হলো ফরম পূরণ বাবদ। এরপর গেলাম ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনে। এখানে বেশি সময় লাগলো না। ইমিগ্রেশন শেষে এপাশের দালালের ঘরে এলাম। কে পি ঘোষ, একদম দরজার গোড়ায় এই দোকানটি। এখান থেকেই রুপি নেবার কথা। ব্যাটারা এতো খারাপ, আমার কাছ থেকে বেশি দাম নিয়েছে। ১০০ টাকায় আমি পেয়েছি মাত্র ৮২ রুপি। যেখানে অন্যান্য দোকানে পাওয়া যাচ্ছে ৮৩ রুপিরও বেশি। শুনতে লাগে মাত্র ১ রুপি কম-বেশি, কিন্তু ৫০,০০০ টাকা ভাঙ্গালে প্রায় ১,০০০টাকা লস হয়। আমি দেশ থেকে আমার সবগুলো প্যান্টের ভিতরের অংশে দুটি করে পকেট বানিয়ে নিয়ে এসেছি। মন খারাপ করে পাসপোর্ট আর রুপিগুলো সেখানে ঢুকিয়ে ফেললাম। একটা কথা বলে রাখি, এইসব দালাল আর কুলি না ধরে নিজের কাজ নিজে করলে কোন সমস্যা নেই, বরঞ্চ অনেকগুলো টাকা বেঁচে যায়। কিন্তু আমার বাবা আমাকে এতো ভালোবাসে যে আমার যেন কোন সমস্যা না হয় সেজন্যই এই ব্যাবস্থা।

জিপি সিম দিয়ে শেষবারের মতো বাবার সাথে কথা বলে উঠে বসলাম অটোতে। এই অটোগুলো বনগাঁ স্টেশন পর্যন্ত যায়। সময় লাগে ২০ মিনিটের মতো। বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়ায় ঢুকলে প্রথমেই যে সুবিধা পাওয়া যায় তা হচ্ছে সময়ের। ওরা আমাদের থেকে আধাঘন্টা পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় অনুযায়ি সাড়ে নটায় ঢুকলেও ভারতে তখন সকাল নটা বাজে।

অটো থেকে বনগাঁ স্টেশনে নেমে টিকিট কাউন্টারে গেলাম। বনগাঁ থেকে শিয়ালদা যাবার অনেকগুলো ট্রেন আছে। ভাড়া ২০ রুপি। কিছুক্ষণ পরপরই ট্রেন ছাড়ে। তবে পার্ক স্ট্রীট বা নিউ মার্কেট যেতে হলে বনগাঁ থেকে উঠে দমদমে নামা ভালো। ভাড়া ১৫ রুপি। দমদমে নেমে প্ল্যাটফর্ম বদলে মেট্রোতে উঠতে হবে। পার্ক স্ট্রীট যেতে হলে পার্ক স্ট্রীট স্টেশন, নিউ মার্কেট যেতে হলে এসপ্ল্যানেড, আর পিয়ারলেস হাসপাতাল যেতে হলে কবি সুভাষ স্টেশনে নামতে হবে। মেট্রো ট্রেনের ভাড়া সর্বচ্চো ২৫ রুপি।

তবে আমি কাটলাম বিবাদি বাগ স্টেশনের টিকিট। কারণ আমি যাবো ফেয়ারলি প্লেস। ফেয়ারলি প্লেসে ফরেন কোটায় সারা ইন্ডিয়ার ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায়। যেখানে সাধারণ ভারতীয়দের কোন দূরপাল্লায় যেতে হলে চার মাস আগে থেকে ট্রেনের টিকিট কাটতে হয় সেখানে বিদেশিরা যাত্রা শুরুর চার ঘন্টা আগেও ফরেন কোটায় টিকিট পেতে পারে। এ থেকেই বোঝা যায় ইন্ডিয়ান সরকার পর্যটনে কতোটা মনযোগী। কলকাতায় ফরেন কোটায় ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায় ফেয়ারলি প্লেসে। আর বিবাদি বাগ স্টেশনের সঙ্গেই ফেয়ারলি প্লেস। বনগাঁ স্টেশন থেকে ৯’৫০ এর মাঝেরহাট লোকাল ট্রেনটি দমদম থেকে শিয়ালদার দিকে না গিয়ে ডানদিকের পথ ধরে হুগলি নদীর ধার দিয়ে মাঝেরহাট স্টেশনে যায়। মাঝেরহাটের কয়েক স্টপেজ আগেই পড়ে বিবাদি বাগ স্টেশন।

