সাজেক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা – যেখানে মেঘ এসে ছুয়ে দিয়ে যায়

কল্পনা করুন তো, আপনি ১৮০০ ফুট উচু একটা পাহাড়ে দাড়িয়ে আছেন। চারপাশ দিয়ে মেঘ বয়ে চলেছে। মেঘের আড়ালে খানিক দূরের বস্তুও আপনি দেখতে পাচ্ছেন না।  মাঝেমাঝে খুব কাছে এসে মেঘ গুলো ছুয়ে দিয়ে আপনার শিহরণ বাড়িয়ে দিচ্ছে….

ঢাকা থেকে রাত ১০ টায় শান্তি পরিবহণের বাসে চড়ে আমাদের যাত্রাটা শুরু হয়, উদ্দেশ্য – সাজেক। যেই সাজেকের গল্প এতোদিন শুধু লোকমুখে শুনেই এসেছি, এবার সেই স্বপ্ন সত্যি হবার পালা। শান্তির বাস আমাদের খুব ভোরে নামিয়ে দেয় ‘দীঘিনালা’। আমরা পুরো গ্রুপে ছিলাম টোটাল ৩৪ জন। ওখানে নেমে আমরা নাস্তা করে নেই। তারপরে আগে থেকে ঠিক করে রাখা চাদের গাড়িতে করে রওনা দেই মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যেতে।

সাজেকের হ্যালিপ্যাড থেকে মেঘ দেখার দৃশ্য

১ম দিন

সাজেক যাওয়ার পথে হাতের বামে একটা ঝর্ণা আছে। ঝর্ণাটার নাম ‘হাজাছড়া‘ ঝর্ণা এই ঝর্ণাটা দেখার জন্যে বাস থেকে নেমে আমরা একটা মুহূর্তও দেরি করিনি। কোনো রকমে নাস্তা করেই রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে ঝর্ণাটা আমরা দেখতে পারি নি। নিরাপত্তা জনিত কারণে সেনাবাহিনী অনুমতি দেয় নি।

যাই হোক, আমাদের গাড়ি খাগড়াছড়ির পাহাড়ি ভূমি পারি দিয়ে সামনে এগুতে লাগলো। সকাল ৯ টার দিকে আমরা পৌছালাম দীঘিনালা সেনানিবাসে। এখান থেকেই ১০.৩০ এ আর্মি এস্কর্ট ছাড়বে। আর্মি এস্কর্ট সম্পর্কে কিছু বলে নেই। এই এস্কর্ট দিনে দুইবার ছাড়ে। একটা সকাল ১০.৩০ এ, অন্যটা বিকেল ৩ টায়। সকল টুরিস্টদের গাড়িকে একত্র করে সামনে আর পিছনে আর্মি পাহাড়া দিয়ে গাড়ি গুলোকে সাজেক নিয়ে যায়। কোনো ভাবে যদি এস্কর্ট মিস করেন তাহলে কিন্তু বাশ খাবেন। আমাদের একটা গ্রুপ ফিরার পথে এস্কর্ট মিস করে, যার জন্যে আমরা বাশ খাই, একথায় পরে আসছি।

