ঘুরে এলাম উত্তর সিকিমের লেপচা গ্রাম জোংগু থেকে

এবারও গ্রীষ্মে ঝাড়খন্ড -পুরুলিয়ার বনে,পাহাড় তলিতে কুসুম-পলাশের আগুন জ্বলেছিল, মার্চ –এপ্রিলে হিমালয়ের বরফ গলা পাহাড়ি ঢাল সেজেছিল রঙবাহারি মরসুমী ফুলের সাজে’আর চোপতা –ভার্সে-ইয়ুমথাং এর জঙ্গলের পথে নাকি উপচে পড়েছিল লাল-গোলাপী-বেগুনী-হলুদ রডডেনড্রন গুচ্ছ! কিন্তু সবই ঘটলো আমার চোখের আড়ালে। সেই ২০১৮ এর আগস্ট মাস থেকে নাছোড়বান্দা কাজের তালিকায় টিক মারতে মারতে দু’হাজার উনিশের মে মাস এসে গেল তবুও এই গরম আর দূষণ সহ্যকরে পরে আছি কলকাতায়! আর ঠিক এই সময়েই বন্ধুরা সব পাহাড়ে চড়ে বেড়াচ্ছে। কেউ কোমরে দড়ি বেঁধে বরফকুঠার ঠুকে ঠুকে বরফের দেওয়াল বাইছে, তো কেউ পিঠে রুকস্যাক চড়িয়ে আপন মনে পাইন জঙ্গলে হাটতে হাটতে বাতাসের শিরশিরে শব্দে আর পাখির গানে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাচ্ছে! ওদের পাঠানো সব মন কেমনকরা ছবি দেখছি আর ভেতরে ভেতরে পাগল পাগল লাগছে! কিছুতেই আর বেড়োতে পারছি না। দু’চারদিনের জন্য যাও বা সময় পাই, তো ট্রেনের টিকিট উধাও, আবার কোনো ক্রমে টিকিট যোগার হয় তো অবকাশই হয় না।

নাহ,আর পারছি না! মরিয়া হয়ে ট্রেনের টিকিট খুঁজতে খুঁজতে শেষমেষ পাওয়া গেল স্পেশ্যাল ট্রেনের একটা টিকিট, শিয়ালদা থেকে এন.জে.পি! ব্যাস, আর পায় কে? ১০ই মে দুপুর তিনটে তে চড়ে বসলাম ট্রেনে, ফেরার টিকিট এখনও ওয়েট লিস্টে! যাক গে, সে সব পরে ভাবা যাবে, আগে তো বেরিয়ে পড়ি!

তিস্তার বুকে সকালের কুয়াশা

১১ তারিখ সকাল সাড়ে পাঁচটায় (নির্ধারিত সময় সকাল তিনটে চল্লিশ) নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছেই রওয়ানা হলাম গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। মেল্লি বাজারের একটু আগে পথের পাশে একটা দোকানে নাস্তা সারলাম ম্যাগী-অমলেট আর চা দিয়ে। খেতে খেতে দোকানের জানালা দিয়ে দেখি মেঘলা পাহাড়ের কল বেয়ে বয়ে আসছে এক শীর্ণ জলের ধারা পাথরের রাজ্য বেয়ে। নাস্তা শেষে আবার গাড়িতে চরে বসলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম সিংথাম হয়ে মঙ্গন এবং সেখান থেকে এবারের গন্তব্য উত্তর সিকিমের ‘জঙ্গু’ (DZONGU) তে পৌঁছাবো। কিন্তু জোঙ্গু যেতে গেলে সিকিম ট্যুরিজ্‌ম অফিসের অনুমতি পত্র লাগে। অনুমতি পত্র দেওয়া হয় মঙ্গন অথবা গ্যাংটক – এর ট্যুরিস্ট অফিস থেকে। আজ সপ্তাহের দ্বিতীয় শনিবার হওয়ার কারণে ট্যুরিস্ট অফিস বন্ধ! বেশ ভালো সমস্যা হলো! অনুমতি পত্র ভিন্ন জংগুতে আমাদেরকে তো ঢুকতেই দেবে না, কারণ জংগু হলো কেবল মাত্র লেপচাদের জন্য সংরক্ষিত গ্রাম!