টিকিট কেটে ট্রেনের একদম শেষের বগিতে উঠে বসলাম। কারণ সমনের বগিতে অতিরিক্ত ভিড় হয়। ভারতের লোকাল ট্রেনগুলোতে মহিলাদের জন্য আলাদা বগি সংরক্ষিত থাকে। সেই বগিতে কোন পুরুষ উঠলে তার কপালে ভয়াবহ দুঃখ আছে। গবদা গবদা মহিলা পুলিশ এসে সেই পুরুষগুলোকে আচ্ছামতো পিটায়। তবে সাধারণ বগিতে নারী-পুরুষ সবাই উঠতে পারে। এটা সেই সংরক্ষিত বগি না এটা নিশ্চিত হয়ে আমার মোটা ব্যাগটাকে সিটের নিচে চালান করে দিয়ে জানালার ধারে আরাম করে বসলাম।

একেবারে ঠিক সময়েই ট্রেন চলা শুরু হলো। দুপাশের দৃশ্য বাংলাদেশের মতো। সবুজ ধানক্ষেত। তবে মাঝে মাঝে যে দুয়েকটি বাড়ি-ঘর দেখা যাচ্ছে তা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক নিম্নমানের। পাঁচ-ছটা স্টেশন যাবার পর দম বন্ধ হয়ে গেল। এতো ভিড় যে ভয়ঙ্কর অবস্থা। তারই মধ্যে কেউ কেউ তাস খেলছে আর চিল্লাপাল্লা করছে। আর এদের বাংলা উচ্চারণ এতো বিদঘুটে আর নাকে নাকে যে কিছুক্ষণের মধ্যে মাথা ধরে যায়। একজন তো আমি সিটের নিচে ব্যাগ রেখেছি কেন এজন্য আমার সাথে রাগারাগি শুরু করে দিলো। একেকটি স্টেশন আসছে আর ঝাপিয়ে ঝাপিয়ে আরো লোক উঠছে।

বয়স্ক মহিলা যাত্রীদের অবস্থা দেখে সত্যিই খুব খারাপ লাগে। কিন্তু এখানকার লোকগুলো দেখি নিরবিকার। আমি যে তাদের আমার জায়গায় বসতে দেব, এমন অবস্থাও নেই। ভাগ্যিস আমি জানালার পাশে বসেছি বলে কিছুটা বাতাস পাচ্ছি। কিন্তু অন্যদের অবস্থা ভয়ঙ্কর। আবার এরই মধ্যে দেখি কিছু লোক ঘুমাচ্ছে। আমাদের দেশে লোকে যেমন বাসে মাথা পেছনে হেলিয়ে মুখ উঁচু করে হাঁ করে ঘুমায় তেমনটি নয়; এরা চিবুকটা বুকের কাছে ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে আর ট্রেনের দুলুনির সাথে সাথে দুলছে। নির্দিষ্ট স্টপেজের ঠিক পাঁচ মিনিট আগে উঠে আড়ামোড়া ভেঙে এই ভয়ঙ্কর ভিড় ঠেলে দরজার কাছে গিয়ে দাড়াচ্ছে। আমি খুব অবাক হলাম এই ভেবে যে, এদের নামার ঠিক ৫ মিনিট আগে ঘুম ভাঙ্গে কিভাবে!

ঘন্টা দেড়েক পর ট্রেন যখন দমদম জংশন আসলো তখন কিছুটা স্বস্তি পেলাম। কারণ অধিকাংশ লোক নেমে গেল মেট্রো ট্রেন ধরতে। এবার একটু হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। এতোক্ষণ ৮জনের সিটে ১৫জন বসে ছিলাম আর গায়ের উপর দাঁড়িয়ে ছিল আরো পাচ-ছজন। স্টেশনের এক মহিলা দেখি পূজো শেষে ট্রেনের জানালা দিয়ে সবাইকে প্রসাদ বিতরণ করছে। এতোক্ষণ ধরে চিল্লাপাল্লা করা লোকগুলি কি ভক্তিসহকারে সেই প্রসাদ চেয়ে নিলো, তারপর আরো ভক্তিসহকারে সেগুলি গলাধঃকরন শুরু করলো।

