ভূটান ভ্রমনের আদ্যপ্রান্ত

প্রথমবারের মত লিখছি সুতরাং কোন ভুল ত্রুটি হলে অবশ্যই ক্ষমা করবেন। আমি গত ২৬ এপ্রিল, ২০১৭ রাতে শ্যামলী এস.আর বাসে করে ভূটান ঘুরে আসলাম। যাওয়ার আগে শুনতাম ছবির মতো সুন্দর একটা দেশ কিন্তু যাওয়ার পর বুজলাম তার থেকেও সুন্দর গোছানো একটা দেশ ভূটান। এবার আসি বিস্তারিত বর্ণনায়, কিভাবে যাবেন, কই থাকবেন, কি করবেন?

ইমিগ্রেশন অফিস

প্রথমেই ভারতীয় ট্রানজিট ভিসার প্রয়োজন হবে যা ঢাকার শুধুমাত্র গুলশান শাখা থেকে করিয়ে নিতে পারবেন। ট্রানজিট ভিসার বিস্তারিত বর্ণনা এই লিংকে

তারপর আগে থেকে টিকিট করে রাখা শ্যামলী বাসে উঠে পরুন। আরামবাগ থেকে রাত ৮টায় এবং কল্যাণপুর থেকে ৯টায় ছাড়ে। সময় লাগে ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা। তারমানে পরদিন সকাল ৮টার মধ্যে আপনি বুড়িমারি সীমান্তে। ৯টায় ইমিগ্রেশন অফিস খুললে প্রয়োজনীয় কাজ শেষ করে ঢুকে পরুন ইন্ডিয়াতে। ২ সীমান্তের বর্ডারের কাজ শেষ করে আপনার জন্য অপেক্ষারত বাসটিতে উঠে পরুন।

ভুটানের যাবার জন্য ময়নাগুরি নামক জায়গায় নেমে ১টা লোকাল বাসে উঠে পরুন ভাড়া নিবে ৩০ রুপি। ঐখান থেকে নেমে সাফারি নামের গাড়িতে উঠুন ভাড়া পড়বে ৩০/৩৫ টাকা যা আপনাকে জয়গাও ভূটান-ইন্ডিয়া বর্ডারের কাছাকাছি নিয়া যাবে। এরপর ৭টাকা ভাড়া দিয়ে অটোতে (আমাদের দেশে সিনজি) উঠে চলে যাবেন জয়গাও ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসে এবং এক্সজিট সিল লাগিয়ে সোজা চলে যান ভূটান। মনে রাখবেন ভূটান-ইন্ডিয়া ওপেন বর্ডার, যখন খুশি যাওয়া ও বের হওয়া যায়। কোন সমস্যা নেই। আমার মতে খাওয়া দাওয়ার কাজটা জয়গাও তে সেরে নেয়াই উত্তম হবে।

আমরা Phuentsholing পৌঁছাই বিকেল ৪ টাইয় এবং সেখান থেকে ১টা ৮ সিটের গাড়ি ভাড়া করি এবং সোজা চলে যাই ওদের রাজধানী থিম্পুতে। যেতে যেতে প্রায় রাত ১১:৩০। ও ভালোকথা, বাংলাদেশ এবং ভুটানের সময় একদম এক (GMT+6 ) । আমরা থিম্পুতে Yoesel Hotel 2 তে ছিলাম যার ডাবল বেডের রুমের ভাড়া ছিল ৭০০ রুপী এবং ট্রিপল বেডের রুমের ভাড়া ছিল ৯০০ রুপী। গোছান, ছিমছাম হোটেল।

ভূটান গেট

প্রথম দিনঃ

সকালে ঘুম থেকে উঠে পাশের হোটেলের রেস্টুরেন্ট Hotel Choephal Norkye থেকে নাস্তা করে নেই। এখানের খাওয়া মজার। আমাদের প্রথম দিনের নাস্তার আইটেম ছিল Cheese Egg, Parata, Dal Fry & Coffee. আমরা প্রথই দিনই থিম্পু থেকে Punakha নামক শহরে যাওয়ার permit করিয়ে নিয়েছিলাম যেন পরবর্তীতে কোন সময় নষ্ট না হয়।

অফিসিয়াল কাজ শেষে আমরা থিম্পুতে সিটি ট্রিপ দিলাম এর মধ্যে zoo, Dzhong, Monestry ছিল কিন্তু বুদ্ধা পয়েন্ট ছিল মনে রাখার মতন ১টা জায়গা। অসম্ভব সুন্দর ১টা শহর। দেখলেই মন ভরে যায়।

