দার্জিলিং এর ভালোলাগার যতো চা বাগান

দার্জিলিং (Darjeeling) জেলার সবুজ পাহাড়ের ঢালে একের পর এক চায়ের বাগান, যেন সবুজ গালিচার মত মুড়ে রেখেছে পাহাড়কে। সে দৃশ্য দেখে মোহিত হয় না এমন মানুষ বিরল। চা বাগানের ঢালে নেপালী মহিলাদের পিঠে ঝুড়ি নিয়ে চা পাতা তোলা – পাহাড়ের এক অতি চেনা এ দৃশ্য। আর যদি এমন কোনো চায়ের বাগানে বসে সে বাগানেরই চা পান করার সৌভাগ্য হয়, সে তো সোনায় সোহাগা। আবার যদি এমনই কোনো রূপসী চা বাগানের কোলে, নিরিবিলি প্রকৃতির মাঝে ছোট্ট একটা আশ্রয়ে কাটানো যায় কয়েকটা দিন – সে তো পরম প্রাপ্তি।

T-T-T – এই নিয়েই দার্জিলিং পাহাড়। Tea, Timber & Tourism. বিশ্বের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট চায়ের উৎপাদন পূর্ব হিমালয়ের কোলে দার্জিলিংয়ের পাহড়ে। মূলত ইংরেজদের হাত ধরেই যে দার্জিলিংয়ে চায়ের উৎপাদন শুরু, নেপালী বসতি তৈরী ও সমগ্র দার্জিলিং পাহাড়ের শ্রীবৃদ্ধি – একথা মানতেই হবে। কোনো পুঁথিগত রেকর্ড না থাকলেও, মনে করা হয় ব্রিটিশ আর্মির এক অফিসার Captain Samler প্রথম চায়ের চাষ শুরু করেন কার্শিয়াংয়ের কাছে মকাইবাড়ি অঞ্চলে ১৮৪০ সালের কাছাকাছি সময়ে। পরবর্তী কালে সেই চায়ের বাগানের মালিকানা যায় তাঁর সহযোগী G C Banerjee এর হাতে। সেই থেকেই বাঙালি মালিকানাধীন মকাইবাড়ি চা বাগান। আবার আরেকটি মতে দার্জিলিংয়ের Superintendent Dr Campbell ১৮৪১ সালে প্রথম দার্জিলিংয়ে চায়ের উৎপাদন করে ইংল্যান্ডে পাঠান। তারপর থেকেই বাণিজ্যিক ভাবে লাভ দেখে পুরো পাহাড়ি অঞ্চলে একে একে অসংখ্য চা বাগান গড়ে ওঠে। বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে দার্জিলিং চায়ের খ্যাতি। আজ পুরো পাহাড় জুড়ে অসংখ্য চায়ের বাগান, হিমালয়ের শোভা বর্ধন করেছে। সমগ্র পাহাড় জুড়ে ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ির’ উপাখ্যান। আজ আমার ভালবাসার দার্জিলিং হিমালয়ের বিশেষ ভাল লাগা কিছু চা বাগানের এলোমেলো কথা…

ছোটবেলায় প্রথমবার যখন দার্জিলিং যাই, কালিম্পং থেকে পেশক রোড ধরে গাড়িতে যাবার পথে সম্ভবত প্রথমবার চা বাগান দেখি – ‘পেশক চা বাগান’। পাহাড়ের ঢালে সবুজ চা বাগান আর তার মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে চলা পাহাড়ি রাস্তা – এ দৃশ্য এক অদ্ভুত ভাল লাগা তৈরি করেছিল কিশোর মনে। বাড়ি ফিরেও সেই চা বাগানের ঢালের মধ্যে দিয়ে চলা পথে সফরের কথা বারবার মনে পড়ত। সে সময় থেকেই তৈরি হয়েছিল পাহাড়ের প্রতি ও চা বাগানের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ। বড় হয়ে একাধিকবার গিয়েছি ঐ পেশক রোড ধরে। গাড়ি থামিয়ে নেমেছি পেশক চা বাগানের ভিতরে।