দীঘিনালার পর থেকেই গাড়ি খাগড়াছড়ি ছাড়িয়ে প্রবেশ করলো রাঙ্গামাটি জেলায়। আর তার সাথে সাথেই শুরু হলো পাহাড়ের অপূর্ব সৌন্দর্য। চারপাশে সারি সারি পাহাড়! দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ আর সবুজ। মাঝেমাঝে ওই দূরে কিছু ছোট ছোট জুম ঘর চোখে পরে। উচু নিচু পাহাড়ের মাঝে সাপের মতো একেবেকে চলা রাস্তাতে আমাদের গাড়ি সামনে এগুতে লাগলো। এই দূর্গম এলাকাতেও পাহাড়ের মাঝে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে গাড়ি চলাচলের জন্যে রাস্তা তৈরি করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী :-)। পথে চলতে চলতে দুপাশে চোখে পরলো পাহাড়িদের বাড়িঘর। দুপাশে ছোট ছোট বাচ্চারা হাসিমুখে দাড়িয়ে ছিলো চকলেটের জন্যে। এভাবে চলতে চলতে আমরা পৌছালাম ‘মাসালং বাজার’ আর্মি ক্যাম্পে। এখানে এসে সব গুলো গাড়ি একত্রে জমা হয়। তারপরে আবার যাত্রা শুরু। দীঘিনালা থেকে সাজেক পৌছাতে প্রায় দুই ঘন্টার মতো সময় লাগলো। আমরা যখন সাজেকে পৌছালাম তখন ঝুম বৃষ্টি বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ব্যাগ নিয়ে দৌড় দিলাম আমাদের জন্যে আগে থেকেই রিজার্ভ করে রাখা রিসোর্ট – ‘নগরাই নক’ এ।

রিসোর্টে পৌছে আমরা শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হলাম। ওখানের পানিটা কেমন যেনো! সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার পরেও মনে হচ্ছিলো হাতে বোধহয় আরো সাবান রয়ে গেছে। পাহাড়ে পানির খুুবই সংকট। আপনারা যারা পাহাড়ে যাবেন চেষ্টা করবেন একটা বিন্দুও পানি অপচয় না করতে কেননা এই পানি গুলো খুব কষ্ট করে আনা হয় (কোনো জায়গাতেই পানি অপচয় করা উচিত না)। যাই হোক, দুপুরের খাওয়া শেষ করে রিসোর্টের বারান্দায় গিয়ে বসলাম। বসেই আমি হতবাক!! মাই গড!! এতো দেখি সত্যি সত্যি মেঘ!! এতোকাল শুধু ট্রাভেল গ্রুপ গুলোতে রিভিউ পরে এসেছি। মেঘ যে সত্যিই এভাবে জমাট বেধে থাকে তা ছিলো আমার কল্পনারও অতীত ছিলো। সাজেকের প্রায় সব গুলো রিসোর্ট থেকেই এই ভয়াবহ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। যতদূর চোখ যায় শুধু দিগন্ত বিস্তৃত সারি সারি পাহাড় আর পাহাড়। আর তার মাঝে মাঝে জমে আছে সাদা মেঘের ভেলা! এ যে কত সুন্দর যে সামনাসামনি না দেখেছে সে কোনোদিনই অনুভব করতে পারবে না। মনে হচ্ছিলো যে, এই দৃশ্যটা আজীবন দেখলেও দেখবার স্বাদ মিটবে না!

নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা

সবাই বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীনের এই অপূর্ব সৃষ্টি উপভোগ করলাম। বিকেল বেলা রোদটা একটু ধরে এলে হ্যালিপ্যাডে গেলাম সূর্যাস্ত দেখতে। পুরো পার্বত্য চট্রগ্রামে এরিয়া বাংলাদেশ আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সাজেকও তার ব্যতিক্রম না। সাজেকে সেনাবাহিনীর ব্যবহার করার জন্যে দুইটা হ্যালিপ্যাড আছে। দুটো প্যাড থেকেই ওই বিশাল আকাশের অপূর্ব ভিউ পাওয়া যায়।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলো পরে সবাই তখন আড্ডা দিতে ব্যস্ত। আমি একা একা বের হলাম রাতের সাজেক দেখতে। একটা সিটির সত্যিকারের সৌন্দর্য ফুটে উঠে রাতের বেলা তার বাজারের মধ্যে। রাতের আকাশে শত সহস্র নক্ষত্রকে বন্ধু করে আমি একা একা হাটতে লাগলাম সাজেকের এ মাথা থেকে ও মাথা। মাঝে চেখে দেখলাম পাহাড়ি ডাব, বাশ কোরাল আর উপজাতীদের ক্যাফেতে বানানো গরম কফি। আরেকটু রাত বারতেই সবাই ডিনার করে নিলাম। আমাদের একটা গ্রুপ তখন গানের আসরে ব্যস্ত। আর আমাদের রুম তখন ঘুমে আচ্ছন্ন। আলো ফোটার আগেই উঠতে হবে। একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য দেখবো কাল সকালে….

