একদিনের ট্যুরে হামহাম ঝর্ণা দেখা

৩ জন বোকা মানে 3 idiots ছবিটা দেখেন নাই এমন লোক সম্ভবত খুব কমই পাওয়া যাবে। যাই হোক, ছবিটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সৌভাগ্য বলার কারনটা পরে বলছি। তার আগে বলে নেই ঠিক কি কারনে হামহাম ঝর্ণার ভ্রমণে এই ছবিটার প্রসঙ্গ টানলাম। ছবির একটা দৃশ্যে আমির খান তার বন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বলছিল ” জীবনের এমন একটা সময় আসবে যখন তুমি অসুস্হ অবস্হায় বিছানার বেডে শুয়ে চোখের পানি ফেলবে আর ভাববে আমি তো আমার অমুক ইচ্ছাটা পূরন করতে পারতাম বা এমন একটা দুঃখ তৈরি হবে তোমার মধ্যে যে তুমি সেই কাজটা চাইলেই করতে পারতে কিন্তু তুমি করো নি, কিন্তু এখন তোমার আর সেই ক্ষমতাও নেই যে তুমি চাইলেই করতে পারবে। মোটামুটি ডায়ালগের মূল অর্থের কাছাকাছি ছিল এটি, যা আমি বুঝাতে চেষ্টা করলাম। কারন আমি হিন্দি ভাষা খুব একটা পরিষ্কার বুঝি না। যা বুঝি আবছা আবছা। অন্য আরেকজনের সাহায্য সহযোগিতাও নিতে হয় এই অধমকে, ডায়ালগের ভাষাগুলো বুঝার জন্য। যাই হোক, ডায়ালগের মূল উদ্দেশ্যটা ছিল খুব পরিষ্কার। তা হল তোমার মন যা চায়, তুমি তাই-ই করো, কারন এমন একটা সময় আসবে তখন তুমি সময় বের করতে পারবে না বা তোমার ক্ষমতায়ও কুলাবে না।

এইবার হয়তবা অনেকেই বুঝতে পেরেছেন কেন আমি এই ছবির প্রসঙ্গটা টেনেছি। যাই হোক, সেই থেকে ছবির এই ডায়ালগ আমার জীবনের পাথেয় বানিয়ে ছিলাম। জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই ডায়ালগের দৃশ্যগুলো আমার চোখে ভেসে ওঠে। তখন আমি আর নিজেকে, নিজের গন্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে পারি না। চেষ্টা করি নিজের ইচ্ছাগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার।

এতক্ষণে শুধীজন সমাজে আমাকে নিয়ে হয়ত নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। ব্যাটার আসল হিস্ট্রির খবর নাই, আইছে নিজের হিস্ট্রি শুনাইতে। হয়ত বা এরকম “অনেক বকবক হইছে, এলা আসল কাহিনী কন “। হুম আমার তাই মনে হচ্ছে কোথা থেকে কোথায় যাচ্ছি। বস্তুত এই বিষয়গুলোই ট্রাভেলিং জগতে আমাকে অনুপ্রেরনা দিয়ে আসছে বছর তিনেক ধরে। এইসব বিষয়ই ছিল ঘটনাগুলোর মূল হোতা 😊। কিভাবে? সেটা জানতে আরোও কিছুক্ষণ বকবক করে যেতে হবে আমাকে 😁

