প্রথমবারের মত বান্দরবানের অরন্যে, নিষিদ্ধ সুন্দরীদের মোহে

প্রথম পর্ব

খুব কর্মব্যস্ত সময় কাটানোর পর লকডাউনে পরে একেবারে ঘরে বন্দি। সতর্কতা ও আতঙ্কের কারনে বিষয়টা এমন হয়েছিলো যেন ঘরের দরজা খুলে বাইরে উকিও মারতাম না। টানা কয়েক মাস এভাবে কাটিয়ে জনজীবন কিছুটা স্বাভাবিক হলেও আমি রয়ে গেলাম সেই আগের মতই। দরকার পরে না তাই বাইরেও যাওয়া হয় না। এর কয়েকদিন পরেই আবার এরিয়া ভিত্তিক লকডাউনে পরলাম আরো একুশ দিন। এই সময়টা একাকিত্ব একেবারে গ্রাস করে ফেললো। তারপরে কিছুটা চলাফেরা শুরু করতেই শুনলাম আসিফরা ট্যুর প্লান করতেছে, ওরা নাকি ঘুরতে যাবে বান্দরবান। ওহ, আসিফ হচ্ছে আমার বন্ধুদের মধ্যে পাহাড়প্রেমী বা পাহাড় ও ঝর্না প্রেমী বন্ধু। এই পর্যন্ত অনেকবারই ওকে দেখেছি পাহাড় ও ঝর্নার জন্য পাগল হয়ে ছুটতে।

ট্যুরে যাবে শুনে প্রথমেই নাদিয়াকে নক করলাম। দেখলাম সে এক কথাতেই রাজি। ব্যস আমিও রাজি। নাদিয়া, আমার বান্ধবী, যার সাথে আমার এদিক সেদিক ছোটো বড় বেশিরভাগ ঘোরাঘুরি হয়। আসিফকে জানিয়ে দিলাম আমি আর নাদিয়া যাবো ওদের সাথে।

আমার একটা বাজে দিক হলো আমি কাছের কারো সাথে কোথাও গেলে কোনো রকম রিসার্চ ছাড়াই চলে যাই। যারফলে আমার কোনো ধারনাই থাকে না সেই জায়গা নিয়ে। জীবনে প্রথমবার বান্দরবান যাচ্ছি। শুধু জানি এটা অফরুট, দেখবো জাদিপাই, ত্লাবং আর বাকলাই ঝর্না, আর্মির কাছে ধরা পড়লে ফিরেও আসতে হতে পারে, পরিস্থিতি অনুযায়ী প্লান পরিবর্তনও হতে পারে। আরেকটা বিষয় বলা হয়েছিলো সেটা হলো এটা কষ্ট করে ট্রেকিং করে যেতে হবে পুরো ট্রিপ জুরে। এর বেশি কিছু জানতাম না, জানাতে চাইলেও আমার জানার আগ্রহ ছিলো না কারণ আমি তো আসিফের ভরসায় যাচ্ছি।

আসিফ রুট প্লান বলেছিলো – ঢাকা থেকে বান্দরবান, সেখান থেকে থানচি, থানচি থেকে বাকলাই হয়ে থাইক্ষ্যাং পাড়ায় গিয়ে রাতে থাকা, পরদিন সকালে ত্লাবং ঝর্না দেখে জাদিপাই পাড়ায় গিয়ে রাতে থাকা, পরদিন জাদিপাই ঝর্না দেখে বাকলাই পাড়ায় এসে রাতে থাকা এবং পরদিন সকালে বাকলাই ঝর্না দেখে এসে ঢাকার উদ্দেশ্য পাড়া থেকে বেরিয়ে পরা। যেহেতু অফরুট এবং বিগত কিছু ট্যুরে পাড়ায় ট্যুরিস্ট থাকতে দেয় নাই সেহেতু একরাত আমাদের জুমঘরে থাকতে হতে পারে।  কিন্তু যে জীবনে বান্দরবান যায় নি সে কীভাবে বুঝবে এই প্লান।আমি এসব না কানে তুললাম, না কিছু বুঝলাম। এমনকি গুগল থেকে এই তিনটা ঝর্নার ছবি পর্যন্ত দেখি নাই।

ট্রিপে যাওয়ার ব্যাপারে অনেকটা  ভয় কাজ করতো আমার মাসল ক্রাম্প নিয়ে। পূর্ব ট্রেকিং অভিজ্ঞতা বলতে গেলে আমার চন্দনাথ পাহাড়। আর সেখানেই আমার ভায়ানক মাসল ক্রাম্প হয়েছিলো। যাইহোক এখানেও আসিফ বলেছিলো এটা প্রবলেম হবে না। অনেক ভয় থাকলেও মনস্থির ছিলো যে যাবো। যতই দিন ঘনিয়ে আসতেছিলো ততই মনোবল যেনো কমে আসতেছিলো। চুড়ান্ত যাত্রার তিনদিন আগে একবার আসিফ কে বললাম যে যাবো না কারণ একটাই মাসল ক্রাম্প।  তখন আসিফ আর নাদিয়া দুইজন ই মোটিভেট করলো। অফরুটের ট্রিপ ও ট্যুরিস্টবহুল এরিয়া না হওয়ায় ঢাকা থেকে টিমের খাবার দাবার কিনে নেওয়া হবে। কোনটা কতটুকু লাগবে সেটা অনুমানে সাহায্য করার জন্য সদ্য বিয়ে করে সংসারী হওয়া বান্ধবীকে নিয়ে গেলাম একটি সুপার শপে। কেনাকাটা শেষ করে বাসায় ফিরে গুছিয়ে ফেললাম নিজের ব্যাগপ্যাক ।

কিন্তু হঠাৎ করেই সমস্যা দেখা দিলো গাইড নিয়ে। গাইড ফোন দিয়ে বলল বান্দরবানে অনেক বৃষ্টি, ট্রিপ ক্যান্সেল করে কয়েকদিন পরে যেতে। তার বাড়ি থিনদলতে পাড়ায়। কথা ছিলো থানচি এসে নিয়ে যাবে। কিন্তু বৃষ্টির জন্য সে বের হতে পারছে না। এইদিকে টিম মেম্বার দের ছুটি নেওয়া সহ সকল প্রস্তুতি নেওয়া শেষ, অপেক্ষা শুধু বান্দরবানগামী বাসে ওঠা। ওরা ট্রিপটা ক্যান্সেল না করে গাইডকে বললো যতটুকু পারে আগাতে আমরাও যেতে থাকি দেখা যাক কি হয়।

অক্টোবর ২২, ২০২০, বাসা থেকে আমি আর নাদিয়া বের হলাম বৃষ্টি মাথায় করে। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা পেলাম  আসিফ ও বাকি টিম মেম্বারদের। বাকিরা আসিফের পরিচিত। সেখানে ছিলো তন্ময়, রাসেল ভাই ও ওয়াহিদ ভাই। বাসে উঠে আমি আর নাদিয়া বসে ভালো অনুভুতির আবেগে ভাসতে লাগলাম। নাদিয়া একজনের ছবি দেখিয়ে বলল “দেখ, মানুষ ঘুরতে গিয়ে কত সুন্দর জীপের সাথে ছবি তুলে”। বাস চলতে শুরু করলে কিছুক্ষণ এটা ওটা নিয়ে গল্প করলাম। তারপরে ঘুমাতে ঘুমাতে বৃষ্টিভেজা পিচঢালা রোড ধরে প্রথমবারের মত চললাম বান্দরবানের পথে।

ভোর ভোর বান্দরবান পৌছালাম, নেমে নাস্তা করে নিলাম এবং সেখানে দেখা হলো আরো কিছু টিম মেম্বারদের সাথে। সেখানে ছিলো সাদিক, নিপুণ আপু, ফ্রু আপু আর মামুন ভাই। নিপুণ আপু, পেশায় ডাক্তার মিষ্টি একজন মানুষ এবং রাসেল ভাইয়ার জীবন সঙ্গী। আসিফ আর নাদিয়া বাদে টিমের সবার সাথেই প্রথম পরিচয়। হোটেল থেকে বাইরে এসে আমাদের জীপ দেখে আমি আর নাদিয়া অবাক সেই সাথে অনেক খুশিও। কারণ আমাদের জীপের রংটা খুব সুন্দর,জলপাই রংয়ের।

