মিজোরাম

ভারতের পূর্ব-দক্ষিণের রাজ্য মিজোরাম। মিজোরাম অর্থ পাহাড়ী মানুষের রাজ্য। মি = মানুষ, জো = পাহাড়, রাম = রাজ্য। রাজধানীর নাম আইজল। মিজোদের জাতীয় নেতা লালডেঙ্গার দেশ এটি। একারণে লালডেঙ্গার আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে আইজলের মাঝখানে। মিজোরামের আয়তন বাংলাদেশের তুলনায় এক তৃতীয়াংশ। পুরোটাই পাহাড় ঘেরা। স্রষ্টা যেন পাহাড়গুলোকে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন মিজোরামে। আইজলের উত্তর-পূর্বে মণিপুর। চামপাই জেলার পূর্বে মায়ানমার। মিজোরামের সর্ব দক্ষিণ প্রান্ত সাইহা জেলার পূর্বে ও দক্ষিণে মায়ানমার। লুংলেই জেলার পূর্বে মায়ানমার এবং পশ্চিমে বাংলাদেশ। অর্থাৎ পশ্চিমে বাংলাদেশ, পূর্বে ও দক্ষিণে মায়ানমার। আসাম, ত্রিপুরা ও মণিপুরের সঙ্গেও এর সীমান্ত রয়েছে।

রাজধানী আইজল (Aizawl)

দেখার মত শহর। পাহাড়ের কোন ক্ষতি না করে কিভাবে শহর হয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আইজল। রাতের আইজল যেন স্বপ্নপুরী। বাসা-বাড়ির বিদ্যুৎ বাতিগুলো দূর থেকে মনে হয় জোনাকীর মত। আইজলের পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে সড়ক। সড়কের পাশ ২০/২৫ ফুট। ফুটপাতও আছে। তবে ফুটপাতের পরিধি ৫/৬ ফুটের বেশী নয়। কোন ভাঙ্গাচোরা নেই। শহরের অধিকাংশ বাসিন্দার রয়েছে নিজস্ব কার। শহরবাসীর বেশভূষা ও চলনে বলনে পাশ্চাত্যের চাপ। অধিকাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করেন নারীরা। পুরুষ কিংবা নারী উভয়ের ব্যবহার অমায়িক এবং অত্যন্ত মিশুক । শহরের ৯০ শতাংশ লোকই খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বি। তাই সবখানে রয়েছে গীর্জা। আইজলকে গীর্জার শহরও বলা হয়। এর সংখ্যা প্রায় শতাধিক। তবে আইজলের প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে একটি মসজিদও। মসজিদের পাশে একটি গলিতে রয়েছে মুসলিম ব্যবসায়ীদের কয়েকটি দোকান। পুরো মিজোরাম পাহাড়ঘেরা হলেও আইজলে ফুটবল খেলার মাঠও আছে। মূল শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বিমান বন্দর। আগরতলা-আইজল এবং কলকাতা-আইজল নিয়মিত ফ্লাইট রয়েছে।

রেইক (Reiek)

আইজল শহর ছাড়িয়ে যেতে হবে আরও ৩০ কিমি। রেইকের (জেলা মামিট) উচ্চতা পাঁচ হাজার ফিটের কিছু বেশি। ঘন সবুজ বনাঞ্চলে ঘেরা পথ, মাঝে মাঝে ঝরনা – নীল আকাশ আর প্রান্তরের সবুজ মিশে তৈরি হয়েছে এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য। পথে পড়বে মিজোরামের প্রধান নদী Tiawng। শান্ত আরণ্যক পরিবেশ, রেইকে বেড়াতে আসার সবচেয়ে ভাল সময় এপ্রিল মাস –এখানে তখন এদের প্রিয় ফুলের নামে হয় আন্তুরিয়াম উৎসব। এই উৎসবের অন্যতম উদ্দেশ্য দেশজ শিল্প-সংস্কৃতিকে তুলে ধরা। মেলায় নানা জনজাতি সম্প্রদায়ের লোকেরা আসে তাদের তৈরি সামগ্রী নিয়ে। ৭ দিন ধরে চলে তাদের নিজস্ব লোকগীতি ও নৃত্য। এখনও পথের পাশে বাঁধা মাচা যেন গত উৎসবে পশরা নিয়ে আসা নানা জনজাতির কথা বলে।

মুইফাং (Hmuifang)