সমাধান বাতলালো আমাদের ড্রাইভার বীরেন। ওর এক বন্ধুকে গ্যাংটকে ফোন করে হোয়াটসঅ্যাপে আমাদের ছবি আর ফটোসহ পরিচয়পত্র পাঠিয়ে দেওয়া হলো। কথা হলো, সেই বন্ধু তার প্রভাব খাটিয়ে গ্যাংটকের টুরিস্ট অফিস থেকে অনুমতি পত্র বানিয়ে রাখবে আমাদের জন্য! অগত্যা সিংথামের বদলে আমরা চললাম গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। গাড়ি চলেছে তিস্তার পাড়ে পাড়ে, মেঘলা সকাল, নদীর বুকে এখনও জমাট বেঁধে আছে কুয়াশা! নদীর কোলঘেঁষে দেখা যাচ্ছে ঘুমন্ত মেল্লি বাজারকে। সেবক ছুঁয়ে, তিস্তা ব্রিজ, মেল্লি পেরিয়ে যখন গ্যাংটক পৌঁছলাম, বেলা তখন দশটা! এন.জে.পি .থেকে যে গাড়িতে এলাম, সেটাকে এবার ছেড়ে দিতে হবে কারণ সিকিমে সমতলের ভাড়ার গাড়ি চলার নিয়ম নেই।

বীরেনের যে বন্ধু অনুমতি পত্র করে দিয়েছে, তারই গাড়িতে গ্যাংটক থেকে মঙ্গন হয়ে জঙ্গুর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। এখান থেকে জঙ্গুর দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলো মিটার, পৌঁছাতে সময় লাগবে তিন ঘন্টার কাছাকাছি। বেলা ১০ঃ১৫টা নাগাদ রওয়ানা হয়ে যখন জঙ্গুর লিংথেম গ্রামে পৌঁছালাম, তখন বেলা দেড়টা বেজে গেছে! গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে ডানদিকে চাইতেই দেখি পাহাড়ের চড়াই বেয়ে একশ’ আটত্রিশটা দেড়ফুটিয়া ধাপের পাথরের সিঁড়ি সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে! একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম প্রথমটা, এতগুলো সিঁড়ি বাইতে হবে? কিন্তু কী আর করা। উঠতে তো হবেই! এলাচ আর ‘ফরগেট-মি-নটের’ ঝোপঝাড়ের গা ঘেঁষে সিঁড়িটা সোজা উঠে গেছে ‘সংদুপ লেপ্চার’ হোমস্টে ‘লিংথাম ল্যাং’ – এর উঠোনে! আমরা ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করলাম হোমস্টের উদ্দেশ্যে! মালপত্র হোমস্টের ছেলেরাই উঠিয়ে আনলো উপরে, কিন্তু আমার তো সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই বুকে হাঁফ ধরে যাওয়ার জোগাড়! প্রথমটা একটু কষ্ট হলেও একদিক থেকে অবশ্য ভালই হলো, কারণ,জায়গাটা বেশ উঁচুতে হওয়ায় চারপাশের দৃশ্য খুব সুন্দর দেখা যায়!

লিংডেম থেকে লিংথামের দিকে বয়ে চলেছে তিস্তা

মঙ্গনের পর থেকে যে আঠেরো কিলো মিটার পথ বেয়ে লিংথাম এলাম, তার সৌন্দর্য্য মন ভরিয়ে দিলো। সরু, ছায়াঘেরা পথের দু’পাশে বাঁশ আর এলাচের জঙ্গল; হাজারো নাম-না-জানা লতা গুল্ম আর বনৌষধিতে ঢাকা সবুজ পাহাড়ী ঢাল! থোকা থোকা ফুটে থাকা নীল-সাদা-বেগুনী ‘হাইড্রান্জিয়া’ ফুলের ঝোপ পথের দুপাশের সীমা দেখিয়ে চলেছে! বাঁয়ে খাদ, ডাইনে খাঁড়া পাথরের দেওয়াল ছেঁয়ে সবুজ ফার্ন আর এলাচগাছের ঝোপের বাহার! আর সেই ঘন সবুজ জঙ্গল ভেদ করে কিছুদুর অন্তর অন্তর নেমে এসেছে দুধসাদা উচ্ছ্বল ছোট ছোট ঝর্নাধারা, পথের উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে হারিয়ে গেছে নীচের জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে! চলতি পথে তাদের উড়ন্ত জলকণা হাওয়ায় ভেসে এসে চোখে মুখে ঝাপটা দেয়, স্নিগ্ধ শীতলতায় জুড়িয়ে যায় শরীর -মন!

