ভারত ভ্রমণ – কলকাতা পর্ব

২৪/১১/২০১২

নিউ মুনসুরাবাদের শ্যামলী কাউন্টারে বসে আছি । জুমন ভাই থেকে একটা ব্যাগ ধার নিছিলাম যেটা ছিড়ে গেছে এই লম্বা যাত্রা শুরুর আগেই। মাথা গরম হয়ে আছে। যাত্রার শুরুতেই ঝামেলা। নতুন ব্যাগ কিনে কাউন্টারে গ্যাট হয়ে বসে আছি। তিনটে ত্রিশ এ বাস এলো , বিজনেস ক্লাস বাস। ৩/১ সিট। আমার পড়লো একেবারে একা সিটটা। মনটাই সাথে সাথে ভাল হয়ে গেল। হোটেল নুরজাহানে বাস প্রথম ব্রেক নিল। শুধু এক কাপ চা খেলাম। বমি বমি লাগছিল , তাই আর কিছু খেলামনা। ঢাকাই যখন ঢুকতেছিলাম তখন একটা খবর শুনলাম যে বহদ্দারহাটের নির্মানাধীন ফ্লাই ওভার ধসে পড়ছে , অনেক মানুষ মারা গেছে। খু্বই খারাপ লাগলো। ঢাকায় শ্যামলী কাউন্টার থেকে হালকা নাস্তার একটা প্যাকেট দিল। সেটা খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম।

[ নোটঃ ইন্ডিয়ান ভিসা পাওয়া অত্যাস্ত সহজ , অনলাইনে (www.ivacbd.com) ফরম ফিলআপ করে প্রিন্ট আউট নেবেন। ওই ফরম এ দেওয়া ডেট এন্ড টাইম অনুযায়ী ওদের অফিসে উপস্থিত হয়ে যাবেন ওই ফরম , পাসপোর্ট , ছবি নিদৃষ্ট সাইজের (2″*2″) , জন্ম নিবন্ধী ও অন্যান্য কাগজের ফটোকপি সহ। ভিসা ফি ৪০০ টাকা । পরের দিন কোন ছুটি না থাকলে সেদিন-ই ভিসা পেয়ে যাবেন। বা আপনাকে দেওয়া রসিদে টাইম এন্ড ডেট দেওয়া থাকবে। শ্যামলী বাস একেবারে কোলকাতা পর্যন্ত দিয়ে আসবে আপনাকে চট্রগ্রাম থেকে । এসি বাস ৪০০০ টাকা রিটার্ণ সহ এবং এটায় আপনি বেনাপোল থেকে কোলকাতার মারকুইস স্ট্রিট পর্যন্ত যেতে পারবেন । এবং বর্ডারে আপনার পোর্টার কস্ট এবং কাগজ পত্রের কাজ ও এরা করে দেবে। ননএসি ১৪০০ টাকা । প্লাস বর্ডার থেকে ১৫০ রুপি কোলকাতা পর্যন্ত শ্যামলি বাস। এছাড়া আপনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রেনে যেতে পারেন। মত্রি এক্সপ্রেস ট্র্রেন যায় কোলকাতা পর্যন্ত। ভাড়া AC কোচ – ১১০০ টাকা , AC চেয়ার ৬৬০ টাকা , নন এসি ৪৩০ টাকা। বাংলাদেশ রেইলওয়ের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত পাবেন [http://www.railway.gov.bd/maitreeexpress1.asp]। ]

২৫/১১/২০১২

রাত দুটার দিকে ঘুম ভাংগলো। দেখি বাস চলছেনা। বাসের সিটেও মানুষ কম। কি ঘটনা দেখতে বাস থেকে নামলাম ক্যামেরা সমেত। দেখি আমি বাস সমেত বিশাল একটা ফেরিতে। কিছু ছবি তুললাম। এদিক সেদিক ঘুরলাম। এরপর টয়লেটে ট্রাই মারলাম, ময়লা, দুর্গন্ধ। পেটের নাড়ি – ভুড়ি উল্টে আসে। ফেরির ক্যান্টিনে গেলাম। প্যাকেজ সিস্টেম খাবার নিলাম, ১৫০ টাকা । মুরগী একবারই কিন্তু সবজী, ভাত যত খুশি। পানির উপর দিয়ে পেটে অনেক গুলো বাস আর ট্রাক ভরতি নৌযানটি নিয়ে অপুর্ব অনেক চরকে পাশ কাটিয়ে আমরা ঘাটে পৌছিলাম। ঘুমন্ত যশোরের উপর দিয়ে খুব ভোরে বেনাপোল পৌছালাম। বর্ডার খোলে ৯টায়। তাই নাস্তা করে এদিক সেদিক ঘুরলাম।

