কেওক্রাডং ভ্রমণ

আমি ছিলাম বাবা-মায়ের ছোট্ট আদরের মেয়ে! চার দেয়ালের মাঝেই কাটছিলো আমার জীবন। হঠাৎ এলো কিছু পরিবর্তন। এলাম ঘরের বাইরে, হয়ে গেলাম উড়ে উড়ে, ঘুরে বেরানো ডানা ছাড়া এক পাখি। তারই ধারাবাহিকতায় ফেসবুক ভিত্তিক একটি ভ্রমন গ্রুপের এর সাথে চলে গেলাম পাহাড়ি পথে!!

বলা বাহুল্য বান্দরবান জেলায় এটা আমার প্রথম ভ্রমন তথা প্রথম ট্রেকিং অভিজ্ঞতা। ভয় ছিলো পারবো কি না, কিন্তু কিছু সুপরিচিতজনের সমর্থন, সাহচর্য আর সহায়তায় আমি দিলাম পাড়ি সুউচ্চ সেই পথ।

চলতি পথের শুরুতেই বিপত্তি, বৃষ্টি বিঘ্নিত তিলোত্তমার যানজটময় সড়ক। তখনও জানতাম না, পরদিন থেকেই দেখবো স্বপ্নীল কিছু দৃশ্য! খুব ভোরে গিয়ে নামলাম বান্দরবান শহরে, নাস্তা সেরেই বাসে চড়ে রওনা দিলাম রুমা উপজেলার পথে, ছাদে বসে পাহাড়ি রুপ দেখার যে কী অনুভূতি, তা অক্ষরে বলা অসম্ভব!

প্রশাসনিক আনুষ্ঠানিকতা ও মধ্যাহ্নভোজ সেরে চান্দের গাড়িতে চড়ে শুরু করলাম ১০ মাইল অভিমুখে যাত্রা। বেশ বাজে রকম রাস্তায় রোলার কোস্টারের কয়েক গুন অনুভূতি নিয়ে গিয়ে নামলাম বগালেক থেকে প্রায় ৮ কিলো দূরবর্তী এক পাহাড়ের চুড়ায়, ভর দুপুরে ঢালু পথ নামতেই জান শেষ! তারপর কেবলই হাঁটা আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দর্শন। পড়ন্ত বেলায় প্রচন্ড ক্লান্তির সাথে প্রবল মানসিক শক্তির উপর ভর করে সন্ধ্যা হবার মুখে পৌঁছে গেলাম বগালেকের প্রান্তে। আহ! কী শান্তি। রাতে স্বাভাবিক আড্ডা, খাওয়া, বিশ্রাম, ঘুম আদিবাসী কটেজে।

পরদিন খুব ভোরে উঠে আসল ট্রেকিং শুরু, গন্তব্য বাংলাদেশের পঞ্চম উচ্চতম পাহাড় এর চূড়া। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, পাহাড়ি পাড়ার রূপদেখে, বিশ্রাম নিয়ে সকাল ১১:১৫ মিনিটে কেওক্রাডং (Keokradong) সামিট করলাম।

আমার অনুভূতি তখন “আজ ম্যায় উপার, আসমা (পড়ুন অন্য সব পাহাড়) নিচে” !!

ঘন্টাখানেক বসে আল্লাহর অপরূপ সৃষ্টি দেখে, লালা বমের হোটেলে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ফিরতি পথ ধরলাম। পথে নামলো বৃষ্টি, দেখার মাধুর্য্য থাকলেও দূর্দশাও নেহায়েত কম না। উফফ! বৃষ্টির মাঝে ট্রেকিং অনেক কষ্টের! চলে এলাম চিংড়ি ঝর্নার পাদদেশে। জীবনে প্রথম ঝর্না দর্শন, তাই সিক্ত হবার সাধ দমিয়ে রাখতে না পেরে, ঝুঁকিপূর্ণ পিচ্ছিল পথ গাইডের সহায়তায় পাড়ি দিয়ে চলে এলাম ঝর্ণার তলে! আহ! শান্তি।

তারপর আবার ট্রেকিং শুরু। একবার পিছলে গিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকেই বেঁচে গেলাম। এক ট্যুরমেট বড় ভাই সাহায্য না করলে যে কী হতো! রাতে বগালেকে সিয়াম দি’র কটেজে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে অপার বিশ্রাম।

পরদিন খুব সকালে আবার বের হওয়া, এবার ফিরবো রুমার পথে। সবই ভালো ছিলো, কিন্তু বগার ডাউনহিল আর ১০ মাইল যাওয়ার শেষ ভয়াবহ পিচ্ছিল, কাদাময়, ছায়াবিহীন আপহিল পাড়ি দিতে গিয়ে মনে মনে ভাবছিলাম, জীবনে এটাই শেষ। কিন্তু না, এটাই হবে শুরু…

দুপুরে উঠলাম ট্রলারে, সাঙ্গুর জলে ভেসে ভেসে শেষ বিকেলে ফিরলাম বান্দরবান শহরে। রাতের বাসে রওনা দিলাম ঢাকা শহরের উদ্দেশ্যে। মোটের উপর ঘুরে বেড়ানো, থাকা-খাওয়া, আড্ডা-আনন্দের অভিব্যক্তি আসলে লিখে বোঝানো সম্ভব না, এটা অনুভবের ব্যাপার। যা রবে চির অম্লান, চিরকাল।

তবে যা বলছিলাম, আবার যাবো পাহাড়ে, আহারে আহারে!

বিশেষ ধন্যবাদ Jubair কে, সে পাশে না থাকলে এই স্বপ্ন অদেখাই রয়ে যেতো!

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Bandarbankeokradong