আলীকদমের গল্প-১ (ওয়াংপা ঝর্ণা, দামতুয়া/ডামতুয়া ঝর্ণা)

গ্রুপ মেম্বারঃ ৮ জন
তারিখঃ ০৩/০৮/২০১৮

অনেকদিন থেকে দূরে কোথাও ঘুরতে যাব বলে মনস্থির করলেও নানা কারনে যাওয়া হচ্ছিলো না। হটাৎ সিদ্ধান্ত হয় আমরা আলীকদম যাব। এরপর শুরু হয় প্লানিং, এস্টিমেশন। একটা মোটামুটি প্লান রেডি করে আমাদের তুখোড় ট্রেকার অভিজিৎ হীরা। দুইদিনে আলীকদমের দামতুয়া/ডামতুয়া আর মাতামুহুরী নদী দেখার প্লান হয়। আজকে বলব প্রথমদিনের গল্প।

আমরা চট্টগ্রামের নতুন ব্রীজ থেকে চকোরিয়ার বাস ধরি সকাল ১১ টার দিকে। চকোরিয়া নেমে দুপুরের খাবার খেয়ে চান্দের গাড়ি ঠিক করে আলীকদমের দিকে রউনা হই। পথে মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স পড়ে। গাড়ি থামিয়ে মিরিঞ্জা কমপ্লেক্স ঘুরে দেখলাম। পাহাড়ের মাথা থেকে সামনে দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের সারি আর সবুজের সমারোহ মন ভালো করে দেয়। গিরিদ্বারের সাথেই একটা বিরাট খাদ। পরের পাহাড়ের মাথায় ঝুলে আছে এক টুকরো মেঘ; যে কোন মুহুর্তে আকাশের কান্না হয়ে ঝরে পড়ার অপেক্ষায়। মিরিঞ্জা ঘুরে শেষ করে ফিরে এসে দেখি চান্দের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় ঘন্টাখানেক ড্রাইভার ভাই চেষ্টা করেও কুলকিনারা করতে পারল না। ফলে বাধ্য হয়ে চান্দের গাড়ি ছেড়ে ঢাকা থেকে আসা হানিফের বাসে উঠে বসলাম। আলীকদমে যখন পৌছালাম তখন সন্ধ্যা। রেস্ট হাউজে উঠে পড়লাম সবাই। রাতে খাওয়া শেষ করে দুই রুমে ৮ জন ঘুমিয়ে পড়লাম।

মিরিঞ্জা পর্যটন কেন্দ্র থেকে তোলা

পরদিন সকাল শুরু হল ভোর ৬ টায়। উঠে রেডি হয়ে পানবাজার থেকে খিচুড়ি আর দেশি মুরগি সাবাড় করে আগেরদিন কথা বলে রাখা মোটরসাইকেলে চড়ে বসলাম। পাহাড়ি আকাবাকা উচু নিচু পথ ধরে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলতে লাগল মোটরসাইকেল। দুইপাশে নয়নভিরাম দৃশ্য। কিছু কিছু পথ এত খাড়া নেমে গেছে যে ভয় হয় মোটসাইকেল যেতে পারবে কিনা। কিছুক্ষন পর আদুপাড়া পৌছাই এর মাঝে ১৭ মাইল আর্মি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি আর এনআইডির কপি দিয়ে আসতে হয়। আদুপাড়া নেমে গাইড ঠিক করে ট্রেকিং এর প্রস্তুতি নিয়ে ট্রেকিং শুরু করি সকাল ৮:১৫তে।

দামতুয়া যাবার পথে

প্রায় ৫০ মিনিট ট্রেকিং এর পর মেম্বারপাড়া পড়ে। এর একটু আগে ওয়াংপা ঝর্নার আপারস্ট্রিম দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নেই ফেরার পথে ওয়াংপা দেখেই ফিরব। যাই হোক মেম্বার পাড়া থেকে প্রায় ১ ঘন্টা পর কাখৈ পাড়া। মাঝে মাঝে জিরিয়ে নিয়ে গ্রুপের সবাই ছবি তুলতে তুলতে আর চারপাশের স্বর্গীয় দৃশ্য দেখতে দেখতে আরো একঘন্টা পর পৌছে গেলাম ক্যাসকেডে। এই প্রথম বিশাল ক্যাসকেড দেখে ভাবছিলাম এই মনে হয় ডামতুয়া। যাই হোক ক্যাসকেডের বিরাট জলের ধারার দিকে কিছুক্ষন মুগ্ধভাবে তাকিয়ে থাকলাম। এরপর নেমে কিছুক্ষন লাফালাফি করে আবার রওনা হলাম দামতুয়া জয়ের জন্য। ১০ মিনিটের মাথায় পৌছে গেলাম দামতুয়ায়। আক্ষরিক অর্থেই হা করে কিছুক্ষন এর সৌন্দর্য গিলে নিলাম। বিশাল সাদা ফেনিল জলের স্রোত পাহাড় বেয়ে চঞ্চল হরিন শাবকের মতই দুরন্তবেগে ধেয়ে আসছে। বাতাসের ঝাপটায় পানির কনা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