ফেরি রাতের আধারে।

ব্যাংক খোলার পর ৩০০ টাকা বাংলাদেশ সরকারের নামে জমা দিয়ে কাগজ সহ রর্ডারের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করলাম। অনেক দালাল রা ট্রাই করলো আমার থেকে ব্যাগ নিয়ে বর্ডার ক্রস করে দেবে বলে। ব্যাগ চেক করবেনা কর্মকরর্তারা। কান দিলাম না। ভারতে এর আগেও অনেক বার এসেছি। যানি এরা কেমন। তাই নিজের মত এগুলাম। কোন ঝামেলা ছাড়াই ক্রস করলাম। ইন্ডিয়ার মাটিতে পা দিয়েই কেমন জানি একটা ফিলিং হতে লাগলো। কারণটা সহজ। নতুন কোন ভ্রমনের আসা , অন্য একটা দেশ। প্রথমেই শ্যামলী কাউন্টারে ঢুকে ফ্রেস হলাম। সেখানেই ডলার এক্যচেন্জ করা যায়। কিন্তু করলামনা। ঢাকাই একটা ফোন করলাম কারেন্ট রেট জানতে। ( কোলকাতার ভেতরে প্রায় ১০-১২ কিমি পর্যন্ত গ্রামীন এবং রবি নেটেওয়আর্ক কাজ করে। ) পরে পাশের একটা এক্সচেঞ্জ থেকে ডলার ভাংগিয়ে রুপি নিলাম। রিসিটটা/রশিদ নিতে ভুললামনা। শ্যামলীর বাসে করে কোলকাতা যাত্রা শুরু হলো। পথে ধাবা মতো একটা প্লেসে গাড়ি দাড়ালো। ১০০ রুপি দিয়ে নাস্তা খেলাম। ভারতের এই যাত্রার প্রথম খাবার এবং খরচ। যাত্রা হলো শুরু।

দুপুর দুটা নাগাদ বাস আমাকে কলিং স্ট্রিট নামিয়ে দিল। প্রথমে আমি গতবার যে হোটেল এ উঠেছিলাম সেটায় খোজ নিলাম। ভাড়া ডাবল চাইলো। হিন্দি ভাষা আমার খারাপনা। তাই অনেক বুঝালাম তাদের ভাষায়। লাভ হলোনা। আশপাশের অন্যান্য হোটেল গুলায় দেখলাম। রুম নাই। এদিকে সিম কার্ড কেনার ট্রাই করলাম। দেখলাম নিয়ম কানুন অনেক পরিবর্ত হয়েছে। দু-তিনদিন লাগবে অ্যাকটিভ হতে। সিম আর নিলামনা। কারণ আমি এ শহরে বেশিদিন থাকবোনা। অ্যাকটিভেট না হলে তাদের কোন সাহায্য পাবোনা। একটা হলুদ ক্যাব নিয়ে সোজা জাকারিয়া স্ট্রিট চলে আসলাম। এখানে না খুদা মসজিদের ঠিক পরের গলিতে ঢুকে একটা হোটেল নিলাম। মাত্র ৩০০ রুপি দিয়ে।

জাকারিয়া স্ট্রিট যাওয়ার পথে।

হোটেল এ ফ্র্রেশ হয়ে বের হলাম। প্রচন্ড খুদা লাগছে ততক্ষনে । কিন্তু এ সময়ে কোথাও চাউল পেলামনা। ভারতীয়রা ভাতকে চাউল বলে। সো ইন্ডিয়ান রুটি দিয়ে সবজী খেলাম। বাইরে এসে দেখলাম খুব সুন্দর সুন্দর পেয়ারা বিক্রি করতেছে একটা ৫ রুপি দিয়ে কিনে খাইতে খাইতে শহরের এদিত সেদিক হাটতে লাগলাম। এখানে শপিং এর অনেক জিনিস। কিন্তু আমার ট্রাভেল গুলো যেহেতু কম বাজেটের হয়। আমি শপিং পরেই করি। প্রথমে গেলাম মসজিদটা দেখতে। সুন্দর এবং বিশাল একটা মসজিদ ওটা।