এইবার আসি মূল প্রসঙ্গে। আমার অফিসের এক কলিগ বলতেছিল হাম হাম ঝর্না দেখতে যাবেন কিনা? শুনে একটু চিন্তা করে বললাম, “এটা কোথায়? ” বললেন মৌলভীবাজারের কমলগন্ঞ্জে। কথা ছিল গত বছরের শেষের দিকে যাবো। সেবার আর যাওয়া হয় নি মিনিমাম ট্যুরমেট ম্যানেজ করতে না পারার কারনে। মাসখানেক আগে আবার সেই কলিগের উদ্যোগে অবশেষে যাওয়া হলো। কল্পনাও করতে পারি নি যাওয়া হবে। যাই হোক গেলাম। টিমে ছিল ১০ জন। সারাদিনের জন্য হায়েস ভাড়া করলাম ৭০০০ টাকা দিয়ে। আমরা রওনা করেছিলাম আশুগন্ঞ্জ, ব্রাহ্মনবাড়িয়া থেকে। যাত্রা করেছিলাম সকাল ৭ঃ৩০ মিনিটে। আমরা যখন হাম হাম জলপ্রপাতের যাওয়ার মূল রাস্তায় পৌঁছায় তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে বারোটা ছুঁই ছঁই। দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে আমরা ছুটলাম হাম হামের উদ্দেশ্যে। ও আরেকটা কথা বলা হয় নাই তা হলো সকালের নাস্তা করার জন্য আমরা শ্রীমঙ্গলের পানশিতে গিয়েছিলাম। খাবারের মান যথেষ্ট ভালো বলে মনে হল আমাদের সবার কাছে।

কখনো আগে আসা হয়নি এখানটাই। তবে ঐ কলিগ আর ইউটিউবের মাধ্যমে বেশ ভালোই একটা ধারনা হয়ে গিয়েছিল। জানতে পেরেছি হাম হামে যেতেই নাকি লাগে দেড় ঘন্টা। তাহলে কি দাঁড়ালো? যেতে আসতেই লাগবে কমপক্ষে ৩ ঘন্টা ( যদি মোটামুটি বিরতি নেওয়া হয় পথিমধ্যে )। সেটা না হয় দেওয়া যাবে। কিন্তু রাস্তা যে সমতল নয়। পাবেন হয়ত সামান্য কিছু অংশ। বেশির ভাগ রাস্তাই পাবেন একেবারে উঁচুতে চলে গেছে আবার একেবার নিচে চলে গেছে টাইপের । একবার পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে ওঠবেন তো আরেকবার নিচে নামবেন । এই উঠা আর নামা যেন একবারে শেষ হতেই চাচ্ছিল না । জীবনে এই ধরনের ট্রেকিং কখনোই করা হয় নি আমার। তাই নিজেকে একজন বীর ভেবে মনকে সাত্বনা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এদিকে এক কলিগ তো সিধান্ত নিয়ে ফেলেছিল ফিরে যাওয়ার। পরে সঙ্গি সাথি না পাওয়ায় একেবারে নিরুপায় হয়েই আমাদের সাথে যেতে বাধ্য হল। আসলে সেও বুঝতে পারি নি কতটা কঠিন হবে এই ট্রেকিং। বার বার মুখের ওপর দিয়ে বেয়ে পড়া ঘাম মুছতেছি কাধে ঝুলানো গামছাটা দিয়ে। ও আচ্ছা আমরা একজন গাইডকে ভাড়া করেছিলাম ২০০ টাকার বিনিময়ে, রাস্তা চিনিয়ে নেওয়ার জন্যে। যদিও পরবর্তিতে মনে হয়েছিল ভাড়াটা আরেকটু বেশি দিলেও কষ্ট লাগতো না। কারন সে সাথে থাকাতে অনেক উপকার হয়েছিল আমাদের। যা বলতেছিলাম, কোন কোন সময় দেখবেন আরামে নামতেছেন, কিন্তু পরক্ষনেই দেখবেন আবার সেই লেবেলের হাই ট্রেক। পাহাড়ের রাস্তা ধরে উপরে ওঠতে ওঠতে মনে হচ্ছিল ব্লাড প্রেসার একবার বেড়ে যাচ্ছে আবার ধপাস করে নেমে যাচ্ছে নামার সময়। শুধু যে খাড়া আর নিচু পথ তাও কিন্তু না। মানে আপনি যদি কোন কারনে একটু বেখেয়াল হয়ে ট্রেক থেকে সরে যান অর্থাৎ নিচে পড়ে যান তাহলে কি ঘটবে আমি জানি না। একমাত্র আল্লাহ-ই ভালো জানেন পড়ে যাওয়া লোকটির ভাগ্যে কি লেখা আছে। পড়ে গেলে জীবত থাকা আর না থাকা এক সমান মনে হল আমার কাছে। মানে সেই লেভেলের গভীর এবং গহীন খাঁদ । মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করতেছিলাম বর্ষাকালে আসি নাই। তাহলে পা পিছলে হাত-পা ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম ছিল না। আশা করেছিলাম যাওয়ার পথে পাহাড়ি ঘরবাড়ি দেখতে পাবো। কিন্তু কিসের ঘরবাড়ি? ওইখানে ভূত-প্রেত ছাড়া আর কিছু থাকার কথাও নয়। নাম না জানা অজানা হাজার গাছপালা, লতা-গুল্ম আর বাঁশ ঝাড় ঢেকে রেখেছে পুরাটা অন্ঞ্চল আর পাহাড়ি পথ। হাম হামে যাওয়ার জন্য ঝিরিপথও আছে। তবে গাইডের ভাষ্যমতে সেখান দিয়ে যাওয়াটা নাকি ওতো সহজ নয়, যতোটা সহজ পাহাড়ি রাস্তায় হয়। পথ চলতে চলতে কথা হচ্ছিল গাইডের সাথে। তারা নাকি চাচ্ছে ঝিরিপথটা ব্যবহার করার জন্য। সেটা হলে নাকি সময় এবং কষ্ট দুইটাই কমে যাবে। যাক ভবিষ্যত ভালো হোক হাম হামে আসার।