লেপ্চা ভাষায় ল্যাং (Lyang) শব্দর অর্থ স্বর্গ; সত্যি মনে হচ্ছে স্বর্গে পৌঁছে গেছি! খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ‘লিংথাম ল্যাং’ হোমস্টের পাথর বাঁধানো উঠোনে উঠে আসতেই মনটা নিমেষে ভালো হয়ে গেল!পাথর বাঁধানো প্রশস্থ উঠোনে পা রাখতেই বাঁশের ছাউনি আর কাঠের দেয়াল দেওয়া ছবির মত একটা ঘর থেকে সপরিবারে হাসি মুখে বেড়িয়ে এলো হোম স্টের কর্তা সাংদুপ লেপ্চা আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাতে! নীচের রাস্তায় দাড়িয়ে থাকা আমাদের গাড়ি থেকে মাল-পত্র আগেই উপরে নিয়ে এসেছিল সাংদুপের দুই ভাইপো সোদং আর টোপকো। উঠোনে পেতে রাখা গোল গোল করে কাটা গাছের গুড়ি দিয়ে বানানো হয়েছে বসার জায়গা; আমরা সেখানে বসতেই গরম গরম চা নিয়ে এলো সাংদুপের ভাইজি। ডান হাতে চায়ের কাপ আমাদের্ দিকে এগিয়ে দেবার সময় লক্ষ্য করলাম মেয়েটি ওর বাঁ হাত দিয়ে নিজের ডানহাতের কনুইটা স্পর্শ করে একটু সামনে ঝুঁকে মুখে হাসি মুখে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে দিল! এটা অতিথি আপ্যায়নের সৌজন্য; পরেও দেখেছি প্রতিবার জল, খাবার অথবা অন্য কিছু পরিবেশন করার সময় ওরা মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে এই অভ্যেসটা সর্বদা পালন করে থাকেন!

লিংথাম ল্যাং হোমস্টে

বেলা হয়ে গিয়েছিল, তাই চা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় দুপুরের খাবার ডাক পড়ল সেই সুন্দর কাঠের ঘরটায়। ভেতরে ঢুকে তো অবাক! দারুন ছিমছাম করে সাজানো একটা বড়সড় হল ঘরের এককোন ঘিরে রান্না ঘর; গ্যাসের উনুন আর কাঠের উনুন দুরকমই আছে! কাঠের দেয়াল, বাঁশের টেবিল–সোফা-চেয়ার, সবই স্থানীয় উপাদানে তৈরী! আমাদের খেতে দেওয়া হলো ভাত, শাক ভাজা , সবজি আর ডিমেরঝোল! চমৎকার! খেতে খেতে সাংদুপের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ হলো, আর গল্পে গল্পে ক্রমে প্রায় বিকেল হয়ে এলো।

খাওয়া শেষে এসে দাড়ালাম বাইরের উঠোনে, ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম চারপাশটা। আকাশে এখনো হালকা মেঘের আস্তরণ, তারই ফাঁকে পড়ন্ত সুর্য্যের আলোয় সবুজ পাহাড়ে ঘেরা জংগুকে মোহময়ী লাগছে! লিংথামের সবচেয়ে উঁচুতে আমাদের এই হোমস্টেটা; তিন পাশে উঁচু, ঘন সবুজ পাহাড় ঘেরা জংগুকে দেখে মনের ভেতরটা কেমন যেন আরামের অনুভুতিতে ছেঁয়ে গেল! পশ্চিমের আকাশের নরম আলোর প্রেক্ষাপটে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকা খোঁচা খোঁচা বরফ চূড়াগুলোকে কেমন অপার্থিব লাগছে; ডানদিকে, পাহাড়ের আরও একটু উপরে গ্রামের মনাস্ট্রি, উঠোনের উত্তর-পশ্চিম দিকে হোমস্টের মূল বাড়িটার পিছনের আকাশে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে আছে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর সিনিওলচু শিখর! আগামীকাল আকাশ পরিস্কার থাকলে হয়ত দেখা পাব তাদের! পুবদিকে, অনেক নীচ দিয়ে গাড়ির রাস্তাটা এঁকে বেঁকে সাপের মত কোথায় যেন জঙ্গলের আড়ালে গা ঢাকা দিয়েছে! পথের ওপারে ঢেউ খেলে নেমে গেছে সবুজ পাহাড়ি ঢাল নীচে তিস্তার বুকে!

উঠোনের কিনার ঘেঁষে গোল গোল করে কেটে রাখা গাছের গুঁড়িগুলোর একটার উপর গিয়ে বসলাম আকাশের দিকে তাকিয়ে; মনে এক অজানা আবেশ! এই বিশাল প্রকৃতির মাঝে নিজের ক্ষুদ্র অস্তিত্ব যাচাই করতে গিয়ে নিজেরই বিস্ময় লাগে, আনন্দে কাঁটা দেয় গায়ে ভেবে যে, আমিও তো এই বিশালতার, এই অসীম সৌন্দর্য্যের ভাগীদার, মিশে আছি এই পৃথিবীরই মাটিতে-ঘাসে! কখন যেন অজান্তেই আপন মনে বুকের মধ্যে সুর বেজে ওঠে –

“আকাশ ভরা সূর্য্য তারা, বিশ্ব ভরা প্রাণ,
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান …..”

