প্রথম ঝর্না দেখা আমার সীতাকুণ্ডের সহস্রধারা। কতশত সিড়ি ভেঙে নেমেছিলাম। উঠে এসে পায়ের ব্যথা নিয়ে ভেবেছিলাম এত কষ্ট করে ঝর্না দেখার কি আছে! তারপরেও আমি বান্দরবান গিয়েছিলাম সেই ঝর্না দেখার প্লানেই। তবুও কেনো যেনো মাথায় এই ভাবনাটা অপরিবর্তনীয়ই ছিলো। এরপরে যখন পাহাড় চূড়া দেখতে গেলাম তখন মনে আরো কিছু যুক্তি দাড় করালাম যে, পাহাড় আরোহনই বরং ভালো, বর্ষা এড়িয়ে যাওয়া যায় এবং জোক থাকে না। ভাবলাম আমার মনে হয় ঝর্না তেমন পছন্দ না। কিন্তু ফিরে এসে কয়েকমাসের মধ্যেই আবার বান্দরবান যাওয়ার প্লান করতে লাগলাম আসিফ ও নাদিয়ার সাথে মিলে। সেটাও ঝর্না দেখার প্লান। মন বড়ই অদ্ভুত! প্রথমে একটা তারিখ ক্যান্সেল হলে সাথে সাথেই আরেকটা তারিখ ঠিক হয়ে গেলো। কিন্তু ট্যুরের দিন সামনে আসতে আসতে আসিফের ছুটির সমস্যা হওয়ায় ও প্লান ক্যান্সেল করে দিলো। আমি তখন ঠিক করলাম নাদিয়া ও আমি মিলে কোনো না কোনো ইভেন্টের সাথেই বরং চলে যাবো। ক্যান্সেল হওয়া প্লানটাতে লুংফেরভা সাইতার ঝর্নাটা ছিলো। ইউটিউবে ভিডিও দেখেছিলাম ঝর্নাটার। তারপর ঘুমের মধ্যে তো স্বপ্নেও দেখেছিলাম সেই ঝর্নায় ভিজতেছি। এরপরে প্লান ক্যান্সেল হওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিলো।
আরিফ তখন টিম নিয়ে থানচি ও রুমার ঝর্নার ইভেন্টে। নেটওয়ার্কের মধ্যে নেই জানার পরেও নক দিলাম “মামা, নেটওয়ার্কে আসলেই আমাকে রিপ্লাই করবা”। এবং রিপ্লাই পেয়ে ওকে জানালাম আমাদের প্লানটা হচ্ছে না কিন্তু আমি এই প্লানেই ট্যুরে যেতে চাই। এমনকি হোক সেটা কোনো ইভেন্টের সাথে। একই প্লানের একটা ট্যুর করে এসে আরিফ আবারও একটা ইভেন্ট দিলো ওর “এন্টারটেইনমেন্ট ট্রাভেল গ্রুপ” থেকে মাত্র কয়েকটা দিনের ব্যবধানে।
আগ্রহ হারিয়ে ফেলে নাদিয়া যাওয়া ক্যান্সেল করে দিলো। সেই মুহুর্তে আমার একজন মেয়ে ট্যুরমেট এর দরকার হয়ে পরলো। মাথায় আসলো একটা নাম, জান্নাতুল ফেরদৌস ছবি।
ছবি ও আমার গ্রাম একই জেলার একই থানায় এবং আমরা একই প্রতিষ্ঠানে একসাথে পড়ি। বান্দরবানের প্রথম প্লান হওয়ার সময় হঠাৎ করেই ছবি আমাকে বলে কোথাও ঘুরতে গেলে ওকে যেনো জানাই ও যাবে। কিন্তু তখন ওকে আমি বলি একটা প্লান হচ্ছে তবে সেটাতে নেওয়া যাবে না কারণ ছবি বান্দরবান এর আগে যায়নি এবং কখনও ট্রেকিং ও করেনি তাই। আমাদের প্লানে থানচি দিয়ে গিয়ে জিংসিয়াম দেখার কথা ছিলো অর্থাৎ ট্রেক করতে হবে অনেক বেশি। কিন্তু এখন তো আমার নিজের জন্যই ওকে দরকার। ভাবলাম ওকে নিয়েই বরং যাই পরে পারবে কি পারবে না সেটা সেখানে গিয়ে দেখা যাবে। তাছাড়া আরিফ তো আছেই। ছবিকে খুব ভালো ভাবে বোঝালাম যে এখানে কিন্তু অনেক কষ্ট করতে হবে। সব শুনে ভেবেচিন্তে ওর উত্তর পজিটিভ ই হলো। সপ্তাহ খানেক আগে একই রুটে একই ঝর্না দেখে আসার পরে ইফতিও চললো চুড়ান্ত যাত্রার ঠিক আগ মুহুর্তে। বিগত কয়েকদিন ধরেই অবশ্য আমি বার বার ইফতিকে বলেছিলাম যাওয়ার জন্য এবং আরিফকেও বলেছিলাম ওকে নেওয়ার জন্য।
একেবারেই স্বল্প সময়ের ইভেন্টে আরিফের টিম মেম্বারও কম হলো। আরেকটা ইভেন্টের সাথে কোলাবোরেশানে হলো চুড়ান্ত টিম। বাসের জন্য আরামবাগের বাস কাউন্টারে গিয়ে প্রথমেই যেটা আমার নজরে পড়লো সেটা হলো অন্য টিমের এক আপুর হিল পড়ে আসা এবং ট্রেকিং ব্যাগের সাথে একটি ট্রেকিং পোল পাশে রেখে অপেক্ষারত বয়োজেষ্ঠ্য একজন কে। যাকে আমার সাথের সবাই ট্যুরমেট হিসেবে ভাই ডাকে তবে আমি আংকেল ডাকি। আরিফ কে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হলাম এরা সহ আমরা এক সাথেই যাচ্ছি। সেই সাথে আরিফ এটাও বললো আঙ্কেল এর আগেও ট্রেক করেছে এবং ঐ আপু ট্রেক শুরু হওয়ার আগ পর্যন্তই হিল পরবে। এটা শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম “যাক বাবাহ! তাহলে চিন্তা নাই।” আমার ভাবার কারণটা ছিলো এজন্য যে দুইটা টিম মিলে বেশ বড় একটা টিম, দুই একজনের প্রবলেম হলে সবারই কিছুটা প্রবলেম হবে তাছাড়া ছবি কে নিয়েও আমি বেশ চিন্তিত। তার ওপরে আমাদের প্লান ছিলো- লুংফেরভা,তারপি,তারতে,ত্লাবং/ফাইপি,জাদিপাই/জিংসিয়াম সুতরাং ট্রেক বেশ লম্বা।
ঢাকা থেকে বান্দরবান, বান্দরবান থেকে থানচি, থানচি থেকে বাক্তলাই পাড়া হয়ে আমরা সেদিনই চলে যাই লমোয়াল পাড়ায়। ট্যুরের আগে ছবিতে এই পাড়াটা দেখে আরিফকে আমি ঢাকা থেকেই বলি প্লানে এই পাড়াটা রাখতে। যেকোনো নতুন পাড়ার প্রতি আমার আগ্রহ থাকে অনেক। তারপরে রুট প্লান টা যেভাবে হয় তাতে করে এই পাড়াটা এমনতিই পরে যায়। পাড়ায় ঢুকতে ঢুকতে আমাদের সেদিন সন্ধ্যা হয়ে যায়। তারপরেই নামে ঝুম বৃষ্টি। প্রথমদিন হওয়াতে সবার সাথেই আলাপ কম। আমি ও ছবি নিজেদের মত করে ফ্রেশ হয়ে খেতে যাই। ইফতি ও আরিফ রান্না করে ফেলেছিলো সকলের ফ্রেশ হতে হতে। খেয়ে দেয়ে এক ঘুমে সকাল। সকাল বেলা উঠেই ছবি তুলতে বের হয়ে যাই। পাড়াটা ছোটো, সেভাবে দেখার সুযোগ হয়নি। যেই ঘরে ছিলাম সেখান থেকে একটু দূরে উচু একটা জায়গায় গিয়ে নিজেকে ভীষণ সুন্দর একটি স্থানে আবিস্কার করলাম। সূর্য তখন উঠছে বিপরীত পাশে আকাশের এক কোনে গুমোট বাধা মেঘ জমে আছে। সমান্তরালভাবে সামনে তাকাতেই সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিলো। একটি ঘর থেকে রান্না করার ধোয়া বের হচ্ছিলো। লমোয়াল পাড়ার সৌন্দর্য পেয়ে গিয়েছিলাম।
সেখানেই পাতা এক বেঞ্চিতে বসে ইফতির বন্ধু রাহাত, আমি ও ছবি নুডলস খেয়ে নিয়েছিলাম। তারপরে একে একে রেডি হওয়ার পালা। অনেক আগে তৈরি হতে গেলেও আমার আর ছবির তৈরি হয়ে বের হতে হতে সবার পরে হলো যার জন্য দায়ী আমরা ছিলাম না। কারণ টা ছিলো অন্য কেউ। কিন্তু দেরি করে বের হতেই আরিফ যখন আমাদের দোষ দিতে লাগলো ছোট্ট করে একটু মেজাজ দেখানো ওর সাথে আমার তখন হয়ে গেলো। তারপরে চলতে লাগলাম লুংফেরভার উদ্দেশ্যে।
পাড়া ছেড়ে বেড়িয়ে প্রথম জুমের রাস্তা ধরতেই সামনে এগিয়ে যাওয়া ইফতিকে ফিরে আসতে দেখলাম। এবং এসেই বললো “সামনে সুন্দর ভিউ আছে। ভিডিও সুন্দর হবে।” ব্যস, আমি ও ছবি হাটতে হাটতে সেখানে গিয়ে ইফতিকে দিয়ে ভিডিও করিয়ে নিলাম। তারপর আবার হাটা। যেতে যেতে দূর থেকে একটি পাড়া দেখতে পেলাম। আরিফ নাম বললো ফাইনম। আরো একটু এগিয়ে একটি জুম ঘরে গিয়ে সেই পাড়াটাকে সামনে রেখে এবং মেঘকে সাথে নিয়ে সবাই একে একে ছবি তুলে নিলো। তারপরে ট্রেইল ধরে এগিয়ে চলা। ফাইনম পাড়ায় যখন ঢুকি তখন রৌদ্রজ্বল মেঘমুক্ত আকাশ। রং তুলিতে আকা ছবির মত সুন্দর একটি ছোট্ট পাড়া।