মুইফাং মিজোরামের অন্যতম জনপ্রিয় পার্বত্য শহর। রেইক থেকে আইজল হয়ে যেতে হবে মুইফাং, আইজল শহর থেকে দূরত্ব ৫০কিমি। সবুজ গালিচায় মোড়া প্রশস্ত উঁচুনিচু প্রান্তর। পাহাড় দিয়ে ঘেরা, পাহাড়ের অরণ্যের অনেকাংশেই মানুষের পদচিহ্ন পড়েনি এখনও। দূরে দূরে কিছু কিছু জনবসতি। ভিনদেশের লোক দেখে সবাই আলাপ জমাতে চায়, ভাষা সমস্যা থাকলেও চোখেমুখের আন্তরিকতা সেই সমস্যা মেটায়। এখানে আমাদের মেয়াদ একরাত্রি, কিন্তু ভবিষ্যতের পর্যটকদের বলে রাখি –অন্তত দু’রাত কাটান এইখানে।

চাম্ফাই (Champhai)

মুইফাং থেকে চলে যাবেন চাম্ফাই। রাস্তায় পড়বে থানজোয়াল (Thanzowal) – মিজো বয়নশিল্পর কেন্দ্র। ঘরে ঘরে তাঁতে বোনা হচ্ছে উজ্জ্বল রং এর মিজো পোশাক, চাদর, ব্যাগ – রং-এর সমাহার দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। এখান থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে ভেন্টাং (Ventwang) জলপ্রপাত। মিজোরামের সবচেয়ে বড় জলপ্রপাত, এক পাহাড়ের মাথা থেকে দেখছি আরেক পাহাড় থেকে নেমে আসা জলপ্রপাত, দূর থেকেও বোঝা যাচ্ছে তার দাপট। কাছেই আছে আরেকটি জলপ্রপাত -তুইরিহিয়ান (Tuirihian)। ভেন্টাং এর তুলনায় অনেক ছোট, কিন্তু একেবারে পাশে বসে দেখা যায় – এ যেন অনেক আপন।

চম্ফাই শহর জেলা সদর। সীমান্ত ঘেঁসা, মায়নামারের পাহাড় দিয়ে ঘেরা এক উপত্যকা। মিজোরামের সর্বাধিক সমতল ভূমি এই উপত্যকাতেই আছে। প্রধানত ধানচাষ হয়, সমস্ত মিজোরামে চালের যোগান দেয় এই  চম্ফাই। মিজোদের প্রধান খাদ্য, অন্য পূর্ব ভারতীয় রাজ্যদের মত – ভাত। আর হয় আঙুর, চম্ফাইর Winery বিখ্যাত। মুইফাং থেকে সকালে রওনা হয়ে এখানে পৌঁছাতে বিকেল হবে। চমৎকার ট্যুরিস্ট কটেজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় নীল পাহাড়ে ঘেরা ধূধূ ধানের ক্ষেত। এখান থেকে যাওয়া যায় মায়নামারের রি ডিল (Rih dil)Dil কথার অর্থ মিজো ভাষায় হ্রদ। এই হ্রদটি মায়নামারে হলেও একে বলা হয় মিজোরামের বৃহত্তম প্রাকৃতিক হ্রদ। বুঝলাম রাষ্ট্রনেতাদের ইচ্ছে যেমনই হোক, সাধারণ মানুষের কাছ এই হ্রদ এখনও মিজোরামেরই অঙ্গ। এদের কাছে এই হ্রদ অত্যন্ত পবিত্র- কারণ পুণ্যাত্মাদের  স্বর্গে যাওয়ার পথ নাকি এইটি। চম্ফাই থেকে ২৭ কিমি দূরে সীমান্ত গ্রাম Zokhawthar, সেখান থেকে ৩ কিমি দূরে সেই হ্রদ-মায়নামারের রিখাদ্বার (Rihkhadwar) গ্রামে।  মাঝে বয়ে  চলেছে  নদী। সীমান্তে কড়াকড়ি নেই।

রি ডিল লেকের একটা গল্প আছে – রি ও তার ছোট্ট বোন থাকত বাবা ও সৎ মায়ের সাথে। অত্যাচারী সৎ মায়ের পরামর্শে বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার ছলে বনে গিয়ে বাবা হত্যা করেন ছোট মেয়েকে। বনে ছোট বোনের রক্তাক্ত দেহ দেখে রি-এর কান্না আর বাঁধ মানেনা। ‘লিসি’ নামের এক পবিত্র আত্মার তাকে দেখে মায়া হয়। তিনি সন্ধান দেন এক গাছের যার পাতার সাহায্যে রি তার বোনের প্রাণ ফেরায়। তারপর বোন যখন তৃষ্ণায় ছটফট করে, তখন কোথাও জল না পেয়ে রি ওই পাতার সাহায্যে নিজেকেই হ্রদে পরিণত করে। এর থেকেই তৈরি হয় রি ডিল।

চাম্ফাই থেকে আইজলে ফেরার পথে পড়বে সাইতুল (Saitul), সাইতুলের কাছেই আছে মিজোরামের আরেকটি হ্রদ Tamdil। সাইতুল থেকে ৭ কিমি দূরে অরণ্যে ঘেরা ছোট্ট হ্রদ – Tamdil। হ্রদের পাশেই পর্যটন বিভাগের রেস্ট হাউজ আছে। সাইতুল থেকে আইজল ঘন্টা তিনেকের পথ।