আঁধার নামল পাহাড়ে, পাখিরা ঘরে ফেরার আগে দিনের শেষবারের মত কিচির-মিচির করে মুখরিত করলো আকাশ – বাতাস, তারপর ধীরে ধীরে মৌনতায় ডুব দিল পাহাড়-জঙ্গল; আর ঠিক তখনই বাঁশের ঝাড়ে আর এলাচের ঝোপে কনসার্ট শুরু করলো রাত জাগা পাহাড়ী-পতঙ্গরা! অনেক নীচে গভীর খাদ থেকে ভেসে এলো তিস্তার ক্ষীন কলতান, মিশে গেল পতঙ্গের নৈশ জলসায় ,ঠিক যেন “ মিলে সুর মেরা-তুমহারা,সুর বনে হামারা ..;”

উঠোন ছেড়ে আমরা উঠে এলাম রান্না-খাওয়া তথা বসার সেই রোম্যান্টিক ঘরটাতে। শুরু হলো আমাদের সান্ধ্য গুলতানী। আড্ডায় যোগ দিল কসবার মেয়ে মৈত্রী। শহুরে জীবনের হুল্লোর আর চটক থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে, কোলাহল থেকে দূরে আপনমনে একলা ঘুরে বেড়ানোর নেশা লেগেছে ওর! আলাপ করে মনে হলো মৈত্রী মেয়েটা একটু অন্য রকম, সাবলীল, প্রানবন্ত এবং আত্মনির্ভর! নিজে থেকেই খুব সহজে আলাপ জমিয়ে নিল! আলাপ করে বুঝলাম, অনুকরণের ধারাবাহিকতার বাইরে, জীবন সমন্ধে ওর একটা নিজস্ব সংজ্ঞা এবং মূল্য বোধ আছে! ভালো লাগলো মেয়েটাকে! আমাদের পরবর্তী সফরসূচিতে মৈত্রী আমাদের সারাক্ষণের সঙ্গী ছিল। আমাদের আড্ডায় সেই সন্ধ্যায় ছিল সাংদুপ, ওর স্ত্রী, মা, ভাইপো-ভাইজীরা; আর ছিল কলকাতার এক অল্পবয়সী বাঙালী দম্পতি,যারা আমাদের জমাটি আড্ডার থেকে একটু দূরে বসে নিমগ্ন ছিল নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে ইংরেজীতে কথা বলায় এবং সাংদুপদের ঘরে তৈরী কমলালেবুর ওয়াইন পানে। ওয়াইন নয়, আমাদের জন্য এলো ‘ছ্যাঙ’।

সাংদুপের খামারের মিলেট গেঁজিয়ে তৈরী ‘ছ্যাঙ’ অথবা ‘চী’ বাঁশের চোঙ্গায় করে গরম জল ঢেলে বাঁশের নল দিয়ে যখন আমাদের সামনে পরিবেশন করা হোলো, তখন বুঝলাম ,পাহাড়ে বেড়াতে এসে এই ছ্যাঙ মিস করলে নিতান্তই বোকামি হোতো! ছ্যাঙ-এর গন্ধে একটা আলাদা মাদকতা আছে! স্বাদে আর গন্ধে বিদেশী অনেক বিয়ারের থেকে উত্কৃষ্ট! সংদুপের বৃদ্ধা মা, যিনি সংসারের গৃহকর্ত্রী, তিনিও বসেছে আমাদের সঙ্গে ছ্যাঙ-এর আড্ডায়! আড্ডার ফাঁকে ফাঁকেই সংদুপের বউ নানা রঙের সিল্কের কাপড় দিয়ে সেলাই করে চলেছে প্রার্থনা পতাকা।

হিমালয় ভ্রমণের হাজারো গল্প আর অভিজ্ঞতা বিনিময়ে জমে উঠলো আমাদের ভ্রমন আড্ডা! সঙ্গে চলতে থাকলো ‘ছ্যাঙ’আর হাসিঠাট্টা! দেখতে দেখতে রাত হলো, রাত আটটা নাগাদ রাতের খাওয়া এলো, রুটি,ডাল, ভাজা আর মুরগীর ঝোল। আমরা আগামী কাল এখানেই থাকব, তাই খেতে খেতেই আগামী কালের ভ্রমন সূচীটাও ঠিক করে নিলাম সংদুপের সঙ্গে কথা বলে। তারপর যে যার ঘরে ফিরে গভীর ঘুমে ডুব।