গিয়েই একটি ঘরের সামনে গাছের ছায়ায় সবাই বসে জিরিয়ে নিলাম। সেই ঘরের দাদার সাথে টুকটাক গল্প হলো। একটি সুন্দর ছাগছানা ছিলো সেখানটায়। সকলে বলতে গেলে সিরিয়াল ধরে ওকে নিয়ে ছবি তুললো। একে একে সবাই উঠতে লাগলো। আরিফ বললো এবারে নাকি বেশ খাড়া পাহাড় উঠতে হবে। গল্পে গল্পে আগাতে লাগলাম আমরা। আরিফ ও ইফতি সামনেই জুমের একটি দাদার গল্প করতে লাগলো। নাম তার পাকং, দাদা খুব ভালো, সিলোপী পাড়ায় তার বাস, তার পিচ্চি ছেলের নাম আব্রাহাম। ওঠা নামা করতে করতে আমারা কিছু লোকের সামনে পরলাম। সেখানে নাকি পাড়া থেকে গাইড নিয়ে যেতে হবে এমনটা নিয়ম। এটা ওদের একটা টাকা আয় করার পদ্ধতি বলা চলে। আরিফ এটাকে এড়াতে চেয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে নি। গাইড ফি ঠিক হওয়ার পরে আমরা চললাম লুংফেরভার পথে। জুমঘরের কাছাকাছি গিয়ে ওদের পরিচিত সেই দাদা, তার স্ত্রী ও বাচ্চাকে পাওয়া গেলো সেখানে। বাচ্চাটা তখন ঘুমাচ্ছিলো। জুমঘরে সবাই সবার ব্যাগ রেখে আমরা নামলাম কাঙ্ক্ষিত সেই লুংফেরভার জন্য।
হালকা এক পশলা বৃষ্টি শুরু হয়েও আবার থেমে গেলো। ঝর্নার কাছাকাছি গিয়ে নামার রাস্তাটুকুন বেশ বুনো। নামতে নামতে আমরা পেয়ে গেলাম আমাদের লুংফেরভা সাইতার। তথাকথিত ঝর্নার গড়নের চাইতে এর গড়ন কিছুটা সতন্ত্র। ওপর থেকে পানি ছিটকে পরে কয়েকটি জায়গায় ভাগ হয়ে পরতে থাকে। লতাপাতা জন্মানো পাহাড়ের গায়ের ওপর দিয়েই পানি পরে এক বুনো সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। অপর টিমের যে মেয়ে সদস্যরা ছিলো ওদের নেওয়া শাড়িটাই একে একে সবাই মিলে পরে ছবি তুলতে থাকি আমরা। হাতে ফুল, পড়নে শাড়ী এবং ওপর থেকে পড়া ঝর্নার পানি ও সেই সাথে স্থিরচিত্র আমাদের আনন্দকে পূর্ণতা দিয়েছিলো।
কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমাদের ফিরার জন্য উঠতে হয়। সামনের গন্তব্য সেদিন খুব একটা কাছে ছিলো না। যেতে হবে সিলোপী পাড়া হয়ে থিনদলতে পাড়ায়। আমরা উঠে আসতেই দেখলাম সেই ছোট্ট আব্রাহাম ঘুম থেকে জেগেছে। বারবার ডেকে, চকলেট এর লোভ দিয়েও ওকে কোলে নিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত দূর থেকেই ছবি তুললাম। সেখান থেকে ঘুরে সামনে আগাতেই গলায় কেমন যেনো একটুখানি জ্বলন হলো। হিজাবের নিচে হাত দিতেই বুঝলাম সেখানে একটি জোক। তারপরে আবার কি! চিল্লাচিল্লি করে সেই জোকটা ছাড়ানো হলো। এবং দলবেঁধে সকলে মিলে চলতে লাগলাম।
সামনেই নাকি পরবে সিলোপী পাড়া। তবে সেদিনের মত আমাদের চূড়ান্ত গন্তব্য সিলোপী পাড়া হয়ে থিনদলতে পাড়ায়। হাটতে হাটতে আরিফ কে জিজ্ঞেস করলাম, “সিলোপী পাড়া দেখতে কেমন?” আরিফ বলেছিলো পাড়াটা নাকি অনেক উচুতে এবং অন্যতম একটি সুন্দর পাড়া। মনের মধ্যে তখন ভীষণ সুন্দর একটি পাড়া দেখার প্রত্যাশা। যেতে যেতে আমরা পাড়ার নিচ থেকে একেবারে উপরে উঠে মাঠের পাশে বসেও উঠে গেলাম চারপাশ টা অপরিষ্কার হওয়ায়। উঠে গিয়ে বসলাম সেই পাকন দাদার ঘরের বাইরের অংশে। তারা সবাই জুমে, দরজা লাগানো, সেখানেই বিশ্রাম নিলাম। ক্ষুধাও পেয়েছিলো সবার। পাড়ার দোকানের খোজ নিয়ে দেখা গেলো সেটা বন্ধ। সাথে থাকা শুকনা খাবারগুলো খেতে লাগলাম সবাই। কিন্তু পাড়াটা আমার তেমন ভালো লাগলো না। কেমন যেনো একটু অগোছালো লেগেছে। হয়তোবা আমি আগে থেকেই বেশি সুন্দরের প্রত্যাশা করেছিলাম তাই। তবে মাঠ থেকে দৃশ্যটা খারাপ না। চারপাশে দুরের পাহাড় গুলো একটি ভিন্ন সৌন্দর্য দিয়েছিলো। সেই পাড়ায় নেটওয়ার্ক পাওয়ার কথা ছিলো৷ কিন্তু সেই জায়গাটা একটু দূরে হওয়ায় সেখানে যাওয়ার আগ্রহ পেলাম না। আমারা সেখান থেকে এক গ্রুপ থিনদলতে পাড়ার জন্য আগে আগেই রওনা হলাম।
গাছপালা, ঝোপঝাড় পেরিয়ে পরিস্কার আকাশ দেখা যায় এমন পথ ধরলাম। তারও কিছুটা আগানোর পর জুমের রাস্তা শুরু হতেই কার যেনো ফোন বেজে উঠলো। অর্থাৎ নেটওয়ার্ক পাওয়া যাচ্ছে। সবাই সেখানে যার যার মত করে সাবার বাসায় যোগাযোগ করে নিলাম আমরা। একটু হেটে, একটু জিরিয়ে আগাতে আগাতে আমরা জুমের রাস্তা ধরে অনেকখানি রাস্তা যাওয়ার পর আমাদের চোখ এক মনোমুগ্ধকর স্বাদ পেলো। গোধূলি বেলায় বিস্তৃত জুম সহ পাহাড়গুলো সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে বসেছিলো। সেবারই প্রথম আমি জুমের রাস্তার সৌন্দর্য অবলোকন করেছিলাম। আমি যেনো এক অফুরন্ত ভালো লাগার মোহে ছিলাম।
বার বার শুধু মনে হচ্ছিলো “এই পথ এতটা সুন্দর কেন!” পরিস্কার আকাশে সূর্য পশ্চিমে ধাবমান, যতদূর চোখ যায় সবুজ সোনালী পাহাড়। সবাই যার যার মত একে ওকে ডেকে ডেকে ছবি ও ভিডিও করে নিলাম। বেশ ভালো সময় নিয়ে সেই রাস্তা টুকুন আমরা উপভোগ করেছিলাম। কাছেই থিনদলতে পাড়া, ইফতিকে আগে আগে পাঠানো হলো খাবার দাবার ও অন্যান্য সব কাজ কিছুটা এগিয়ে রাখার জন্য। পাহাড়ের এক দাদা রাস্তায় দেখে বললো থিনদলতে ত্লাং পাহাড়ের চূড়াটা একেবারে কাছেই তাদের বিশ পঁচিশ মিনিট লাগে আমাদের এক ঘন্টার মত লাগবে। সাথে সাথে আরিফ কে বললাম সামিট টা করিয়ে আনতে। কিন্তু আরিফ রাজি হয়নি। কারণ তাহলে আমাদের পাড়ায় ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাবে। তখনই সময়টা প্রায় সন্ধ্যা ছিলো। আরিফের ওপর কিছুটা মনোক্ষুণ্ণ হয়ে পাড়ার দিকে হাটা দিলাম এবং পাড়ায় পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। খাবার তৈরির দায়িত্ব যথারীতি ইফতি ও আরিফের। ঘরে থাকা একমাত্র চৌকিটাতে আমি আর ছবি আগে থেকেই জায়গা নিয়ে নিলাম। আকাশে ভরা পূর্নিমার চাঁদ। আমি ও ছবি কলতলায় গেলাম ফ্রেশ হতে। এক পর্যায়ে চাঁদের আলোতেই দেখতে পেলাম কি যেনো লাফাচ্ছে। জোঁক সন্দেহ করে হেড ল্যাম্প জ্বালাতেই দেখলাম বড় একটা টাইগার জোক। তারপরে জোকের ভয়ে অতি সন্তর্পনে কাজ শেষ করে আমরা চলে এলাম ঘরে। এসেই রান্নাঘরে গিয়ে চুলা থেকে একটু উষ্ণতা নিয়ে নিলাম। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে এক ঘুম।
