দীঘা সমুদ্র সৈকত

দীঘা (Digha) পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র সমুদ্র কেন্দ্রীক ভ্রমণ কেন্দ্র। কলকাতা থেকে মাত্র ১৮৭ কিলোমিটার দূরে মেদিনিপুর জেলায় সমুদ্র, বালিয়াড়ি, ঝাউ বন আর আপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মিলিয়ে অপেক্ষা করছে প্রকৃতি প্রেমিক পর্যটকদের জন্য। ৭ কিলোমিটার লম্বা সমুদ্রতট এক পাশে গভীর সমুদ্র অন্যপাশে ঝাউ গছের অগভীর জঙ্গল। ভেঙ্গে পড়া ঢেউ-এর জলে পা ভিজিয়ে হেঁটে যাওয়া যায় দীর্ঘ পথ। সকালের সমুদ্র তটে দেখা মিলবে পায়ে পায়ে হেঁটে চলা নানা বর্ণের শামুক, ঝিনুক এবং ছোট বড় শঙ্খের। একটার পর একটা ক্লান্তিহীন অবিরত সমুদ্রের বুকে তৈরি হওয়া বিরাট বিরাট ঢেউ আছড়ে পড়ছে সমুদ্রতটের বালিয়াড়িতে। যতদূর চোখ যায়, ঠিক যেখানে জল আর আকাশ একে অপরের সঙ্গে মিশে গেছে ঠিক সেই জায়গাটায় অন্ধকার সরিয়ে প্রথম ভোর হয়।

দীঘায় দু’টি সৈকত রয়েছে একটি পুরানো দীঘার সৈকত, অপরটি নতুন দীঘার সৈকত। সমুদ্রের জলে গা ভেজানোর জন্য হাতের কাছের দিঘা সবারই প্রিয়। দীঘার বীচ শক্ত, জমাট। ভারতের সব চেয়ে শক্ত সৈকত। এই সৈকতভূমি দিয়ে গাড়ি ছোটে অনায়াসে। হেলিকপ্টারও নামতে পারে এই সৈকতে।

দীঘা সমুদ্রস্নানের উপযুক্ত হলেও সমুদ্র অনেকটা এগিয়ে আসায় কংক্রিট দিয়ে বাঁধানো হয়েছে পাড়। বাজারের কাছে অনেকটা জায়গা জুড়ে পর্যটকদের স্নানের ভিড় লেগে থাকে। যাত্রী চাহিদা মেটাতে দীঘার সৈকত প্রসারিত হয়েছে নিউ দীঘা (New Digha) পর্যন্ত। নিউ দীঘার সৈকতটি তুলনায় প্রশস্ত, ঝাউগাছে মোড়া। স্নান করার জন্য নিউ দীঘার সী বীচ আদর্শ। ওল্ড দীঘাতে একটি বিশেষ স্থান চিহ্নিত করা আছে, শুধুমাত্র সেখানেই স্নান করা যায়, অন্য সব জায়গায় বোল্ডার থাকার দরুন নিরাপদ নয়। ওল্ড দিঘাতে সেই স্নানের জায়গাটি (স্নানঘাট) sea hawk হোটেল ছাড়িয়ে আরও ৫মিনিট হাঁটলে পৌঁছবেন।

দীঘায় কোথায় ঘুরবেন

দীঘা থেকে বেড়িয়ে নেওয়া যায় অমরাবতী লেক, সর্প উদ্যান, দ্যা মেরিন অ্যাকরিয়াম অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, দীঘা বিজ্ঞান কেন্দ্র, সায়েন্স পার্ক প্রভৃতি। আরও এগিয়ে একেবারে ওড়িশার লাগোয়া উদয়পুর সৈকত। কিয়াগেড়িয়া মোড় থেকে বাঁ দিকে যে রাস্তা বরাবর সমুদ্রে গিয়ে পড়েছে তার ডান দিকে ওড়িশা আর বাঁ হাতে পশ্চিমবঙ্গ। সেই রাস্তা মিশে গিয়েছে উদয়পুর সৈকতে। বছরকয়েক আগেও উদয়পুর ছিল নিরিবিলি, নির্জন। আজ জমজমাট। এখন যেন পর্যটকদের মেলা বসে। রকমারি বিনোদনের আয়োজন সেই সৈকতে। আগে এখানে থাকার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। এখন পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের নৈশাবাসের ক্যাম্প আছে।