হোমস্টের পিছন দিকে সকাল বেলায় মেঘের আড়ালে কাঞ্চনজঙ্ঘা

পরের দিন সকাল হলো। ঘরের পিছনের ক্ষেত থেকে যদি কাঞ্চনজন্ঘা আর সিনীয়ল্চুর দেখা মেলে, সেই আশায় ভোর পৌনে পাঁচটায় ক্যামেরাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বিছানা ছেড়ে; উঠোন পেড়িয়ে দু’ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলাম ধাপ চাষের ক্ষেতে; এখানথেকে বেশ ভালো দর্শন মেলে কাঞ্ছঞ্জঙ্ঘা আর সিনিওলচুর! কিন্তু কপাল মন্দ, আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন! শুধু হালকা মেঘের ফাঁক দিয়ে দেখা গেল কাঞ্চনজঙ্ঘার পাদদেশের বিশাল তুষার ক্ষেত্রের একাংশ! ছবি তুললাম কয়েকটা, মন ভরলো না, একটু হতাশ লাগছে! উঠে এলাম উঠোনে। এই ভোরেই সংদুপের মা পুজো করেছেন উঠোনের অন্য এক কোনে সিমেন্টের তৈরী ছোট্ট বৌদ্ধ চোর্তেনটার সামনে! বাগানের লতা গোলাপের গাছ থেকে ফুল তুলে সাজিয়েছেন চোর্তেনের বেদী, ছোট ছোট বাটিতে সাজিয়ে দিয়েছেন জল, জ্বেলেছেন মোমের বাতি আর একটা পাত্রে জুনিপারের পাতা জ্বেলে ধুনো দিয়েছেন! সে এক অপূর্ব স্বর্গীয় পরিবেশ! মৌন, স্নিগ্ধ সকাল, বাতাসে জুনিপারের সুবাস, ঝোপে-ঝাড়ে পাখী ডাকছে আর সেই কাকলির ছ্বন্দে সুর মিলিয়ে সংদুপের মা প্রার্থনা চক্র ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুর করে উচ্চারণ করে চলেছেন ভগবান বুদ্ধের বাণী! স্নিগ্ধ, শান্ত সকালে এক আবেশ জড়ানো পরিমন্ডলের সৃষ্টি হয়েছে!

আমি তাকিয়ে আছি পূব আকাশের দিকে; ক্রমে আকাশ লাল থেকে কমলা হয়ে সোনা রং ধরলো, আর সেই সোনা রঙের প্রেক্ষাপটে দেখা দিল সারি সারি নাম-নাজানা তুষারাবৃত পাহাড়চূড়া। আমার বুকের ভিতরে কেমন এক গভীর পূর্ণতার আবেগ, কেমন এক গায়ে কাঁটা দেওয়া শিরশিরে সুখের অনুভুতি আমাকে আচ্ছন্ন করছে, যেন আনন্দ সাগরে ডুবে আছি!

ঘোর কাটল উঠোনে লোকজনের কথা বার্তায়। আজ সংদুপদের বাড়িতে পুজো, তাই সকাল থেকেই সবাই কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভোর ভোর একদল বেড়িয়ে গেল জঙ্গল থেকে বাঁশ কেটে আনতে; তার পর সেই বাঁশের খুঁটির গায়ে গতকাল রাতে বাড়ির মেয়েদের সেলাই করে রাখা বুদ্ধের বাণী সম্বলিত রেশমী পতাকার মালা জুড়ে দিয়ে বানানো হলো প্রার্থনা পতাকাদন্ড, আর পুঁতে দেওয়া হলো বাড়ির চার কোনায়! উদ্দেশ্য, বাড়ির চৌহদ্দিকে ভগবান বুদ্ধের শান্তির বাণীমন্ত্র দিয়ে ঘিরে রাখা, অশুভ শক্তির নজর থেকে রক্ষা করা! এইবার পুজোর আয়োজন শুরু! উঠোনের মাঝখানে একটা লাল রঙের টেবিল পেতে তার উপরে সংদুপের মা একটা রেকাবিতে খানিকটা চাল রেখে তার ওপর ফুল এবং টাকা দিয়ে সাজালেন; পেতলের হাতল দেওয়া চমরীগাই-এর লোমের একটাসুন্দর চামর রাখলেন পাশে। মঙ্গলঘট ভরে আমাদের আম্রপল্লবের কায়দায় ঘটের জলে চুবিয়ে দিলেন কাছের গাছটা থেকে তুলে আনা কয়েকটা পাতা, প্রদীপ জ্বালালেন, জুনিপারের পাতা দিয়ে ধুনো দিলেন, পূর্ণ হলো পূজার আয়োজন! এবার শুরু হবে পুজো।

বেলা সাড়ে সাতটানাগাদ পূজা শেষ হলো, এবার আমাদের চা –জলখাবারের পর্ব; রুটি,তরকারী দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে কাপ দুয়েক চা পান করে আমরা উঠে পরলাম স্নানের জন্যে স্নান সেরে তৈরী হয়ে নিয়ে এপাশ-ওপাশ কিছুটা ঘুর ঘুর করলাম, কিছু ছবি তুললাম তারপর বেলা দশটা নাগাদ লাঞ্চ করে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম জংগু ভ্রমনের উদ্দেশ্যে! একটা গাড়ি আগে থেকেই ঠিক করা হয়ে ছিল; সেই গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা, সঙ্গে সংদুপের ভাইপো সোদং এবং টোপকো সহ আরো জনা কয়েক হই হই করে উঠে পড়ল আমাদের গাড়িতে; ওরাও যাবে আমাদের সঙ্গী হয়ে। ভারী প্রানবন্ত আর সহজ সরল এই ছেলেগুলোকে সাথে পেয়ে আমরাও খুশি, চললাম সবাই একসঙ্গে!