এইভাবেই চলে যাচ্ছিল সময়গুলো। ঘন্টা খানেক হয়ে গেল। হাটতেছি তো হাটতেছিই। এর যেন শেষ নেই। শেষের ধাপটা ছিল নামার। মনে হতে পারে এ আর তেমন কি কষ্ট? সারাটা রাস্তা ট্রেকিং করে আসতে আসতে এখানে এসে মনে হল পা যেন আর চলছেই না। প্রতিটি স্টেপ-ই ফেলছিলাম আমরা, খুব সতর্কতার সাথে। এই ধাপে নামার আগে একটা ঘটনা আমাদের সকলের মনকে প্রভাবিত করল। দেখলাম এক তরুন দম্পতি তাদের দুই ছোট ছেলে মেয়েকে নিয়ে শেষ ধাপের আগে একটা বিশ্রামস্হানে বসে কলিগদের সাথে গল্প করতেছে। আমি তো পুরাই থ হয়ে গেলাম। শুনলাম উনারা নাকি হাম হাম ঝর্না দেখে ফিরছেন। এসেছেন ব্রাক্ষনবাড়িয়া থেকে। এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটা আমাদের সবার মনকে সমানভাবে নাড়া দিল । তখন মনে হল আমাদের কোন কষ্ট-ই হয় নি। মনে হল আমরা ট্রেনিংএ এসেছি। আর্মি ট্রেনিং 😁। নামার সময় রাস্তাটা কিছুটা পিচ্ছিল ছিল। তাই মনের মধ্যে এক অজানা আতংক বিরাজ করছিল নেমে আসার আগ পর্যন্ত। এখানে আমি যে ভিডিওটি শেয়ার করেছি তা দেখলে সহজেই বুঝতে পারবেন। তবে সবার কাছে অনুরোধ আমার মতো এইরকম ভিডিও কেউ করতে যাবেন না। তাহলে যে কোন সময় বিপদ ঘটে যেতে পারে। বিয়ার গ্রিলস কিভাবে ক্যামেরা সাথে করে নিয়ে দুর্লভ ভিডিও নির্মান করে তাই অনুভব করতে যেয়ে এই রিস্কি কাজটা করেছি। ভিডিওটি করার সময় আমার এক হাতে ছিল বাঁশ আরেক হাতে মোবাইল।