২য় দিন

ভোর ৪.৩০, পূব আকাশে হালকা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। সমগ্র আকাশ আলোর বর্ণিল ছটায় উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে! যেনো কিসের এর আগমনের প্রতিক্ষায়…

খুব দ্রুতই রেডি হয়ে আমরা বের হয়ে গেলাম হ্যালিপ্যাডের উদ্দেশ্যে। আকাশের রং তখন ধীরে ধীরে আরো উজ্জ্বল হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিকট আকাশের নির্দিষ্ট একটা অংশ অধিকতর উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগলো। আমাদের অপেক্ষার প্রহর বারতে লাগলো। আর তার পরপরই উদয় হলো সূর্যের। হাজার হাজার বছরের পুরোনো সেই সূর্য! শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যা কিনা প্রতিদিনই এভাবে প্রবল দম্ভে হাজির হচ্ছে সবুজ এই পৃথিবীর দুয়ারে। এতো কাছ থেকে জীবনে এই প্রথমবারের মতো দেখা!

সূর্য উঠছে

হ্যালিপ্যাড থেকে সূর্যদয় দেখার পরে আমরা মোট ১১ জন রওনা হলাম সাজেক ভ্যালিক সর্বোচ্চ চূড়ায় – ‘কংলাক পাহাড়’। এই পাহাড়টা আমার কাছে কিছুটা রহস্যঘনই মনে হলো। এর উচ্চতা সমতল থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট উপরে। পাহাড়টায় চড়ার ট্রেইলটা মোটামুটি সহজই, যদিও ৩০-৪০  মিনিটের মতো লাগবে। এতো উচু পাহাড়ের মধ্যেও মানুষের বসবাস। এখানে কয়েক শত বছর ধরে (তাদের ভাষ্যমতে) বসবাস করে আসছে ‘লুসাই’ আর ‘ত্রিপুরা’ উপজাতি। স্থানীয় এক ত্রিপুরা দোকারদারের সাথে অনেকক্ষণ আলাপ আলোচনা করলাম। কাছ থেকে ঘুরে ঘুরে দেখলাম তাদের জীবনযাপন, পরিবেশ, সংস্কৃতি!! সবাই তখন ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমি পুরোনো অভ্যেস মতো একা একা তাদের পুরো পাড়া ঘুরে দেখলাম। এই পাড়ার অর্ধেক হিন্দু আর অর্ধেক খ্রীস্টান। ওখানে একটা খ্রীস্টান গীর্জা আর কবরস্থান আছে।

কংলাকে কেনো যেনো বেশিক্ষণ মন টিকলো না। কেমন যেনো একটা বিদঘুটে গন্ধ ছিলো চারিদিকে। কংলাকের একপাশে একটা পুলিশ ক্যাম্প আছে। ওখান থেকে ভারতের মিজোরাম রাজ্যের পাহাড় গুলো স্পষ্ট দেখা যায়। তবে কংলাকে উঠতে পারলে আপনি একদম তরতাজা মেঘের স্পর্শ পাবেন। সাজেকের থেকেও বেশি বাতাস এখানে। চোখের সামনে দিয়ে মেঘ গুলো তাদের শীতল হাত বাড়িয়ে ছুয়ে যাচ্ছিলো আমাদের! আহা! জীবনটা ভারী সুন্দর।

কংলাক থেকে নামার পথে একটা দোকান থেকে পাহাড়ি কলা কিনে খেলাম। ছোট ছোট ১ জোড়া কলা ১০ টাকা, খুবই মিষ্টি। রুমে যখন ফিরলাম তখন সূর্য প্রায় মাথার উপরে। সকালের নাস্তা করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। একটু পরেই শুরু হবে আরেকটা ট্রেকিং – ‘কমলক ঝর্ণা’।