পড়ন্ত বিকেলে ধাপ চাষের জমিতে আকাশের ছায়া

প্রথমে গেলাম জোংগুর মনাস্ট্রি দেখতে। চলতে শুরু করার মিনিট দশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম মনাস্ট্রির গেটে! আমরা কলকাতা থেকে এসেছি শুনে মনাস্ট্রির একজন কর্মী আমাদেরকে খুব আপ্যায়ন করে ভিতরে নিয়ে গেলেন। সেদিন ছিল মনাস্ট্রিতে বিশেষ পূজার দিন, তাই চারি দিকে একটা উত্সব উত্সব ভাব। আমরা ভিতরে প্রবেশ করলাম; শান্ত, ধ্যানগম্ভীর পরিবেশ। ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে ভগবান বুদ্ধের বসার বেদী, পিতলের সারি সারি চকচকে পাত্রে দেওয়া হয়েছে জল আর চালের রঙিন পিটুলি দিয়ে তৈরী নানাবিধ খাদ্য! সার সার মোমবাতি, প্রদীপ আর ধুপকাঠি জ্বেলে বুদ্ধদেবের চরণে নিবেদন করা হয়েছে ভক্তির ডালি! উঁচু বেদির উপর পদ্মাসনে উপবিষ্ট বুদ্ধের বিশাল ধাতব মূর্তি সোনার মত উজ্জ্বল, মুখে স্মিত হাসি! মনাস্ট্রির মেঝেতে দুই সারিতে বসে পুঁথি পড়ছেন বৌদ্ধ সন্যাসীরা, সঙ্গে গুন গুন করে উচ্চারণ করে চলেছেন মন্ত্র সারা মনাস্ট্রির দেওয়াল জুড়ে নিপুন দক্ষতায় উজ্জ্বল বর্ণে চিত্রায়িত হয়েছে বুদ্ধের জীবন কাহিনী!

মনের মাঝে নীরব প্রশান্তি নিয়ে আমরা বেড়িয়ে আসছি ভেতর থেকে, দেখি দরজার বাঁপাশে এক বিশাল মূর্তি! জানতে চাইলে সোদং জানালো, ‘ইনি হলেন লেপ্চারাজ রিমপোচে, লেপচাদের রক্ষক’! উঠোন চত্তরে বেড়িয়ে এসে চারপাশে ঘুরে ফিরে দেখতে দেখতে নজরে এলো মূল মনাস্ট্রির পাশেই আরো একটা ছোট মনাস্ট্রির ভিতরে বড় বড় ধর্ম চক্রে ঘুড়িয়ে মহিলারা আলাদা করে প্রার্থনায় বসেছেন। আরো একটা জিনিস দেখে বেশ কৌতুহল হলো; পাহাড়ের কিনারে একটা ছাউনি দেওয়া ঘরের খোলা জানালা দিয়ে একদল ছোটো ছোটো লামা ছেলের দল খোলা পাহাড়ের দিকে মুখ করে বড় বড় শিঙ্গা নিয়ে ফুঁকিয়ে চলেছে! জানতে পারলাম, এভাবে নাকি বুদ্ধের বাণী উন্মুক্ত পাহাড়ে,আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দিছে ওরা, এটা ওদের ধর্মবিশ্বাস আর রীতি!