দ্বিতীয় দিনঃ

যাত্রা এবার পুনাখা। সকাল ১০টায় রওনা দিলাম, ২/২:৩০ ঘণ্টার মতন সময় লাগে পৌছাতে। যাওয়ার পথে Duchala, Punakha Dzhong, এবং Suspension Bridge তো মাথা নষ্ট করে দেয়। আবহাওয়া অন্য শহর থেকে একটু ভিন্ন কিন্তু খুবই উপভোগ্য। কেউ ভূটান গেল, কিন্তু পুনাখা গেল না, তাহলে তার ভূটান যাত্রাই অপূর্ণ। সারাদিন ঘুরে রাতে আবার থিম্পুতে ফিরে গেলাম কারন পুনাখাতে থাকার মতন ভাল হোটেল নেই। আর থিম্পু হয়ে যেহুতু পারো যাওয়া লাগে তাই থিম্পুতে চলে যাওয়াটাই ভাল সিদ্ধান্ত।

দোচুলা পাস

তৃতীয় দিনঃ

থিম্পু এবং পুনাখা দেখা শেষে এবার আমাদের যাত্রা স্বপ্নের শহর Paro এর উদ্দেশে। এখানে আমরা ছিলাম Hotel Dragon এ, এটা ইন্ডিয়ান হোটেল খুব সম্ভবত এর মালিক কলকাতার লোক। তাই এখানে সর্ব ধরনের বাঙালি খাবার পাওয়া যায়। যেমন; সাদা ভাত, আলু ভর্তা, আলু ভাজি, শুকনা মরিচ দিয়া আলু ভর্তা, খাসির তরকারি, মুরগির তরকারি, সবজি এক কথায় পুরা ১৬ আনা বাঙালি খাওয়া তবে দাম একটু বেশি। তবে কয়েক দিন টানা ফ্রাইড রাইস আর চাউমিন খেতে খেতে আমরা অস্থির হয়ে গেচিলাম। তাই বাঙালি খাবার পেয়ে এই সুযোগ কেউ হাত ছাড়া করি নাই।

এখন আসি আসল কথায়, পারো হচ্ছে ওদের সবথেকে সুন্দর শহর, এই শহরেই ওদের একমাত্র আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্ট আছে। থিম্পু থেকে আসার পথে অনেক সুন্দর সুন্দর যায়গা আছে যা না দেখলেই নয়। এদের মধ্যে অন্যতম হল case bridge. এটা যেমন মজার তেমনই ভয়ঙ্কর।

চতুর্থ দিনঃ

এবার পারোর সব থেকে বড় আকর্ষণ Tiger Nest/ taksin. যেটা ওদের ধর্মীয় এবং পর্যটনের দিক থেকে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিন হাজার ফুট হেটে উঠতে হবে আবার নেমে আসতে হবে। পায়ে হাটার বিকল্প কোন বেবস্থা নাই। আমাদের উঠতে সময় লেগেছিল প্রায় ৩:৩০ ঘণ্টার মতন আবার নামতে সময় লেগেছে ১ ঘণ্টার বেশি। দিন শেষে এটাই ছিল সব থেকে মজার এবং সারা জীবন মনে রাখার মতন একটা ঘটনা।

টাইগার নেস্টের সামনে দাঁড়িয়ে

পঞ্চম দিনঃ

ভুটানের সব সুন্দর সৃতি সাথে নিয়ে এবার আমাদের গন্তব্য আরেক সৌন্দর্যের রানি দার্জিলিং। চা বাগানে ঘেরা অপুরুপ সুন্দর দার্জিলিং শুধু টিভিতেই দেখেছি কিন্তু এবার সুযোগ এসেছে সামনে থেকে দেখার। এবার রওনা হলাম পারো থেকে দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে। সকাল ১১টা। আমাদের যাত্রা শুরু। ৪:৩০/৫ ঘণ্টা সময় লাগে ফুএেন্টসলিং পৌছাতে। পথে যাত্রা বিরতি বেশি নিলে সময়তো একটু বেশি লাগবেই। অবশেষে ভূটান বর্ডার গেটে পৌছালাম স্থানীয় সময় ৫টায়। এক্সিট সিল নিয়ে হেঁটে চলে গেলাম ইন্ডিয়ার ভিতর সোজা ওদের ইমিগ্রেশন অফিসে আর লাগিয়ে নিলাম এন্ট্রি সিল। যেহুতু দারজেলিং যাব তাই রাতটা শিলিগুড়ি থাকতে হবে। ৩,৫০০ টাকায় একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিলাম এবং রাত ১০:৩০ নাগাদ শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলাম। বলে রাখা ভাল যে ইন্ডিয়া ঢুকেই ইন্ডিয়ার টা মোবাইল সিম কিনি ইন্টারনেট প্যাকেজ সহ। তাই অনলাইনেই টা হোটেল বুক দিয়া সরাসরি উঠে পরি হোটেলে। ২ রুম, ২ রাত সর্বমোট ৩,০০০ রুপি। রাতে আরেকটা গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলাম পরের দিন সারা দিন যেন ভালভাবে ঘুরতে পারি কোন ঝক্কি ছাড়া।