পরদিন ভোর। উঠেই আগে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে দেয়ে ট্রেক শুরু করার জন্য তৈরি হয়ে বেরোলাম। বার বার ডেকে ডেকে ইফতিকে একটু উচু জায়গায় নিয়ে গেলাম পাড়াটাতে ছবি তোলার জন্য। থিনদলতে পাড়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে থেকে উল্টো পাশে তাকালে থিনদলতে পাড়ার যে অংশটা দেখা যায় সেটা অনেকটা ক্যালেন্ডারের পাতার কোনে মনোরম দৃশ্যের মতো। আমরা সেখানে টুকটাক ছবি তুলে বেড়িয়ে পরলাম। অনেকখানি নামতে হবে আমাদের। পাড়া থেকে বেরিয়ে কিছুটা যাওয়ার পরই আবার চোখ ধাধানো দৃশ্য। এমন অবস্থায় সবার একটাই কাজ সেটা হলো একে ওকে ডেকে ডেকে ছবি তুলে নেওয়া। খাড়া রাস্তা ধরে নামতে নামতে সবাই ক্লান্ত। এবং ক্লান্ত হতে হতে আমরা ঝিরিতে নামলাম। ছবি আমার আগেই বাকিদের সাথে নেমে গেছে। এই মেয়েটা আমাকে প্রচন্ডভাবে অবাক করেছে। ঢাকা থেকে যাওয়ার আগে যাকে নিয়ে আমি ভয়ে ছিলাম সে কিনা তার জীবনের প্রথম ট্রেক এবং বেশ লম্বা ও মোটামুটি ভালোই কঠিন ট্রেক অনায়াসেই করে ফেললো! গ্রুপে মেয়েদের মধ্যে ভালোভাবে ট্রেক সম্পুর্ণ করার মধ্যে ছবি অন্যতম। শুধুই কি ভালো হেটেছে! আমার খেয়াল রেখেছে, যত্ন নিয়েছে এবং আমার সাথে সঙ্গ দিয়ে হেটেছে। চাইলেই ও দ্রুত হেটে আগে চলে যেতে পারতো সেটা না করে বেশিরভাগ সময়ই আমাকে সাথে নিয়ে হেটেছে। ঝিরিতে নামতেই শুনলাম একটা ছোটোখাটো তবে গুরুত্বপূর্ণ অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে এই ছবি। ওর চশমাটা ঝিরির পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে। মানে অতি আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশের সময় চশমাটা পরে গিয়েছে আর কি। ওর আবার এক চোখে পাওয়ার মাইনাস ২.৫০ এবং আরেক চোখে মাইনাস ৩। সাথে এক্সট্রা কোনো চশমা নাই। এই মেয়ে ভালো ট্রেক করেও চশমা হারিয়ে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলো। ঝিরির পাশে পাথরে সবাই সবার ব্যাগ রেখে হালকা খেয়ে নিলো। সেই মুহুর্তে কোনো এক কারনে ইফতির ওপর মেজাজটা এত গরম হয়েছিলো যে খুব কড়া কথাও শুনিয়েছিলাম। তারপরে তো ওর কোনো হেল্প না নিয়ে, ওর দিকে না তাকিয়ে, ওর ফোনে ছবিও তুলবো না ভাবতে ভাবতে তারতে ঝর্নার দিকে আগালাম। যাওয়ার আগে আরিফ সবাইকে বলে দিলো কোনো গাছের গায়ে কেউ যেনো হাত না দেয় ওখানে নাকি গাছে গাছে সাপ থাকে। মনের মধ্যে জেঁকে বসা ভয় নিয়ে আমরা আগাতে লাগলাম৷ কাছেই পেয়ে গেলাম তারতে ঝর্না।
সেখানে গিয়ে নিজে নিজেই আমার ফোনে যেমন ছবি আসে তেমনই তুলতে লাগলাম আমার ও ছবির ছবি। একবার আমার মেজাজ খারাপ হলে তখন সেটা অন্যদের ওপর ও পরে। তারই ফলস্বরূপ আরিফের সাথেও রাগ করে বসে থাকলাম। এবং তারতে থেকে তারপি ওঠার রাস্তাটা একটা ভয়ংকর রাস্তা। ওটাকে রাস্তা বলা ভুল, ওটা কোনো রাস্তা ই না। পাথরের গা বেয়ে বেয়ে উঠতে হয় একে ওপরের সাহায্য নিয়ে নিয়ে। বলা যায়, অনেকটা টানা হ্যাচড়া করে করে একে অপরকে ওপরে তোলে। যেহেতু আমি আরিফ ও ইফতির ওপর রাগ এবং ওদের হেল্প নিতে চাচ্ছিলাম না তাই প্রথমে আমি মানা করে দেই। এটা শুনে আরিফ ও রেগে যায় তারপরে আমিও চিল্লাই। কিন্তু যাই করি নাছোড়বান্দা আরিফ ওপরে আমাকে নিবেই। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেলে এটাই ভিন্ন আনন্দ। তোষামোদ পাওয়া যায় ভালোই। এরপরে সেই এ্যাডভেঞ্চাচারাস যাত্রা শুরু। যাত্রা ছোটো কিন্তু ভীষণ কঠিন। একা একা তো দূর দুই তিনজনেও কষ্ট। গ্রুপ করে অনেকটা ঝুলে ঝুলে গাছ পাথর বেয়ে তার পরে উঠেছি। বিভিন্ন জায়গায় কেউ না কেউ টেনে টেনে তুলেছে। প্রতিটি ঝর্নাই বেশ সুন্দর। তারপিও তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে ভীষন সুন্দর। রাগ করে ছিলাম বলে উঠেই ছবি তুলতে না গিয়ে চুপচাপ বসে বসে ঝর্না দেখতে লাগলাম। তখন এই ঝগড়াঝাটির মধ্যস্থতা করতে আসলো রাহাত৷ ইফতির এই বন্ধু ইফতির সাথে বান্দরবান থেকে যোগ হয়েছিলো। ইফতি বলেছিলো ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। ট্যুরে যতটা না ভালো সম্পর্ক হয় তার চেয়ে বেশি ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে ফিরে এসে৷ একে নিয়ে ভালো অনুভুতিগুলোর অন্যতম একটি হলো আমাকে প্রায়রিটি দিয়ে সবসময় খোজ খবর রাখে এমনকি আমি খোজ না নিলেও৷ সেসময়ে রাহাত এসে বলে “আপু, আপনি যে জন্য ইফতিকে বকতেছেন সেখানে ইফতির কোনো দোষ নাই। ভুল বুঝতেছেন।” এই মধ্যস্থতায় কাজ হয়। আমার আবার মেজাজ খারাপ হতেও সময় লাগে না আবার ভালো হতেও সময় লাগে না। বর্ষার আকাশের মত এই মেঘ, এই বৃষ্টি তো এই আলো ঝলমলে রোদ। মন ফুরফুরে হয়ে গিয়ে উঠে বাকি সবার সাথে ওপরে গিয়ে শাড়ি পেচিয়ে বিশাল পাথরের গায়ে বসে ঝর্না দেখতে দেখতে ছবি তুললাম।
ছবি ও বাকিরাও ছবি তুলে নিলো। আবার সেই ভয়াবহ রাস্তাটা দিয়ে নিচে নেমে এলাম। এসে সবাই যার যার ব্যাগপত্র নিয়ে তৈরি৷ সবাই ডাবল ফলস যাবে। আরিফ আমাকে বললো, “চলো মামা, আগাতে থাকো।” আমি তখন বিস্ময়ের সাথে বললাম, “মামা, আমি ডাবল ফলস কেনো যাবো? আমি তো ডাবল ফলস গিয়েছি। তুমি তো বলেছিলা আমাকে ফাইপি দেখাবা।” আরিফের উত্তর তখন যেটা ছিলো সেটা এমন যে ফাইপি যেতে হলে যেই পথে আমরা এসেছি সেই পথে অন্যদিকে যেতে হতো এখন যেদিকে যাচ্ছি সেদিকে ডাবল ফলস। আমি তখন ওকে বলেছিলাম দরকার হলে আমাকে পাড়ায় পাঠিয়ে দিতে আমি সেখানে গিয়ে নিজের মত করে সময় কাটাবো কিন্তু একই ঝর্নায় আমি আবার যাবো না। পাহাড়ে গিয়ে প্রতিবারই আমার চেস্টা থাকে ভিন্নভাবে স্বাদ নেওয়ার তাছাড়া যে কোনো পাড়ায় সময় কাটানোর প্রতিও আমার আগ্রহ প্রচুর। কিন্তু ব্যাপারটা ছিলো আমরা যেখানটায় ছিলাম সেখান থেকে ডাবল ফলস হয়েই পাড়ায় যাওয়ার রাস্তা। এবং উল্টো পাশে ফাইপি হয়ে পাড়ায় যাওয়ার রাস্তা। এবং যেহেতু টিমের সবাই ডাবল ফলস যাবে কারন ইভেন্টে ডাবল ফলসই অন্তর্ভুক্ত ছিলো সুতরাং ফাইপি যাওয়া যাবে না। আরিফকেও ওর বাকি মেম্বার দের নিয়ে ডাবল ফলস দেখাতে হবে এটাই স্বাভাবিক।