দীঘা থেকে ঘুরে আসা যায় ৬ কিলোমিটার দূরের চন্দনেশ্বর মন্দির। ওড়িশা এর এই মন্দির জনপ্রিয় হয়েছে দীঘা ভ্রমণকারীদের বদান্যতায়। ২ কিলোমিটার দূরে যাওয়া যায় তালসারি সমুদ্রসৈকত। এখানেও দু’টো দিন কাটানো যায়, ওড়িশা পর্যটনের পান্থনিবাসে।

দীঘা শংকরপুর উন্নয়ন পর্ষদের অফিসের নিচে দেখানো হয় 7D Adventure Show.অমরাবতি পার্কের শেষে উল্টো দিকে রাস্তার ঠিক উপরে এই অফিস। গঠনের জন্য অনেকে একে জাহাজ বাড়িও বলে। সকাল ৯টা থেকে প্রতি ৩০ মিনিট পরপর হয় এই show. ১০০ টাকা জনপ্রতি টিকিট কিনতে হয় ওখানে গিয়ে, অনলাইনে ব্যবস্থা নেই। ঘুরতে গিয়ে রোলাকোস্টায় চেপে ডায়নোসরদের সাথে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে বেশ ভালোই লাগবে সকলের। তবে সবথেকে বেশি মজা করবে ছোটরা। 

খাওয়া দাওয়া

ভোজন রসিক বাঙালি কথাটা দুই বাংলাতেই সমানভাবে প্রযোজ্য। হোটেলে পাবেন আপনার পছন্দ অনুযায়ী সব কিছু। নানা ধরনের মাছ থকে শুরু করে চাইনিজ, মোগলাই, থাই কিংবা ইতালিও খাবার দাবার। সমুদ্রের ধারে আছে মাছ ভাজার দোকান। সেখানে পমফ্রেট, চিংড়ি থেকে শুরু করে রকমারি মাছ ভাজার আয়োজন। একবার চেখে দেখতেই পারেন। তবে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ কথাটি যদি আপনার জন্য হয়ে থাকে তবে খুব সকালে একবার হাজির হতেই পারেন বাজারে কিংবা সমুদ্রে থেকে ফেরা মৎস্যজীবীদের কাছে।

দীঘা কিভাবে যাবেন

কলকাতা থকে ১৮৭ কিলোমিটার দূরত্বের এই সমুদ্র শহরে যাওয়ার জন্য আছে রেলপথ। কলকাতা থেকে রেলে চেপে পৌছনো যায় সাড়ে ৩ ঘণ্টার মধ্যে। রেল স্টেশনটি নতুন দীঘায়। হাওড়া থেকে দীঘা আসার ট্রেন গুলি হলো –

  • 12857 তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস প্রতিদিন সকাল ৬:৩৫ মিনিটে।
  • 15722 পাহাড়িয়া এক্সপ্রেস (কেবলমাত্র শনিবার) সকাল ৭:৫০ মিনিটে।
  • 12847 সুপার এসি এক্সপ্রেস প্রতিদিন সকাল ১১:১০ মিনিটে।
  • 22897 কান্ডারী এক্সপ্রেস প্রতিদিন দুপুর ২:১৫ মিনিটে।

এছাড়াও একটি EMU লোকাল ট্রেন চলে মেচেদা থেকে দীঘা পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৭:৪৮ মিনিটে। হাওড়া থেকে আমতা বা উলুবেড়িয়া লোকাল বাদে যেকোনো লোকাল ট্রেন এ মেচেদা নেমে (দেড় ঘণ্টা) এই ট্রেনটি ধরা যেতে পারে। তবে বলার অপেক্ষা রাখেনা যে সবচেয়ে ভালো টাইমিং একদম সকালের ট্রেন তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস এর। সেজন্য ভালোই ভিড় হয়। অবশ্যই reservation করে নেবেন। ১০০টাকা ভাড়া।