সুন্দর রংয়ের জীপ ও আমরা

বান্দরবান শহরেই গাইড দাদার সাথে কথা বলে জানতে পারলো সে থাইক্ষ্যাং পাড়ায় এসে সামনে আসতে পারতেছে না। তাকে বলা হলো অন্ততপক্ষে বাকলাই পাড়া পর্যন্ত আসতে, আমরা কোনোভাবে থানচি থেকে বাকলাই পাড়া পর্যন্ত যাবো। গাইড পাওয়ার অনিশ্চয়তা, হালকা বৃষ্টি ও মেঘাচ্ছন্ন আবহাওয়ার মধ্যেই জীপে করে ছুটে চললাম থানচির উদ্দেশ্য। পথের মধ্যে একটু আধটু কথার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে পরিচিত হয়ে চলতে থাকলাম। প্রথমবার যাওয়ার জন্যই মনে হয় সবকিছু দেখে মুগ্ধ হতে থাকলাম। পাহাড়ি পথ, পথের বাক, ওপর থেকে দেখা নদী সবই যেন মনকে আনন্দ দিচ্ছে। ট্যুরের স্বাদ পাওয়া শুরু হয়ে গিয়েছিলে জীপ চলা শুরু করা থেকেই। ওপর থেকে যখন নদী দেখালাম তখন কে যেনো বলল এটাই সাঙ্গু নদী। চারপাশে পাহাড় বেষ্টিত নদীটা দেখতে অপরুপ। ছোটবেলায় বইয়ে পরার মাধ্যমে এই নদীর নাম জানা। সেই নদীও যে এতটা সুন্দর হতে পারে তার ধরনা আগে ছিলো না৷ এখানে এসে সব কিছুই যেন আমার কাছে ধরা দিচ্ছে অপার সৌন্দর্য নিয়ে বিস্ময়ের সাথে। চলতি পথে মেঘগুলোকেও দেখলাম কাছ থেকে। সে যেন এক ভীষন ভালো লাগা।

পথের মধ্যে আর কোনোভাবেই গাইড দাদার সাথে যোগাযোগ করা গেলো না। সবাই এটা নিয়ে চিন্তিত।  জীপের মধ্যে বসে ওরা আরকটা ব্যাকআপ প্লান রেডি করলো। এই প্লান ক্যান্সেল হলে একুশ কিলো দিয়ে আলিকদম হয়ে ক্রিসতং রুংরাং যাওয়া যাবে। সেজন্য ঐ রুটের গাইডের সাথেও প্রাথমিক কথা বলে নিলো। বললো থানচি গিয়ে তাকে ফাইনাল জানানো হবে। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কি হয় এবং আমাদের কোথায় যাওয়া হয় এই দুশ্চিন্তাটুকু নিয়ে চলতে চলতে আমরা চলে এলাম বলিপাড়া ক্যাম্পে।

ট্যুরের আগে কেউ একজন পারিজাত ক্যাফের রাতে ধারণকৃত একটি ছবি দিয়েছিলো মেসেঞ্জার গ্রুপে। জায়গাটা সেই ছবির মতই সুন্দর। নেমে প্রথমেই আমি আর নাদিয়া সুন্দর রংয়ের জীপের সাথে আগে ছবি তুলে নিলাম। ক্যাম্পে আমরা বললাম আমারা সবাই থানচি যাবো। সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হলো। এরমধ্যেই অন্য একটা নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে বলল তাকে এই নাম্বার থিনদলতে পাড়ার সেই গাইড দাদা দিয়েছে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, তার বাড়ি বাকলাই পাড়ায়। তার সাথে কথা বলে বলিপাড়া থেকে বের হয়ে সুন্দর এক যাত্রাপথ অতিক্রম করে আমরা দুপুর নাগাদ থানচি পৌছালাম।

সেখানে খাওয়াদাওয়া শেষ করলাম, বৃষ্টির জন্য সবাই পলিব্যাগ দিয়ে তাদের ব্যাগকে প্রটেক্ট করে নিলো। যেহেতু আগে যাই নি আর কিছুই জানি না সেহেতু অনেক কিছুই বুঝি না। তখন শুনলাম আবহাওয়া খারাপ হওয়ার কারনে সাঙ্গু নদী দিয়ে কোনো ট্যুরিস্ট যেতে দিবে না। ওই রুটে সবার ট্রিপ ক্যান্সেল। এমন সময় আসিফের এক বন্ধু আরিফ আসলো। ও টিম নিয়ে আমিয়াখুম নাফাখুম যাচ্ছিলো কিন্তু ট্রিপ ক্যান্সেল হওয়াতে ও আমাদের সাথে যোগ দিলো। এমন ট্রিপ ক্যান্সেলের খবর শুনে সেখানে মনে হলো কেমন যেন একটু আশাভঙ্গ পরিস্থিতি। কিন্তু আমাদের রুট তো অন্য, যাবো বাকলাইয়ের দিকে লুকিয়ে লুকিয়ে। তখনো আমাদের থানচি থেকে বাকলাই পথে যাওয়ার জীপ পাওয়া যায় নি।

বাকলাইগামী পথের এক মোহাচ্ছন্ন রুপ রয়েছে ফটোগ্রাফারঃ ওয়াহিদুর রহমান

নতুন যে দাদা ফোন দিয়েছিলো সে একটি জীপের নাম্বার দিলো তার সাথে কথা বলে ঠিক হলো বিকেল বিকেল বের হতে হবে। তানাহলে আর্মিদের কাছে ধরা পরে যেতে পারি। সুতরাং থানচি থেকে আমাদের দেরি করে বের হতে হবে। থানচি থেকে বাকলাই এর ঐ রোডটাতে কনস্ট্রাকশনের কাজ চলতেছে। বৃষ্টির জন্য রাস্তা খারাপ, ১৫ কিলো পর্যন্ত জীপ যেতে পারবে না। ১১ কিলো নামিয়ে দিবে সেখান থেকে আমাদের হেটে যেতে হবে। গাইড দাদাকে এসে এগিয়ে নিয়ে যেতে বললে সে বললো সে আগাবে না, ১৫ কিলোর সামনে থাকবে। এরপরে ঠিক করা সেই জীপটা আমাদের সামনে দিয়ে এগিয়ে চলে গেলো। থানচি বাজার থেকে কিছু টা পায়ে হেটে সামনে যেয়ে তারপর আমাদের জীপে উঠতে হবে।

গাইড, জীপ ও নানা বিষয়গুলো দেখতেছিলো আসিফ, সাদিক ও তন্ময়। যখন আমাদের ওপরে উঠতে বলা হলো তখন কিছুটা উঠেই মনে হলো আর পারবো না।  কিন্তু পারলাম, উঠে গিয়ে জীপে বসলাম। এবং সেই বাকলাই এর ১১ কিলো রাস্তার যেই মনভোলানো সৌন্দর্য দেখেছিলাম সেটা বর্ননাতীত। আকাশে মেঘের আনাগোনা এবং মাঝে মাঝে বৃষ্টি পরিবেশটাকে ভয়ংকর সুন্দর করে তুলেছিলো। গাড়ি থেকে নেমে আমরা সবাই হাটতে শুরু করলাম। উচু নিচু পথ, চারপাশে চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য। কিন্তু সেই পথ হেটে হেটে খুব ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার অবস্থা। একটু পর পর খাড়া উচু ঢাল দেখলেই মনে হতো এ আমি কোথায় এসে পরলাম। কিছুক্ষণ পরে দেখলাম দুইজন মেয়ে আসতেছে পিছনে একটি ছেলে। মেয়েরা সামনে আসতেই জিজ্ঞেস করলো আমরা কোথায় যাচ্ছি। জাদিপাই এর কথা শুনে ওরা বললো অনেক কষ্ট যাওয়া এবং প্রচুর জোক। শুনে তো ভয়ে আমাদের অবস্থা খারাপ হওয়ার জোগাড়। কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবলে চলবে না তাই সেই ভাবনাটা মাথা থেকে উড়িয়ে দিলাম। চলার পথে ওরা যখনই নেটওয়ার্ক পাচ্ছে গাইড দাদার সাথে কথা বলে নিচ্ছে।  এভাবে চোখজুড়ানো সুন্দর কিন্তু ক্লান্তিকর পথ পাড়ি দিতে দিতে হাপিয়ে পরেছিলাম। সাথে বৃষ্টির পানিতে ভিজে একাকার। সবার শেষের যেই খাড়া রাস্তাটুকু ছিলো সেটা ওঠার সময় বার বার মনে হচ্ছিলো শরীর আর মনের জোর এই বুঝি ভেঙে পড়লো।