দার্জিলিংয়ের চায়ের কথা বলতেই সবচেয়ে আলোচিত হয় ‘মকাইবাড়ি’র নাম। অতুলনীয় ফ্লেভারের বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ও উৎকৃষ্টতম চা। তবে উপরের দিকের কোয়ালিটি সবটাই বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায়। বেস্ট কোয়ালিটি নাকি নিলাম হয় কেজি প্রতি লক্ষাধিক টাকায়। মকাইবাড়ি বাগান অনেকেই দেখেছে দার্জিলিং থেকে ফেরার পথে, কার্শিয়াং ছাড়িয়ে পাঙ্খাবাড়ি রোডের ধারে।

মিরিক যাবার পথে টিংলিং চা বাগান

তেমনই শিলিগুড়ি থেকে মিরিক যাওয়ার পথে ও মিরিকের আশেপাশে একের পর এক চা বাগান, চা বাগানের মধ্যে দিয়েই গাড়ির রাস্তা। এদিকের বাগানের চাও বেশ উচ্চ গুণমানের। এপথে পড়ে ‘গয়াবাড়ি’, ‘ফুগুরি’, ‘সিংবুলি’ ‘টিংলিং’, ‘সৌরেনি’ প্রভৃতি বাগান। মিরিক ছাড়িয়ে রয়েছে দুটি অতীব সুন্দর চা বাগান – ‘থুব্রো টি এস্টেট’ ও ‘গোপালধারা টি এস্টেট’। গোপালধারা চা বাগানের মাঝে অপূর্ব গোলপাহাড় ভিউ পয়েন্ট – পর্যটকদের কাছে অতি প্রিয়। গোপালধারা টি এস্টেটে রয়েছে বাগানেরই চা বিক্রির দোকান। অপূর্ব স্বাদ ও গন্ধের নানান মানের চা টেস্ট করা যায় চা বাগানে দাঁড়িয়েই।

আর দার্জিলিং শহরের উপকন্ঠে ‘হ্যাপি ভ্যালি চা বাগান’ – ছোটবেলায় দার্জিলিং বেড়াতে গিয়ে এ চা বাগানে আমরা প্রায় সবাই গিয়েছি আর চা গাছের ঝোপের আড়ালে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছি। হয়তো আমাদের পুরনো অ্যালবামে এরকম একটা আধটা ছবি খুঁজলেই পাওয়া যাবে।

তিস্তার পূর্বপাড়ে, অধুনা কালিম্পং জেলায় তুলনায় চা বাগানের আধিক্য কম। তবুও উল্লেখ করতেই হবে গরুবাথান থেকে পাহাড় চড়ার সময় ‘ফাগু টি এস্টেট’ ও পাহাড়ের বেশ খানিকটা উচ্চতায় লাভার কাছে ‘সামেবিয়াং টি এস্টেট’। পাহাড়ের ঢালে অন্যতম সুন্দর এই সামেবিয়াং টি এস্টেটের পাশে হয়েছে থাকার ব্যবস্থাও।

এবার আসি এমন কিছু চা বাগানের কথায় যেখানে থাকার সুযোগ হয়েছিল একেবারে চা বাগানের ধারেইঃ-

