দুধপাথরি

দুধপাথরি (Doodhpathri) হিমালয় পর্বতমালার পীর পাঞ্জাল রেঞ্জে গামলার মতো এক উপত্যকা যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯ হাজার ফুট উঁচুতে জম্মু ও কাশ্মীরের বুডগাম (Budgam) জেলায় অবস্থিত। শ্রীনগর থেকে ৪২ কিলোমিটার দূরে প্রকৃতির এক আশ্চর্য লীলাভূমি এই দুধপাথরি। দুধপাথরি নামের অর্থ দুধের উপত্যকা, এর সঙ্গে কাশ্মীরের বিখ্যাত মুসলিম সাধক শাইখ উল আলম নূর-উদ্দিন নূরানীর নাম জড়িয়ে আছে। এখানে যে পানি প্রবাহিত হয়, তা দূর থেকে দেখলে দুধের মতো সাদা মনে হয়। তাই এই এলাকাকে কাশ্মীরের দুগদ্ধ উপত্যকা বলা হয়। এর পশ্চিমে অবস্থিত বিখ্যাত তুসামিদান। অল্প দূরেই রয়েছে স্বচ্ছ জলের লেক নীল নাগ। লেকের জলে সত্যিই যেন নীল গুলে দিয়েছে কেউ। আশেপাশে গভীর জঙ্গল, ইতস্তত ঘাসজমি আর দূরের পাহাড় নিয়ে আদর্শ পিকনিক স্পট এই নীল নাগ। শ্রীনগর থেকে দূরত্ব মাত্র ৪৭ কিলোমিটার।

প্রকৃতি যেন তার রঙের বাক্স উপুড় করে দিয়েছে এই দুধপাথরি উপত্যকায়। হাতছানি দিয়ে ডাকছে পুরু সবুজ ঘাসের গালিচা আর ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা রঙের বুনো ফুল। মৃদুমন্দ বয়ে চলেছে পাথুরে নদী। তার বরফগলা ঠান্ডা জল ক্লান্ত শহুরে শরীরকে স্নিগ্ধ করে। দূরে দিঘল গাছের সারির মাথায় নানা রঙের খেলা শুরু হয় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তে।

একদিকে হিমাচল প্রদেশ আর অন্যদিকে জম্মু-কাশ্মীর, এর ঠিক মাঝখানে মগ্ন মৈনাকের মতো ঘুমিয়ে আছে পীরপঞ্জাল রেঞ্জ। ভৌগলিকভাবে হিমালয়ের এই পীরপাঞ্জাল রেঞ্জেরই অংশ দুধপাথরি, যার একদিকে ছড়িয়ে আছে চিরসবুজ পাইন আর দেবদারু গাছের জঙ্গল, আর অন্যদিকে ঘাসের গালিচা। পশুচারণের উপযুক্ত এই তৃণভূমিতে দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় কাশ্মীরী ভেড়ার পাল। বসন্তেভার গ্রীষ্মে উপত্যকা ছেয়ে যায় ডেইজি এবং বাটারকাপের মতো হলুদ সাদা বুনো ফুলে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! মনে হয় রাশি রাশি জোনাকি জ্বলে আছে সবুজের বুকে।

নামকরন

দুধপাথরি’ শব্দটার অর্থ দুধ ভর্তি পাথর বা দুধের উপত্যকা। এই নামের পিছনে লুকিয়ে আছে একটা মজার গল্প। স্থানীয় উপকথা মতে, অনেককাল আগে এই কাশ্মীর উপত্যকায় বাস করতেন এক ধর্মপ্রাণ মানুষ। একাধারে কবি, গীতিকার ও সুফি সাধক সেই মানুষটার নাম শেখ নূর-উদ্দিন নূরানী। একদা বিশেষ এক প্রয়োজনে এই পথ দিয়েই চলেছিলেন সুফি পীর শেখ নূর। নামাজের সময় হয়ে যাওয়ায় পথের মধ্যে ঘাসেঢাকা এক অজানা মাঠে থামতে বাধ্য হন তিনি। নামাজের আগে অজু করতে জল দরকার। এদিকে আশেপাশে নদী বা ঝর্ণা কিছুই নেই। ভারি বিপদে পড়লেন ঋষি নূর। জল খুঁজতে গিয়ে মাঠের শক্ত মাটিতে লাঠি দিয়ে আঘাত করেন তিনি। সেই আঘাতে আশ্চর্যভাবে মাটি ফেটে বেরিয়ে আসে দুধের ধারা।

কথিত আছে যে, দুধ বেরোতে দেখে বিস্মিত হয়ে বলে ওঠেন শেখ নূর, বলেন, এ দুধ দিয়ে কী করব আমি! দুধ পান করা যেতে পারে, কিন্তু তা দিয়ে অজু করা তো যাবে না। সাধকের মুখে এ কথা শোনামাত্র দুধের সেই ধারাই বদলে যায় স্বচ্ছতোয়া জলে। পাহাড়ের উপরে ঘাসজমির মধ্যে দিয়ে সেই দুধেল জল না কি আজও বয়ে যায়। আর এই ঘটনার পরই এই ঘাসেঢাকা উপত্যকার নাম হয়ে যায় দুধপাথরি। সত্যি বলতে, এই শীতের দেশে দূর থেকে ঘাসের জমির উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্বেতশুভ্র জলের সাদা ধারাকে দুধ বলে বিভ্রম জাগলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