আবারও মন খারাপের জোগার হওয়া অবস্থায় মাথায় এলো আমাদের টিমে তো আরিফ ও ইফতি দুইজন আছে। দুইজনই রাস্তা চিনে এবং দুইজনই আগে এগুলো দেখেছে। তবে আরিফ ওসব পাহাড়ি রাস্তায় ইফতির চাইতে বেশি গিয়েছিলো এবং তারপি তারতে থেকে ফাইপি হয়ে থাইক্ষং পাড়ার রাস্তায় ইফতি একবার গিয়েছিলো। আমি তখন বললাম একজন টিম নিয়ে ডাবল ফলস যাক আরেকজন আমাকে নিয়ে ফাইপি যাক। কিন্তু আরিফ ও ইফতি দুইজনই ডাবল ফলস যেতে চাইলো। এমতাবস্থায় ঠিক হলে ইফতি আমাকে নিয়ে ফাইপি যাবে বাকিরা সব ডাবল ফলস যাবে। তখন আবার আরেক মতবাদ নিয়ে হাজির হলো আমাদের ছবি। সে বললো আমাদের সাথে ফাইপি যাবে তারপর থাইক্ষং পাড়ায় আমাকে রেখে ইফতিকে নিয়ে ডাবল ফলস যাবে। সময়টা তখন দুপুর গড়িয়ে সামনের দিকে। সুতরাং সন্ধ্যার আগে দুইটা ঝর্না দেখা অসম্ভব। কারণ ভালো ট্রেক করলেও ঠিক ঐ অল্প সময়ে দুইটা ঝর্না কভার করার মত ফাস্ট ট্রেক ওর সম্ভব না। আমার দ্বারা তো আরো আগে না। অগত্যা ছবি ডাবল ফলসের দিকে টিমের সাথে এবং আমি ফাইপির দিকে ইফতির সাথে। ওদের যাওয়ার আগে রাহাতকে বার বার বলেছিলাম ছবি কে দেখে রাখতে কারন ছবির চশমা নাই।
প্রথমে সেই যে নেমে এসেছিলাম সেই রাস্তায় আবার উঠলাম সেখানে থিনদলতে পাড়ার এক দাদার সাথে দেখাও হলো। কেন জানি না তাকে দেখে আমার কেমন যেনে একটু ভয় লাগলো। উঠতে উঠতে ইফতি আমাকে এক জায়গায় এসে ঝোপঝাড়ের ওপর থেকে দূরে রেখে আসা তারপি ঝর্না দেখালো। কিন্তু আমি সেটা দেখতে পেলাম না। উচ্চতা ম্যাটারস! ওর উচ্চতা নিয়ে যেটা দেখা সম্ভব আমার উচ্চতা নিয়ে সেটা সম্ভব নয়। আমি তো তাকিয়ে ঝোপঝাড় টাই পার করতে পারি নাই। ব্যর্থ হয়ে আবারও আগালাম। কিছুটা ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আবার নামলাম। এবং নেমে একটা ঝিরি পেতেই সামনে থেকে এক গাল হেসে ইফতি এসে বললো সামনে হলুদ প্রজাপতির একটা ঝাঁক বসে আছে। ট্যুরে যাওয়ার আগে সেই সময়ে ঐ রুটের অনেকের ট্যুরের এমন প্রজাপতির সাথে ভিডিও দেখে আমারও মনের এক সুপ্ত বাসনা ছিলো এমন একঝাক প্রজাপতি যেনো আমিও দেখি। কিন্তু পিছনের পুরো রাস্তায় প্রজাপতির ঝাঁক না পেয়ে যখন আশা ছেড়েই দিচ্ছিলাম তখনই পেয়ে গিয়ে আনন্দে একেবারে আত্মহারা। সেখানে ধীরে ধীরে ব্যাগ রেখে সন্তর্পনে এগিয়ে গিয়ে প্রজাপতি উড়িয়ে ইফতিকে দিয়ে আমার ভিডিও করিয়ে নিলাম। ঝিরিতেই ইফতি বললো সামনে অনেক খানি উঠতে হবে। উঠতে উঠতে নাকি বিরক্ত চলে আসে। শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ইফতি পাহাড়ে যথেষ্ট কমফোর্ট। ট্রেকিং এ কোনো ক্লান্তি নাই এমন টাইপ সেই ওর ই যদি বিরক্ত চলে আসে আমার তো তাহলে ট্রেক কমপ্লিট করাটাই সন্দিহান হয়ে পরবে।
পুরোপুরি উল্টোভাবে আমরা দুইজন ও বাকি পুরোটিম দুই দিকে যাওয়ার প্রায় বিশ পঁচিশ মিনিট হাটার পরই আমার কেমন যেনো ভয় ভয় করতেছিলো। তারপরেও এগিয়েই চলিতেছিলাম। ঝিরি থেকে খাড়া রাস্তা ধরে উঠতে লাগলাম। এবং পুরোটা সময় জুরে ভয় আর পিছু ছাড়লো না। বারবার শুধু মনে হতে লাগলো এটা আমার ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে গেলো কি! মাত্র দুইজন মানুষ নির্জন পাহাড়ি রাস্তায় বেড়িয়ে পড়লাম। এটা কি এমন কোনো ভুল হতে পারে! যা শুধরানো যাবে না! আমার কথা রাখতে গিয়ে ইফতি ছেলেটাও বিপদে পরবে নাতো! আমার কোনো সমস্যায় ইফতি সাপোর্ট দিতে পারবে কিন্তু ইফতির কোনো সমস্যা হলে আমি তো কিছুই করতে পারবো না। একজনের কিছু হলে অপরজন নির্ঘাত মহাবিপদে। এমন অসংখ্য দুর্ভাবনা আর দুশ্চিন্তা নিয়ে চলতে লাগলাম। খাড়া পাহাড়ের প্রতিটা ঢালুতে “সামনেই সামিট পয়েন্ট” বলে বলে, গম্ভীর ভাবটা হালকা করে করে ইফতি উঠাতে লাগলো।ট্রেকিং ট্যুরের জন্য সব ঠিক হওয়ার পর যাত্রা শুরুর কয়েকদিন আগেই আমার মনে হয় ঝুকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই ফাইপি যাওয়ার সিদ্ধান্তটাকে তখন মনে হয়েছিলো দুঃসাহসিক একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
যেতে যেতে আমাদের নাকি একটা ওয়াই জংশন পরবে। সেখান থেকে সোজা থাইক্ষং পাড়ার রাস্তা এবং বামে ফাইপির রাস্তা। ‘সামনেই সামিট পয়েন্ট’ বলে বলে যখন ইফতি আমাকে খাড়া পাহাড় উঠাচ্ছিলো তখন বলেছিলাম ওয়াই জংশন এ চলে আসলে খুশি হয়ে যাবো। খুশি হওয়ার কারণ দুইটি, এক- রাস্তা কমে যাওয়া ও দুই- পাড়ার কাছাকাছি চলে যাওয়া। অর্থাৎ মাত্র দুইজনের ঝুকিপূর্ণ যাত্রার কিছুটা স্বস্তি বোধ হওয়া। এবং উঠতে উঠতে হঠাৎই ইফতি বললো “এটাই ওয়াই জংশন”। শুনে আমি খুশিতে ডগমগ এবং কাছেই পাড়া এই ভাবনাটা মনের ভয় কিছুটা দূরীভূত করলো।ইফতি ওয়াই জংশনে ব্যাগ রেখে ঝর্নায় যাওয়ার কথা বললো। আমি ওকে বলেছিলাম “মামা, কোনোভাবে যদি ব্যাগ হারায় তুমি আমি শেষ। বাকি দুইদিন পাহাড়ে টিকা লাগবে না।” এবং ইফতি ভরসা দেয় এই বলে “পাহাড়ে আর যাই ই থাকুক চোর নাই।” আমার ব্যাগটা একটি গাছের সাথে ঝুলিয়ে এবং ইফতির ব্যাগটা একটু উঁচু জায়গায় রেখে আমরা চললাম ফাইপির উদ্দেশ্যে।
রাস্তাটা বাজে, কর্দমাক্ত পথে হাটা মুশকিল। পা দিলে কাদায় ডেবে যায়। আমরা কিনার ধরে ধরে আগাচ্ছিলাম। ইফতি বললো গয়াল হেটে আর বৃষ্টিতে অমন অবস্থা হয়েছে। কিছুদূর এগিয়ে ঝর্নার জন্য নামা। ঐ রাস্তায় গয়াল চলাচলের জন্য অনেক বেশি বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছিলে। একটু পরপর তিন চার দিকে এমন ভাবে রাস্তা গিয়েছে যে মনে হয় সবগুলোই বুঝি নিচে নামার রাস্তা। ঝোপঝারে গয়ালের অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম আমরা ওদের শব্দে। আমার বার বার মনে হচ্ছিলো ভুলভাল রাস্তায় চলে আসলাম না তো! তবে ইফতির ওপর ভরসা ছিলো। ও এক সপ্তাহ আগেই এই পথে ঘুরে গেছে। সাদিক ও ইফতি একবার গেলেই পাহাড়ের রাস্তা ভালো চিনে দেখে আমার বন্ধু আসিফ বলে “ওরা চট্টগ্রামের মানুষরা পাহাড় ভালো বোঝে”।আমিও আসিফের সাথে একমত। যতটুকু পাহাড়ে গিয়েছি ততটুকুর মধ্যে সবচেয়ে বিভ্রান্তিকর রাস্তাটা পেরিয়ে ইফতি আমাকে ফাইপি ঝর্নার সামনে নিয়ে দাড় করালো।