কিভাবে যাবেন

কলকাতা থেকে সরাসরি বিমানে যাওয়া যায় আইজল। এছাড়া আগরতলা থেকে আইজল এর নিয়মিত ফ্লাইট রয়েছে।

বাই রোডে মিজোরাম যাওয়ার উপায়

আসামের গৌহাটি থেকে মিজোরাম যেতে পারেন অথবা মেঘালয়ের জোয়াই হয়ে শিলচর দিয়েও মিজোরাম যেতে পারেন। বাংলাদেশীরা ডাউকি থেকে ট্যাক্সি করে জোয়াই যেতে পারেন অথবা শেয়ারড ট্যাক্সিতে করেও যেতে পারেন। এরপর জোয়াই থেকে শিলচর পর্যন্ত টাটা সুমোতে যেতে পারেন। ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৩০০-৩৫০ রুপি। শিলচর থেকে আইজল পর্যন্ত টাটা সুমোতে যাওয়া যায়। শিলচর থেকে আইজল ১৭৩ কিমি। ভাড়া জনপ্রতি ৪৫০ রুপি। আবার শিলচর এবং গুয়াহাটি থেকে ফ্লাইটেও যেতে পারেন আইজল পর্যন্ত। তবে মনে রাখবেন ডাউকি থেকে বাই রোডে একদিনে আইজল পৌঁছানো সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে আপনাকে শিলচর একরাত থাকতে হবে।

ঘোরাঘুরি

আইজল থেকে গাড়ি নিয়ে নেওয়া ভালো কারন এক্ষেত্রে খরচও কম হবে। গাড়ী ৫-৬ দিনের জন্য ভাড়া করলে সব জায়গা ঘোরা সম্ভব। গাড়ী প্রতি কিলোমিটার ১৯-২০ রুপি আর ড্রাইভারের জন্য দিনপ্রতি ৮০০-১০০ রুপী।

কোথায় থাকবেন

আইজলে নানা ধরণের হোটেল আছে। অন্য সব জায়গাতে সরকারি পর্যটনের হোটেলের ব্যবস্থা বেশ ভালো, সস্তাও বটে। বুকিং করা যায় টেলিফোনেও, টেলিফোন নম্বর পাওয়া যাবে মিজোরাম সরকারি পর্যটন বিভাগের ওয়েবসাইটেসরকারি রসোর্টের খোঁজ এখানে এবং প্রাইভেট রিসোর্টের খোঁজ এখানে নিতে পারবেন।

রেইক এ সরকারি ট্যুরিস্ট রিসোর্ট আছে। ছোট্ট রিসর্ট, সাকুল্যে বোধহয় তিনজোড়া কটেজ। এছাড়া মুইফাং এ সরকারি রিসোর্ট আছে, কাঁচে ঘেরা ছোট ছোট কটেজ, রিসর্টের ঘর থেকে চোখে পড়বে সবুজ পাহাড়ের কোলে মেঘের খেলা।

মিজোরাম যেতে Inner Line Pass (ILP) এর দরকার পড়বে। এটা আইজল বিমানবন্দরে নেমেও করা যাবে। এছাড়া কলকাতা, গৌহাটি, দিল্লী, শিলং, আসামের শিলচর থেকে Inner Line Pass (ILP) নেয়া যাবে। বিস্তারিত এখানে দেখে নিন

আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও চীনা নাগরিকদের জন্যেঃ
For a group of 4 or more persons, Restricted Area Permit (RAP) can be obtained from the Government of Mizoram through the Liaison Officers at New Delhi, Kolkata and Guwahati. For less than 4 persons, RAP has to be obtained from the Ministry of Home Affairs, Government of India.

মিজোরাম ভ্রমণের পারমিট পাওয়ার নিয়ম (FRO)

বিদেশী হলে মিজোরাম ঢোকার আগে আপনাকে FRO নিতে হবে। বাই রোডে মিজোরাম ঢোকার আগে একটা চেক পোস্ট পড়ে। ঐ চেক পোস্টে নাম এন্ট্রি করে নিতে হবে। বিদেশীদের FRO এন্ট্রি করে নিতে হবে আর ইন্ডিয়ান হলে ILP (Inner Line Permit) নিতে হবে। বিদেশীদের এন্ট্রি প্রসেস খুবই সোজা। পাসপোর্ট দিলেই ওরা এন্ট্রি করে নিবে।কিন্তু ইন্ডিয়ান নাগরিকদের ILP অপেক্ষাকৃত ঝামেলার। IPL করতে হলে এক কপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি জমা দিতে হবে। ঐ ছবিসহ তারা একটা অনুমতির রশিদ প্রদান করবে।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ indiamizoram