অতঃপর, যখন আমরা গাইড দাদার দেখা পেলাম তখন সূর্য অস্ত যাওয়া মুহুর্ত এবং আকাশে রক্তিম আভা। দাদা আমাদের শুরুতেই কি কি করা যাবে এবং কি কি করা যাবে না সেই রুলস ও রেগুলেশন নিয়ে একটু ব্রিফ করে দিলো। যেমন- লাইন ধরে দলবদ্ধ হয়ে পাড়ায় ঢুকতে হবে, সবাইকে দাদার পিছনে থাকতে হবে, জোরে কথা বলা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। সবশুনে আমরা চললাম বাকলাই পাড়ার উদ্দেশ্যে  এবং দাদাকে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগলাম “আর কত দূর.?”। আর দাদার উত্তর “এই তো সামনেই “। অথচ অতটুকু ট্রেকিং কে পুরো ট্রিপের ট্রেলার বললেও ভুল হবে। তার চেয়েও কম ছিলো। সামনে ছিলো অনেক লম্বা পথ। পাড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রকৃতিতে অন্ধকার নেমে এলো। আমরা দাদার বাড়িতে গিয়ে ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে নিজেদের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত হলাম।

চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য কি অবসাদও দুর করে? ফটোগ্রাফারঃ ওয়াহিদুর রহমান

তখন সেই আগে কথা বলা থিনদলতে পাড়ার গাইড দাদা চলে এলো। পরে ওরা বললো তাদের নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিতে। তারা দুইজন ও আমাদের টিমের ছেলেরা কথা বলে সিদ্ধান্ত হলো বাকলাই পাড়ার এই দাদাই আমাদের পুরো ট্রিপ ঘুরাবে। শুরুতে প্লান ছিলো প্রথমদিন থাইক্ষ্যাং পাড়ায় যাওয়ার কিন্তু আমরা প্রথমদিন বাকলাই পাড়া অতিক্রম করতে না পেরে সেই পাড়াতেই থেকে যাই। নিপুণ আপু রান্না করলো খিচুরি। আরিফের নিয়ে যাওয়া আচার দিয়ে খিচুড়ি খেয়ে শুয়ে পরলাম।  পরদিন পরিস্থিতি অনুযায়ী প্লান করা হবে এটা ঠিক করে  সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম। অন্যদিকে সারারাত ঝড়সহ প্রবল বৃষ্টিপাত হলো।

দ্বিতীয় পর্ব

ভোর ভোর ঘুম ভাঙলো। ঘুম ভাঙতেই শুনতে পেলাম আলোচনা হচ্ছে পরবর্তী যাত্রা নিয়ে। প্রথমদিন ত্লাবং দেখার প্লান ছিলো যদি আমরা আগেরদিন থাইক্ষ্যাং পাড়া  যেতে পারতাম। কিন্তু সেটা হয় নি। রাতভর তুমুল বৃষ্টির কারনে ঝিরিতে নাকি অনেক পানি এবং সেই সাথে স্রোতও থাকবে বেশি। আর ত্লাবং এর জন্য কিছুটা পথ ঝিরি ধরে আগাতে হবে।তাই প্লান পরিবর্তন করার কথা হচ্ছে। পাড়ায় বসেই আশেপাশের ঝিরি থেকে পানির স্রোতের শব্দ শোনা যাচ্ছে খুব। নানা রকম দুর্ঘটনার কথা মাথায় আসায় আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম এখান থেকে আর না এগিয়ে এই পাড়াতেই দুই একদিন থেকে বরং চলে যাই।  ওটা ছিলো মনে মনে আমার একটি দুর্বল মনোভাব  যেটা প্রকাশের সাহস ছিলো না। যাইহোক, শুয়ে শুয়ে ওদের বললাম “দেখো, তোমরা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিও না যাতে আমরা বড় কোনো বিপদে পরি”। তারপর সবাই সিদ্ধান্ত নিলো আগে জাদিপাই ঝর্না দেখবে। কারন আমাদের রুটপ্লানে সেখানে যেতে কোনো ঝিরি ধরে আগাতে হবে না। তখনও আমার মনের মধ্যে ইচ্ছাটা ছিলো টিমের কেউ একজন এই পাড়ায় থেকে গেলে আমিও থেকে যাবো।

বৈরীভাবাপন্ন প্রকৃতিতে মানুষ মানুষের জন্য ; হিউম্যান চেইন ফটোগ্রাফারঃ আসিফ আহমেদ তন্ময়

কিন্তু প্রত্যেকেই যাবে তাই আমিও যাবো। সবাই উঠে নিজেদের ফুডপ্যাক থেকে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। আমার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস আসিফের ব্যাগে দিয়ে বাকি জিনিসসহ ব্যাগ বাকলাই পাড়ায় রেখেই টিমের সাথে হাটা শুরু করলাম। উদ্দেশ্য জাদিপাই পাড়া তারপর জাদিপাই ঝর্না। বাকলাই পাড়া থেকে সেদিন আরো দুইটি টিম বের হয়েছিলো একটি একটু ছোটো এবং একটি বেশ বড় টিম। আমরা প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে বের হলাম। ধীরে ধীরে হাটতে হাটতে এগিয়ে চললাম। কিছুদুর গিয়েই একটি ঝিরি পার হতে হলো। স্রোত থাকায় হিউম্যান চেইন করে ঝিরিটা পার হলাম। এবং হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারলাম অসংখ্য জোকের মধ্যে দিয়ে হাঁটতেছি। অথচ এই জোককে প্রচন্ড রকমের ভয় পাওয়া মানুষ আমি। পরিস্থিতিটা এমন ছিলো যে জোকের ভয়ের দিকে মন দেওয়া যাবে না হাঁটতে হবে। গাইড দাদাকে আমরা যতবার জিজ্ঞেস করি কতক্ষণ হাটতে হবে, সে বলে থাইক্ষ্যাং পাড়ার আগের ওয়াই জংশন পর্যন্ত দুই ঘন্টা হাটতে হবে। কিন্তু সেই দুইঘন্টা যেন আর শেষ হয় না। পথটা খুব সুন্দর ছিলো। অসংখ্য ঝিরি আর ছোটো ঝর্না ছিলো। কিছুক্ষণ পর পর বিশ্রামের জন্য দাঁড়ালে খুব সুন্দর দৃশ্য দেখা যেতো। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিলো যেনো মেঘের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে এবং শরীর থেকে জোক ছাড়াতে ছাড়াতে প্রায় চার ঘন্টা ট্রেকিং এর পর আমরা পৌছালাম ওয়াই জংশন।

সেখানে বিশ্রাম নিলাম কিন্তু বসলাম না জোকের ভয়েতে। অন্য টিমটি চলে গেলো থাইক্ষ্যাং পাড়ার দিকে। সবাই বললো কাছেই থাইক্ষ্যাং পাড়া। তখন মনে হলো যাত্রাটা বোধহয় জাদিপাই পাড়া না হয়ে থাইক্ষ্যাং হলেই ভালো হতো। কিছুটা তাড়াতাড়ি শেষ হতো। তারপর শুরু হলো আবার হাটা। পুরো ট্রেইলে আমার সাথে ছিলো আসিফ। গল্প করে, পরামর্শ দিয়ে, মোটিভেট করে করে সামনে নিয়ে যাচ্ছিলো। এবারও ইচ্ছাটা আমার এমন ছিলো যে আগে জাদিপাই পাড়ায় যাই। তখন সিদ্ধান্ত নিবো যে ঝর্না দেখতে যাবো কি যাবো না৷ এই পথেই যাওয়ার সময় আসিফ মোটিভেশান স্বরূপ বললো জাদিপাই আর ত্লাবং ঝর্না দেখতে পারলে ঢাকায় গিয়ে সুলতানস ডাইন এর কাচ্চি খাওয়াবে।