বাংলাদেশ বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়ায় ঢুকলেই প্রথমে যে জিনিসটা আলাদাভাবে চোখে পড়ে তা হচ্ছে এখানকার মহিলারা। এরা খুব পরিশ্রমী এবং এরা পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। এখানকার মহিলারা খুব সাইকেল চালায়। এমনকি বয়স্ক মহিলাদের পর্যন্ত আমি শাড়ি পরে সাইকেল চালাতে দেখেছি। বাংলাদেশের মেয়েদের মতো এদের মধ্যে ন্যাকা ন্যাকা ভাব নেই। খুব ভীড়ের মধ্যে পুরুষদের সাথে যুদ্ধ করে এরা ট্রেনে চাপে। তবে এদের রুচিবোধ কিছুটা নিম্নমানের। এরা খুব সস্তা ধরণের পোষাক-আশাক পড়ে। এদের মধ্যবিত্ত ঘরের মহিলারা পর্যন্ত এতো সস্তা দামের শাড়ি পড়ে যে আমাদের দেশের কোন বাড়ির কাজের মহিলাকে ৫০০টাকা দিলেও সেই শাড়ি পড়তে রাজি হবেনা।

তাছাড়া এদের শাড়ি পড়ার ধরণটিও অন্যরকম। বিশেষ করে হিন্দু মহিলাদের। এদের শরীরের বেশিরভাগ অংশই উন্মুক্ত থাকে। আর এ নিয়ে তাদের মাঝে কোন বিকার নেই। কলকাতা (Kolkata) এর বেশিরভাগ মহিলারা শাড়ি পরে। আবার অনেক বয়স্ক মহিলা থ্রী-কোয়ার্টার প্যান্ট আর গেঞ্জি পড়ে ঘুরে বেড়ায়। বেঢব আকৃতির এসব মহিলাদের দেখতে যে কি বীভৎসই লাগে। এমনকি এখানকার অল্পবয়সী মেয়েরা অনেক খোলামেলা হলেও ততোটা সুন্দর নয়। অথচ বাংলাদেশী মেয়েরা দেখতে কতো সুন্দর।

তো ট্রেন দমদম জংশন ছাড়িয়ে আবার চলা শুরু করলো। দমদম স্টেশনের কিছু পরেই চিতপুর স্টেশন, যেটির আরেক নাম হচ্ছে কলকাতা স্টেশন। এই স্টেশন থেকেই আন্তর্জাতিক মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলাচল করে। কলকাতা স্টেশন ছাড়ানোর পরই ট্রেন হুগলি নদীর ধার দিয়ে চলা শুরু করে। হুগলি নদীর চলিত নাম হচ্ছে গঙ্গা নদী। এই জায়গাটি আমার কাছে খুব ভালো লাগে। ডানদিকে গঙ্গা নদী আর বাদিকে পুরানো কলকাতার দুশো-তিনশো বছরের পুরানো তিন-চার তলা বাড়ি আর ট্রাম রাস্তা। ট্রেনের জানালা দিয়ে ঘড়ঘর শব্দ করে ট্রামের ছুটে চলা দেখছি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্টেশন। শোভাবাজার, বড়বাজার এরকম আরো কয়েকটি স্টপেজ পার হয়ে পৌছে গেলাম বিবাদি বাগ স্টেশনে। বনগাঁ থেকে আসতে প্রায় দু’ঘন্টা লাগলো। স্টেশনটির ডানদিকে নদী,যেটি পার হলেই বিখ্যাত হাওড়া স্টেশন। আর বাম দিকে বাইরে বের হলেই ফেয়ারলি প্লেস।

ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন থেকে বাইরে বের হলাম। রাস্তা পার হলেই ফেয়ারলি প্লেস ভবন। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর বিদেশীদের জন্য নির্ধারিত জায়গাটি খুজে পেলাম। কাঁচের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। দু’জন নিরাপত্তাকর্মী আমার পাসপোর্ট চেক করলো। শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত বিরাট হলরুমটি খুব পরিচ্ছন্ন। একটা অংশে মৈত্রী ট্রেনের টিকিট আর অন্য অংশে বিদেশীদের জন্য ভারতীয় ট্রেনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে। ঘরটির এককোনে পরিচ্ছন্ন একটা টয়লেটও আছে।

কাউন্টার থেকে একটা ফরম নিয়ে তা পূরণ করতে বসলাম। ভাগ্যিস আমি একটা কলম নিয়ে গিয়েছিলাম। ফরমটিতে নাম, বয়স, লিঙ্গ, ঠিকানা, জাতীয়তা, কোন ট্রেনে ও ট্রেনের কোন শ্রেণীতে ভ্রমণ করতে ইচ্ছুক, ট্রেনের নম্বর, প্রারম্ভিক ও সমাপ্তি স্টেশন ইত্যাদি তথ্য ইংরেজিতে পুরণ করতে হয়। আমার ইচ্ছা ছিল সেদিনের ট্রেনেই রওনা দেবার। কারণ একদিনও কলকাতায় থাকতে গেলে অযথা কিছু টাকা খরচ হবে। আমার গন্তব্য ছিল কালকা মেল ট্রেনে করে হাওড়া স্টেশন থেকে কালকা যাওয়া।

