বান্দরবান অভিযান – একটি ভ্রমণ কাহিনী এবং কয়েকটি ঘটনা

কক্সবাজারে সবকিছুর নামের মধ্যে যেমন ‘সী’ শব্দটা আছে, তেমনি বান্দরবানের সবকিছুতেই ‘হিল’ শব্দ জুড়ে দেয়া। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পিক আপ, বাস-ট্রাক সবকিছুতেই। আমরা হোটেল হিল ভিউ থেকে প্রথম দিন রওনা দিলাম নীলগিরির উদ্দেশ্যে। চান্দের গাড়ি(পিক আপ) ভাড়া করলাম সারা দিনের জন্য। ৬৯ কিলো রাস্তা পাড়ি দেয়ার সময় সবার মুখ দিয়ে ‘জটিল’ ‘জোশ’ ‘শি-রাম’ টাইপের শব্দগুলো বেরুচ্ছিলো! কারণ পাহাড়ের কোলে নিচু হতে হতে, উঁচু হতে হতে থমকে যাওয়া আঁকাবাঁকা রাস্তা। তার দুপাশে, মাঝে মাঝে ঢিবির মতো উঁচু পাহাড়ের চাদর দেখে রবীন্দনাথ ঠাকুর ও হয়তো বলতেন, ‘অনিন্দ্যসুন্দর’ ‘নয়নাভিরাম’ ‘মনোরম’ ‘অতুলনীয়া’ টাইপের শব্দগুলো! বন্ধু আলবার্ট তো বলেই ফেললো, ‘ওটা আমার পাহাড়!’ মনে হল ওর বাপ দাদার সম্পত্তি! শ্রীকান্ত দূর পাহাড়ের দিকে চিৎকার করে গার্লফ্রেন্ডকে উদ্দেশ্য করে ডাক ছাড়লো, ‘শান্তা………………………!’ কিন্তু নারীজাতি স্বার্থপর। প্রতুত্তরে আর শ্রীকান্তকে ডাকলো না কেউ। উত্তর ফিরে এল ‘শান্তা…………!!!’

নীলগিরি

অবশেষে আমরা নীলগিরিতে পৌঁছলাম। সেখানে দেখি আবার নীলের ছড়াছড়ি! রেস্টহাউজের নাম নীলাঞ্জণা, ছোট কোটেজের নাম নীল আলয় ইত্যাদি। তারপর শুরু হলো ছবি তোলার ঝড়! মনে হল জীবনটা ছবি ছবিময়! চারপাশে পাহাড়ী উপত্যকা। তার মাঝে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তোলা হলো। গ্যাংনাম স্টাইল কিংবা মধ্যমা আঙ্গুলের সেই অশ্লীল ভঙ্গিটাও বাদ গেল না!

আমরা হোটেল থ্রী-স্টারে (থ্রী-স্টার হওয়ার কোন যোগ্যতা যার নাই) প্রথম খাবার খেলাম সকালে। আতপ চালের ভাত (পাথরে ছড়িয়ে থাকা কিছু কিছু ভাত), আলু ভর্তা আর ডাল দিয়ে নাস্তা করলাম। পরটা ছিল না। এ রকম বাজে খাবারেও আমাদের কোন সমস্যা হল না। উল্টো পরবর্তী বেলাগুলোর জন্য বুকিং দিলাম! দুপুরে মুরগির মাংস ছিঁড়তে গিয়ে আমার গালের মাংস ছিড়ে গেলো! এই খাবারের ভয়াবহতা ধরা পড়লো রাতে। প্রায় সবার পেটের পীড়া দেখা দিলো। কয়েকটা গ্যাস সিলিন্ডার ভরে ফেলা যেত সেই রাতেই! শুধু সমস্যা হল না মাহমুদের। তার গর্ব আর কে দেখে! কিন্তু ইমরুল তার গর্বে জল ঢেলে দিয়ে বিজ্ঞের মত ঘোষণা দিলো, ‘আমাদের সবার পেটের সমস্যা দেখা দিয়েছে শুধু মাহমুদ ছাড়া। তার মানে সমস্যা আমাদের না, সমস্যা ওর নিজের। আবহাওয়া আর স্থান পরিবর্তন করলে পেটে সমস্যা দেখা দিতেই পারে। বরং না দেখা দেয়াটাই সমস্যা।’ এরপর সবাই মিলে মাহমুদকে পরামর্শ দেয়া হল ঢাকায় গিয়ে সে যেন ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়!