সন্তর্পনে এগিয়ে চলা ফটোগ্রাফারঃ আসিফ আহমেদ তন্ময়

পথের সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে সামনে আগানো শুরু করলাম। বলা হয়েছিলো ওয়াই জংশন থেকে দেড় ঘন্টা ট্রেকিং করলে পাবো জাদিপাই পাড়া। আমরা সেই দেড় ঘন্টার ট্রেকিং কে আমাদের মত করে উপভোগ করতে করতে আগালাম। পথিমধ্যে মনোমুগ্ধকর ছোট্ট একটি পাড়া পরলো। নাম নাকি “উদ্যমী জাদিপাই”। ভীষণ সুন্দর এই পাড়ার কিছু কিছু জায়গায় গিয়ে আমরা ছবি তুলতে লাগলাম। সেই  পাড়াতে একরাত থাকার খুব ইচ্ছা জাগলো। কিন্তু সেটা সম্ভব না। মনে মনে আমি কিছুটা আশাহত হলেও আবার সামনে আগালাম। গাইড দাদা বললো খুব কাছেই আমাদের গন্তব্য। এবং ধীরে ধীরে আমরা পৌছে গেলাম জাদিপাই পাড়ায়।ওয়াই জংশন থেকে আমাদের সময় লাগলো আড়াই ঘন্টা। বৃষ্টি আর জোকের জন্য সেদিন আমাদের ট্রেকিং টাইমটা কিছুটা বেশি লেগেছিলো। আবার সেই গাইড দাদার নিয়ম অনুযায়ী লাইন ধরে কথা না বলে তার পিছু পিছু হেটে পাড়ায় ঢুকলাম। 

পাড়ায় ঢুকেই প্রথম মনে হলে “ওয়াও, কি সুন্দর জায়গা”। সময়টা তখন দুপুরের শেষ শেষ, প্রায় আড়াই টার মত হবে। আকাশ কিছুটা মেঘমুক্ত। প্রকৃতিটাকে মনে হলো অন্যরকম সৌন্দর্য নিয়ে বসে আছে। পাড়াটা কল্পনার মত সুন্দর লাগলো আমার কাছে। পাড়াকেন্দ্রটা খুব পছন্দ হলো। শখ হলো সেখানে একটা ছবি তুলবো। কিন্তু তাড়াহুড়ায় ছবিটা তোলা হলো না। যেই ঘরে আমরা থাকবো সেটা আমাদের গাইড দাদার শ্বশুর বাড়ি। সেখানে গিয়ে প্রথমেই চলে গেলাম ভিতরের রুমের পাশে খালি জায়গাটায়।এবং বেশ খানিকটা সময় নিয়ে আমি নাদিয়া আর ফ্রু আপু শরীরে জোক আছে কিনা চেক করতে লাগলাম। ফ্রু আপুর কাপড়ে বেশ কিছুটা জায়গায় রক্ত দেখা গেলো যদিও শরীরে জোক পাওয়া যায় নি। তারপর কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম আর খেয়াল করলাম পায়ে ফোসকা পরে গেছে।

হালকা কিছু খেয়ে প্রায় সাড়ে তিনটা নাগাদ বের হলাম ঝর্নার উদ্দেশ্য।পাহাড়ে যাওয়ার আগেই খুব ইচ্ছা ছিলো পাহাড়ি মুরগী খাওয়ার। তাই যাওয়ার আগে যে ঘরে আমরা থাকবো তাদের বলে দেওয়া হলো একটা পাহাড়ি মুরগীর ব্যবস্থা করতে। পাড়া থেকে বের হয়ে আমাদের এবার শুরু হলো নামার পালা। বেশ ক্ষানিকটা সময় ধরে নামতে নামতে টের পেলাম পাহাড়ে শুধু ওঠাটাই কষ্টকর না, নামাটাও কষ্টের। এভাবে নেমে নেমে আমরা একটা সময় ঝিরি পার হলাম। কিন্তু ঝিরি পার হতেই মনে হলো যেন আর রাস্তা নেই,  ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে হাটা দিলাম। গাইড দাদা কে গলা ছেড়ে ডেকে ডেকে একটু নিশ্চিত হয়ে নিলাম যে সামনে আগাবো কিনা।

সামনে আগাতে আগাতে ধীরে ধীরে ঝর্নার শব্দ কানে আসতে লাগলো। এবং অনুভুতিটা তখন থেকে ভালো হতে শুরু করলো। সামনে আগানোর স্পৃহা টা বেড়ে গেলো। যেতে যেতে একটা ব্রিজ পেলাম। ব্রিজের ওপর রাস্তাটা ভালো না। আসিফ বললো পাহাড় ধ্বস হয়েছিলো নাকি। সেই ব্রিজ, ব্রিজের ওপর মাটি,গাছপালা পরে থাকা রাস্তা পার হয়ে সামনে যেতে থাকলাম। এর মধ্যেই শুনলাম কেউ জোরে জোরে চিল্লাচ্ছে। বুঝলাম আমাদের টিমের কেউ ঝর্নার কাছে চলে গেছে।  সেটা আরিফ ছিলো। সামনে গিয়ে যখন ঝর্নাটা দেখতে পেলাম তখন মনে হলো যেনো একটা ঘোরের মধ্যে যাচ্ছি। তখন প্রায় পাঁচটা বাজে, প্রকৃতিতে বিকেলের স্নিগ্ধতা।  আগের রাতের ভাড়ি বৃষ্টির জন্য ঝর্নায় পানি অনেক বেশি। পানির প্রবাহ, আর শব্দ মিলে সেখানটায় ছিলো এক বিমোহিত পরিবেশ। টিমের সবাই বললো জাদিপাই এর এই রুপ কোনো ছবিতেই নাকি দেখে নাই। প্রথম দেখা যায় যেখান থেকে সেখানে আমরা কিছু ছবি তুলে নিলাম। কিন্তু কথা হলে আরো নিচে নামবো কিনা।  আসিফ, আরিফ, তন্ময়, সাদিক, ওয়াহিদ ভাই  ওরা নামবে। ফ্রু আপু নামবে না। নিপুন আপুরা তখনও পৌছায় নাই। আমি আর নাদিয়া নামার সাহস পাচ্ছিলাম না। নিচে নামার রাস্তাটা ভয়ংকর খারাপ। কোনো রাস্তা নাই। একদম খাড়া, পাথর ভাঙা নুরি এবং গাছ উপরে পরা। ধরে নামা বা ধরে ওঠার মত কিছু নাই।  আসিফ কে বললাম নামবো না। পুরো ট্রিপ সাহস জুগিয়ে আসার পর এই অবস্থা দেখে আসিফও আর জোর করলো না৷

ঝর্নার রানি জাদিপাই ফটোগ্রাফারঃ আব্দুল আল মামুন

তখন আরিফ আর তন্ময় বললো “এতটা রাস্তা এসেছো। কিছুটা নিচে নেমেই দেখো।” বিশেষ করে আরিফ বলেছিলো যে “আরেহ পারবা, নামো”। এবারে মনে হলো আসিফেরও সাহস বেড়ে গেলো। আসিফও নামার কথা বলতে লাগলো। যতটা সম্ভব নিচে নামলাম “আল্লাহ আল্লাহ ” করতে করতে। এখনো ওই রাস্তাটুকুর কথা মনে পরলে ভয় করে। সামান্য ভারসাম্য এদিক সেদিক হলেই নিচে পরে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ভীষণ সুন্দর সেই ঝর্নাকে আরো কিছুটা কাছ থেকে দেখার অনুভূতি টা তখন অনেক বেশি ভালো ছিলো। খুব বেশি কাছে না গিয়েও প্রচুর পানির প্রবাহ থাকায় ছিটে পানিতেই আমরা সবাই ভিজে একাকার। ঠিকমত ছবিও তোলা যাচ্ছিলো না পানির জন্য। এমনকি সেই পানিতে ওয়াহিদ ভাইয়ার ফোনও নষ্ট হয়েছিলো। তখন প্রায় শেষ বিকেল।  কিছুক্ষণ পরেই সন্ধ্যা নামবে। সুতরাং ফিরতে হবে আমাদের। সবাই চেয়েছিলো সন্ধ্যার আগে অন্তত ঝোপঝাড়ের রাস্তাটুকু যেনো পার হতে পারি। আমরা সৌন্দর্য অবলোকনের পার্ট চুকিয়ে ফিরার জন্য ভাবলাম। মাত্র আধ ঘন্টা সময়ে কিছু অপার সৌন্দর্যের মুহুর্ত কাটিয়ে সাড়ে পাচটার দিকে ফিরতে শুরু করলাম।