এটি ভারতের প্রথম দুরপাল্লার আন্তঃনগর ট্রেন। ১৮৬৬ সাল থেকে এটি চলাচল করছে। ট্রেনটির নম্বর হচ্ছে ১২৩১১। ফরমের সবকিছু পূরণ করে বসে রইলাম। ঘরটিতে দেখি দু’য়েকটা সাদা চামড়া আর বাকি সব বাংলাদেশী যাত্রী। আর এই বাংলাদেশী যাত্রীদের মধ্যে হুজুর শ্রেণীর লোকের সংখ্যা বেশি। যারা দিল্লীর বিভিন্ন মসজিদে যাবে। বসে বসে তাদের সাথে গল্প শুরু করলাম। ঘন্টাখানেক পরে আমার পালা এলো।

গিয়ে বসলাম কাউন্টারের সামনে রাখা চেয়ারে। ফরম জমা দেবার পর লোকটা কম্পিউটারে চাপাচাপি শুরু করলো। আল্লাহর রহমতে সেদিন সন্ধ্যার কালকা মেলের বিদেশীদের সিট খালি ছিলো। তবে সমস্যা বাধলো অন্য জায়গায়। হোটেলের ঠিকানা না দিলে টিকিট দেবার নিয়ম নেই।

কিন্তু আমি যেহেতু ঘন্টাখানেক আগে কলকাতায় এসেছি আর সন্ধ্যার ট্রেনেই কালকা যেতে চাই একথা শুনে ভদ্রলোক আমার জন্য ব্যাবস্থা করে দিলেন। আর এই ব্যাবস্থা করার জন্য তাকে ২০ রুপি উপঢৌকন দিতে হলো। ভারতের একটা আন্তর্জাতিক অফিসের রেলের অফিসার আমার কাছ থেকে ২৫ টাকা ( ২০ রুপি ) ঘুষ নিলো। ছিঃ ঘেন্না! এর চাইতে যদি ২০০রুপিও চাইতো তবু আমি খুশি হতাম।

হাওড়া থেকে হরিয়ানা প্রদেশের শহর কালকা পর্যন্ত ১,৭১৩ কিঃমিঃ দূরত্বের ৩৪ ঘন্টার কালকা মেইলের স্লীপার ক্লাসের ভাড়া ৬৮০ রুপি। থ্রী-টায়ার এসিতে গেলে এর ভাড়া ১,৮০০রুপি। আমি গরীব মানুষ, আমার জন্য স্লীপারই ভালো। কালকা যাবার কারণ হচ্ছে কালকা থেকে সিমলা পর্যন্ত ৯৬কিঃমিঃ পাহাড়ি টয় ট্রেন আছে। যেটাতে চড়ার আমার বহুদিনের শখ।

কাউন্টারের লোকটা আমাকে কালকা থেকে সিমলা যাবার কালকা মেইলের সংযুক্ত টয় ট্রেনের টিকিটও কেটে দিতে চাইলো । অর্থাৎ কালকা মেল ট্রেনটি কালকা স্টেশনে পৌছালে এর যাত্রীরা এই টয় ট্রেনে করে সিমলার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। কিন্তু আমি রাজি হয়নি। কারণ সংযুক্ত টয় ট্রেনটির সবগুলি সিট চেয়ার। আমার যদি উল্টোমুখ চেয়ারে সিট পড়ে তাহলে কিছুই ঠিকমতো উপভোগ করতে পারবো না। ভাবলাম কালকা স্টেশনে পৌছে যে টয় ট্রেনের বেঞ্চওয়ালা সিট খালি পাবো সেটাতে উঠে পড়বো।

টিকিট সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকান্ড শেষে বের হলাম ফেয়ারলি প্লেস থেকে। তারপর বিবাদি বাগ স্টেশন পার হয়ে নদীর ধারে এসে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে হাওড়া স্টেশনে যাবার ফেরীর টিকিট কাটলাম। একটা ফেরী দাড়িয়ে ছিলো উঠে পড়লাম সেটাতে। কিছুক্ষণের মাঝেই ফেরী চলা শুরু করলো।