দুধপাথরি এর দর্শনীয় স্থানসমূহ

দুধপাথরির চারিপাশ মখমলের মতো নরম সবুজ ঘাসে ঘেরা। দূরে দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে পাইনের বন। সবুজ উপত্যকায় ছবির মতো ঘুরে বেড়ায় ভেড়া-ঘোড়ার দল। ট্যুরিস্ট রিসেপশন পেরিয়ে পৌঁছাতে হয় পরিহাজ নামের জায়গায়, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় ‘পারেজ’। দুধপাথরির অন্তর্গত এই জায়গাও অবর্ণনীয় সুন্দর। ইচ্ছে হলে চেপে পড়ুন ঘোড়ার পিঠে অথবা পায়ে হেঁটে ট্রেকিং করে দেখে নিন আশপাশের জায়গা৷

দুধপাথরি এর দর্শনীয় তালিকায় রাখুন সুখনাগ নালা। ৫০ ফুট উচ্চতায় এই জলধারাবেষ্টিত অঞ্চলকেই মূলত দুধপাথরি বলা হয়। দুধপাথরির মূল প্রবেশদ্বার থেকে আট কিলোমিটার দূরে রয়েছে শালিগঙ্গা নদী। ঘন নীলরঙা এই নদীর চারপাশের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে। ৯,০০০ ফিট উচ্চতায় অবস্থিত এই জায়গাটি পাহাড়ি গাছের সবুজে মোড়া। তারই বুক চিরে বয়ে চলেছে শালিগঙ্গা নদী, যার উৎপত্তি আলিটার নামের জায়গা থেকে। আলিটার প্রায় সারা বছরই বরফ মোড়া থাকে। সেখান যেতে হলে একমাত্র ভরসা ঘোড়া। শালিগঙ্গা নদীর ওপর ছোট্ট কাঠের সাঁকো রয়েছে। সাঁকো ধরে হেঁটে আসতে পারেন ওপারের ঘন জঙ্গল মোড়া পাহাড়ের দিক থেকে। শান্ত প্রকৃতিঘেরা এ জায়গা, শব্দ বলতে কানে আসবে পাখির ডাক আর জলের শব্দ।

এছাড়া সময় থাকলে দুধপাথরির পশ্চিমে ঘুরে আসুন তোসাময়দান। দুধপাথরি থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে ইয়ুসমার্গকেও রাখতে পারেন আপনার তালিকায়।

ভ্রমণের সেরা সময়

দুধপাথরি ভ্রমণের সেরা সময় হলো মে থেকে সেপ্টেম্বর মাস। এসময় এখনকার দুধ সাদা পানিরও দেখা মিলবে, কারণ বছরের অন্য সময়ের বেশির ভাগই বরফে ঢেকে থাকে।

দুধপাথরি যাওয়ার উপায়

কলকাতা থেকে জম্মু যাওয়ার দুটি ট্রেন আছে। একটি হিমগিরি এক্সপ্রেস ও অন্যটি জম্মু তাওয়াই এক্সক্সপ্রেস। হিমগিরি এক্সপ্রেস সপ্তাহে ৩ দিন চলে। রাত ১১:৫০ টায় হাওড়া থেকে জম্মুর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। সময় লাগে ৩৫ ঘন্টা ৩৫ মিনিট। আর জম্মু তাওয়াই এক্সপ্রেস প্রতিদিন চললেও এই ট্রেনে সময় একটু বেশী লাগে। আনুমানিক ৪৫ থেকে ৪৬ ঘণ্টায় পৌছানো যায়। এছাড়া কলকাতা থেকে ফ্লাইটে শ্রীনগরের শেখ উল আলম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যেতে সময় লাগে প্রায় ৫ ঘণ্টা। জম্মু থেকে জীপ ভাড়া করে শ্রীনগর পৌছাতে পারবেন।

এছাড়া ঢাকা কিংবা কলকাতা থেকে বিমানে দিল্লি লেওভার নিয়েও শ্রীনগর পৌছাতে পারবেন। শ্রীনগর থেকে গড়ি করে দুধপাথরি পৌছানো যায়।

দুধপাথরিতে কি কি খেতে পেতে পারেন?

দুধপাথরির রাখালরা যারা এখানের ছোট ছোট কুঁড়েঘরে থাকে তারা এক ধরনের নুন চা (কাশ্মীরি চা) বিক্রি করে। সাথে পাবেন মাক্কি রোটি (ভুট্টার আটার রুটি) বা লাভাসা, আরও এক ধরনের ফ্ল্যাট রুটি। এর পাশাপাশি, কেহওয়া নামে একটি বিখ্যাত মিষ্টি কাশ্মীরি পানীয় পরিবেশনের জন্য ছোট ছোট দোকান রয়েছে। এছাড়াও কিছু স্থানীয় দোকান আছে যেখানে আপনি স্ন্যাকস পেতে পারেন।

Leave a Comment
Share