এই ঝর্ণাটার আরেক নাম ‘পিদাম তৈসা’ ঝর্ণা। কেউ কেউ আবার ‘লুসাই ঝর্ণা’ বলেও ডাকে। সকালে কংলাকে যাওয়ার পথে একটা বাশ কিনেছিলাম। সেটা সম্বল করেই যাত্রা শুরু করলাম। তখনও ভাবতে পারি নি যে সামনে কি আছে :/  এই ঝর্ণাটা ভূমি থেকে প্রায় ১৫০০ ফুট নীচু তে। বুঝতেই পারছেন অবস্থাটা। নামার সময় শুধু খাড়াই বেয়ে নামতেই থাকলাম। কোনো সমতলের নাম গন্ধও নেই। একদম নীচের দিকে ঢালু খাড়াই! নামছি তো নামছিই! তখন একবারও মাথায় আসে নি যে এটাতে বেয়ে উঠতে কতটুকু ভর্তা হতে হবে। যাই হোক, প্রায় ৪০ মিনিট একটানা নীচের দিকে আকাবাকা পথে নামতে নামতে ঘন সবুজের মাঝে ঝর্ণার শব্দ শুনতে পেলাম। বৃষ্টি না থাকায় ঝর্ণাতে খুব পানি ছিলো মোটামুটি। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যে ভরা বর্ষায় এর যৌবণ কতটা ফুলে ফেপে উঠে। প্রায় ঘন্টা খানিক সবাই মিলে ভিজলাম, ভিজালাম।

ওই যে ওপারের পাহাড় গুলো ভারতের মিজোরাম রাজ্যের

এবার এরপরে উঠার পালা  এর আগে আরো অনেক ট্রেইলে গিয়েছি। কিন্তু এই ট্রেইলটা সত্যিই আমাকে প্রায় ভর্তা বানিয়ে দিচ্ছিলো। ৬০-৭৫ ডিগ্রী অ্যাঙ্গেলে উপরের দিকে শুধু উঠছি তো উঠছিই! পথ যেনো আর শেষই হয় না! থেমে যে একটু বিশ্রাম নিবো সেই উপায়ও নেই। একেতো জোকের ভয়, তার উপরে ঝাকে ঝাকে পাহাড়ি মশা। আমাদের গ্রুপে অনেকেই জীবনে প্রথমবারের মতো এমন কোনো ট্রেইলে এসেছিলো। তাদের প্রত্যেকের অবস্থা ছিলো খুবই খারাপ। উঠছিলাম আর ভাবছিলাম এখানে বসবাস করা পাহাড়িদের কথা। কতটাই না কষ্ট করে তারা এখানে বসবাস করে!! অবশেষে একটা সময় এই ভয়ানক ট্রেইলও শেষ হলো। আমরা ৬/৭ জন ট্রেইল ছাড়িয়ে লোকালয়ে এসে প্রায় ২০ মিনিটের মতো বিশ্রাম নিলাম। পিছনে তখন পুরো গ্রুপ পরে রয়েছে। আমাদের রুমে ঢুকারও প্রায় ৪০ মিনিট পরে ওরা একেক জন ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাজির হয়।

দুপুরে যখন রিসোর্টের পাশের হোটেলেই খেতে বসলাম তখন বাহিরে তুমুল বৃষ্টি। কিছু স্থানীয় ছেলেপুলে মহা আনন্দে বৃষ্টির পানিতে ভিজছে। আমরা ভাগ্যবান সাজেকে প্রায় ২/৩ রকম আবহাওয়াই আমরা দেখেছি। প্রবল সংকল্প করে ফেললাম খাওয়া শেষে বৃষ্টিতে ভিজার। কিন্তু যেই না আমি মাত্র খাওয়া শেষ করলাম ওমনি বৃষ্টিও থেমে গেলো :/