অবশেষে খাড়া ধাপটা অতিক্রম করে কিছুদুর যাওয়ার পরপরই দেখা পেলাম গহীন পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক ধারার ঝর্ণা হাম হামকে। প্রকৃতি তার অপার রূপ লাবন্য দিয়ে ঢেলে সাজিয়েছে হাম হামকে। হাম হামের শীতল পানির স্পর্শে শরীরটা ক্লান্তিহীন হয়ে গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই। সকলের মধ্যে প্রশান্তি এনে দিল এই ঝর্ণা। কেউ কেউ ব্যস্ত হয়ে ওঠল পানি ছুড়াছুঁড়ি খেলায়। এ সুযোগে সেলফি কিংবা গ্রুপ ছবি তুলতে কেউ-ই পিছিয়ে পড়ল না। এভাবেই ঘন্টাখানেক কাটানোর পর সামান্য খাবার আর ঝর্ণার পানিতে তৈরি এক কাপ চা খেয়ে হাম হামকে বিদায় জানিয়ে যখন লোকালয়ে প্রবেশ করলাম ততক্ষনে সূর্যিমামা আমাদের বিদায় জানাতে অতিব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমরা মোটামুটি ফ্রেশ হয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম বাড়ি ফেরার তাড়ায়।

পরিশেষে বলতে চাই, এই ট্রেকিংএ বাঁশের ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই। তাই হাম হামে যাওয়ার আগে অবশ্য অবশ্যই পোক্তা দেখে একটি বাঁশ নিবেন। দেখবেন ছোট ছোট বাচ্চারা দৌড়ে আসতেছে বাঁশ বিক্রি করার জন্য। মাত্র ৫ টাকার বিনিময়ে পাবেন এই বাঁশ। বিশেষ দ্রষ্টব্য, হাম হামে কোন মোবাইল নেটওয়ার্কেই কাজ করে নাই। তবে সৌভাগ্যক্রমে রবি নেটওয়ার্ক কাজ করলেও করতে পারে। আমি পেয়েছিলাম আমার এক কলিগের সিম্পনি ফোনে রবি সীম থাকার কারনে। যদিও আমার কাছে রবি সীম ছিল। বাট কাজ করি নি। তাই হাম হাম যাওয়ার পূর্বে প্রয়োজন পড়বে এমন কাউকে আগেই অবশ্যই ফোন করেন জানিয়ে রাখুন। কারন ৫ ঘন্টার জন্য আপনাকে ফোনে নাও পাওয়া যেতে পারে। দুপুরে লান্ঞ্চ করার পরিকল্পনা থাকলে সকাল ১০ টার মধ্যেই রওনা করতে হবে হাম হামের উদ্দেশ্যে। আমাদের অবশ্য লান্ঞ্চ করার সৌভাগ্য হয় নি। তাই ফেরার পথে আবার পানশিতেই সেরে ফেলি দুপুরের লান্ঞ্চ সন্ধ্যায় 😁। বাড়ি ফেরার পথে ভাবতেছিলাম আর কখনও হাম হামের উদ্দেশ্যে আসা হবে? আর ওই ছেলে মেয়েগুলোর কি হবে যারা দিনের আলো নিভে যাওয়ার অন্তিম সময়েও হাম হামে অবস্থান করছিল। হয়ত বা ক্যাম্পিং এর নেশায় তারা সেদিনের মতো বাড়ি ফিরে নি।

লোকালয়ে ফেরার কিছু পূর্বে যখন আধার ঘনিয়ে আসছিল তখন বুকের মাঝটা যেন দুরুদুরু করে ওঠছিল। আল্লাহ না করুন যদি কোন কারনে সময় মতো লোকালয়ে ফিরতে পারি তখন কি হবে আমার। ততক্ষনে আমাদের অগ্রগ্রামীরা লোকালয়ে ফিরে গেছে। চারপাশের ঝোপঝাড়গুলো যেন আমাকে ঘিরে রেখেছে না ফিরতে দেওয়ার জন্য। হার্ট বিট বেড়েই চলছে অজানা আশংকায়।

Leave a Comment
Share