যেহেতু আমি স্লো ট্রেকার এবং ওপরে উঠতে বেশ সময় নেই তাই আমি কিছুটা হলেও সবার থেকে আগে রওনা দিতে চাইলাম। আরিফ সেই ভয়ংকর পথটুকু উঠিয়ে দিয়ে গেলো। তারপর আসিফ আসলো এবং আমরা আবার হাটা শুরু করলাম। নিপুন আপুরা নিচে পর্যন্ত নামেই নি। তারা আমাদেরও আগে ফিরতে শুরু করেছিলো। কিছুটা ফিরার পরই সন্ধ্যা টা যেন হঠাৎ নেমে এলো। হেড ল্যাম্প জালিয়ে আমরা হাটা অব্যহত রাখলাম। অন্ধকারে পোকামাকড়ের নানা রকম শব্দের সাথে চলতে থাকলাম। একটু পর পর পায়ে বসা জোক ছাড়াই। এর মাঝে মনে হলো পায়ে একটু বেশিই জ্বলতেছে। লাইট দিয়ে দেখি যেই জায়গাটায় ফোসকা পরেছিলো সেটার চামড়া উঠে গেছে এবং সেই ক্ষততে জোক কামরে ধরেছে। তখন ভীষন রকমের জ্বলন হচ্ছিলো। কোনোমতে জোকটা ছাড়িয়ে আবার হাটা দিলাম। এর মধ্যে পিছন থেকে কেউ কেউ এসে আমাদের ক্রস করে সমানে চলে যাচ্ছে। মাঝে শুনতে পেলাম ওয়াহিদ ভাইয়া পায়ে খুব ব্যথা পেয়েছে গাইড দাদা তাকে নিয়ে আসতেছে। তারপরে আগাতে আগাতে আমরা পাড়ায় পৌছালাম প্রায় সাড়ে সাতটার দিকে।

এসে গোসল করে ঘরে গিয়ে বসলাম আর প্রচন্ড শীত জেকে বসলো। সেই সাথে শরীরে ব্যথা আর অবসাদ। ওয়াহিদ ভাইয়া এসেছিলো বেশ দেড়ি করে। তার শরীর খুব খারাপ ছিলো। এসেই সে রেস্ট নিচ্ছিলো। মামুন ভাই তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও মেডিসিন দিয়েছে। অন্যদিকে আমাদের রান্না হচ্ছে। আজকের রান্না করছে ফ্রু আপু। সবাই মিলে বললাম মাংস টা ঝাল বেশি দিয়ে রান্না করতে। বাকিদের কেউ কেউ কাটাবাটায় সাহায্য করছে। আমি গিয়ে চুলার পাশে বসলাম আগুন পোহাতে। তখন আসিফের ফোনে ঢাকা থেকে ফোন আসলো আমার ভাগনি নিঝুমের। জাদিপাই পাড়ায় আবার নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। নিঝুমের সাথে কথা বলে জানলাম আমার অনার্সের রেজাল্ট দিয়েছে। বাসায় এডমিট কার্ড খুজে পাচ্ছে না বিধায় রেজাল্ট বের করতে পাচ্ছে না। আর আমারও মনে পড়ছে না এডমিট কার্ড কোথায় রেখেছি সেইসাথে রোল নম্বরও মনে নেই যে ওকে বলবো। বাকি বান্ধবীদের রেজাল্ট জেনে গেছে তারাও আমার রোল নম্বর বের করতে না পেরে হতাশ। কথা বলে মনে হলো নিঝুম ও আমার বান্ধবীরা খুব চিন্তিত আমার রেজাল্ট না জানতে পেরে। অথচ আমি তো পাহাড়ের প্রকৃতিতে মত্ত, এই চিন্তাটা আমার মনে খুব প্রভাব ফেললো না। এবং ঢাকায় ফিরার আগ পর্যন্ত সেটা আর খুব একটা মনেও পড়লো না।

পায়ের সেই ফোসকা পরা, জোকে ধরা জায়গাটা দেখে নিপুণ আপু বললো এটাতে ইনফেকশন হয়ে পরার সম্ভাবনা রয়েছে। শুনে একটু ভয় পেলাম, আর ব্যথাটাও ছিলো প্রচন্ড।  কিন্তু মামুন ভাই প্রাথমিক একটা চিকিৎসা দিয়ে দিলো। কিছু সময় অন্তর অন্তর দুইটা মলম দিলো আমাকে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে নিতে। খাবার হয়ে গেলে আমরা সবাই মিলে খুব মজা করে খেয়ে নিলাম। আরো কিছু ওষুধও সে রাতে খেয়ে নিয়েছিলাম পরদিন ঠিকমত হাটার জন্য। থাকার ঘরটায় ছোট্ট একটা চৌকি ছিলো। আমার আর নিপুণ আপুর ইচ্ছা ওপরে শোয়ার।  নাদিয় ও ফ্রু আপুও কোনো আপত্তি করলো না।  নিপুণ আপুর পাশে চৌকিটার ওপর শুয়ে পরলাম। রাতে ওরা বের হলো পাড়া দেখতে। খুব ইচ্ছা থাকা সত্বেও শীতের জন্য বের হতে পারি নি। এক ঘুমে রাত পার।

তৃতীয় পর্ব

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙলে, কাথার নিচ থেকে বের হতে ইচ্ছা করলো না ঠান্ডার মধ্যে। কিন্তু পাহাড়ে ভোরবেলাটা দেখার প্রবল ইচ্ছার সামনে আর বের না হয়ে পারলাম না। একটু হেটে সামনে যেতেই দেখলাম দূরে মেঘ ভাসতেছে এবং আকাশটা খুব সুন্দর নীল। সূর্য ততক্ষনে উঠে গেছে। মনে হলো পাহাড়ের ওপর আকাশটা বুঝি এক ভিন্ন রকম সুন্দর রুপ ধারণ করে আছে। দেখলাম ওয়াহিদ ভাইয়াও সকাল দেখতে বের হয়েছে পায়ে ব্যাথা নিয়েই। ছবিও তুললো সে। জাদিপাই পাড়াটাও খুব বেশি পছন্দ হয়ে গেলো। আফসোস হতে লাগলো সেখানে যদি দুই তিন দিন থেকে অবকাশ যাপন করতে পারতাম তাহলে খুব ভালো হতো।

মন্ত্রমুগ্ধ জাদিপাইয়ের সকাল ফটোগ্রাফারঃ আব্দুল আল মামুন

এরপরে সকালের নাস্তা করে যার যার মত তৈরি হয়ে নিলাম। নাদিয়া ওর কাপ নুডুলসটা আমাকে খায়িয়েই দিলো। আমার পায়ে যেন ইনফেকশন না হয় সেজন্য মামুন ভাইয়া ব্যান্ডেজের পরামর্শ দিলো। তার ফার্স্ট এইড থেকে ব্যান্ডেজ নিয়ে আসিফের সাহায্যে পা ব্যান্ডেজ করে নিলাম। পাড়া থেকে বের হওয়ার আগে সেই পছন্দ হওয়া পাড়াকেন্দ্র ঘরটার সামনে গিয়ে সাদিক কে বললাম ছবি তুলে দিতে। সেদিন বের হতে কিছুটা দেরি হলো, প্রায় সাড়ে আটটা বেজেছিলো। সকালে চলতে শুরু করলে বুঝলাম হাত, পা ও শরীরে বেশ ব্যাথা আছে। সেটাকে নিয়ে চলতে চলতে কিছুক্ষণ পরে শয়ে গেলো। আসিফ প্রথম থেকে আমাকে বলেছিলে আগে আগে হাটার। আমি স্লো হয়ে যাই তাই আগে থাকার চেস্টা করতে তানাহলে পিছনে পরে যাবো। যেহেতু তখন নামতে হবে বেশি তাই চেস্টা করলে আগে আগে থাকা যাবে। ওর কথামত আগে আগে হাটা দিলাম।

গল্প করতে করতে আমরা ননস্টপ হাটলাম এমনকি সবাই রেস্ট নিলে আমরা সেখানও বেশিক্ষণ দাড়ালাম না। এমন করে আমরা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেলাম। সেদিনের রৌদ্রজ্বল সেই সকালের পথটা বেশ উপভোগ্য ছিলো। একটা সময় শুনি পিছন থেকে সাদিক ডাকতেছে আমাদের। আসিফ ডাকে সাড়া দিয়ে বলল যে আমরা সামনে আছি। সাদিক এসে বললো পিছনে অন্য একটা রাস্তায় কে যেন অ্যারো দিয়ে গেছে সেজন্য সবাই ভেবেছে আমরা ভুল পথে গেছি এবং গাইড দাদা সেই পথে খুজতে গেছে। পিছনে টিমের আমি, আসিফ ও ওয়াহিদ ভাইয়া মিসিং। আসিফ বললো ওয়াহিদ ভাইয়া আমাদের ক্রস করে সামনে এগিয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনে পরলো না কখন ওয়াহিদ ভাইয়া আমাদের সামনে গেলো। ইতিমধ্যেই তন্ময় আসিফকে ডাকতে ডাকতে সামনে চলে আসলো। এবং আসিফকে দেখে খুব রাগারাগি করলো কারণ ওরা সবাই খুব ভয় পেয়েছিলো এই ভেবে যে আমরা ভুল পথে গেছি। তন্ময়ের সেই রাগান্বিত চেহারা দেখে আমি খুব বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।  এমনকি কিছুক্ষণ কথা বলতেও ভয় হচ্ছিলো যেন আবার না রেগে যায়।