রুমে ফিরে তখন কেউ আড্ডা দিচ্ছিলো, কেউবা ঘুমাচ্ছিলো। বিকেলে আবার হাটতে বের হলাম অন্য হ্যালিপ্যাডে। সাজেকে অনেক গুলো রিসোর্ট আছে। তবে আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর রিসোর্ট হচ্ছে ‘রুন্ময়’। এই রিসোর্টটা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মালিকানাধীন। মনে মনে আফসোসস হচ্ছিলো, ইশ! আজ যদি একটা অফিসারের Rank থাকতো তাহলে হয়তো এখানেই এসে উঠতাম। পরক্ষণেই আবার মন বলে উঠলো থাক, এবার হয় নি তো কি হয়েছে। পরের বার না হয় অফিসারের Rank সহ নিজের প্রিয় মানুষটার হাত ধরেই রুন্ময়ের দোলনায় দোল খাবো (ইনশাল্লাহ) 🙂

যতদিন ওখানে ছিলাম চেষ্টা করেছি সাজেকের ভিন্নধর্মী সব খাবার গুলো চেষ্ট করতে। বাশ চা খেয়েছিলাম ২ বার। সাথে পাহাড়িদের হাতে বানানো কিছু মিষ্টি আর ঝাল পিঠা। ২য় দিন রাত্রে আমরা ডিনার করলাম ‘ব্যাম্বু চিকেন’ দিয়ে। বাশের মধ্যে স্পেশাল পদ্ধতিতে মুরগী রান্না করা হয়। মারাত্নক ঝাল এই খাবারটা ভারী মুখরোচক।

বাঁশের চা, সাজেকের ইউনিক একটা আইটেম।

৩য় দিন

সাজেকে সাধারণত সবাই ১ দিনের জন্যে আসে। আমরা রিলাক্স ট্যুরে ছিলাম ২ দিন। ৩য় দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আবারও চলে গেলাম সূর্যদয় দেখতে। এবার হ্যালিপ্যাডে না উঠে তার পাশেই আর্মি ক্যাম্পের পার্কে চলে গেলাম। ২০ টাকা করে টিকেট কেটে ভিতরে গেলাম। ভিতরটা একটু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা। বেশ কয়েকটা দোলনা আছে। ওই দিন সকালে কেনো জানি মেঘ গুলো বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো। এতো সারি সারি জমাট বাধা মেঘ যে দেখতে পারবো তা আমি জীবনে কল্পনাও করি নি। ওই পার্কে সকালটা কাটিয়ে রুমে ফিরে এলাম। দ্রুত নাস্তা করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। বেরুতে হবে। সকাল ১০.৩০ এর এস্কর্টে সাজেক ছাড়বো আমরা ১১ জন। বাকিরা ফিরবে বিকেলের এস্কর্টে। আর তারপর সবাই মিলে রাতের বাসে ঢাকা ফিরবো।

রওনা দেয়ার আগে সাজেক মূল গেটের পাশেই ‘স্টোন গার্ডেনে’ প্রবেশ করলাম। এখানেও ২০ টাকা টিকেট। খুব আহামরি কিছু না। একটা কৃত্রিম ব্রীজ আর ২ টা দোলনা আছে। ছবি তোলার জন্যে অবশ্য পারফেক্ট জায়গা।

ঠিক ১০.৩০ বাজতেই গাড়ি গুলো রওনা হলো। যারা সাজেক যাবেন, তারা এই টাইমিংটা মাথায় রাখবেন। আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম পাহাড়ের ঘন সবুজে হারাতে। ফিরার পথে আমি কখনো ছিলাম চান্দের গাড়ির ছাদে, কখনো বা গাড়ির পিছনে ঝুলে ঝুলে, আবার কখনো বা ড্রাইভারের পাশের সিটে। মোট কথা আমি পুরোটা রাস্তার সৌন্দর্যই একদম কাছ থেকে অনুভব করেছি আর আপ্লুত হয়েছি আল্লাহ রব্বুল আলামিনের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে! গাড়ি এবার ব্যাপক ঢালু পথ বেয়ে নীচের দিকে নামছে। মাঝেমাঝে চোখে পরছে কিছু বিচ্ছিন্ন পাহাড়ি ঘরবাড়ি, বাজারে হুক্কা টানা অবস্থায় বসে থাকা পাহাড়ি লোকজন আরোও কত কি….!

