তাজিংডং – বিভীষিকাময় জোকের পাহাড়

ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি তাজিংডং (Tazing Dong) নাকি বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় কিন্তু এর ভয়াবহতা সম্পর্কে তেমন কিছু কখনোই জানা হয়নি। সত্যি বলতে ছোটবেলা থেকেই প্রহর গুনতাম আমিও একদিন তাজিংডং এর চূড়ায় ওঠব। তাই নাফাখুম, আমিয়াখুম আমাকে যতটা না টানত, আকৃষ্ট করত তারচেয়ে বেশি টানত এই তাজিংডং। আর ফেসবুকে ইন্টারনেটে নাফাখুম, আমিয়াখুম, ক্রাইক্ষং ঝর্ণার ছবি দেখে এসব জায়গারও প্রেমে পড়ে যাই।

তাই অনেকদিন ধরে ভাবতে ছিলাম বান্দরবনের গহীনের এসব জায়গা যদি এক ট্রিপে ঘুরতে পারতাম। ফাইনালি সবকিছু ম্যানেজ হল আমার প্রিয় এক বড় ভাই ফয়েজ ভাইয়ের সাহায্যে। তারপর ধারাবাহিকভাবে রেমাক্রি ফলস্, নাফাখুম, ক্রাইক্ষং ঝর্ণা, আমিয়াখুম এসব জায়গা সব ঘুরে জিন্নাপাড়ায় বসে যখন তাজিংডংয়ের কথা চিন্তা করতেছিলাম তখন আমাদের সবারই শরীর, মন উভয় ক্লান্ত। তবুও সবার মুখেই একটাই কথা ছিল যে করেই হোক আমরা তাজিংডং এ যাবই।

পরদিন সকালে খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে জিন্নাপাড়ায় সকালে ভাত, ডিম, সবজি দিয়ে নাস্তা করে বেড়িয়ে পড়লাম তাজিংডং এর উদ্দেশ্যে। কিছু দূর যাওয়ার পর পাহাড়ি উঁচুনিচু পথ শেষ তারপর শুরু হল নদীপথ। এভাবে পাহাড়ি নদীপথে ৩ ঘন্টা হাটার পর একটা জায়গায় এসে আমরা সবাই থামলাম। নদীপথে আর সামনে যাওয়া যাবে না। এখান থেকে আবার পাহাড়ে ওঠতে হবে। আমরা যখন সবাই ঐখান বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম তখন আমাদের গাইড ক্লিমেনদা সবাইকে হাত পায়ে গুল লাগিয়ে দিচ্ছিল এবং বলতে ছিল ভালো ভাবে যেন হাতে পায়ে এংলেট লাগিয়ে নেই। তখনও বুজতে পারতেছিলাম না সামনে কি অপেক্ষা করতেছে। তারপর যখন একটা বাশের দেওয়াল টপকিয়ে পাহাড়ে ওঠলাম সাথে সাথে আশেপাশে কিছু একটার উপস্থিতি টের পেলাম।

শেরকর পাড়া

হাতে পায়ে, ট্রেকিং এর লাটিতে যেদিকেই তাকাই শুধু জোক আর জোক। এত রং বেরঙ্গের জোক জীবনে কখনো দেখি নাই। সবাই চিৎকার চেচাঁমেচি শুরু করলাম। যে যার মত দৌড়াতে শুরু করল। জোকের জন্য কোথাও দাড়ানোই যাচ্ছিলো না। কারন আমরা সবাই জোক দেখে অভস্ত হলে জোকের স্বর্গরাজ্য দেখে কেউই বা অভ্যস্ত ছিলাম না । রাস্তা ও খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের গাইড আগে থেকে রাস্তা ঝাড়ঝোপ পরিষ্কার করে দিচ্ছে তারপর আমরা সামনের দিকে এগোচ্ছি। এভাবে ঘন্টাখানেক হাটার পর আবার ঝিরিপথের রাস্তায় ফিরে আসলাম। এসে দেখি সবাই রক্তাক্ত। সবাই যে যার মত জোক সাড়ানোর কাজে ব্যস্ত, কেউ বা একে অন্যকে সাহায্য করছে। তারপর ঝিরিপথের রাস্তা শেষ করে একটা আধিবাসীদের পাড়ার এসে থামলাম, এখান পেটপুরে পাহাড়ি শসা, পেপে এবং সাথে রাখা খেজুর খেয়ে নিলাম।