‘একটি দ্বীপ ও একজন রূপবতী’

বান্দরবানেও আমরা দ্বীপ খুঁজে পেলাম! এই দ্বীপের আবিষ্কর্তা স্বয়ং রকি! আমরা সেদিন বগালেকে পৌঁছেছি। সন্ধ্যায় সবাই ক্লান্তি দূর করার জন্য চা, সিগারেট, কলা ইত্যাদি খাচ্ছি। কিন্তু রকির মন পড়ে আছে আবিষ্কারের নেশায়। সে ঠিকই দ্বীপ আবিষ্কার করলো! আমাদের কটেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল এক হাল্কা পাতলা গড়নের (সাহাবুদ্দিনের সাথে তূলনীয়) যুবক। কাঁধে প্রমাণ সাইজের গিটার। রকি তার সাথে কথা বলছিল। আমরা এগিয়ে গেলাম ঐ দিকে। পরিচিত হলাম দ্বীপের সাথে! ঢাকায় ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে স্টাডি করেছেন। কিন্তু তাতে কি? এই দ্বীপের বিশেষত্ব কোথায়? বিশেষত্বটা ধরা পড়লো একটু পরে। আমরা হৃদয় দিয়ে, চর্ম-চক্ষূ দিয়ে অনুভব করতে পারলাম এই দ্বীপ ভাইয়ের সাথে একজন রুপবতী আছে! টী-শার্ট আর টাইটস পরিহিত সেই রূপবতী আমাদের সামনে দিয়ে দ্বীপ ভাইয়ের সাথে হেঁটে চলে গেল! আমরাও তাদের নাড়িনক্ষত্র খুঁজে বের করলাম। ৩-৪ মাস আগে তারা বিয়ে করেছে। বিয়ের আগে থেকেই এখানে তাদের আসা যাওয়া। আমরা টিকটিকির মত লেগে থাকলাম তাদের পিছে। এই ট্যুরের বাড়তি একটা বিনোদন হয়ে রইলো রকির কল্যাণে!

বগালেক

আমরা সবাই বগালেকে নেমে গোসল করছিলাম। পাহাড়ে ঘেরা লেক। আমি কিভাবে সাঁতার কাটা শিখলাম সুব্রতকে ব্যাখ্যা করলাম। ছোটবেলায় বড় আপু পুকুরের মাঝখানে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দিতো। জীবন বাঁচানোর তাগিদে হাত পা নাড়াচাড়া করতে করতে সাঁতার কাটা শিখি। তন্ময় বলল, ‘আমি সাঁতার জানি, কিন্তু বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে পারি না।’ ইমরুল এর চমৎকার সমাধান দিলো, ‘বরফ পানিতে ভাসে কেন? কারণ বরফের ঘনত্ব পানির ঘনত্ব থেকে কম। সেই হিসেবে তোর ঘনত্ব পানির চাইতে বেশি। তাই তুই ভেসে থাকতে পারিস না। যেদিন তোর ঘনত্ব পানির চেয়ে কমে যাবে সেদিন তুই ভেসে থাকতে পারবি!’ আর্কিমিডিসের সূত্র আবার নতুন করে আবিষ্কার হলো !!!

পাহাড়ে আগুন!!!

কেওক্রাডং জয় করে ফিরছি। আমাদের চোখে মুখে বিজয়ের হাসি। দার্জিলিং পাড়া পার হয়ে আমরা অনেকটা নিচে নেমে এসেছি। পাহাড়ের কোল ঘেষে উঁচু নিচু পথ। একটু এ দিক ও দিক হলেই সর্বনাশ! ততক্ষণে আমরা আবিষ্কার করেছি পাহাড়ে ওঠা কষ্টকর কিন্তু নামাটা ভয়ঙ্কর! পাহাড়ের ঢালুতে গাছপালা, তৃণ গুল্ম যা আছে সব শুকিয়ে হলুদ হয়ে আছে। কিছু কিছু জায়গায় এ সব পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ছাই, কয়লা তার প্রমাণ। হঠাৎ শ্রীকান্ত তার পকেট থেকে লাইটার বের করলো। আমি,রকি আর সুশান্ত ওকে প্ররোচিত করলাম। পাহাড়ে আগুন লাগার বিরল দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হবে আমাদের! শ্রীকান্ত সত্যি সত্যি আগুন লাগালো একটা ঝোপে। আমরা তিন চার জন কিছু বোঝার আগেই দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো! কিছুটা পিছনে ছিলেন আমাদের গাইড। তিনি ছুটে আসলেন। ‘কি করছেন আপনারা? মরার প্ল্যান করেছেন নাকি!’ বলেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন আগুন নিভানোর জন্য। আমরাও বোতলের পানির সদ্ব্যবহার করলাম। চোখে মুখের বিজয়ের হাসি ততক্ষণে উবে গেছে ! আর একটু দেরি হলে সবগুলো পাহাড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়তো!

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Bandarbanbogakeokradong