একেবারেই নিরিবিলি বিশাল সে ঝর্নার সামনে আমি ও ইফতি দাড়ানো। পিছনে তাকালে বড় বড় পাথর, গাছ ও রোমাঞ্চকর পরিবেশ। আবারও আমার ভয়টা বেড়ে গেলো। কোনোমতে তাড়াহুড়ো করে কয়েকটা ছবি ও ভিডিও করলাম। ইফতি বড় একটা পাথর থেকে নিচে থাকা খুমে লাফ দিতে চাইলে আমি বারণ করলাম। একে তো আমরা মাত্র দুইজন উপরন্তু বুনো একটা জায়গা। সামান্য ব্যথা পেলেও ভোগান্তির শেষ থাকবে না। স্বল্প কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা ফিরে আসলাম সেখান থেকে। সেই বাজে বিরক্তিকর রাস্তাটুকুন পেরিয়ে ওয়াই জংশন এর সামনে আসতেই দেখি ব্যাগের মত একটা বস্তু পরে আছে এবং সেটা গয়াল খাওয়ার চেস্টা করছে। পাশেই নীল রংয়ের পলিটা পরা। ইফতি বললো “মামা, এটা তো আমাদের ব্যাগ।” কিন্তু ভয়ে গয়ালটার কাছে যেতে পারছিলাম না আমরা। অনেক চেষ্টায় ইফতির ব্যাগটা নেওয়া হলো। কিন্তু সমস্যা মিটলো না। গয়ালটা গাছের সাথে ঝোলানো আমার ব্যাগটায় নজর দিলো। প্রমদ গুনতে লাগলাম কখন যেনো ছিড়ে ফেলে ব্যাগটা। এরমধ্যেই দেখি থাইক্ষং পাড়ার এক দাদা আসতেছে। তাকে দেখে সাহস সঞ্চয় করে গয়ালকে তাড়িয়ে আমার ব্যাগটা নিয়ে আমরা থাইক্ষং পথে ছুটলাম। এবং ফাইনালি পাড়ামুখে এসে বাধ টপকিয়ে সস্তির নিঃস্বাস ফেলেছিলাম। আর মনে মনে আল্লাহর কাছে অসংখ্য শুকরিয়া আদায় করতেছিলাম যে পথে কোনো বিপদ হয়নি। ফাইপি দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্তটা ভুল প্রমানিত হয় নি। কেমন যেনো একটা বিজয় বিজয় ভাব চলে আসছিলো মনে তখন। তারপরে হাটতে হাটতে সূর্যের আলো থাকতেই আমরা থাইক্ষং পাড়ায়। আরিফ ও ইফতির পরিচিত এক দাদার ঘরে গিয়ে উঠলাম। আমি সেখানে অপেক্ষা করতে লাগলাম ত্লাবং থেকে ফিরে আসা টিমের জন্য। টিম আসলে হোস্টরা কথাবার্তা বলে ঠিক হলো আমরা অন্য ঘরে থাকবো। তো আমরা অন্য ঘরে চলে গেলাম৷ সেরাতে আমরা যেই ঘরে ছিলাম সেই ঘরের দাদার সাথে আরেক পাড়াবাসীর বেশ ঝগড়া লাগে এবং সেটা ঘর পর্যন্ত চলে আসে। আমরা প্রতিটা মেয়ে বেশ ভয় পেয়ে যাই। আরিফ ও মাসুম ভাইকে ছেলেরা যেই ঘরে ছিলো সেখান থেকে আমরা ডেকে নিয়ে আসি। পাশের ঘর থেকে ওরা চলে আসে। এবং ঝগড়াঝাটির শেষ হলে আমরা ঘুমিয়ে পরি।
আগের রাতে পাড়ার ঝগড়া ঝাটিতে পরার পর এইদিন সকালে উঠলাম কিছুটা দেরি করেই। উঠে আমি পাড়াটা টুকটাক দেখে নিলাম এদিক সেদিক হাটাহাটি করে। একটা টিম যাবে জাদিপাই এবং আমারা কয়েকজন যাবো জিংসিয়াম। কিন্তু জিংসিয়াম অনেক বেশি দূরে এবং আমাদের দেরিও হয়ে গিয়েছিলো বেশ। মূলত পাড়ার দাদারা নিজেরা ঝগড়াঝাটি করে সিদ্ধান্ত নিয়ে গাইড ঠিক করে দিতে দিতে এই দেরি। কয়েকজন বাদে কেউ ই জাদিপাই দেখেনি তাই বেশিরভাগ সবাই জাদিপাইয়ের দিকে যাবে। এবং সেই টিম ইফতি লিড দিয়ে নিয়ে যাবে। আমার সিদ্ধান্ত ছিলো হয় আমি জিংসিয়াম যাবো নাহয় আমি পাড়ায় থাকবো। দেরি হয়ে যাওয়া, দুই টিমের দুই দিকে যাওয়া, কে কে কোন দিকে যাবে সেটা নিয়ে দ্বিধাবোধ তৈরি হওয়া সব মিলিয়ে সকালটা বেশ ঝামেলাপূর্ণ ছিলো। জিংসিয়াম যাওয়ার টিমের প্রায় প্রত্যেকে এক এক বার করে বেকে বসল যে যাবে না। এমনকি আমি সহ। আমি যখন বললাম যাবো না আরিফ সেটা মানলো না। ওর এককথা আমাকে জিংসিয়াম যেতেই হবে। ছবি একটু অসুস্থ ছিলো, যেহেতু ও জাদিপাই দেখে নাই এবং জাদিপাই এর রাস্তা ছোটো সুতরাং আমি ওকে বাকিদের সাথে জাদিপাই পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। এইদিকে জিংসিয়ামের রাস্তা বেশ বড় হওয়ায় আমি নিজেকে নিয়েই চিন্তায় ছিলাম। আমি যখন পাড়ায় থাকতে চাইলাম ছবি তখন আমাকে পাড়ায় থাকতে দিতে নারাজ ওর কথা হয় আমাকে জিংসিয়াম যেতে হবে নাহয় আমাকে ওদের সাথে জাদিপাই যেতে হবে। এমন অবস্থায় কেটে গেলো আরো কিছু সময়। ছয় জন জিংসিয়াম ও বাকি সবাই জাদিপাই এর জন্য টিম ঠিক হওয়ার পরে হঠাৎই ছবি বললো ও জিংসিয়াম যাবে। আমি আবারও সংকটে পড়ে গেলাম। ছবির হালকা অসুস্থতা, লম্বা ট্রেক, দেরি করে বের হওয়া,টিম ছোটো রাখার প্রয়োজনীয়তা সব মিলিয়ে আমি ছবিকে নিরুৎসাহিত করলাম যাওয়ার জন্য। এমন কি টিমের কেউই ওর জিংসিয়াম যাওয়া সমর্থন করলো না৷ শেষ পর্যন্ত আমরা দুইদিকে ভাগ হয়ে যাত্রা শুরু করলাম। বেশ বুনো জঙ্গলের একটা রাস্তা ধরে অনেক খানি নেমে আমারা থাইক্ষং পাড়ার জুমে উঠে জুমের রাস্তা ধরলাম। গাইড দাদা আমাদের একটা জুমঘরে নিয়ে গেলে সেখানে এক বাচ্চা পেলাম। পেয়ারা ও চকলেট দিয়ে ওকে একটু কোলে নিলাম, ছবি তুললাম এবং আরিফের আনা পেয়ারাগুলো সবাই ভাগযোগ করে খেয়ে নিলাম। এরপরে আবার সামনে আগানো।
জিংসিয়াম যাবো বলে সেদিন মনটা একটু ফুরফুরেই ছিলো। তারই বহিঃপ্রকাশ স্বরুপ লাল রংয়ের লিপস্টিক দিয়ে বের হয়েছিলাম। জুমের রস্তা ধরে দীর্ঘ পথ আমাদের পাড়ি দিতে হবে। এই রাস্তার সৌন্দর্যটুকু বলে বোঝানো সম্ভব নয় আমার দ্বারা। আমার শব্দভান্ডার নেহায়াতই গরিব। আমার চোখ যেটা দেখেছিলো ক্যামেরা সেটা ধরতে পারেনি। আমার মন যেটা উপলব্ধি করেছিলো শব্দ সেটা প্রকাশ করতে পারবে না। এত এত চোখজুড়ানো দৃশ্য দেখে আমি ছবিকে ভীষন মিস করতে লাগলাম। মেয়েটার যাওয়ার খুব ইচ্ছা ছিলো। আমাদের কেউ একজন যদি একটু সাহস করতো তাহলেই ও যেতো। কিন্তু ট্রেইল সহজ হলেও অনেক বেশি লম্বা ছিলো বলে কেউ কাউকে সাহস জোগায় নাই। উল্টো আমি তো নিজেই নিজেকে নিয়ে সন্দিহান ছিলাম। পারবো নাকি না। আর ও যেহেতু জাদিপাইও দেখেনি তাই আমরা ভেবেছিলাম ও জাদিপাই ই দেখুক। সমস্যা হলে বরং অল্প মানুষেরই হোক। তবুও শেষ মুহূর্তে ওর যেতে চাওয়াটা আমাকে পুরো রাস্তা ওর কথা মনে করিয়েছিলো। চোখের তৃষ্ণা মেটাতে মেটাতে আমরা এগিয়ে গেলাম। সামনেই পরবে সুংসাং পাড়া। এই পাড়াতেই আর্মি ক্যাম্প। মাসুম ভাইয়া বলল “আমরা কিন্তু অনেক রিস্কি রাস্তা নিলাম।” মানে আর্মির কাছে ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেক। তখন একবার মনে হয়েছিলো ছবি না এসে ভালোই হয়েছে ধরা পরলে ওর কোনোটাই দেখা হতো না।
