লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে মিশরের টলেমিক রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া (Library of Alexandria) গ্রন্থাগারটি গড়ে উঠেছিল। মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে অবস্থিত এই গ্রন্থাগারটি প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থাগারগুলির একটি। এখানে লাইব্রেরিটির পাশেই রয়েছে একটি থিয়েটার, একটি ঐতিহাসিক যাদুঘর ও কনফারেন্স হল।

লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া ছিল মিশরের ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার প্রতীক। সারা পৃথিবী থেকে বই ধার করে তার অনুলিপি তৈরি করে এখানে রাখা হতো। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের দায়িত্ব ছিল সারা বিশ্বের জ্ঞান সংগ্রহ করা। এই গ্রন্থাগারে কোন যুগের ঠিক কতগুলি বই ছিল, তার অনুমান করা আর সম্ভব নয়। তবে অনেকের মতে, সাত আট লাখ বইয়ে সমৃদ্ধ হয়েছিল এই লাইব্রেরি। গ্রন্থ সংগৃহীত হতো প্যাপিরাসের আকারে। ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের পর থেকে অবশ্য কোডেক্সও ব্যবহৃত হয়েছে। আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারের গ্রন্থসংগ্রহকে কখনও পার্চমেন্ট কাগজে ধরে রাখা হয়নি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া তে গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, পদার্থবিদ্যা, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও অন্যান্য নানা বিষয়ের গ্রন্থ ছিলো। সাম্রাজ্যের প্রধান গ্রন্থাগার হওয়ায় এখানে প্রাচীন বিশ্বের প্রথম এবং প্রধান গ্রন্থপাঠ সমালোচনার কেন্দ্র ছিলো এই গ্রন্থাগার।

বিভিন্ন মহাদেশের অসংখ্য পণ্ডিতের পদচারণায় মুখরিত থাকতো লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পণ্ডিতরা এখানে এসে জড়ো হয়েছিলেন এবং তারা সার্বক্ষণিক চিন্তাভাবনা, গবেষণা, ভাষণ প্রদান ও পাণ্ডুলিপি পুনর্লিখনের কাজে নিয়োজিত থাকতেন।অবাক করা বিষয় হল-সে সময়ে এই পাঠাগারে জ্ঞান আহরণের ক্ষেত্রে নারী পুরুষ কোনো ভেদাভেদ ছিল না। হাইপেশিয়া ছিলেন ঐ সময়ের আলেক্সান্দ্রিয়ার একজন বিখ্যাত নারী গণিতবিদ। সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য এক তীর্থস্থান হিসাবে গণ্য করা হতো এবং আজও তা অব্যহত আছে।আমি যখন একা একা ঘুরে দেখছিলাম,তখন পরিচয় হয়েছিল ওমর নামের সদ্য স্কুল পেরনো এক ছেলের সাথে।ওর সাথে কথা বলে জানতে পারলাম-সে নিজেও অন্যদের মত এখানে এসেছে জ্ঞান আহরন করতে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল এই পাঠাগার থেকেই।

এখানে বসেই অ্যারিস্টারকাস বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে ক্রমাগত ঘুরছে। ইউক্লিড লিখেছিলেন Elements of Geometry, যা এখনো জ্যামিতি নিয়ে লেখা সবচেয়ে সফল এবং প্রভাবশালী পাঠ্যপুস্তক হিসাবে বিবেচিত। হেরোফিলাস এখানে জমাকৃত স্ক্রলগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্য হতে বলেছিলেন, মানব মস্তিষ্কই হচ্ছে শরীরের নিয়ন্ত্রক এবং উন্মোচিত হয় চিকিৎসাশাস্ত্রের এক নতুন অধ্যায়।

অ্যাপোলোনিয়াস ও আর্কিমিডিস এর মতো জ্ঞানীরাও কোনোকালে এই পাঠাগারে এসেছিলেন তাদের জ্ঞান তৃষ্ণা মেটাতে। ভাবতেই ভাল লাগছিল যে,এমন একটি স্থানে আসতে পেরে।

লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া একটা সময় পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। যার ফলে বহু স্ক্রোল ও বই চিরতরে নষ্ট হয়ে যায়। সম্ভবত ৪৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জুলিয়াস সিজারের মিশর আক্রমণের সময়, ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে আরেলিয়ান আক্রমণের সময়, ৩৯১ খ্রিষ্টাব্দে কপটিক পোপ থেওফিলাসের নির্দেশে সংঘটিত পৃথক পৃথক অগ্নিকাণ্ডে আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারটি ভস্মীভূত হয়।

পরবর্তীতে ১৯৭৪ সালে,ভূমধ্য সাগর তীরে যেখানে প্রাচীন গ্রন্থাগারটি একসময় দাঁড়িয়ে ছিলো, সেখানেই পুরানো লাইব্রেরিটিকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। নির্মাণ কাজ ১৯৯৫ সালে শুরু হয় এবং কমপ্লেক্সটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৬ অক্টোবর ২০০২ তারিখে উদ্বোধন করা হয়। এতে ব্যয় হয় প্রায় ২২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এখন আপনারা ঘুরতে গেলে এই আধুনিক অনিন্দ সুন্দর স্থাপনাটি দেখতে পারবেন। গ্রন্থাগারটির সাথে থিয়েটার, ঐতিহাসিক যাদুঘর ও কনফারেন্স হল দেখতে এখানে প্রতিদিন অনেক পর্যটক আসেন।

লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া যাওয়ার উপায়

মিশরে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কোনো বিমান যোগাযোগ নাই তাই অন্য দেশে ট্রানজিট হয়ে যেতে হয়।

কন্টেন্ট সহযোগিতায়ঃ তৌহিদ বিন আব্দুল খালেক
Leave a Comment
Share