এরপর রাস্তার পাশে অনেক্ষন দাড়িয়ে থাকলাম ট্রামে চড়বো বলে ট্রাম পেলামনা। সারা রাস্তায় ট্রামের লাইনের ছড়া ছড়ি কিন্তু ট্রাম নেই। তাই হাটতে লাগলাম। একসময় অজানা রাস্তায় হাটতে হাটতে হাওড়া ব্রিজ চলে আসলাম। ব্রিজের পাশে নদী এবং ঘাটে নৌকা দেখে দেখে টাইম পাস করতে লাগলাম। রাত্রে তেহেরীর মত কিছু খেলাম। আর স্ট্রিট ফুড সাফারী করলাম। মিষ্টি , আলু চপ , পানি পুড়ি খেয়ে হোটেল এ এসে একটা লম্বা ঘুম দিলাম।

স্টিমার আর ওই হাওড়া ব্রিজ। এই স্টিমারে মাত্র কিছু রুপি দিয়ে কিছুক্ষন চড়লাম।

[ নোটঃ ফেরিতে অপরিচিত কিছু খাবেননা। বর্ডারে ৩০০ টাকা সরকারি কর দিতে হবে । এবং ছোট খাটো কিছু ফরম পূরন করতে হবে। যা আপনি শ্যামলীর লোকদিয়ে ও করতে পারবেন কিছু টাকার বিনিময়ে। আর নিজে চাইলে নিজেই করতে পারবেন। বর্ডারে কারো কোন হেল্প লাগবেনা। কাউকে কোন টাকা দিতে হবেনা। কম খরছে হোটেল চাইলে যেখানে আমি উঠছিলাম সেদিকে যেতে পারেন। আর ভালমানের হোটেল চাইলে বাস কাউন্টারের আস-পাশেই থাকতে পারেন। ]

২৬/১১/২০১২

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভবন।

সকাল সকাল উঠে লোকাল বাসে উঠবো বলে রওনা দিলাম “ফেয়ারলি প্লেস” নামে একটা ভবনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু পথেই ট্রাম পেয়ে গেলাম। এই ভবনেই আছে ইন্ডিয়ান রেইল এর ফরেন গেস্টদের টিকিট কাউন্টার। টিকেট কাটতে পাসপোট দেখাতে হয়। ভিসা সহ। টিকিট কাটলাম দিল্লি যাওয়ার। স্লিপার ক্লাস টিকেট না থাকায় ৩A টিকিট কাটলাম। যার খরছ ১৫৫০ রুপি। এত্ত গুলাটাকা বের হয়ে গেলো। যেখানে অন্য টিকিট মাত্র ৫৫০ রুপি। তবে আমাকে বলা হলো ট্রেনটা ( দুরন্ত এক্সপ্রেস ) নতুন এবং খুবই ভালো। খাবারের মানও ভালো ট্রেনটাই।

দিল্লি যাওয়া নিশ্চিত করে , এরপর হাটা শুরু করলাম পার্ক স্ট্রিটের উদ্দেশ্যে প্রায় ৩ কি:মি রাস্তা। চাইলে আমি মেট্রো ট্রনে যেতে পারতাম। কিন্ত মেট্রো ট্রেনে মাত্র ১ মিনিট লাগে। যেখানে হাটলে আমি পুরো শহরটা দেখতে দেখতে যেতে পারবো। পথে লেবুর শরবত আর একটা বার্গার খেয়ে নিলাম। রাস্তার আশপাশ দেখে দেখে চলতে লাগলাম।

অবশেষে পৌছালাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল । মাত্র ১০ রুপি টিকিট কাটলাম। যেখানে বাইরের দেশের টুরিস্ট দের জন্য ৭০ রুপি। আমার চেহারা দেখে বোঝার উপায় নাই যে আমি বাংলাদেশী। 😛 মিউজিয়ামের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ । তাই সব ছবি বাইরের।

এভাবে ঘুরতে ঘুরতে রাত হলো। আমি মেট্রো ট্রেন করে হোটেলের পথ ধরলাম। যে রাস্তা হেটে আসতে আমার ১ ঘন্টা লাগছিল সেটা মট্রোতে ১ মিনিট এ চলে আসলাম। নিল ৫ রুপি।
কাল সাইন্স সিটি অভিযান। তাই খেয়ে ঘুমাতে গেলাম।

[ নোটঃ শহরে অল্প দুরত্বের রাস্তা হেটে ঘুরাই ভাল। টিকিট কাটতে বা কিছু কিনতে বাংলাদেশী বা আপনি বাইরের পরিচয় না দিলে কম খরচ পড়বে। আর কোলকাতায় দ্রুত পাবলিক যান হলো মেট্রো ট্র্রেন । মূহুত্বে এক স্থান থেকে শহরের আরেক স্থানে চলে যেতে পারবেন। স্টেশনে ঢুকতেই ট্রেনের রুট প্লান এবং ভাড়া দেখে নেবেন। ]

২৭/১১/২০১২

কি নেই সাইন্স সিটিতে?