আলো ঝলমলে রোদ, হঠাৎ হঠাৎ মেঘের আনাগোনা, এক পশলা বৃষ্টি, দূর পাহারে ঝুম বৃষ্টি দেখতে দেখতে আমরা সুংসাং পাড়ার কাছাকাছি চলে এলাম। এবং একটা মোটর সাইকেল দেখে সবাই অবাক হলাম। তারপরে পাড়ার একেবারে কাছে এসে আমাদের সবাইকে বসিয়ে রেখে গাইড দাদা গেলো পাড়ায়, সেখানকার অবস্থা বোঝার জন্য। এবং ফিরে এসে সে আমাদের পাড়ার ভিতরে দোকানেও নিতে চাইলো। তার এই প্রস্তাব শুনে আমরা বুঝলাম পাড়ায় আর্মি তো নেই ই সেইসাথে গাইড দাদার এই পাড়ায় যোগাযোগ ভালো। সুংসাং পাড়ার সাথেই আর্মি ক্যাম্প হওয়ায় এই পাড়া ক্রস করাটা সবাইকে ভাবায়। আমরা গাইড দাদার প্রস্তাব প্রত্যাখান করে পাড়া পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। সামনে লুংথাউসিহ পাড়া থেকে আমরা জিংসিয়াম এর জন্য যাবো। ছবির মত সুন্দর একটা রাস্তায় টুকটাক ছবি তুলে দিয়েছিলো আমাদের ট্যুরমেট ফুয়াদ ভাই। যার সাথে বেশিরভাগ সময় এই ট্রেইলে হেটেছিলাম। আরিফ খুব একটা ভালো ছবি তুলে না তবুও “নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো” প্রবাদের প্রয়োগস্বরুপ আরিফকে দিয়েও ভিডিও করিয়েছিলাম।
যেতে যেতে আমরা লুংথাউসিহ পাড়া পেয়ে গেলাম।তখন সময়টা দুপুর। পাড়ার শুরুতে ঢুকতেই খুব সুন্দর লাগলো পাড়াটা। গিয়ে আমরা দোকানে বসলাম।কয়েকজন ছেলে ছিলো দোকানটায়। সুংসাং পাড়া পার হয়েই রুম্পা আপু এক পাহাড়ি লোকের কাছ থেকে একটা ডাব কিনেছিলো। সেটা দোকানে এসে কেটে একটা গ্লাসের ছয়ভাগের একভাগ হয় এতটুকুন পরিমান পানি পাওয়া গেলো। এটা নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতে লাগলাম আমরা। এর মাঝেই নেমে পড়লো বৃষ্টি।
সময়টা খুব সম্ভবত সেই মৌসুমের বর্ষার শুরুর দিকে, কোনো একটা ফেসবুক পোস্টে দেখেছিলাম কোনো এক পাড়ায় বৃষ্টি ভেজা একজনের ভিডিও। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক একটা বৃষ্টির গান। ঠিক তখন আমার মনে হয়েছিলো এরপর পাহাড়ে গিয়ে বৃষ্টি পেলে এমন একটা ভিডিও করবো। এবং ট্যুরের শেষের দিকে লুংথাউসিহ পাড়ায় গিয়ে বৃষ্টি পেয়েও গেলাম আর রুম্পা আপুকে বলে ভিডিও টাও করে ফেললাম।
এই ট্যুরে সব কিছু পেয়েছি। যাওয়ার আগে যা যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে বরং বেশি কিছুই পেয়েছিলাম। প্রকৃতিও মনে হয় মনমতো সব দেওয়ার জন্য উন্মুখ ছিলো। এই সবকিছু পাওয়াটা ট্যুরে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকার বিষটা যে সঠিক ছিলো সেটার প্রমান মনে হচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো প্রকৃতির মন ভালো থাকা একটি সময়ে তার কাছে দ্বারস্থ হয়েছিলাম চোখ ও মন ভরে সৌন্দর্য লুফে নিতে। এবং সে দিতে কার্পন্য করেনি। আরিফের ওপর আবার মনটা ভালো হয়ে গেলো। চা খেয়ে নিলাম সবাই। এবং ঝর্নায় যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পরলাম পাড়া থেকে একজন গাইড ঠিক করে। ফিরে এসে কি খাবো, কই খাবো সব বলে দেওয়া হলো। এবং দুপুর গড়িয়ে বিকেলের শুরুতে আমরা ফাইনালি ঝর্নার জন্য আগালাম।
পাড়ার পাশ দিয়ে গিয়ে আমরা ধান কেটে ফেলা একটা খাড়া জুম দিয়ে নামতে লাগলাম। কতদূর নামার পরে দূর থেকে আমরা জিংসিয়াম ঝর্নার একেবারে নিচের ধাপের ওপরের অংশটা দেখতে পেলাম। এবং প্রফুল্ল মনে সেখানে ছবিও তুলে নিলাম। তারপরে কেবল নামতেই লাগলাম। এবং একটা ঝিরি পার হয়ে কিছুদূর গিয়ে আমরা পেয়েই গেলাম আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত জিংসিয়াম ঝর্নার নিচের ধাপ টা।
সকাল ৯.৪৫ এ এর জন্য বের হয়ে সারাদিন ট্রেক করে ৩.৪০ এ এর সামনে পৌছাই। ৫ ঘন্টা ৫৫ মিনিট পরে একে দেখে আমার মনে প্রথম যে ভাবনাটা এসেছিলো সেটা হলো “আসিফের জিংসিয়াম সাইতার”। যদি কেউ আমাকে পাহাড় ও ঝর্না চিনিয়ে থাকে তাহলে সেটা আমার বন্ধু আসিফ। ওর শখ জিংসিয়াম যাবে। ওর থেকেই প্রথম এই ঝর্নার নাম শোনা ও ছবি দেখা। ওরা কেউ যেতে না পারলেও আমি চলে যাই। এখানে গিয়ে এটা ভাবে খারাপ লেগেছিলো।
এরপরে ঝটপট ছবি তুলে নেই আরিফ মামাকে দিয়ে। ইফতি যেহেতু নাই আরিফ মামাই আমার ভারসা। দিনের আলো কমে যাচ্ছে ওপরে নাকি আরো দুটি ধাপ রয়েছে। তাই কিছুটা তাড়াহুড়ো করেই এখান থেকে আবার ওপরে উঠতে শুরু করি।
লুংথাউসিহ পাড়া থেকে যে গাইড নিয়ে যাই তার সাথে আরেকজন যায় দার্জিলিং পাড়ার একটা ছেলে। সেই ছেলেটাও নাকি এর আগে জিংসিয়াম দেখে নি। কোনো এক দরকারে লুংথাউসিহ পাড়া এসেছিলো সেখান থেকে আমাদের নিয়ে যাওয়া ওর বন্ধুর সাথে মিলে চলে। ওকে পেয়ে আমরা আমাদের গাইড কে নিচে বাকিদের সাথে রেখে আগে আগে পরের ধাপের জন্য ওঠা শুরু করি। এবং সেই ছেলেটা আমাদের খুব যত্ন নিয়ে সাবধানে গাইড করে এগিয়ে নিয়ে যায়। ওর নামটা জানা হয়নি।
প্রায় বিশ মিনিট খাড়া রাস্তা ওপরে ওঠলাম আমরা দ্বিতীয় ধাপের জন্য। আমি, ফুয়াদ ভাই, আরিফ আর সেই দার্জিলিং পাড়ার দাদা আগে আগে। পুরো টা রাস্তা গাছ,গাছের শিকর ও লতা পাতা ধরে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠলাম। গিয়ে এই ঝর্না দেখে আমি মুগ্ধ। এবং সম্ভবত এই প্রথম আমি বড় কোনো ঝর্নার এত বেশি কাছে গিয়েছিলাম।
নিচটা বেশ সুন্দর ও সহজ ছিলো যার কারনে ভয়ের কোনো বিষয় ছিলো না। পানির প্রবাহও ভয়ংকর রকমের বেশি ছিলো না। যারফলে আপ্লুত হয়ে আমি দৌড়ে ঝর্নার নিচে গিয়ে চুপচুপে ভেজা হয়ে আসি। এসেই মনে হলো কোনো ঝর্নায় গিয়ে এতটা সহজ স্বাভাবিক ভাবে আমি এর আগে কখনো উপভোগ করিনি। অথচ আসিফের পাঠানো ছবি দেখে আমি বলেছিলাম “ঝর্নাটা খুব একটা সুন্দর না।” কি ভেবে যে বলছিলাম সেটাই মিলিয়ে পাচ্ছিলাম না। তার ঠিক পাঁচ সাত মিনিট পরেই হঠাৎ পানির প্রবাহ বেড়ে যায়। ভাগ্যিস আমি একটু আগেই পৌছিয়েছিলাম।
দার্জিলিং পাড়ার দাদা তখনই বলেছিলো পাহাড়ি কন্যা জিংসিয়াম এর মর্মান্তিক মৃত্যু টা মুলত এই দ্বিতীয় ধাপের কাছাকাছিই হয়েছিলো। যার জন্য আগের এই “রুমাভা সাইতার” হয়ে ওঠে বর্তমানের “জিংসিয়াম সাইতার”।
দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় ধাপ উঠতে প্রায় মিনিট পনেরো সময় লেগেছিলো। এই রাস্তাতেই ফুয়াদ ভাইকে কোনো একটা পোকা কামড়ে নিলে, আমরা আগেই নিশ্চিত হয়ে নেই কামড়টা কি দুই দাত বসানো কিনা। যখন দেখি যে না তখন কিছুটা স্বস্তি পেয়ে সামনে আগাই। প্রথম গিয়েই দেখি ঝর্নায় বেশ পানি এবং বাতাস। পানির প্রবাহ, ঝর্নার শব্দ, বাতাস সবমিলিয়ে তখন চারপাশটা মোহাচ্ছন্ন। আগাতে নিলে দার্জিলিং পাড়ার দাদা আগাতে নিষেধ করে। অতটা সামনে আমি যাইও নি অবশ্য। কিন্তু মাসুম ভাইয়া একেবারে কাছে চলে গিয়েছিলো। ওখানে গিয়ে ঠিক থেকেছিলো কীভাবে আল্লাহই জানে। আমরা বরং কিছুটা দুরত্ব রেখেই ছবি তুলে নেই। ততক্ষণে সূর্য প্রায় অস্তাচল। ওঠার সময় দার্জিলিং পাড়ার সেই দাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ফেরার জন্য এই রাস্তা ধরেই কি আবার নামতে হবে কিনা। জবাবে তার “না” উত্তর শুনে স্বস্তি পেয়েছিলাম। তারপরেও এখান থেকে আবার লুংথাউসিহ পাড়ার দাদাকে জিজ্ঞেস করে পুনরায় নিশ্চিত হয়ে নিলাম। আমরা এখন অন্য রাস্তা ধরে আগাবো। এবং ফেরার জন্য যাত্রা শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রকৃতিতে সন্ধ্যা নেমে এসেছিলো।
আমি পুরো চুপচুপে ভেজা, পাহাড়ে তখন ঠান্ডা নামতে শুরু করে এবং চারপাশ অন্ধকার। যে যে যার যার হেড ল্যাম্প জ্বালিয়ে ঝোপঝাড় রাস্তার মধ্যে চলতেছিলাম। একটু একটু ভয়ও করতেছিলো তখন। রাস্তায় অনেক জোক ছিলো যা বার বার কামরাচ্ছিলো। সহ্য করতে না পেরে দুই একটা ছাড়িয়েছিলাম এছাড়া জোক ছাড়ানোর জন্যও থামি নি৷ একটানা হাটতে থাকি।মনে ভয় সৃষ্টি করা এডভেঞ্চারাস বুনো একটা পথ পেরিয়ে আমরা পাড়ায় আসি। এসে নিচে থেকে সবাই প্রথমে জোক ছাড়াই। ফুয়াদ ভাইয়ের মোজা খুললে দেখা যায় তার পায়ে অনেকগুলো জোক বসা এবং পা রক্তাক্ত। সেগুলো ছাড়িয়ে আমরা ভেজা কাপড়সহ ই খেতে বসি। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় আমাদেরকে সেখানে সবাই থেকে যেতে বলে। কিন্তু আমাদের পরদিন ঢাকার উদ্দেশ্যে ফিরতে হবে যেটা ঐ পাড়ায় থাকলে অসম্ভব। অর্থাৎ আমাদের সেদিন রাতেই থাইক্ষং পাড়ায় ফিরতে হবে। আমরা প্রায় সাতটা নাগাদ বেড়িয়ে গেলাম লুংথাউসিহ পাড়া থেকে।
লুংথাউসিহ পাড়াটা ভীষণ সুন্দর। পাড়ার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে মানুষগুলো। খুবই আন্তরিক ও অমায়িক। ঝর্না দেখে ফিরে এসে আমরা যে ঘরটায় ভাত খাই সেই ঘরের দাদা ও দিদি এত ভালো যে তাদের মায়ায় না পড়ে কোনো উপায় নাই। যখন ভেজা কাপড় নিয়ে খেতে বসি দিদি গায়ে হাত দিয়ে দ্যাখে কাপড় চোপর সব ভেজা। এবং মুখভঙ্গি দেখেই বোঝা গিয়েছিলো যে সহানুভূতি দেখাচ্ছিলো। বাংলা বলতে না পারায় কি বলেছিলো বুঝিনি। এর পরে একটু আধটু করে কথা বলতে চাইলেও ঠিক বুঝিনি কি বললো। তাদের ঘর থেকে নামার সময় আবারও আমাকে কিছু একটা বললে আমাদের গাইড দাদাকে জিজ্ঞেস করলাম কি বললো। গাইড দাদা ও দিদির ছেলে দুজনেই বললো দিদি বলেছে “তোমার মুখটা খুব হাসি হাসি”। তাদের বললাম দিদিকে বুঝিয়ে বলতে “দিদি অনেক ভালো”। আসতেই ইচ্ছা করতেছিলো না।
মাসুম ভাইয়েরও পাড়া ও পাড়া বাসিদের খুব ভালো লেগেছিলো। আমরা দুইজনেই বলেতেছিলাম যদি কোনোভাবেও থাকার কোনো উপায় থাকতো আমরা থেকে যেতাম। ফিরার জন্য দোকানে এসে মাসুম ভাই বললো যাদের সাথে কথা হলো তদের নামটা জেনে যাওয়া উচিত। দোকানদারের সাথে কথা বলে তাদের নাম জেনে নিলাম। দোকানদারের নাম আনুয়াম, দাদার নাম লালরুয়াত খুম, দিদির নাম প্রিয়াংময় (নামটা ভীষণ সুন্দর ঠিক দিদির মত), যাকে নিয়ে ঝর্না দেখতে গিয়েছিলাম ওর নাম ফ্রান্সিস লিয়ান খুব সম্ভবত ও দাদা ও দিদির ছেলে। দাদার এক ছেলে ঢাকায় চাকরি করে। প্রথমে মাসুম ভাইয়ের এবং পরে আমার ফোন নম্বর রেখেছে। দাদাও খুব ভালো তবে আমি দিদির প্রেমে পরেছিলাম। কি অমায়িক! সবগুলো মানুষ ই অনেক বেশি ভালো।
আমাদের যেই প্লান টা ক্যান্সেল হয়েছিলো সেটাতে এই পাড়াতে থাকার কথা ছিলো। এখানে গিয়ে থেকে তারপর ঝর্না দেখা হতো। কিন্তু সেটা না হওয়াতে এই পাড়াটা আসলে আমরা যাত্রা পথে ক্রস করেছিলাম। এই পাড়াতে থাকার খুব শখ। প্রথমবার বান্দরবান গিয়ে আমার উদ্যমী জাদিপাই পাড়াতে থাকার ইচ্ছা জেগেছিলো যেটা হয়নি। আর এইবারে এই পাড়াটাতে থাকতে না পাড়ার একটা কষ্ট নিয়ে ফিরে এসেছি। যদি কখনোও কোনোদিনও থাকা না হয় তাহলে আজীবন এই আক্ষেপটা থেকে যাবে।
আমরা রাতের বেলা পথ চলতে লাগলাম। আমাদের গাইড দাদার সাথে লুংথাউসিহ পাড়া থেকে আরো একজন দাদাও যোগ হলো থাইক্ষং পাড়া আসার জন্য৷ ঝোপ ঝাড় পেরিয়ে খোলা আকাশের নিচে আসলাম। আকাশ পরিষ্কার, ঝলমলে একটা সুন্দর চাঁদ আমাদের সঙ্গ দিচ্ছিলো। চাঁদের উজ্জল আলোতে হেড ল্যাম্প এর দরকার পরলো না। সম্পূর্ন শরীর ভেজা, পাহাড়ের চড়াই-উৎরাই পার হওয়ার জন্য চলতি পথে সেভাবে ঠান্ডা না লাগলেও বিশ্রাম নিলে শীতে কাঁপুনি ওঠার জোগার। কিছুক্ষণ পরপর আমরা বিশ্রাম নিলাম। একটা জুমঘরের সাথের মাচাং এ বসে বিশ্রাম নিতে গিয়ে রুম্পা আপু সেখানে ঘুমিয়ে গেলো। তাকে দেখে আমরা সকলেই ছোট্ট একটুখানি ঘুম দিয়ে নেই। সেখান থেকে আবার হাটতে থাকি।
এবারে আমাদের পার হতে হবে সুংসাং পাড়া। পাড়ার কাছাকাছি এসে আমাদেরকে বেশ ভালোভাবে গাইড দাদা ও তার সাথের জন সাবধান করে দিলো। একেবারে শব্দহীনভাবে পার হতে হবে। যাওয়ার সময় পাড়াটার পাশ কাটিয়ে গিয়েছিলাম এবং এখন যেতে হবে এটার ওপর দিয়ে। অনেক বড়, সুন্দর, গোছানো এবং উন্নত একটি পাড়া। রাতের বেলা নিঃশব্দে একটানা দ্রুত হেটে পার হতেও আমাদের প্রায় আট থেকে দশ মিনিটের মত সময় লেগেছিলো। হাটার সময় নিজের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ টাকেও মনে হচ্ছিলো যেনো বেশি জোরে শোনা যাচ্ছে। জীবনে কখনো এই পাড়ায় থাকার সুযোগ পেলে নিঃসন্দেহে আনন্দে আত্মহারা হবো।
এবারে সামনেই থাইক্ষং পাড়া। হাত, পা, শরীর সব ব্যাথা। এনার্জি শূন্যের কোঠায়। কথা বলার ও এনার্জি পাচ্ছিলাম না৷ ঝকঝকে চাঁদের আলোয় যে যে যার যার মত করে চলতেছিলাম। আমি খুব পিছিয়ে পরতেছিলাম। সবাই আগে ছিলো এবং পিছনে আরিফ ছিলো আমার সাথে। থাইক্ষং পাড়ার আগের ছোট্ট সে ঝিরিতে এসে আরিফ বলেছিলো কাছেই পাড়া একটু হাটলেই বেশি সময় লাগবে না। আমার তখন পা চলে না অবস্থা। হাটতে বেশ কষ্ট হওয়ায় আমি ধীর গতিতেই চললাম। আস্তে আস্তে পাড়ায় ঢুকলাম। ঢুকেই দেখি জাদিপাই এর টিমের বেশ কিছু মানুষ সেখানে আড্ডা দিচ্ছে এবং অবশ্যই আমাদের জন্য চিন্তা করছিলো কারণ পাড়ায় ঢুকতে আমাদের প্রায় রাত বারোটার পর হয়েছিলো। সেখানে সবাই উল্লাসের সাথে আমাদের দিকে আসলে মনে হয়েছিলো কিছু একটা জয় করে ফিরেছি। এই মানুষগুলোর মধ্যে কি যে মায়া ছিলো!