পাহাড়ের ঢালে সবুজ গালিচার মত চা বাগানে কর্মরত নেপালি মহিলা, কালিজ ভ্যালি

কালিজ ভ্যালি – দার্জিলিং হিমালয়ের কোলে, সবুজে মোড়া ছবির মত সুন্দর এক উপত্যকা ‘কালিজ ভ্যালি’ বা ‘রেনবো ভ্যালি’, যেখানে থাকার জন্য আছে চা বাগানের ঢালে আছে এক ভীষণ সুন্দর ও মিষ্টি একটি রিসর্ট, যার নাম ‘রেনবো ভ্যালি রিসর্ট’। ঠিক যেন শিল্পীর তুলিতে একটা সবুজ ক্যানভাসে কয়েকটা রঙিন বিন্দু আঁকা একটা ছবি। রিসর্টের পাশে ‘কালিজ ভ্যালি চা বাগান’। এখানে অবসর যাপনে এসে নির্জনতায় মোড়া, বিশুদ্ধ প্রকৃতির মাঝে সারাদিন ধরে চা বাগান, পাহাড় ও ভ্যালির অসাধারণ দৃশ্য দেখে ও হরেক রকম পাখির ডাক শুনে মন ভরে যায়। উপত্যকার নিচে রয়েছে রামধনু জলপ্রপাত।

সিঙ্গেল টি এস্টেট – দার্জিলিং যাবার পথে কার্শিয়াং ছাড়িয়ে ২ কিমি চললেই হিল কার্ট রোডের ধারে ‘সিঙ্গেল অর্গানিক টি এস্টেট’। মূল রাস্তা ছেড়ে খানিক নেমে চা বাগানের ঠিক মাথার উপর রয়েছে নেপালী পরিবার দ্বারা পরিচালিত এক ছোট্ট হোম স্টে। নিচেই চা বাগান। চা বাগানের মধ্যে দিয়ে চলা রাস্তা এঁকে বেঁকে নেমে গেছে অনেক নিচের ফ্যাক্টরি পর্যন্ত। সে পথে নিশ্চিন্তে, নিরিবিলিতে হেঁটে চলতে চলতে কখন যেন ব্যস্ত জীবনের সমস্ত ক্লান্তি গায়েব হয়ে যায়।

মিরিক যাবার পথে পড়ে থ্রুবো টি এস্টেট

অহলদাড়া – কমলালেবুর খ্যাতি সত্ত্বেও, দার্জিলিং হিমালয়ের নব আকর্ষণ সিটংয়ে রয়েছে চা বাগানও। আর সিটংয়ের মাথার উপর অহলদাড়ায় এক ছোট্ট চা বাগানের মাঝে থাকার জন্য রয়েছে এক সুন্দর হোম স্টে। যদিও এ বাগানের চায়ের গুণগত মান তেমন কিছু নয়, তবুও এখানে থাকা মানেই ৩৬০ ডিগ্রি জুড়ে পাহাড় ও উপত্যকার অসাধারণ দৃশ্য উপভোগ করে শুধুই মুগ্ধ হতে হয়। অন্যতম সুন্দর এক ভিয় পয়েন্ট অহলদাড়া। চা বাগানের অনেক নিচে দেখা যায় রূপোলি ফিতের মত তিস্তাকে। পরিস্কার দিনে সবুজ চা বাগানের মাথার উপর রাজকীয় ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকে শ্বেত শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা।

একটা অকপট স্বীকারোক্তি দিয়ে শেষ করি এই চা উপাখ্যান। আমি নিজে চা প্রেমী বা চায়ের সমঝদার কোনোটাই নই। এমনকি নিয়মিত চা পানও করি না। কিন্তু সেই ছোটবেলায় প্রথম দেখার পর থেকেই পাহাড়ের প্রতি ও পাহাড়ের ঢালের চা বাগানের প্রতি এক অমোঘ আকর্ষণ জন্মে গেছে। সেই টানেই বারবার ছুটে যাই দার্জিলিংয়ের পাহাড়ে। এমনকি এই বর্তমান পরিস্থিতি ও লক ডাউনেও মনটা যেন হারিয়ে যেতে চায় পাহাড়ের কোলে কোন চা বাগানের ঢালে।

রইল বিভিন্ন সময়ে আমার তোলা দার্জিলিং পাহাড়ের নানান চা বাগানের ছবি।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ DarjeelingTea garden