এছাড়া কলকাতার বিভিন্ন জায়গা (ধর্মতলা, লেকটাউন, করুণাময়ী, উল্টোডাঙা, গড়িয়া প্রভৃতি) থেকে সারা দিন ধরেই বিভিন্ন সময়ে দীঘার বাস যাচ্ছে। এ ছাড়াও আসানসোল, বর্ধমান, দুর্গাপুর, হলদিয়া, মেদিনীপুর ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গের বড় শহরগুলি থেকে দীঘার বাস ছাড়ে।

বাসে ৫ থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাবেন দীঘা। মাঝ পথে থাকবে কিছুক্ষণের বিশ্রাম। বাস থামে পুরানো দীঘায়।

কোথায় থাকবেন

দীঘা শহরে ঢোকার মুখে সমুদ্র সৈকত থেকে কিছুটা দূরে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের ট্যুরিস্ট লজ। শহরের শুরুতেই দীঘা ডেভেলপমেন্ট স্কিমের সৈকতাবাস। এ ছাড়া রয়েছে বেনফিশের হোটেল মীনাক্ষি। পশ্চিমবঙ্গ পর্যটনের কলকাতা অফিস থেকেও বেনফিশের হোটেল বুকিং করা যায়। আর ডিরেক্টরেট অব সোশাল ওয়েলফেয়ার-এর কল্যাণ কুটির রেস্ট হাউস। এছাড়াও দীঘা ও নিউ দিঘা জুড়ে নানান সংস্থার হলিডে হোম ও বেসরকারি অজস্র হোটেল রয়েছে।

নিউ দীঘাতে সমুদ্রের দিকে মুখ করা হোটেল সেরকম কিছু নেই। তবু হোটেলে বসে সমুদ্রের আস্বাদ পেতে হলে Hotel Jairam Hi-Tide অথবা হোটেল অমৃতাতে থাকতে পারেন। এগুলো নিউ দীঘা বিচের সবচেয়ে কাছে এবং সার্ভিসও ভালো।

বেশিরভাগ সমুদ্রের দিকে মুখ করা হোটেলগুলো ওল্ড দীঘায় আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে ভালো ভিউ চোখ বন্ধ করে Hotel Sea Hawk. হাত বাড়ানোর দূরত্বে সমুদ্র দেখা যায় রুম ব্যালকনি থেকে। এটির অবস্থান ব্যারিস্টার কলোনিতে, তুলনামূলক ভাবে তাদের জন্য যাঁরা একটু ভিড় এড়িয়ে ঘুরতে চান। দ্বিতীয় বেস্ট অবশ্যই Hotel Blue View. এটি ওল্ড দীঘা মার্কেট এর পশ জায়গায়। সামনেই সমুদ্র সৈকত এবং বাজার। তবে এটি তুলনামূলক ভাবে একটু ঘিঞ্জি স্থানে। এরপরেই নাম আসে Hotel SeaGull এর। সমুদ্র সৈকত থেকে খুব কাছেই, ২মিনিটের হাঁটা রাস্তা। কয়েকটি রুম sea facing এবং প্রধান ফিচার হলো হোটেলটির ট্যারেস এ নিজস্ব সুইমিং পুল আছে।

এরপরে আসে Hotel Saikatabas (সৈকতাবাস) এর নাম। এই হোটেলটি বাকিগুলোর মত প্রচারের আলো পায়নি, sea hawk হোটেলের একদম পাশেই। ফাস্ট ফ্লোরের রুম গুলি থেকে সমুদ্র দেখা যাবে, আর এই হোটেলের ক্যান্টিনে অন্য হোটেল থেকে ট্যুরিস্ট রা খেতে আসেন, এত ভালো এদের খাবারের মান।

Leave a Comment
Share