ছবি আমাকে নিয়ে যেখানে আমরা থাকবো সেখানে যেতে লাগলো। মাঝপথে একটা কলতলায় ফ্রেশ হয়ে নিলাম। তারপর শুনলাম ছবিরাও খুব আনন্দ করেছিলো সেই দিনটায়। তুলনামুলক ছোট ট্টেইল হলেও ওরা উপভোগ করতে করতে গিয়ে এসে বেশ সময় লাগিয়েছিলো। এবং পূর্নিমার আলোয় জ্যোৎসনাস্ন্যান করতে করতে ওরা ট্রেইল ধরে পাড়ায় ফিরেছিলো। তারপরে রান্নাবান্না সেরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতেছিলো।
খেতে বসলে আরিফের সাথে সামান্য কারনে হয়ে গেলো এক দফায় ঝগড়া। খাবার ফেলে ঘুমাতে চলে গেলে আরিফ ও ইফতি মানাতে গিয়ে জোর করে আবার উঠিয়ে নিয়ে আসে গল্প করার জন্য। কিন্তু অনেক ক্লান্ত থাকার ফলে গল্প জমে উঠলো না। এবং সবাই ঘুমাতে চলে গেলাম।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে সবাই এই কয়েক দিনের যাত্রায় বেশ ক্লান্ত। ঘুম থেকে উঠেই ইফতিকে নিয়ে পাড়ার দোকানে একটা ঢু মেরে আসলাম। একে একে সবাই ফ্রেশ হয়ে, খেয়ে, রেডি হতে ব্যস্ত। ছবি, শাম্মি, জেবা, জান্নাত, আখি ওরা সবাই যেই ঘরটায় ছিলাম সেটার জানালা দিয়ে ফুল সহ ছবি তুলে নিলো। ওদের দেখাদেখি আমিও তুললাম। ধীরে ধীরে আমরা পাড়া ছেড়ে বের হলাম। আরিফকে আগেই বলেছিলাম ও সবার সাথে আগে আগে যাক। আমি ইফতিকে নিয়ে পেছন পেছন আসি। এতে করে সুবিধা হলো মন মতো ছবি তোলা যাবে কোনো ঝামেলা ছাড়াই। কথাগুলো আরিফকে বুঝিয়ে বলার পরেও ওয়াই জংশনে গিয়ে বিপত্তিটা বাধে।
থাইক্ষং পাড়ার ওয়াই জংশনে আমি এর আগেও একবার গিয়েছিলাম। ভাঙাচোরা একটা ছাউনি ছিলো, জোকও ছিলো অনেক। মেঘের কারনে চারপাশে খুব বেশি দেখা যায়নি। এবারে গিয়ে দেখলাম বেশ সুন্দর একটি ছাউনি করা হয়েছে। জোকের প্রকোপ দেখলাম না। এবং রৌদ্রজ্বল ঝলমলে আকাশ থাকায় সেখানে বেশ মনোরম দৃশ্য। ইচ্ছা ছিলো ছাউনিটাকে নিয়ে সুন্দর একটা ছবি তুলবো। সবাইমিলে সেখানে গ্রুপ সেলফি তুলে নেওয়ার পর যার য়ার মত করে ছবি তুলে নিলো। ভিতরে বসে আমিও তুললাম। সেখানেই আরিফকে বললাম সবাইকে নিয়ে চলে যেতে আমি ইফতিকে নিয়ে পরে আসি। আরিফ তখন বেশ রাগান্বিত স্বরে বললো “এই মামা তুমি আগে আগে যাবা না কেনো? তুমি কি ফাস্ট ট্রেক করো? তুমি তো অনেক স্লো?”
ব্যস, মেজাজ আমার তখনই সপ্তমে। একা একা একটানা হাটা দেই। থাইক্ষং টু বাকলাই এর রাস্তাটা এই নিয়ে দুইবার যাই। দুইবারই একটানা হেটে চলে যাই প্রথমবার রাতেরবেলা বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ভয়ের কারনে আর দ্বিতীয়বার ঝগড়া করে মুড অফ করে । রাস্তায় ইফতি নানা ভাবে সাপোর্ট দিতে চায়। কিন্তু আমি নেই নি। মানাতে চায় বারবার। ওদের কারো সাথে বিশেষ করে আরিফের সাথে তো কথাই বলি নাই। বিশ্রাম নিতে বসে আরিফের দেওয়া চকলেট গুলো নিজে না খেয়ে সব অন্যদেরকে দিয়ে দেই৷ আরিফও আসে কয়েকবার মানানোর জন্য আমি কথা বলি না।
আগেরবার আমি বাকত্লাই ঝর্নায় যাই নাই। আরিফের সাথে ঝগড়া করে আসতে আসতে এইবারও যাবো না যাবো না বলেই পুরো রাস্তা কাটিয়েছি। এবং যতবার বলেছি যাবো না ততবার ইফতি আর আরিফ বলেছে যেতেই হবে। ওরা আমাকে নিয়েই যাবে। এরপরে যখন আমরা মাচাং ঘরে আসলাম তখন ব্যাপারটা এমন যে আমি যাবো না আর ওরা রেখে যাবে না। এমনটা চলতে চলতে শান্তশিষ্ট ভদ্র ও ছবির মত সুন্দর মেয়েটা (ছবি) গো ধরলো ঠিক এই বলে “তুই না গেলে আমিও যাবো না। এরপরেও না গেলে দেখবি আমি কি করি।” একটি শীতল ধারার এমন উত্তাল রুপ দেখে আমি ঝর্নার জন্য নিচে নামা শুরু করলাম। একেবারে খাড়াভাবে নামতে হয়। আবারও সবাই নামতে নামতে ক্লান্ত। এক পর্যায়ে পেয়ে গেলাম আমরা বাকত্লাই ঝর্না।
তর্ক সাপেক্ষে এটা বাংলাদেশের সর্ব উচু ঝর্না৷ আমি বরং তর্কের দিকে না যাই। সর্বোচ্চ না হলেও দ্বিতীয় উচু ঝর্নাও হতে পারে। সেটাই বা কম কিসের।
যেতে যেতে মাসুম ভাই বলেছিলো পানি পাওয়া যাবে না। এই ঝর্নায় পানি পেতে নাকি ভরা বর্ষা লাগে। যেবারে আমি মিস করেছি ওদের থেকে শুনেছি সেবার নাকি বেশ ভালো পানি ছিলো।
এবং ঝর্নার কাছে গিয়ে প্রথমে যারপরনাই হতাশ। কিন্তু এরপরে ভালোই লেগেছিলো। আমার মনে হয় ঝর্নায় অতিরিক্ত পানি থাকলে আমি উপভোগ করতে পারি কম। এখানে বেশ কিছুক্ষন বসেছিলাম আমি আর ছবি। সবার ঝর্নায় ভেজার উছলে পরা আনন্দ দেখতেছিলাম। এরপরে ঝটপট ছবি তুলেই ফিরার জন্য উঠতে থাকি। এমনকি সেখানেও শাড়ি পরেছিলাম ছবি তোলার জন্য। সেদিন একমাত্র ফটোগ্রাফার ছিলো মাসুম ভাই। বেশ খানিকটা নিচে গিয়ে সেখান থেকে সবার ছবি তুলে দিচ্ছিলো।
ঝর্না থেকে আমরা কিছু মানুষ আগে আগে ফিরতে লাগলাম। এসে বাক্তলাই পাড়ায় উঠলাম। প্রথমবার এখানে সুন্দর একটি সকাল কাটিয়েছিলাম। আর্মি চলে আসায় শ্বাসরুদ্ধকর কিছু সময় পার করেছিলাম।সেবার পাড়াটা পছন্দ হয়নি। তবে এবার খুব একটা খারাপ লাগেনি।সেখানে দেখি আমার প্রথম ট্যুরের গাইড দাদাকে। সে গাছ থেকে বেশ কিছু কাঁচা তেতুল পেরে দিলো। সেগুলো নিয়ে ফিরতে লাগলাম এবং রাস্তায় বের হয়ে জীপে চড়ে বসলাম।
একঝাক নতুন মানুষের সাথে মেশা হয়েছিলো মুগ্ধকর এক প্রকৃতিতে। মনের কোনে তৈরি হয়েছিলো সুন্দর অনুভুতির এক রচনাগাথা। এদের সাথে আমার দেখা হোক, কথা হোক। মনে পরুক কত অমলিন সুন্দর সময় কাটিয়েছিলাম আমরা।
আট জনের আরিফের টিম ও মাসুম ভাইয়ের টিম একই রুটে একই সাথে যাবে। আরামবাগ বাস কাউন্টারেই সবার সাথে দেখা। এরপরে পথচলা। বান্দরবান গিয়ে দেখি ইফতির সাথে রাহাত। এই পর্যন্ত তিনবার বান্দরবান গিয়েছি। প্রতিবার বান্দরবান শহর থেকে পুরাতন একজনের সাথে নতুন একজন চাটগাঁইয়া কে পেয়েছি। যারা পরবর্তীতে আমাকে এটা ভাবতে বাধ্য করে “আরেহ, এই চট্টগ্রামের এর মানুষগুলা তো জোশ হয়”। সবচেয়ে কিউট লাগে ওদের একটু চাটগাঁইয়া সুরে আমাদের সাথে কথা বলা টা। রাহাত ছেলেটাও কেয়ারিং। তারপি তারতে যেদিন দেখলাম বেশ কয়েকবার আমার ব্যাগ ক্যারি করতে চেয়েছিলো। আর বার বার জিজ্ঞেস করেছিলো “আপু, কষ্ট হচ্ছে না তো?”। ঢাকায় ফিরে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন ধরতেই দেখি রাহাত। ঠিক মত এসেছি কিনা সেজন্য ফোন দিয়েছে। এই টিমে কয়েকজন বাদে সবাই আমার ছোটোই হবে। মেয়েগুলো এত প্রানোচ্ছল যে পুরো ট্রিপ জুরে ওদের জন্য একটা এনার্জেটিক ভাইব পাওয়া গেছে। এই পিচ্চি মেয়েগুলো হেটেছে, উপভোগ করেছে,রান্নাঘরে সাহায্য করেছে, হাসি, ঠাট্টা, দুষ্টামিতে মাতিয়ে রেখেছে। সকলেরই সেন্স অফ হিউমার ভালো ছিলো। সকলেরই একুশজনের টিম ছিলো। কারো আট জন কিংবা কারো তেরো জনের না। শাম্মি, জেবা জান্নাত এর আপু আপু করে ডাকাটা ভাবলেই ভালো লাগে। রুম্পা আপুর মধ্যে একটা কেয়ারিং মনোভাব ছিলো সবসময়। মেয়েগুলো সবসময় খুব প্রানবন্ত ছিলো। টিমের প্রত্যেকে একে অন্যকে কোনো না কোনো ভাবে ভালো অনুভুতি দিয়েছিলো।
Leave a Comment