তারপর আমরা সবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম যে একসাথে সামনে আগাবো।  কিছুক্ষণ পরে পিছনের সবাই সামনে চলে এলো গাইড দাদা এলো তারও পরে। এই ঘটনায় বেশ খানিকটা সময় আমাদের নষ্ট হলো। আমরা আবার হাটা শুরু করলাম। ওয়াহিদ ভাইয়া সামনে আছে এই ভেবেই আগাতে থাকলাম কিন্তু আমার মনে কিছুটা ভয় আর সন্দেহ থেকে গেলো। হাটতে হাটতে থাইক্ষ্যাং পাড়ার আগের ওয়াই জংশন এ গিয়ে দেখি ওয়াহিদ ভাইয়া সেখানে বসে আছে। তখন সস্তি এলো কেউ পথ হারায় নাই দেখে। সেখানে আবার কিছুটা রেস্ট নিয়ে নিলাম। তারপর আগালাম গাইড দাদার সেই নিয়ম অনুযায়ী সে থাকবে সবার আগে বাকিরা লাইন ধরে তার পিছন পিছন এবং কথা বলা যাবে না। সামনে এগিয়ে আমরা একটি সাপ দেখতে পেলাম। আরিফ সাপটা দেখে আমাদের দেখালো, সবুজ রংয়ের একটি সাপ। হঠাৎ ই গাইড দাদা সাপটিকে জোরে এক বাড়ি দিলো। সবাই বারণ করা সত্বেও গাইড দাদার এই কাজে আরিফ প্রচন্ড রেগে গেলো। ওকে সবাই বোঝালো যাতে রাগ না করে। গাইড দাদা আমাদের বলল তারা নাকি এটা মানেন যে শত্রুকে দেখলে ছেড়ে দিতে নাই।  সাপের কামড়ে যেহেতু মানুষ মারা যায় তাই সাপ আমাদের শত্রু। পরে সবাই মিলে আমরা দাদাকে বোঝালাম তার কাজটি ঠিক হয়নি এবং এমনটা যেন আর না করে। তারপরে আবার সামনে চলা।

একেবারে পাড়ায় ঢুকার মুহুর্তে আমরা আবার গাইড দাদার নিয়ম মেনে শৃঙ্খল হয়ে পাড়ায় ঢুকলাম। সূর্যকে ঠিক মাথার ওপরে নিয়ে প্রায় বারোটার সময় আমরা পাড়ায় পৌছালাম। সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নিলাম এবং পেয়ারা খেলাম। পেয়ারা আমার ভীষণ পছন্দের তাই পেয়ারা পেয়ে আমি বেজায় খুশি। আরিফ আমাকে দুইটা পেয়ারা বেশি দিলো। দুপুরে রান্নার ব্যবস্থার কথা বলে আমরা ত্লাবং এর পথে যাত্রা শুরু করলাম। কিছুক্ষন উচুনিচু পথ হেটে আমরা স্রোতোবহা একটি ঝিরি পেলাম। ঝিরি ধরে সামনে যেতে থাকলাম। মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় বেশ ভালো স্রোত। ঝিরিটাও খুব সুন্দর। বেশি সুন্দর এর প্রবাহিত পানির শব্দ। ঝিরির শেষে গিয়ে যেখানটায় আমাদের ঝিরি পার হতে হবে সেখানটাতে অনেক বেশি স্রোত।  থাইক্ষ্যাং পাড়া থেকে যেই লোকাল গাইড নেওয়া হয়েছিলো সেই দাদা একটা একটা গাছের গুড়ি এনে দুই পাশের দুই পাথরের সাথে সেটাকে এমনভাবে আটকে দিলো যাতে স্রোতে কেউ ভারসাম্য হারালেও সেখানে আটকে থাকে। এতে করে বেশ খানিকটা জায়গা কিছুটা নিরাপদ হলো। আমি সহ টিমের কেউ কেউ সাতার জানে আবার কেউ কেউ জানে না। কিন্তু সাতার জানলেও সেই স্রোতের সামানে আমি ভয় পেতে বাধ্য। খুব ভয়ে ভয়ে একে অপরের সাহায্যে আমরা সেটা পার হলাম। এর পরের রাস্তাটাও বেশ অরন্যে ঘেরা। কোনো রাস্তা নাই। কিছু কিছু জায়গা একটু বেশিই হুমকিস্বরূপ।

এমনিভাবে সামনে যেতে যেতে আবার সেই শব্দ কানে আসতে লাগলো। ঝর্নার পানি আছরে পড়ার শব্দটাই যথেষ্ট উত্তেজনায় শক্তি পুনরায় সঞ্চয় করার জন্য। আসিফ বললো সামনে যারা আছে মনে হয় ঝর্না পেয়ে গেছে। তন্ময় বললো “নাহ, ঝর্না পেলে আরিফের সংকেত পাওয়া যেতো”। মানে আরিফ ঝর্না দেখলেই জোরে একটা চিৎকার দিবে।

এবং কিছুক্ষণ পরেই আমরা আরিফের সংকেত পেয়ে গেলাম। তারপরের রাস্তাটুকু চলতে মনে হয় যেন কোনো কষ্টই হয় নি। ঝর্নার কাছে দ্রুত যাওয়ার জন্য সব ভুলে হাটলাম এবং ঝর্নার সামনে এসে পৌছালাম। ওপর থেকে নিচে পানি আছরে পরারও যে এতটা সৌন্দর্য থাকে সেটা তখন অনুভব করলাম। পানির পরিমান বেশি থাকায় আসিফ বললো ” আমার মনে হচ্ছে দুই পাশে দুইটা জাদিপাই ”। ট্যুরের মেসেঞ্জার গ্রুপ যখন আসিফ খুলেছিলো তখন ত্লাবং এর একটা ছবি দিয়েছিলো গ্রপ হেড এ। সেই ছবির থেকে অন্যরকম লাগলো কারণ পানি অনেক বেশি। এমনকি নিচের জয়গাটাও পানিতে পরিপূর্ণ এবং বেশ স্রোত।

দুপাশ থেকে উপচে পরা পানির আছরে পড়ার সৌন্দর্য ; ত্লাবং ফটোগ্রাফারঃ ওয়াহিদুর রহমান

সবাই মিলে ছবি তুললাম। খুব বেশি ভিতরে গেলাম না স্রোতের ভয়ে। শুধু কোনো মতে ছবি তুলেই আমি কিনারে এসে পরলাম। বাকিরা যখন ছবি তুলছিলো,  পানিতে ভিজতেছিলো, সাতার কাটতেছিলো তখন কিনারে একটি পাথরে বসে আমি কেবলই ঝর্না দেখতেছিলাম। ফেরার তাগিদ না থাকলে ঝর্নার দিকে তাকিয়ে হারিয়ে যাওয়া যেতো অফুরন্ত ভালো লাগার রাজ্যে। সময় জ্ঞান যেখানে অনুপস্থিত।  কিন্তু কল্পনা যতই সুন্দর হোক বাস্তবে ফিরতে হয়। আমিও ফিরেছিলাম। সবার সাথে শুরু করেছিলাম ফিরতি যাত্রা। আবার সেই উচু নিচু, ঝোপঝাড়ের পথ, স্রোতবহা ঝিরি সব পেরিয়ে ফিরতে লাগলাম। ঝিরি শেষ করে পাহাড়ি রাস্তায় যখন হাটতে লাগলাম তখন রৌদ্রজ্বল পরিস্কার আকাশ। হঠাৎই  লোকাল যে গাইড দাদা আছে সে বলল আজকে বৃষ্টি হবে। শুনে আকাশের দিকে তাকালাম কিন্তু আকাশ দেখে আমাদের কারো মনে হলো না যে বৃষ্টি হবে।