ষষ্ঠ দিনঃ

ভোর ৪:৩০ টায় ঘুম থেকে উঠে আগের দিন ঠিক করে রাখা গাড়ি করে পুরো দার্জিলিং শহরটা ঘুরে দেখলাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো Zoo, Rock Garden, Bazar, Tiger Hill. সবগুলা যায়গার মধ্যে Tiger Hill সবথেকে আকর্ষণীয়। এখান থেকে সূর্যাস্ত দেখা অন্যরকম আনন্দের। বলে রাখা ভালো যে দার্জিলিং শহরে ঢাকার মতন ট্রাফিক জ্যাম হয়। সারাদিন ঘুরাফিরা শেষে এবার হোটেলে ফিরার পালা। বাস শিলিগুড়ি থেকে ছাড়ে বলে শিলিগুড়িতেই আবার ফিরে গেলাম।

সপ্তম দিনঃ

গত কয়েক দিনের ক্লান্তি পুষিয়ে নেবার জন্য এবার একটা সেই ঘুম দেয়ার পালা কারন বাসতো সেই ১:৩০ টায়। যে কথা, সেই কাজ। ১০ টা পর্যন্ত ঘুমিয়ে নিলাম এবং সকালে নাস্তা করলাম স্ট্রিট ফুড দিয়ে। ২০ রুপিতে ৩ টে পরটা এবং refillable ডাল। চমৎকার স্বাদ, পেটেও তৃপ্তি, জিহ্বাতেও তৃপ্তি। হাল্কা ঘুরে, বিধান মার্কেটে শপিং করে বাসে উঠে গেলাম। গন্তব্য এবার বাংলাদেশ।

কিছু করনীয়ঃ

১। ডলার চেংরাবান্দাতেই ভাংগাবেন কারণ পুরা ভুটানে আমার চোখে কোন মানি এক্সচেঞ্জার পরে নাই। ভুটানে কোন সমস্যা ছাড়াই ইন্ডিয়ান রুপি চলে, সুতরাং ইন্ডিয়ান ৫০০ আর ১০০ করে টাকা নিয়া যান।
২। দার্জিলিং যদি যাওয়ার ইচ্ছা থাকে তাহলেও ডলার চেংরাবান্দাতেই ভাংগাবেন কারণ দার্জিলিং শহরে রেট অনেক কম দেয়।
৩। অবশ্যই ১০০ ডলারের নোট নিয়ে যাবেন কারণ ৫০ বা খুচরা নোটে কম রেট দেয়। আর সর্বদাই চেষ্টা করবেন নতুন ১০০ ডলারের নোটটা নিতে। (আমি চেংরাবান্দাতে ৬৬ রুপি করে পেয়েছিলাম)
৪। ভূটান ও দার্জিলিং এ হোটেলে অবশ্যই দামাদামি করে উঠবেন এতে ২০০/৩০০ টাকা প্রতিদিন শুধু হোটেলেই সেভ হবে।
৫। ভুটানে ২ টা মোবাইল কোম্পানি আছে, Bhutan Telecom Ltd or B-Mobile আরেকটা হল TashiCell। কোন দিন TashiCell ছাড়া অন্যটা ভুলেও কিনবেন না যদি ইন্টারনেট ব্যবহার করার ইচ্ছা থাকে। আর বাংলাদেশে কল করার আগে “010” বসায় নিবেন। ৭.৫ রুপি পরবে per minute.

কিছু সতর্কতাঃ

  • পাসপোর্টের ফটকপি সাথে রাখবেন।
  • পাসপোর্টের ছবি তুলে মোবাইলে নিয়ে নিবেন।
  • যাদের অফিসিয়াল পাসপোর্ট, তারা তাদের প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র সঙ্গে রাখবেন।
  • Phuntsholing থেকে থিম্পু যাওয়ার জার্নিটা অনেক বড়। বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত বাস পাবেন।
  • পারো থেকে Phuentsholing এ যাবার বাস একটাই। তাই আগেরদিন বাসের টিকেট কেটে রাখার ট্রাই করবেন।
  • সুভন্যির কিনতে হলে টাইগার নেস্ট স্টার্ট পয়েন্ট সব থেকে উত্তম জায়গা। অবশ্যই দরাদরি করে কিনবেন।

কিছু প্রয়োজনীয় নাম্বার ও ঠিকানা

Hotel Choephal Norkye (Thimphu)
ফোনঃ +975 17628400
এদের ডাবল বেড ১২০০ এবং ত্রিপল বেড ১৫০০ করে। খুবই স্ট্যান্ডার্ড।

Yoesel Hotel 2 (Thimphu)
ফোনঃ +975 77399406, +975 17852311, +975 17606447
এদের ডাবল বেড ৭০০ এবং ত্রিপল বেড ৯০০ করে। moderate service।

Hotel Dragon (Paro)
ফোনঃ +975 8272174, +975 17762628, +975 17320473
এদের ডাবল বেড ১০০০ এবং ত্রিপল বেড ১৩০০ করে। (This is the best, Bengali foods are available too)

Hotel Diamond (Shiliguri)
ফোনঃ +91 98327 88314
এদের ডাবল বেড ৮০০ রুপী করে। moderate service।

লেখকঃ Ashab Anis Joy

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ bhutanexpensehotelstorytravel