আমরা মনাস্ট্রি দর্শন শেষে বেড়িয়ে পরলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ‘লিংডেম উষ্ণপ্রস্রবনের’ উদ্দেশ্যে! প্রস্রবনে পৌঁছানোর এই পথটা কিন্তু ভারী মনোরম! ঘনসবুজ গাছপালা ঘেরা নিরিবিলির মাঝে সরু পথটা এঁকে বেঁকে সাপের ভঙ্গীমায় এগিয়ে চলেছে সামনে। কিছু দূর এসে দেখা পেলাম তিস্তা নদীর। নদীর ওপারে জল ছুঁয়ে উঠে যাওয়া খাড়া পাহাড়ের একটা অংশ থেকে ধ্বস নেমে সরাসরি মাটি,পাথর আর বোল্ডারের স্তুপ জমেছে তিস্তার বুকে, আর গতিপথে বাধা পেয়ে পাথর আর বড় বড় বোল্ডারেরগায়ে আছঁড়ে পড়ে ফুঁসে ফুঁসে উঠছে তরঙ্গিনী তিস্তা! গতিপথও কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে এইখানে, আর সঙ্গে রাস্তার হালও বেশ খারাপ হয়েছে! কিছুটা এগিয়ে এসে “ফোর্থমাইল মানটামের” কাছে নদী আবার তার আপন স্নিগ্ধতায় ফিরে এসেছে! আমাদের গাড়ি এসে থামল পথের পাশে একজায়গায়! রাস্তার উপরেই একটা ফলকে লেখা দেখলাম “LINGDEM HOT SPRING’’. রাস্তা থেকেই ধাপ দশেক সিঁড়ি উঠে গেছে উপর দিকে; সিঁড়ির পাশে থোকা থোকা ‘ফরগেট মি নট’ ফুটে আছে; সিঁড়ি যেখানে শেষ, সেখান থেকেই একটা সরু মাটি-পাথরের পথ ক্রমশ উপরের দিকে উঠে গেছে। পথের বা পাশ থেকে ঘন ফার্ণের ঝোপ উপচে পড়েছে পথের উপর! ডানপাশের ঢাল বেয়ে ঘন সবুজ জঙ্গল! আমরা ধীরে ধীরে উঠে এলাম জঙ্গলের মাঝে একটা ফাঁকা জায়গায়! ফাইবার গ্লাসের স্বচ্ছ ছাতওয়ালা হলদেটে রঙের একটা বড় বাড়ি; ভিতরে বিশাল এক হলঘরের মত জায়গায় চারপাশ-বাধানো টলটলে জলের উষ্ণকুন্ড, অনেকটা বড়সড় ইনডোর সুইমিং পুলের মত। উষ্ণ কুন্ডের জল থেকে গন্ধকের গন্ধ উঠছে; আমাদের সঙ্গের বাচ্চা ছেলে গুলো তৈরী হয়েই এসেছিল,নিমেষে কাপড় বদলে ঝুপঝাপ নেমে পড়ল জলে! আমাকে নিয়েও নামাবে বলে সমানে অনুরোধ করতে লাগলো। আমার সালফারের গন্ধ সহ্য হয় না, তাই নামলাম না; কিন্তু খুব ভালো লাগছিল ওদের অল্পবয়সী উচ্ছ্বাস দেখে! কিছুক্ষণের জন্য মনটা আবার বালক বয়সে ফিরে গেছিল।

উষ্ণ প্রস্রবনের পিছনেই পাহাড়ের ঢাল গড়িয়ে নেমে এসেছে একটা ঝর্ণা, তার পর নদী হয়ে বয়ে গেছে গভীর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। ছোট্ট নদীটার উপর একটা তারের ঝোলাপুল, এপার থেকে ওপারের গ্রামে যাওয়ার পথ। আমি পুলটার উপর দাঁড়িয়ে মনদিয়ে ঝরনার স্লো মোশান ধরার চেষ্টা করছি, হঠাৎ মনে হলো পুলটা খুব দুলছে! ক্যামেরা থেকে চোখ ফিরিয়ে দেখি, ঝোলার এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে মৈত্রী সজোরে পুলটাকে দোলাচ্ছে আর খিলখিল করে হাসছে! খুব মজা পেয়েছে, আমি ঠিকঠাক ছবি তুলতে পারছিনা বুঝতে পেরে। ওর এই অন্তরঙ্গ দুষ্টুমিটা আমাকে আমার কন্যাদের কথা মনে করিয়ে দিল! খুব প্রানবন্ত এই মেয়েটা!

তিস্তার বুকে ঝুলে পড়েছে লোহার পুল

উষ্ণ প্রস্রবণ দেখে আমরা সবাই গাড়িতে ফিরে এলাম, গাড়ি চলতে শুরু করলো ফিরতি পথে! কিছুদুর এসে একটা বাঁকের মুখে ছেলেমেয়েরা সবাই নেমে গেল গাড়ি থেকে; এই বাঁক থেকে কিছুটা ঢাল পথ ধরে উঠেই একটা বিরাট লম্বা ঝোলা লোহার সেতু তিস্তার এপার থেকে ওপারের গ্রামে পৌঁছে গেছে। এখানে তিস্তা বেশ চওড়া, দুপাশে সাদা বালির বিস্তৃত চড়া, আর তারই মাঝ বরাবর নানা বিভঙ্গে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে হালকা সবুজ রঙ্গা খরস্রোতা তিস্তা! ঠিক হলো, মৈত্রী আর সঙ্গের ছেলেরা এখান থেকে নদীর চড় ধরে পায়ে হেঁটে গিয়ে আমাদের সঙ্গে এক কিলো মিটারদূরে ‘ফোর্থ মাইল’-এ মিলিত হবে, তারপর সেখান থেকে সবাই একসঙ্গে বাড়ি ফিরব! ওরা নেমে গেল, আমি আর আমার স্ত্রী গাড়িতে চেপেই চললাম ‘ফোর্থ মাইলে’ –এর দিকে। আমাদের পথে বাপাশে সঙ্গে চলেছে তিস্তা বালিচড়ে নানা বিচিত্র ছবি আঁকতে আঁকতে! উপর থেকে লোহার সেতুটাকে দেখতে পাচ্ছি, মাঝ নদীতে ঝুলেপড়ে প্রায় নদীর বুক ছুঁয়েছে! নদীটা এখানে ভারী সুন্দর, যেমন স্বচ্ছ, তেমনিই চওড়া, ওপারের ঘন সবুজ পাহাড়ের পা ছুঁয়ে আপন বেগে বয়ে চলেছে। পরিবেশ এখনে নির্মল, দূষণ মুক্ত, কোলাহল বিহীন।

