মেঘ পাহাড়ের দেশ – দার্জিলিং ভ্রমণ (দ্বিতীয় পর্ব)

মেঘ পাহাড়ের দেশ – দার্জিলিং ভ্রমণ (প্রথম পর্ব)

আগের পর্বে আমরা ৯ জন একটা জীপ ভাড়া করে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলাম। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমাদের যাত্রা শুরু করতে প্রায় ২ টা বেজে যায়। আমাদের জীপ এর ড্রাইভার ছিল একজন গোর্খা জাতির আমাদের বয়সের ই ছেলে। গাড়ি ছাড়া মাত্রই মনটা আনন্দে নেচে উঠল। অবশেষে আমরা দার্জিলিং যাচ্ছি।

শিলিগুড়ির সমতল ছেড়ে পাহাড়ের পথে

জীপ শিলিগুড়ির রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করল। প্রথম ১৫-২০ মিনিট এর রাস্তা আমাদের দেশের যে কোনও জেলা শহরের মত। এরপর আমাদের জীপ ক্যান্টনমেন্ট এবং সমতল চা বাগানের মধ্যে দিয়ে চলতে লাগল। আমরাও জীপের মধ্যে গল্প করতে করতে প্রত্যেকের সাথে পরিচিত হতে লাগলাম। দুই ধারে চা বাগান আর কিছুদূর পরে আমাদের জীপ একটা পানিবিহীন নদীর উপরে সরু ব্রিজ ক্রস করে। আমার কাছে নদীর শুকনো পাথরগুলো দেখতে ভালই লাগছিল। আমাদের ড্রাইভার জানালো যে নদীর নাম পাঞ্চাই। এবং বর্ষা শুরু হলে পাহাড়ি ঢলে নদী টি দেখতে আরও সুন্দর লাগে। এভাবে আর ও ২০-২৫ মিনিট চলার পর আমরা সমতল ছেড়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু করলাম।

একটু পর পর তীক্ষ্ণ বাক আর ক্রমাগত উপরে ওঠা। ভিতরে অনেক দিন পর পাহাড়ে ওঠার শিহরণ অনুভব করছিলাম। সেই কবে বান্দরবান গেছিলাম। তবে এখানকার পাহাড়গুলো বান্দরবান এর পাহার থেকেও অনেক উঁচু। এভাবে একটা করে বাক পার হচ্ছিলাম আর আমি ক্যামেরার কথা ভুলে গিয়ে শুধু একবার ডানে তাকচ্ছিলাম আর একবার বামে তাকাচ্ছিলাম। ট্যুর শেষ হওয়ার পর দেখা গেল ঐ রাস্তায় আমাদের কেউ ই কোনও ছবি তুলে নাই। সবাই শুধু গোগ্রাসে দুই পাশের পাহাড় এর সৌন্দর্য গিলছিল।এবং এর মধ্যেই আমরা ইকবাল ভাই আর সজিব ভাই এর উচ্চতাভীতি আমাদের কাছে প্রকাশ হয়ে গেল। এই নিয়ে পুরো রাস্তা আমরা তাদের সাথে মজা করেছিলাম। আরও প্রায় ৩০ মিনিট চলার পর আমাদের জীপ রাস্তার পাশে একটা খাবার দোকানের সামনে ১৫ মিনিটের যাত্রা বিরতি দেয়।

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি বাঁক

আমরা এই সময় নেমে দার্জিলিং এর বিখ্যাত চিকেন মম কিনলাম। কিন্তু স্বাদ এতটাই বিশ্রী যে আমি মনে মনে ভাবলাম এই মম নিয়ে মানুষ কেন এত উচ্ছ্বসিত।(অবশ্য পরে আমার ভুল ভেঙ্গেছিল এবং বলতে গেলে দার্জিলিং এ যে কয় দিন ছিলাম প্রতিদিন রাত এ আমাদের ডিনার মম দিয়েই হত। তাই ভুলেও দার্জিলিং যাওয়ার পথে রাস্তার পাশের দোকান থেকে মম খাবেন না)। ১৫ মিনিটের যাত্রা বিরতি থাকলেও আমাদের ড্রাইভার তার পরিচিত দোকানে গোসল করে খাওয়া দাওয়া করতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় নষ্ট করলেও আমাদের কারো কোনও খারাপ লাগছিল না। সবাই তখন পাহাড়ের সাথে প্রেমে ব্যাস্ত ছিলাম।