একপাশে বিখ্যাত হাওড়া ব্রীজ, আর অন্যপাশে কিছুটা দূরে বিদ্যাসাগর সেতু।

মাঝের জায়গা দিয়ে ফেরী এগিয়ে চলেছে। চলন্ত ফেরীতে বাতাসের ঝাপটা এতো আরামদায়ক যে বলার মতো নয়। তবে সবথেকে ভালো লাগে দূর থেকে হাওড়া স্টেশন দেখতে।

লাল রঙের কতোগুলি বড় বড় ভবনের সমন্বয়ে গঠিত হাওড়া স্টেশন। জানা না থাকলে মনে হবে বিশাল কোন রাজপ্রাসাদ। আমিও প্রথমবার কলকাতায় এসে তাই ভেবেছিলাম।

ফেরী থেকে নেমে মাটির নিচের রাস্তা দিয়ে স্টেশনে প্রবেশ করলাম। ভারতের স্টেশনগুলিতে ক্লকরুম বলে একটা জায়গা আছে, যেখানে লাগেজ জমা রাখা যায়। আমার ব্যাগটা চালান করে দিলাম সেখানে। ফেরত নেবার সময় লাগেজ জমা রাখার ভাড়া হিসাবে ২০রুপি দিতে হয়েছিলো। ব্যাস এবার ঝাড়া হাত-পা। দৌড়ে গেলাম খাবার ঘরে। ভারতের স্টেশনগুলিতে কম দামে ভালো খাবারের ব্যাবস্থা আছে। জন আহারে ঢুকে রুপি জমা দিয়ে টোকেন সংগ্রহ করে খাবার নেবার লাইনে দাড়ালাম। ৬১রুপিতে দুটো দিম, তরকারি, ডাল আর ভাত খেতে অমৃতসম লাগলো।

খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে পুরো স্টেশনটা চক্কর দিতে লাগলাম। আমি আগেও যতোবার স্টেশনটিতে এসেছি ততোবার অবাক হয়েছি। এবারো তার ব্যাতিক্রম হলোনা। ২৩টি প্ল্যাটফর্মের বিশাল এই স্টেশনটিতে সবসময় কোন না কোন ট্রেন এসে থামছে। আর তাতে চড়ে আছে গাদা গাদা মানুষ। প্রতিদিন নাকি গড়ে ১২লাখ লোক এই স্টেশন ব্যাবহার করে। স্টেশনটিতে একগাদা টয়লেট আর গোসল করার ব্যাবস্থা আছে। আর রয়েছে হাজার হাজার খাবার পানির কল, যেখানে স্বাভাবিক আর ঠান্ডা দু’রকম পানিই পাওয়া যায়। স্টেশনটিতে কিছুদূর পরপর ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ড রয়েছে, যেখানে সকল ট্রেনের আসা যাওয়ার তথ্য প্রদর্শিত হচ্ছে। তাছাড়া মাইকে বাংলা, ইংরেজি আর হিন্দিতে এনাউন্স করছে।

লিফটে করে স্লিপার ক্লাসের ওয়েটিং রুমে এসে বসলাম। দেখি পুরুষেরা সব বড় জাঙ্গিয়া অথবা গামছা পড়ে মেঝেতে ঘুমাচ্ছে অথবা গোসলখানা থেকে বের হচ্ছে। মহিলাদের অবস্থাও তথৈবচ। কেউ কেউ মোবাইলে চার্জ দিচ্ছে। নিজেদের ট্রেনের সময় হলে এরা প্যান্ট পড়ে মালপত্র নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি ওয়েটিং রুমের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম।

এই জায়গাটা আমার কাছে অসাধারণ লাগে। স্টেশনের সামনে রাস্তা, তারপর বিশাল নদী যেখানে গাদা গাদা জলযান ঘুরে বেড়াচ্ছে। নদীর ওপারে সিটি অফ জয় কলকাতা শহর আর নদীর বুকে কলকাতার স্মারক চিহ্ন হাওড়া ব্রীজ তার বিশাল লোহার পরিকাঠামো নিয়ে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে আছে।

কিছুক্ষণ ফটোসেশনের পর বের হয়ে এলাম ওয়েটিং রুম থেকে।

স্টেশন থেকে বের হয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম হাওড়া ব্রীজের উপর। ব্রীজের দুপাশে হাটার জায়গা। সেখানে দাড়িয়ে কতোগুলি ছবি তুললাম।