দামতুয়ার আগের ক্যাসকেড

বেশ কিছুক্ষন গোছল আর ঝাপাঝাপির পর ফেরার সময় হল। ফেরার পথ ছিলো দীর্ঘ ও ক্লান্তিকর। যতই আগাচ্ছি ততই পিছনে ফেলে আসছি অপার সৌন্দর্য ঘেরা পাহাড়, ঝিরি আর ঝর্না। প্রায় ২ ঘন্টা পর মেম্বার পাড়ায় পৌছলাম।

দ্যা মাইটি দামতুয়া / ডামতুয়া

এখন ওয়াংপায় যাইতে গাইড রাজি হচ্ছেনা। বহু কষ্টে তাকে এক্সট্রা টাকা দিয়ে ম্যানেজ করা হল। এতক্ষন পথ বেশ সুন্দর ছিলো কিন্তু ওয়াংপাতে খুব কম মানুষ যায় তাই ভালো পথ নেই অনেক যায়গাতেই। এক বিরাট পাহাড় ভেঙ্গে এগিয়ে গেলাম। কিছুক্ষন পর গাইডই আর পথ খুজে পায়না। বেশ কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করে একটা পথ বের করে চলতে শুরু করলাম। এই পথে যে খুব বেশি কারো আনাগোনা নেই তা স্পষ্ট ছিলো প্রতি পদক্ষেপে। হাচড় পাচড় করে প্রায় ৩০ মিনিট পরে কোনমতে উঠে যা দেখলাম তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।

দূর থেকে ওয়াংপা ঝর্ণা

কয়েকশ ফুট উচু থেকে ফেনিল জল নেমে আসছে। ফ্লো যাই হোক উচ্চতা ছিলো দেখার মতই। ট্রেকিং এর কারনে ক্লান্ত কেউ আর নামার সাহস করেনি। কিছুক্ষন থেকে ফিরে আসব এমন সময় আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি শুরু হল। পাহাড়ে সেই ঝুম বৃষ্টি আমার জীবনের সেরা অভিজ্ঞতার একটা হয়ে থাকবে। বৃষ্টির ভিতরেই পাহাড় চড়তে থাকলাম। কিছুক্ষন পর মেম্বার পাড়া হয়ে আদুপাড়া পৌছে গেলাম। পৌছানোর পর মনে হচ্ছিলো যা পাবো তাই কাচা খেয়ে ফেলতে পারব। সামনের দোকান থেকে ৫ টা কলা, দুইটা পাউরুটি, একটা কেক, দুইটা মিষ্টি পিঠা ধরনের জিনিস, চা, পেপে সাবাড় করেও মনে মনে ভাতের অভাবটা অনুভব করছিলাম। এরপর মোটরসাইকেলে চেপে আবার আলীকদম পানবাজারে ফিরে আসলাম। এইভাবে শেষ হল প্রথম দিন।

ওয়াংপা ঝর্ণা

খরচাপাতি

নতুন ব্রিজ টু চকরিয়া বাস ভাড়াঃ ১৪৪০ টাকা (জনপ্রতি ১৮০ করে)
দুপুরে খাওয়াঃ ১২০০ টাকা
চান্দের গাড়ি (মিরিঞ্জা পর্যন্ত) ৫৫০ টাকা
পার্কে এন্ট্রিঃ ১৬০ টাকা (জনপ্রতি ২০)
মিরিঞ্জা টু আলীকদম বাস ভাড়াঃ ৩২০ (জনপ্রতি ৪০)
আলীকদম থেকে পানবাজার ইজিবাইক ভাড়াঃ ৮০ (জনপ্রতি ১০)
ডিনারঃ ১৪৫০ টাকা
পরের দিনের কেক/চকলেট/পানি কেনাঃ ৬০০
রুম ভাড়াঃ ২০০০ (প্রতি রুম ১০০০)
বাইক ভাড়াঃ ৩৪০০ (বাইক প্রতি ৮০০, শেষে আমরাই ২০০ টাকা বখশিশ দিছি কারনে আমাদের টাইম থেকে প্রায় ১ ঘন্টা দেরি হইছিলো আসতে)
সকালের নাস্তাঃ ১১০০
গাইডঃ ৭০০+৪০০=১১০০ (ওয়াংপা যাওয়ার জন্য এক্সট্রা ৪০০ টাকা দিতে হইছে)
পাড়ার ফিঃ ১০০
ট্রেকিং এর পর নাস্তা বাবদঃ ৬০০
সর্বমোটঃ ১৪১০০ টাকা
জনপ্রতিঃ ১৭৬২ টাকা মাত্র।

বিঃদ্রঃ ঘুরতে গিয়ে যত্র তত্র ময়লা, বিস্কুট, চিপস, চকলেটের খালি প্যাকেট, খালি পানির বোতল ফেলবেন না। পরিবেশ নষ্ট করবেন না। পাহাড়িদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন।
Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Alikadamdamtuatuk aou lamonoi