দুপুর ১ টার দিকে দিঘীনালা পৌছে আমরা লাঞ্চ করলাম। তারপরে আরো ১ ঘন্টার রাস্তা পারি দিয়ে পৌছালাম আমার লাইফে দেখা ৫ম ঝর্ণা – ‘রিসাং’ ঝর্ণাতে! রিসাং এক অদ্ভুদ ঝর্ণা। উপর থেকে পানিটা পরছে একদম ঢালু একটা পাথুরে উপত্যকায়। বৃষ্টি ছিলো না বলে ঝর্ণায় প্রবাহ তেমন একটা ছিলো না। তবে চারপাশে পানির চিহ্ন দেখতে বুঝতে পারলাম যে এই ঝর্ণাটা পুরো পানিতে কতটা ভয়াবহ রুপ ধারণ করে। একটা কথা বলে রাখি, এই ঝর্ণাটা মারাত্নক পিচ্ছিল। একটু স্লিপ করলেই ব্যাপক জখম হওয়ার সম্ভাবনা। আমাদের মধ্যে একজন ছবি তোলার জন্যে উতলা হয়ে স্লিপি এরিয়া না দেখেই সামনে এগুতে শুরু করে। একটু পরে দেখলাম মি. বিনের মতো সে নীচের দিকে স্লাইড করে পরে যাচ্ছে। আরেক জন গোসল শেষে মুখে ফেয়ারনেস ক্রিম মেখেছিলো। এরপরে ঝর্ণার পানিতে হাত ধুতে গিয়ে সে-ও কালেমা জপতে জপতে নীচের দিকে পরে যায়। দুজনেই মারাত্নক জখম হয়েছিলো। তবে হ্যা, ঝর্ণাটা সুন্দর, খুবই সুন্দর, ভালো লেগেছে।

রিসাং ঝর্ণা! সামনে থেকে দেখতে খুবই সুন্দর

খুব দ্রুত আমরা ঝর্ণা থেকে উঠে এলাম। আজকের মেইন টার্গেট ‘হার্টিকালচার পার্কে’ কায়াকিং করবো। এই কায়াকিংয়ের জন্যে কোথাও এক ফোটা সময়ও নষ্ট করি নি। আমাদের পরের টার্গেট ছিলো – ‘তারেং’। এখান থেকে পুরো খাগড়াছড়ি শহরের অপূর্ব ভিউ দেখা যায়। তারেংটাকেও বাদ দিলাম কায়াকিংয়ে সময় বেশি দেয়ার জন্যে। রিসাং থেকে সোজা চলে গেলাম ‘আলুটিলা গুহা’ তে। ২০ টাকা করে টিকেট আর ১০ টাকায় মশাল কিনে রওনা দিলাম আলুটিলার ভিতরে। এই গুহার এক মাথা দিয়ে ঢুকে অন্য মাথা দিয়ে বের হওয়া যায়। ওই মশালের আলোতে কিচ্ছুই দেখা যায় না :/ বাধ্য হয়ে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালাতে হয়। এই গুহাতে ঢুকে কিছুটা সময়ের জন্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম আদিম যুগে। সুনশান নীরব এই পরিবেশ। একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার। পায়ের নীচে শীতল পানির ছোয়া! সুযোগ থাকলে অবশ্যই অন্তত একবার এই গুহার স্বাদটা নেয়া উচিত। লাইট হাতে মাঝে একটু ভুল পথে ঢুকে গেসিলাম। হঠাৎ দুইটা বাদুড় এসে আমাকে আক্রমণ করে। সাথে সাথে লাইট নিভিয়ে দেই, আর বাদুড় গুলোও শান্ত হয়ে যায়। গুহার এক মাথা দিয়ে প্রবেশ করে অন্য মাথা দিয়ে বের হয়ে আসতে প্রায় ১০ মিনিটের মতো লাগে। বেশি সময় নিলাম না। এখন সোজা রওনা হবো খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ পার্কে কায়াকিং করার জন্যে। আমাদের গাড়ি তখন মাত্র স্টার্ট দিবে, হঠাৎ বন্ধু ইয়াসিনের মোবাইলে একটা ফোন আসলো – আমাদের যেই গ্রুপটার বিকেলে সাজেক ছাড়ার কথা ওরা এস্কর্ট মিস করেছে।