আমরা ‘ফোর্থ মাইল’–এ নামলাম, এখন বিকেল,আকাশে সূর্য্য নেই কিন্তু নরম আলো আছে। আমাদের ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে কাছেই ওর এক বন্ধুর বাড়ির বারান্দায় বসে জমিয়ে আড্ডা শুরু করলো, আর আমরা দুজন হাঁটা লাগলাম নদীর দিকে! কিছুটা ঢালু পথ পেড়িয়ে এসে দাড়ালাম নদী গর্ভে ভেঙ্গেপরা একটা লোহার পুলের এ’মাথায়; অন্য মাথাটা নদীর জলে ডুবে আছে! সন্তর্পনে ভাঙ্গা পুলটা বেয়ে কয়েক পা নিচে নামতেই ওপর থেকে ড্রাইভার–এর বন্ধু আমাদের সতর্ক করে দিল আর না এগোনোর জন্য! অগত্যা ওখনে দাঁড়িয়েই আমরা পড়ন্ত বিকেলের নদী আর ও’পাড়ের পাহাড়ের শোভা দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম! তারপর আরো একটু ঘুরপথ ধরে সরাসরি নেমে এলাম নদীর পাড়ে,একদম জলের ধারে! নদী এখানে এতটাই চওড়া যে উল্টো পাড়ের সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায় না! বাঁদিকে দূরে দেখতে পাচ্ছি সেই লোহার ঝোলা পুলটাকে, মনে হচ্ছে এই বুঝি নদীর জল ছুঁয়ে দেবে! আর ডানদিকে দূরে নদী যেখানে বাঁক নিয়ে পাহাড়ের পিছনে মুখ লুকিয়েছে, সেইখানে ওই ধ্বসনামা জায়গাটায় পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে ওঠা জলকনার উপর পড়ন্ত সূর্যের আলো পড়ে এক স্বপ্নজগত সৃষ্টি হয়েছে! আহা, নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছেনা, কেমন যেন ঘোর লাগা, আচ্ছন্ন মনে হচ্ছে!

ঘোর কেটে গেল সোদং-টোপকো-মৈত্রী দের কোলাহলে; ওরা এসে পড়েছে নদীর চড় বেয়ে! শুনলাম, ওরা নাকি ওই ঝোলা পুলটার ওপর উঠে নাচানাচি করে এসেছে। ভালো লাগলো ওদের এই তারুণ্যের প্রাণ চঞ্চলতা! সন্ধ্যের একটু পরেই ফিরে এলাম ‘লিংথেম ল্যাং’ হোমস্টেতে! ভেজপাকোড়া আর চায়ের সঙ্গে আবার জমে উঠলো সান্ধ্যআড্ডা! তারপর রাতের খাবার খেয়ে ঘুম!

পরের দিন সকালে স্নান, প্রাত:রাশ সেরে যখন ‘লিংথেম ল্যাং’-এর উঠোনে এসে দাঁড়ালাম, মনটা তখন বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেছে! উঠোনে আমাদেরকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে গোটা পরিবারের সদস্য – সদস্যারা; ওদের হাতে সাদা পট্টবস্ত্রের উত্তরীয়। দুহাত জুড়ে নমস্কার জানিয়ে সেই উত্তরীয় ওরা পড়িয়ে দিল আমাদের গলায় অতিথি বিদায়ের লেপচা রীতি মেনে! এখন লিংথেমের স্বর্গ থেকে আমাদের বিদায়ের পালা! মাত্র তো দুদিনের পরিচয়, তাতেই কী নীবিড় সম্পর্কের রেশ লেগে রইলো আমাদের মধ্যে!

জোংগু ভ্রমণের গল্প শেষ। এখন আমরা ঘরমুখো হব গ্যাংটক, কালিম্পং, শিলিগুড়ি হয়ে; সঙ্গে নিয়ে ফিরবো একরাশ বুক ভরা ভালোলাগা আর আনন্দের রেশ!

Leave a Comment
Share