মেঘ পাহাড়ের দেশ – দার্জিলিং ভ্রমণ (পঞ্চম পর্ব)

মেঘ পাহাড়ের দেশ – দার্জিলিং ভ্রমণ (প্রথম পর্ব)

মেঘ পাহাড়ের দেশ – দার্জিলিং ভ্রমণ (দ্বিতীয় পর্ব)

মেঘ পাহাড়ের দেশ – দার্জিলিং ভ্রমণ (তৃতীয় পর্ব)

মেঘ পাহাড়ের দেশ – দার্জিলিং ভ্রমণ (চতুর্থ পর্ব)

২৯ এপ্রিল, ২০১৬

আজ দার্জিলিং এ আমাদের শেষ দিন।আমাদের আজকের প্ল্যান মিরিক গিয়ে ওইখানে এক রাত থেকে পরের দিন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া। তাই আগে ঠিক করে রেখেছিলাম যে খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে দার্জিলিং এর শেষ সকাল টা উপভোগ করব। সেই অনুযায়ী ভোর ৬ টায় ঘুম থেকে উঠে জানালা খুলে দিলাম। ওয়াও, অদ্ভুত রকমের সুন্দর। গত দুই দিন দেখেছিলাম মেঘ পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে জমাট বেধে আছে, গত দিন বিকাল থেকে অনেক বৃষ্টি হওয়ার পর আকাশ অনেক পরিষ্কার এবং দার্জিলিং শহরের চমৎকার একটা ভিউ পাওয়া যাচ্ছে।

সকালের ম্যাল রোড

কিছুক্ষণ এর মধ্যেই আমরা রেডি হয়ে হাঁটতে বের হলাম। প্রথমে ম্যাল এ গিয়ে কিছুক্ষণ বসে ছিলাম। শীতল বাতাসের সাথে মেঘের ভেলা এসে আমাদের কে স্পর্শ করে যাচ্ছিল। সে এক দারুন অনুভূতি। আমরা হাঁটতে হাঁটতে ম্যাল এর পিছনের রোড ধরে রাজবাড়ির সামনে গিয়ে থামলাম। তারপর ঐখান দিয়ে মহাকাল মন্দির এর দিকে কিছুটা হাঁটলাম। এই সময় মনে হচ্ছিল যে আর একটা দিন দার্জিলিং এ থেকে যেতে পারলে মন্দ হত না। কিন্তু আমাদের ছুটি শেষ হয়ে আসছিল।

ওইখানে প্রায় ৯ টা পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করে আমরা সকালে নাস্তা করতে গেলাম ইসলামিয়া রেস্টুরেন্ট এ । আমরা পরোটা, গরুর গোস্ত দিয়ে নাস্তা সেরে নিলাম। জন প্রতি খরচ পড়েছিল ৮০ রুপি করে। এর মধ্যে শুভ আর রাফি এসে আমাদের সাথে যোগ দিল। নাস্তা শেষ করে মিরিক যাওয়ার জন্য টাটা সুমো ঠিক করলাম ১৯০০ রুপি দিয়ে। পথিমধ্যে আমাদের কে দুইটা স্পট এ নিয়ে যাবে এবং মিরিক ড্রপ করে দিবে। কারন আজকের রাত টা আমরা মিরিক এ থাকার প্ল্যান করেছি। গাড়ি ঠিক করে শুভ আর রাফি কে গাড়ির কাছে রেখে আমরা হোটেল এ গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ১০ টার দিকে বেড়িয়ে আসলাম। আগের দিন রাতেই ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম, তাই তেমন দেরি হয় নি। দার্জিলিং চৌরাস্তা থেকে ঘুম পর্যন্ত রাস্তার একটা জায়গায় একটু ভেঙ্গে গেছিল আগের দিন এর বৃষ্টিতে, তাই আমাদের গাড়ি এবার নতুন এক পথে রওনা দিল। আমরা শহরের আরও উপরে উঠতে লাগলাম, এবং পাখির চোখে দার্জিলিং শহরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেই পথটাও খুব সুন্দর। এভাবে এক সময় আমরা ঘুম রেল স্টেশন পৌঁছে গেলাম। মিরিক যাওয়ার রাস্তা টা ঘুম থেকে ডান দিক দিয়ে। আমাদের গাড়ি মিরিকের পথে চলতে থাকল। গাড়িতে আমার সহযাত্রীরা একটু পর ই ঘুমিয়ে পড়ল। শুধুমাত্র আমি আর আমাদের ড্রাইভার জেগে রইলাম। একজন এক মনে রাস্তার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে গাড়ি চালাচ্ছিল আর একজন দুই দিকের অপার সৌন্দর্য অবলোকন করছিল। 😛 😛 😛