যাইহোক, যাওয়া আসা মিলিয়ে প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টার যাত্রা শেষ করে ধীরে ধীরে পাড়ায় ঢুকলাম আমরা। সবাই ভীষণ ক্লান্ত।এর মধ্যে ফ্রু আপু কিছুটা বেশি ক্লান্ত হয়ে মনোবল হারিয়ে ফেললো। হাত পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আমাদের যেই ঘরে যেতে বলা হয়েছিলো সেখানে গেলাম। ঘরটা দুইতলা সমান উচু এবং সুন্দর। ঘরটাতে কোনো বাসিন্দা নেই। ফ্রু আপু ঘরে উঠে বললো সে বাকলাই পাড়ায় যেতে পারবে না। হয় সবাই সেখানে থেকে যাক নাহয় সে একা থাকুক পরের দিন সে যাবে। অতিরিক্ত গাইড খরচ সে বহন করবে। এটা শুনে টিমের কেউ রাজি হয়নি কারণ পরদিন সকালে সবার বাকলাই ঝর্না দেখতে যাওয়ার কথা৷ এবং সেখান থেকে ফিরে বিকেলে ঢাকার উদ্দেশ্য বের হবে। সুতরাং থাইক্ষ্যাং পাড়ায় থাকার পরিস্থতি নাই। এমনকি আমাদের প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস বাকলাই পাড়ায় রেখে আসা সেগুলোও রাতে লাগবে। গাইড দাদার সাথে কথা বলা হলো এবং সিদ্ধান্ত হলো সবাই বাকলাই পাড়ায় যাবে এবং  ফ্রু আপুকে টিম রেখে আসবে না। এটা খাওয়ার পরে আপুকে বুঝিয়ে বলা হবে।

সেদিন আমাদের খাবার ছিলো ভাত, ডাল আর কুমড়োর ঝোল। আর কিছুই ব্যবস্থা করা যায় নি। সবাই খুব ক্ষুধার্ত।  কুমড়োর ঝোল শুনে আমার পছন্দ হলো না খাবার মেনু কিন্তু ক্ষুধা নিবারনের জন্য খেতে হবে। খেতে বসে সেখানে খাবারের সাথে পেলাম পাহাড়ি মরিচ, নিয়ে নিলাম সেটাও। মরিচ আর কুমড়োর ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে যেই স্বাদ পেলাম সেটা প্রকাশের উর্ধ্বে। বুঝে পেলাম না কুমড়ো এত মজা কীভাবে হয়। এবং এটা শুধু আমিই না টিমের প্রত্যেকের কাছে। নাদিয়ার ভাষ্যমতে, “কুমড়োর ঝোলের সেই খাবার যেন অমৃত। ” সবাই চেটেপুটে খেয়ে নিলো। সাদিক প্রথমে বলেছিলো ভাত খাবে না। কিন্তু পরে আবার খেতে বসলেও কুমড়োর ঝোলটা পেলো না। তার আগেই শেষ।

সবাই খাওয়া শেষে রেডি হয়ে নিলো বাকলাই পাড়ার উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য। তার আগে ফ্রু আপুর সাথে কথা বলা হলো। ছবিও তুলে নিলো যে যার মত। সময়টা তখন পড়ন্ত বিকেল। ঘর থেকে নিচে নেমে আমাদের গাইড দাদার সাথে আমি আর নাদিয়া ছবি তুলে নিলাম। আসিফ সেই পুরোনো কথাই আমাকে আবার বললো সবার আগে যাত্রা শুরুর জন্য এবং আগে থাকার জন্য। আগে আগে হাটতেছি এমন সময় তন্ময়রা দোকানে গেলো সিগারেটের জন্য এবং আমাদের ডাকলো চা খাওয়ার জন্য। কিন্তু সেদিন রবিবার পাড়াবাসির প্রার্থনার দিন, সময় হয়ে যাওয়ায় সবাই ছুটে যাচ্ছে চার্চের দিকে। আমাদের কাছে কেউ কিছু বিক্রি ই করলো না। কারণ ওদের চার্চে যেতে হবে, সময় নাই। আমাদেরও সময় নাই, আমরাও থাইক্ষ্যাং পাড়া ত্যাগ করলাম পাঁচটা বেজে যাওয়ারও পরে, সন্ধ্যা নামার কিছু আগে ।

সেখান থেকে আমরা শুরু করলাম আমাদের যাত্রা, সামনে লম্বা পথ। হাটতে হাটতে আসিফ বার বার আমাকে একটা কথাই বোঝাচ্ছিলো যে স্লো হওয়া যাবে না, পিছনে পরা যাবে না। কিছুদুর যেতেই যেন টুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো। দুইদিন পাহাড়ে সন্ধ্যা নামতে দেখে মিলিয়ে নিলাম একটা কথার সাথে সেটা হচ্ছে “পাহাড়ে নাকি খুব তাড়াতাড়ি হঠাৎ করে সন্ধ্যা নামে।” আমরা নিজেরা নিজেদের হেড ল্যাম্প বের করে নিলাম এবং অব্যহতভাবে হাটা শুরু করলাম। এর মধ্যেই আকাশে বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলো। সাথে সাথে মনের মধ্যে জেকে বসলো ভয়। বৃষ্টিতে রাস্তা পিচ্ছিল, জোকের পরিমান বৃদ্ধি,  ঝিরির পানি বেড়ে প্রবল স্রোত হওয়া সহ নানা অসুবিধার কথা ভেবে ভয় পেতে থাকলো সকলেই।

আমি হাটতে থাকলাম সামনে এবং বার বার আসিফ বলতে থাকলো পিছনে পরা যাবে না। বৃষ্টি পড়া শুরু হলো, জোকের পরিমানও বেড়ে গেলো। সবার পায়ে জোক কামড়াচ্ছে কিন্তু কেউ ছাড়াচ্ছেও না। সবার একটাই চিন্তা তড়াতাড়ি হাটতে হবে। তাছাড়া গতি থেমে গেলে জোক ধরতেছেও বেশি। আমি, নাদিয়া আর আসিফ সবার আগে তারপর তন্ময় চলো আসলো তারপর সাদিক আর আরিফ এবং শেষে আসলো রাসেল ভাইয়া ও নিপুণ আপু। বাকি ফ্রু আপু, ওয়াহিদ ভাই, মামুন ভাই ও গাউড দাদা পিছনে পরে গেলো। আমাদের টিম দুইভাগ হয়ে গেলো।

আরিফ ও সাদিক পাহাড়ি রাস্তা কিছুটা ভালো চিনে। এবং এই পথেই একবার গিয়েছিলাম বিধায় ওদের ভরসায় আমারা সামনে হাটতে থাকলাম গাইড দাদাকে ছাড়া।  মাঝে মাঝে আমি দুই একটা জোক ছাড়িয়ে নিচ্ছি।  নাদিয়াও ছাড়িয়ে নিচ্ছে আর শরীরে যেখানে সন্দেহ হচ্ছে জোকের সেখানে দেখে দিচ্ছি। এর মধ্যে কারো কারো পা রক্তাক্ত হয়ে গেছে। আসিফ চলার পথে একটা পানি জমে থাকা জায়গায় পা দিতেই দেখা গেলো সেটা পুরো লাল হয়ে গেলো রক্তে। মনে হচ্ছিলো যেন ওর পায়ের ব্লিডিং থামতেছে না, যদিও এমন কিছু হয় নি। এবার আরিফ ও সাদিককে সামনে দেওয়া হলো রাস্তা চিনার সুবিধার্থে। পিছনের মানুষদের জন্য কিছুটা চিন্তা নিয়েই সমানে আগাতে থাকলাম। নিপুণ আপু ফ্রু আপুকে নিয়ে বলতেছিলো, ফ্রু আপু অনেক ট্রেক করেছে কিন্তু এবারে মনোবল হারিয়ে ফেলেছে তাই বেশি কষ্ট হচ্ছে।

আগাতে আগাতে একটা সময় আরিফের শব্দ পেলাম। কিছু একটা হয়েছে, খুব কষ্ট পাচ্ছে। সামনে গিয়ে ওর মুখ দেখে ভয় ই পেয়ে গিয়েছিলাম। ওর মত মানুষ অল্প আঘাতে এভাবে কাতরানোর কথা না। আমরা ভাবলাম আবার সাপ টাপ কামড়ালো কিনা। পরে দেখলাম একটা পোকা কামড়েছে৷ পোকাটা বিষাক্তই ছিলো। সেই ব্যাথা নিয়ে ও হাটা শুরু করলো সেই সাথে আমরাও। কিছুদুর গিয়ে দেখলাম তিন দিকে তিনটি রাস্তা গেছে সেখানে সবাই মিলে কথা বলে কিছুটা নিশ্চিত হয়ে একটা পথ ধরে আগালাম। হাটতে হাটতে আমারা খানিকটা বেশি পানি আছে এমন একটি ঝিরি পেয়ে গেলাম। সবাই এই ঝিরিটার জন্যই অপেক্ষা করতেছিলাম। জোকের জন্য রাস্তায় কোথাও দাড়িয়ে বিশ্রাম নেওয়া যায়নি। সবাই মিলে ঠিক করেছিলাম এই ঝিরিটার পানিতে গিয়ে সবাই কিছুটা বিশ্রাম নিবো। সবাই পানিতে নেমে কেউ দাড়িয়ে রইলো আবার কেউ বসে পড়লো।