তবে জায়গাটা আমার কাছে নিরাপদ লাগলো না। একজন আবার আমার হাতে ক্যামেরা দেখে সাবধানও করলো। তাড়াতাড়ি আবার স্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। এক খোলা জায়গায় দেখি ইউরেনাল রাখা আছে আর সবাই সেখানে দাড়িয়ে প্রসাব করছে। ধুতি পড়ে দাড়িয়ে প্রসাব করার ব্যাপারটি যেকোন বাংলাদেশীর কাছেই হাস্যকর। চুপিসারে সেখানেও একটা ছবি তুলে ফেললাম।

এরপর গেলাম তালা কিনতে। ইন্ডিয়ার ট্রেনে নাকি মালপত্র চুরি হবার সম্ভাবনা খুবই বেশি। এজন্য শিকল দিয়ে ব্যাগ বেঁধে রাখতে হয়। দরদাম করে শিকল আর তালা কিনলাম। সেখান থেকে গেলাম বালিশ কিনতে। ট্রেনের স্লিপার ক্লাসের সীট মানে একেক জনের জন্য একটি করে শোবার জায়গা। এসি বগিতে ট্রেন থেকে বালিশ দিলেও স্লিপার ক্লাসে সে ব্যাবস্থা নেই। ফু দিয়ে ফোলানো যায় এমন একটা বালিশ কিনলাম। পরে বালিশটিতে শুয়ে দেখেছি, খুবই আরামদায়ক।

বালিশ কেনা শেষে আবার স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ফেরত এলাম। চুপচাপ বসে রইলাম ঘন্টা দেড়েক। তারপর ক্লক রুম থেকে আমার ব্যাগ ছাড়িয়ে নিয়ে এলাম। তারপর দোকান থেকে পাউরুটি আর মিষ্টি কিনলাম রাতের খাবার হিসাবে। পানির বোতলগুলো ভরে নিলাম।

যেহেতু আজ শনিবার এজন্য হাওড়া থেকে দিল্লী পর্যন্ত যুবকদের জন্য কম খরচের একটা ট্রেন আছে। নাম ইউভা (যুব) এক্সপ্রেস। ট্রেনটি দেখার খুব শখ ছিল। এটি প্ল্যাটফর্মে পৌঁছানো মাত্র ছুটে গেলাম সেটি দেখতে। একেক সারিতে ৬টা করে চাপাচাপি ভাবে চেয়ার বসানো পুরো এসি ট্রেনটি দেখতে খুব সুন্দর। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এই ট্রেন থেকে নেমে এসে আমার কালকা মেইলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। পৌনে সাতটার দিকে মাইকে কালকা মেইলের আগমন বার্তা ঘোষিত হতে লাগলো। দৌড় লাগালাম নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মের দিকে।

খরচঃ ১৯শে সেপ্টেম্বর’১৫

১। ট্রাভেল ট্যাক্স=৫০০ টাকা
২। বাংলাদেশ দালাল=১০০ টাকা

মোট=৬০০ টাকা

১। ইন্ডিয়ান দালাল=১০০ রুপি
২। কুলি=৫০ রুপি
৩। ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ=১০ রুপি
৪। বর্ডার থেকে বনগাঁ স্টেশন পর্যন্ত অটো ভাড়া=২৫ রুপি
৫। বনগাঁ স্টেশন থেকে বিবাদি বাগ স্টেশন পর্যন্ত লোকাল ট্রেন ভাড়া=২০ রুপি
৬। হাওড়া থেকে কালকা পর্যন্ত ১,৭১৩ কিঃমিঃ ট্রেনের স্লিপার ক্লাসের ভাড়া=৬৮০ রুপি
৭। টিকিট কেনার ঘুষ=২০ রুপি
৮। ফেয়ারলি প্লেস থেকে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত নদী পার হবার ফেরী ভাড়া=৫ রুপি
৯। ক্লক রুম ভাড়া=২০ রুপি
১০। দুপুরের খাওয়া= ৬১ রুপি
১১। শিকল ও তালা কেনা=৯০ রুপি
১২। বালিশ কেনা=৭০ রুপি
১৩। রাতে খাবার পাউরুটি ও মিষ্টি=৪২ রুপি

মোট=১,১৯৩ রুপি। ১০০টাকায় ৮২ রুপি হিসাবে ১,৪৫৫ টাকা।

১৯শে সেপ্টেম্বর’১৫ তারিখে মোট খরচ ৬০০+১,৪৫৫=২,০৫৫ টাকা।

পরের পর্ব

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ calcuttaindiakolkatastorytravel