গোর্খা স্টেডিয়াম

প্রায় ১ ঘণ্টা পর গাড়ি সুখিয়াপোখরি হয়ে নেপাল ভারত সীমান্তের একটি ভিউ পয়েন্ট এ এসে থামল।

এই জায়গা টা মূলত সুখিয়াপোখরি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, নাম সীমানা বসতি। আমরা গাড়ি থেকে নেমে পাহাড়ের একেবারে কিনারায় গিয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। আমার কাছে এই জায়গাটা অসাধারণ লেগেছে। আমি এক পাহাড়ের উপর দাড়িয়ে আছি, দূরে ঐ পাহাড়ের উপর চিত্রে মনাস্তারি দেখা যাচ্ছে, এবং দুই পাহাড়ের মাঝের উপত্যকায় মানেভাঞ্জন গ্রাম। যারা সান্দাকফু-ফালুট ট্রেকিং এ যায় তাদের যাত্রা এই মানেভাঞ্জন থেকেই শুরু হয়। আবার মানেভাঞ্জন থেকে জীপ এ করেও সান্দাকফু যাওয়া যায়। মানেভাঞ্জন যেতে হলে সুখিয়াপোখরি নেমে অন্য গাড়ি নিতে হয়। আমরা প্রায় ৩০ – ৪০ মিনিট এর মত এই ভিউ পয়েন্ট এ ছিলাম। ওইখানের নুডলস টা খুব ভালো লেগেছিল। তবে মম টা দার্জিলিং এর মত ভালো না।

চা বাগানে ফটোসেশন

এরপর আমাদের গন্তব্য ছিল পশুপাতিনাথ মার্কেট। কিন্তু ওইখানে গিয়ে আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ হল না। পশুপাতিনাথ মার্কেট টা নেপালের মুল ভূখণ্ডে পড়েছে এবং ভারত-নেপাল বর্ডার থেকে আমাদের কে প্রবেশ করতে দেয় নাই। আসলে শুধু আমাদের না কোনও বিদেশীকেই প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। রীতিমত ইন্ডিয়ান এন আই ডি চেক করে নেপাল এ প্রবেশ করতে দেয়া হয়। আমাদের সাথে দুই ইউরোপিয়ান কেও প্রবেশ করতে দেয়া হয় নাই। এই জন্য আমরা বেশিক্ষণ ওইখানে সময় নষ্ট না করে আবার মিরিক এর দিকে রওনা হলাম। আরও কিছু দূর যাওয়ার পর আমরা পথের পাশে একটা চা বাগানে ১০ মিনিটের জন্য নেমে কিছু ফটোসেশন করে নিলাম।

প্রায় ১ টা ৩০ মিনিটের সময় আমরা মিরিক পৌঁঁছাই। ড্রাইভার আমাদেরকে মিরিক লেক এর পাশে না নামিয়ে ওদের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড এ নামিয়ে দেয়। সেইখান থেকে প্রায় ৩০ মিনিট হেঁটে লেকের পাশ দিয়ে একটা ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে লেক এর ব্রিজ এর কাছে Hotel Park এর সামনে পৌঁছাই।

মিরিক লেক এ পৌঁছেই মেজাজ টা খারাপ হয়ে যায়। এই দেখার জন্য অত সুন্দর দার্জিলিং শহর থেকে এখানে এসেছি। আমাদের ধানমণ্ডি লেকের সাথে এর কোনও তফাৎ নেই। বরঞ্চ ধানমণ্ডি লেক এর থেকে ভাল। তারউপর ৭০০০ ফুট উচ্চতার দার্জিলিং এর ঠাণ্ডা থেকে ৫০০০ ফুট উচ্চতার মিরিক এ এসে অনেক গরম লাগছিল। সব মিলিয়ে মেজাজ সপ্তমে উঠে ছিল। আর যারা যারা মিরিক সম্পর্কে ভালো ভালো মন্তব্য করেছিল এবং ট্যুর প্ল্যান এ অবশ্যই মিরিক রাখার কথা বলেছিল তাদের উপর ও মেজাজ খারাপ হয়েছিল। আফসোস হচ্ছিল প্রথমে কালিম্পং যাওয়ার প্ল্যান ছিল, পরে টা ক্যান্সেল করে মিরিক করেছিলাম।এর মধ্যে একবার তো দার্জিলিং এ ফেরত যাবার চিন্তাও করে ফেলেছিলাম এই ভেবে যে তাহলে সন্ধ্যা আর রাত টা তো দার্জিলিং এ থাকা যাবে। পরে মাথা একটু ঠাণ্ডা হওয়ার পর এবং সবাই মিলে মিরিক থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে আমি একা থাকলে হয়ত শেয়ারড জীপ ধরে আবার দার্জিলিং চলে যেতাম। পরে আমার যে উপলব্ধি হয়েছিল সেটা হল – শিলিগুড়ি থেকে মিরিক হয়ে দার্জিলিং গেলে তখন হয়ত মিরিক ভালো লাগত। কিন্তু দার্জিলিং থেকে মিরিক এসে থাকলে ভালো লাগার কথার না। আর বাংলাদেশ থেকে যারা ট্যুর অপারেট করে তারা দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি ফেরার সময় মিরিক লেক টা একটু টাচ করে যায়, স্পট বাড়ানোর জন্য। এবং কলকাতা হোটেলের দাদা বলতেছিল যে মিরিক এ সাধারণত কেউ থাকে না, শতকরা ৩ জন। আমার মতে, মিরিক যাওয়ার থেকে কালিম্পং যাওয়া আরও ভালো। আর যদি কেউ মিরিক ঘুরতেই চান, তাহলে হয় দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার সময় লেক এ একটু ঢু মারবেন অথবা শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার সময় মিরিক হয়ে যাবেন।