অতঃপর আমাদের গাড়ি ছাড়ল এবং আমরা আরও উঁচুতে উঠতে শুরু করলাম। রাস্তার বাক গুলো আরও খাড়া হচ্ছিল। হঠাৎ করে আমি আর সোহাগ খেয়াল করলাম যে আমাদের গাড়ি একটু পর পর ডান দিকে চলে যাচ্ছে। সোহাগ বলল যে জীপ এ কোনও প্রবলেম আছে। এর মধ্যে একটা প্রায় ১৮০ ডিগ্রি বাঁকে জীপটা এতটাই ডানে সরে গিয়েছিল যে আমি আর সোহাগ ভয় পেয়ে গেছিলাম।(অবশ্য গারিতে এই ব্যাপারে আমরা কোনও কথা বলি নাই। পরে গাড়ি থেকে নেমে আমরা এইটা নিয়ে আলচনা করছিলাম)।

এভাবে চলতে চলতে আমরা এক সময় কুরসিওং পৌঁছে গেলাম। ইকবাল ভাই ভাবছিলেন যে এটাই বুঝি দার্জিলিং চলে এসেছি, এই নিয়ে তাকে আবার ও এক দফা পচানো হল।

মেঘের ভিতর দিয়ে চলা

কুরসিওং পার হওয়ার কিছু দূর পরেই হঠাৎ করে অনেক মেঘ এসে আমাদের ঢেকে দিল। আমাদের জীপ মেঘের ভিতর দিয়ে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে চলতে লাগল। এবং আমি ঠাণ্ডায় কাঁপতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি শুরু হল। আবার থেমেও গেল। এভাবে প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা যখন দার্জিলিং পৌঁছালাম সূর্য্যি মামা তখন পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে।

আমরা মল রোড এর পিছনে সবাই জীপ থেকে নামলাম।

দার্জিলিং ম্যাল রোড

আমাদের কোনও হোটেল বুকিং দেয়া ছিল না। এবার এই পড়ন্ত বিকালে সব থেকে কঠিন কাজ টা শুরু হল – হোটেল খোঁজা। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন দার্জিলিং এর পিক সিজন। তাই সব হোটেল এই ভাড়া বেশি। গ্রুপ এর বাকি সবাই মল এর পিছনে এক গলির হোটেল এ উঠল। আমার আবার হোটেল এর ওয়াশ রুম পছন্দ না হওয়ায় তাদের সাথে না থেকে হোটেল মেইন ওল্ড বেল ভিউ এ উঠলাম। তবে এই হোটেল এর অনেকগুলা ভবন আছে। এক একটি ভবনের রুম ভাড়া এক এক রকম। আমরা ছিলাম কেএফসি এর উপরের ভবনে।

তিন রাত এর জন্য আমাদের রুম ভাড়া ছিল ৪৫০০ রুপি। অবশ্য রুম টা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। জানালা দিয়ে সুন্দর ভিউ ছিল। আমার বন্ধু সোহাগ ও এক রাতের জন্য এই হোটেল এ ছিল ১৫০০ রুপি দিয়ে। পরের দিন ও আর একটু দূরে ১০০০ রুপির আর একটা হোটেল এ উঠেছিল। কারন ওর একার পক্ষে ১৫০০ রুপি বেশি হয়ে গেছিল। অবশ্য ওর পরের হোটেল(Hotel Seven seas) টাও সুন্দর ছিল। হোটেল রুম এ ফ্রেশ হয়ে আমরা রাত এর দার্জিলিং দেখতে বের হয়ে গেলাম।

দার্জিলিং এ রাতের ম্যাল রোড

অনেকক্ষণ মল রোড এ হাটাহাটি করলাম। তারপর মম আর নুডলস দিয়ে রাতের ডিনার সারলাম। ৩০ রুপি দিয়ে ৮ পিস ভেজিটেবল মম পাওয়া যায়। আমরা দুই জন মিলে শেষ করতে কষ্ট হয়ে গেছিল। তারপর ৩০ রুপি দিয়ে নুডলস খেলাম। এই ছিল রাতের ডিনার। আর হাল্কা কিছু খাবার কিনে রাত ১০ টায় ঘুমাতে চলে গেলাম। পর দিন আবার সকালে উঠতে হবে।

ট্যুর এর খরচগুলো এখানে পাবেন

Leave a Comment
Share