সেনাবাহিনীর এস্কর্ট বিকেলেরটা ছাড়ে বেলা ৩ টায়। যেই ড্রাইভারের ওদের নিয়ে আসার কথা সে মাল খেয়ে টাল হয়ে পরেছিলো। আমাদের গ্রুপ ১৮ মিনিট দেরীতে পৌছায় আর ততক্ষণে বের হওয়ার পথ বন্ধ!

এখন বাধ্য হয়ে তাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে পরের দিনের সকালের এস্কর্টের জন্যে। এমনিতেই সবার হাতে টাকা প্রায় শেষের দিকে, তার ওপর অতিরিক্ত আরেকটা দিনের থাকার খরচ। যেই রিসোর্টে আমরা ছিলাম সেটা অন্য আরেক গ্রুপের কাছে ততক্ষণে বুকিংও দেয়া হয়ে গিয়েছিলো। এদিকে আবার ঢাকায় ফেরার বাসের টিকেটও আগে থেকেই কেটে রাখা হয়েছিলো। মানে সব দিক থেকেই বিশাল ঝামেলায় পরে গেলো তারা।

যেই কায়াকিংয়ের জন্যে সারাদিন সবাই মিলে প্ল্যান করে এসেছি, সেই কায়াকিংটাই বাধ্য হয়ে বাদ দিতে হলো। আমরা খাগড়াছড়ির শান্তি বাস কাউন্টারে গেলাম তাদের টিকেট গুলো ক্যান্সেল করাতে। কাউন্টারের ঝামেলা শেষ করে যখন ওখান থেকে বের হয়ে আসলাম তখন দিনের আলো প্রায় নিভুনিভু, আর কায়াকিংয়ের সময় নেই। কি আর করার…. 🙁

আমার ইচ্ছা ছিলো ওই দিনই শেষ বিকেলে ‘নিউজিল্যান্ড পাড়া‘ তে বসে সূর্যাস্ত দেখা। চান্দের গাড়ির ড্রাইভারের কাছে শুনলাম শীতের সিজন ছাড়া নিউজিল্যান্ডে যাওয়া যায় না। তখন ওখানে দাড়িয়েই মনে মনে প্ল্যান করলাম – আমি শীতে আবার আসবো এই খাগড়াছড়িতে। সেবার এক দিনের ট্যুরে এসে ঘুরে যাবো – “হাতিমূড়া, তারেং, হার্টিকালচার পার্ক আর নিউজিল্যান্ড পাড়া”।

সেদিনের রাতের খাবারটা আমরা খেলাম খাগড়াছড়ির বিখ্যাত মনটানা হোটেলে। তাদের খাবারের স্বাদও যেমন মজার, দামও রিজনেবল। কেউ খেলো হালিম দিয়ে নান রুটি, কেউ পরোটা সবজি আবার কেউবা বিরিয়ানী। বাসে উঠার আগে স্থানীয় বাজার থেকে যে যার যার মতো পাহাড়ি বিখ্যাত আচার/চাটনী কিনে নিয়ে বিদায় জানালাম পাহাড়ের শহরকে।

বিদায় খাগড়াছড়ি, খুব দ্রুতই আবার আসবো ইনশাল্লাহ 🙂

বিঃদ্রঃ আমাদের দেশটা খুবই সুন্দর। দয়া করে কোথাও ঘুরতে গেলে পরিবেশটাকে ঠিক সেভাবেই রেখে আসুন যেভাবে আপনি নিজে দেখতে চান। হ্যাপি ট্রাভেলিং!
Leave a Comment
Share