মিরিক লেক ভিউ

ওইখানে প্রথমে Hotel Park এ ভাড়া বেশি চাইলে একটু খোঁজাখুঁজি করলাম হোটেল এর জন্য। পরে Hotel Park এ আমরা ১০০০ রুপি করে দুইটা রুম ভাড়া নিলাম। হোটেলের অবস্থান টা ছিল একেবারে লেক এর মাঝের ব্রিজ বরাবর। রুম এ গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আমরা চললাম লেক আর এক দিকে কলকাতা রেস্টুরেন্ট এ দুপুরের খাবার খেতে। মিরিক এ এটাই একমাত্র বাঙালি হোটেল। এখানে আমরা আইড় মাছ , ভাত, সবজি, ডাল দিয়ে ভাত খেলাম। জন প্রতি খরচ ছিল ২০০ রুপি। এবং হোটেলের দাদা অনেক বেশি কথা বলেন।

দুপুরের খাওয়ার পর প্ল্যান ছিল লেক এ নৌকায় ঘুরব, কিন্তু নৌকা বিকাল ৪ টার পর বন্ধ হয়ে যায়। তাই আমাদের আর নৌকায় চড়া হল না। এর মধ্যে শুভ আর রাফি লেক ওপাড়ে পাহাড়ের চূড়ায় একটা কটেজ এ যাওয়ার জন্য ঘোড়া ঠিক করে ফেলল। আমরা তিন জন রেস্ট নিতে রুম এ চলে গেলাম। বিকাল ৫ টার দিকে আমরাও পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য বের হলাম। আমরা ঘোড়া নেই নাই, একটা কারণ টাকা বাঁচানো, আর একটা কারণ পাহাড়ে একটু হেঁটে বেড়ানো। ঘোড়ার ছেলে গুলো বলতেছিল যে হেঁটে যেতে পারব না, হেঁটে যেতে ১ ঘণ্টা লাগবে, সন্ধ্যার আগে ফেরত আসতে পারব না। কিন্তু আমরা ১৫ মিনিটের মধ্যে উপরে কটেজের গেট এর কাছে চলে গেলাম। কিন্তু গেট এ তালা দেয়া ছিল। ওইখানে ১০ মিনিট এর মত রেস্ট নিয়ে আমরা আবার নিচে নেমে আসলাম।

এর কিছুক্ষণ পর আমরা যখন ব্রিজ এর উপর এলাম কোথা থেকে অনেক মেঘ এসে আমাদের কে ঢেকে দিল। ততক্ষনে আমার মেজাজ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। আমরা লেক এর পাশে পা ঝুলিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে রইলাম।

সন্ধ্যার পর চিন্তা করতে থাকলাম কি করব। কারণ কিছু করার নাই আর সন্ধ্যার পর লেক এর পাশের সকল দোকান বন্ধ হয়ে যায়। আমরা হোটেল এ রাতের খাবার অর্ডার দিলাম। শুভ আর রাফি খেল বিরিয়ানি আর আমরা আলু পরোটা এবং নুডলস খেলাম। আমাদের দুইজনের রাতের খাবারের খরচ হয়েছিল ৮০ রুপি করে জনপ্রতি। মিরিক এ সব কিছুর দাম একটু বেশি। রাতের খাবার শেষ এ কিছুক্ষণ হোটেলের বারান্দায় গল্প করে আমরা ঘুমাতে চলে গেলাম। পরদিন আমরা শিলিগুড়ি হয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিব।

ট্যুর এর খরচগুলো এখানে পাবেন

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Darjeelingmirik