অভিযাত্রী

তারপর আবার ট্রেকিং শুরু করলাম। এদিক দিয়ে রাস্তায় জোক না থাকলেও রাস্তা প্রচন্ড খাড়া। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে আমাদের এই টিমে ৩ জন মেয়েও ছিল। আমরা ছেলেরাই যেখানে রীতিমতো হাঁপিয়ে ওঠছিলাম সেখানে মেয়েরাও সমানতালে আমাদের সাথে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পর কিছু পাহাড়ি গয়ালের দেখা পেলাম। প্রথমে ভয় পেয়ে গেছিলাম। যদিও পরে আমাদের গাইড আর্শস্ত করল যে, এগুলো হিংস্র নয় গৃহপালিত। তারপর এভাবে হাটতে হাটতে একসময়এসে পৌছালাম আদিবাসীদের আরেকটি পাড়া শেরকর পাড়াতে। তখন প্রায় বিকাল ৪ টা বাজে। এখান থেকে তাজিংডং এর চূড়া স্পষ্ট দেখা যায়। কারোরই পেটে কোন খাবার নাই। আগামীকাল আমাদের বাসের টিকেট করা ছিল,আর শেরকর পাড়া থেকে থানচি যেতেই মিনিমাম ৬-৭ ঘন্টা লাগে। তাই সবাই বসে একযোগে মনস্থির করলাম যে করেই হোক আজ আমাদের তাজিংডং এর চূড়ায় ওঠতেই হবে।

পাহাড়ি গয়াল

যেই কথা সেই কাজ। শুরু হল আবার ট্রেকিং। এখন কারোর শরীরেই কোন শক্তি নেই যার করতেছি তা সম্পূর্ন মনের জোড়ে। মানে শরীরকে মনের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছি। কিছুদুর যাওয়ার পর শুরু হল জুম খেতের মধ্য দিয়ে রাস্তা। এদিকেও প্রচুর জোক আছে কিন্তু জোক যেটা শরীরে ওঠছে সাথে সাথেই লাটি দিয়ে সাড়িয়ে নিচ্ছি। একটু পর পর একে অপরকে জোক আছে কিনা চেক করতে বলতেছি। অতঃপর প্রায় সন্ধ্যা নাগাত আমরা সবাই তাজিংডং এর চূড়ায়।

যখন চূড়ায় ওঠলাম চারপাশের সবকিছু সাদা মেঘে ঢেকে গেছে। সমস্তদিনের হাড়ভাঙা খাটুনি নিমিষে দুর হয়ে গেল। এটা ছিল আমার ছোটবেলার লালিত স্বপ্ন, আমি আমার স্বপ্নের পাহাড়ে দাড়িয়ে আছি। সবার দুয়েকটা ছবি তুলার বেশি সময় আর এখানে দেরি করা যাবে না। সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে আসছে। তারপর আস্তে আস্তে সবাই নিচে নেমে আসলাম। চারপাশের সব অন্ধকার মোবাইলের টসলাইট অন করে শেরকর পাড়ার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। এখন কারোরই কোন জোক সাড়ানোর ইচ্ছা নাই, সবার একটাই উদ্দেশ্যে যে করেই হোক শেরকর পাড়ায় পৌছাতে হবে আর জোক যত পারুক কামড়াক। অতঃপর আমরা যখন শেরকর পাড়ায় পৌঁছালাম তখন রাত প্রায় ৮ টা বাজে।সবাই প্রায় অসুস্থ। তারপর কোনরকমে খেয়েদেয়ে ঘুম। আগামীকাল আবার ৭ ঘন্টা হাটতে হবে।

নাফাখুম,আমিয়াখুমের গল্প আরেকদিন বলব আজ এই পর্যন্তই।

বিদ্রঃ পাহাড়িদের সাথে ভালো ব্যবহার করুন। এই কয়েকটা দিনে আমি ওনাদের আত্মার আত্নীয় হয়ে গেছি। আর যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা,পানির বোতল,চিপসের প্যাকেট ইত্যাদি ফেলা থেকে বিরত থাকুন।
Leave a Comment
Share