সকাল এ উঠে একটা অটো নিয়ে বাইপাস রোডের সাইন্স সিটিতে রওনা দিলাম। তার আগে জাকারিয়া স্ট্রিটের বিক্ষাত দুদ চা দিয়ে নাস্তা করতে ভুললামনা। সাইনসৃ সিটিতে ঢুকার দুটা পথ আছে। একটা উড়ে উড়ে একটা নিচেদিয়ে হেটে হেটে। আইমিন একটা ক্যাবল কারদিয়ে অন্যটা গেটদিয়ে ভদ্র লোকরে মত। আমি প্লান করলাম ঢুকবো ক্যাবল কার দিয়ে ঢুকবো আর বের হব হেটে হেটে। সাইন্স সিটিতে পুরা একটা দিন সহজেই কেটে যাবে। দেখার আর শেখার অনকে কিছু। অনেক কিছু। আমি দুটা বিজ্ঞান বিষয়ে ফ্লিম দেখলাম। ডায়নাসর এর যুগের ভবনে ঢুকলাম। মিরোর মেজিক ভবনে ঢুকলাম। আরো কতো কি! ছবি এই পোস্টে এমনিতেই বেশি হয়ে গেছে তাই বেশি আপলোড দিলামনা। চাইলে শুধু সাইন্স সিটি নিয়ে ই একটা পোস্ট এবং ছবি এলবাম খুলা যাই। প্লেসটা আসলেই অসাধারণ।

এবার ফেরার পালা। মেট্রো ট্রেন করে ফেরত এলাম। সোজা হোটেল এ এসে কাপড় চোপড় গোছাতে বসলাম। আগামি কাল দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা হবো। লম্বা একটা ট্র্রেন যাত্রা।

 

২৮/১১/২০১২

হোটেল ছাড়লাম সব ভাড়া মিটিয়ে। ২৪ ঘন্টা চেক আউট টাইম ছিল হোটেল এর। লোকাল একটা বাসে উঠে শিয়ালদহ স্টেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। সেখানে ওয়েটিং রুমে বসলাম। যেহেতু বেশি দামের টিকিট টাই কাটলাম , তাই ওয়েটিং রুমটা ছিল সে রকম। যেন বিমান এর ওয়েটিং রুম। একটা মেশিন ও ছিল যেটায় টিকিট এর নম্বরটা দেওয়ার সাথে সাথে আমার নাম সহ, সিট নম্বর, বিস্তারিত দেখাতে লাগলো। ট্রেন একেবারে ঠিক সময়েই এলো এবং ছাড়লো।

দীর্ঘ যাত্রা শুরু হলো। ট্র্রনের ওই কেভিন এ টোটাল ৮টা সটি। ৮ জনের ই আলাদা আলাদা ঘুমানোর ব্যাবস্থা। যাস্ট সিট গুলো উঠিয়ে নিলেই হলো। খাবার রাখার জন্য তাক আছে। ট্রেন থেকেই খাবার দিল। দুটা মিল। একট ব্রেকফাস্ট। খাবারের মান ভালই। আমার সহ যাত্রি দুজন মেয়ে একজন কেনাডিয়ান ছিল। বাকিরা ভারতীয়। গল্প করতে করতে টাইম পাস করতে লাগলাম। ৫৪B সিটের মেয়েটা খুব সুন্দর ছিল। কয়েকবার চোখাচোখি হলো 😛 । খাবার খেয়ে সিটে আরামে ঘুমাতে গেলাম। ট্রেন থেকেই কম্বল এবং চাদর দিল।

ট্রেন কখনো পাহাড় কখনো ধুধু মাঠের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল। কখনো কোন অজানা ঘুমন্ত শহরের ভেতর দিয়ে। কাল আমি ভারতের রাজধানী থাকবো। সে গল্প পরবর্তী লিখাতে বলবো। অপেক্ষা করতে থাকুন। 😀

[নোটঃ ট্রেনের টিকিট কাটতে খেয়াল করুন কোনটা কাটবনে। আরামের যাত্রা চাইলে 3A টাই কাটুন। নইলে স্লিপার ক্লাস। স্লিপার ক্লাসে বাইরের মানুষ ওঠানামা করে। মনে রাখবেন এই ট্রেন যাত্রাটা অনেক লম্বা।]

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ indiakolkatastorytourtravel