ফিরে আসার রুপ ফটোগ্রাফারঃ আব্দুল আল মামুন

 ঝিরি থেকে বাকলাই পাড়া কাছেই। এখানে এসে মনে পড়লো সেই থাইক্ষ্যাং পাড়া থেকে এই পর্যন্ত রাস্তায় একবারও থেমে বিশ্রাম নেই নাই আমি। ভেবে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। যেখানে ইকটু পর পর আমি হাপিয়ে উঠি, কিছুক্ষণ পর পর আমার থামতে হয়, সেখানে এতটা রাস্তা একটানা এসে আমি হতবাক। এর মধ্যেই টের পেলাম পায়ে কিছু কামড় দিচ্ছে। পানির মধ্যে জুতা খুলে দেখলাম জোক। অথচ ঝিরিতে পানির স্রোতে নাকি জোক থাকে না।  অবশ্য জোকটা আগে থেকেই পায়ের সাথে আসতে পারে। আবার জোকটা রক্ত খেয়ে ফুলে ওঠাও ছিলো। যাইহোক, বেশকিছুক্ষন সেখানে আমরা অপেক্ষা করলাম এই আশায় যে পিছনের টিম মেম্বাররা যেন এসে জয়েন করতে পারে। কিন্তু তাদের দেখা মিলল না। যেহেতু গাইড দাদা তাদের সাথে ছিলো এবং আমাদেরও ঠান্ডায় শরীর খারাপ করতে পারে সেজন্য আমরা আবার পাড়ার দিকে হাটা শুরু করলাম। এবং উচু, নিচু, পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত পথ হেটে আমরা পাড়ায় পৌছালাম প্রায় আটটার দিকে। ভয়পেয়ে ও দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ননস্টপ ট্রেকিং করে আমরা তুলনামূলক কম সময়েই চলে গিয়েছিলাম।

গিয়েই প্রথমে ছেলেদের কলপাড়ে জায়গা দেওয়া হলো ফ্রেশ হতে। তার আগে নাদিয়া আর নিপুণ আপু হাত পা ধুয়ে ঘরে চলে গেলো। আর আমি বাইরে দাড়িয়ে রইলাম জোকের ভয়তে লবন পানি শরীরে ঢালবো সেজন্য। এক গ্রুপ ফ্রেশ হতে হতে দেখলাম গাইড দাদা চলে এসেছে এবং মেজাজটা একটু খারাপই।  তাকে একা দেখে জিজ্ঞেস করলাম ফ্রু আপু কই, সে বলল পিছনে আসতেছে। এরপর মামুন ভাই, ওয়াহিদ ভাই ও ফ্রু আপু আসলো প্রায় সাড়ে নয়টার দিকে। তাদের মুখে শুনলাম রাস্তায় নাকি গ্রিন ভাইপার তাদের সামনে পরেছিলো। একটি সংঘটিত না হওয়া বিপদের কথা শুনেই কেমন গা ছমছম করলো। মামুন ভাই আর ওয়াহিদ ভাই চলে গেলো বাকি ছেলেদের সাথে কলতলায়। যার জন্য আমাকে আরো বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়েই থাকত হলো। ইতিমধ্যে আমি বালতি ও মগের মধ্যে লবন নিয়ে নিয়েছি। ট্যুরের সবচেয়ে বাজে সময়টা ছিলো তখন একা একা দারিয়ে কলতলা খালি হওয়ার জন্য অপেক্ষা করাটা। দাড়িয়ে থেকে থেকে পা ভেঙে আসতেছিলো। সবার কাজ শেষ হওয়ার মুহুর্তে সাদিক বললো ওকে সময় দেওয়ার জন্য ও নাকি গোসল করবে৷ এটা শুনে মেজাজ তখন আমার সপ্তমে। এবং ওর সাথে যখন মেজাজ দেখিয়ে জোরে জোরে কথা বললাম তখন দাদা এসে বলল “দিদি, আস্তে কথা বলুন, সবাই শুনবে। আপনারা তো লুকিয়ে আছেন”। আমরা যে অফরুটে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘুরতে গেছি এবং পাড়ায় থাকার পারমিশন নাই এটা তো আমার মাথায় ই ছিলো না। এবং সাদিক বেচারা কোনো রকম হাত পা ধুয়েই ঘরে দৌড়।  নিপুণ আপু ও ফ্রু আপু অন্য কলতলায় চলে গিয়েছিলো এবং সবশেষে আমার সকল বিরক্তির অবসান ঘটিয়ে কলতলাকে খালি পাওয়া গেলো।

ফ্রেশ হয়ে যখন ঘরে ঢুকলাম তখন শরীরের অবস্থা নড়বড়ে। ঠিকমত পা ও রাখা যায় না। রান্নার জায়গায় গিয়ে দেখলাম নাদিয়া দায়িত্ব নিয়েছে রান্নার। ডিম ভুনা করবে কাটাকুটা সব রেডি। অনেক ঠান্ডায় কিছুক্ষণ গিয়ে বসে থেকে আসলাম চুলার পাশে গরমে। রান্না শেষে সবাই যখন খেলাম তখন ডিম ভুনার স্বাদের সবাই খুব প্রশংসা করতে লাগলো। সবসময় রান্না না করেও এত মজার ডিম রান্না করাটা আসলেই প্রশংসার। তাছাড়া এত ট্রেকিং এর পরে সবার যেই অবস্থা,সেটা নিয়ে রান্না করাটাও  অনেক বড় ব্যাপার। নাদিয়া সবার মন জয় করে নিলো। এর পরে কিছু মেডিসিন খেয়ে সকালে বাকলাই ঝর্নায় যাওয়া হবে নাকি হবে না সেই দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

চতুর্থ শেষ পর্ব

সকালবেলা ঘুম ভাঙলেও চোখ না খোলা অবস্থায় শুয়ে শুয়ে শুনতে পেলাম সবাই কথা বলছে কে কে বাকলাই ঝর্নায় যাবে আর কে কে যাবে না সেটা নিয়ে। ফ্রু আপু আর ওয়াহিদ ভাইয়া যাবে না আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া সেই সাথে শুনলাম নিপুণ আপুও যাবে না। আর নাদিয়াও আমার পাশেই শুয়ে আছে বললো যে যাবে না৷ ঐ দিকে তন্ময় ও শুয়ে শুয়ে বলতেছে যাবে না। বাকিরা যাবে, কিন্তু কথা হলো তাড়াতাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। কারণ ফিরে আসা মাত্রই আমারা পাড়া ত্যাগ করবো। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে যাবো না। শরীর, হাত, পা ব্যথা, রাস্তা অনেক খাড়া আর আমার উঠতে কষ্ট, এই রাস্তায়ও অনেক জোক, আরো কয়েকজন যাচ্ছে না, বাকিরাও খুব একটা জোর করে নাই, ঝর্নার সৌন্দর্যের লোভ দেখায় নি, ছোট ছোট এমন নানা কারণ ছিলো।

কিন্তু মুখ্য কারণ হলো টিমের যারা যাচ্ছে সবাই খুব ফাস্ট ট্রেকার সেখানে আমি গেলে অনেক টাইম লেগে যাবে কিন্তু আমাদের প্লান তাড়াতাড়ি পাড়ায় ব্যাক করা। সেক্ষেত্রে আমি গেলে টিমের কিছুটা অসুবিধা তৈরি হতে পারে। একে একে সবাই ঝটপট তৈরি হতে লাগলো বেরিয়ে পড়ার  জন্য। তন্ময়ও উঠে গেলো যাওয়ার জন্য৷ এমনকি শেষ মুহূর্তে নাদিয়াও উঠে তৈরি হয়ে গেলো ঝর্না দেখতে যাওয়ার জন্য। তখন আবার আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে পরে গেলাম। আসিফ যাওয়ার আগে আবারও জিজ্ঞেস করলো যাবো কিনা। তখন মত বদলে যেতে চাইলে সবার আবারও দেরি হয়ে যাবে কারণ ট্রেকিং এর জন্য আমার তৈরি হয়ে বের হতে সময় লাগবে। সুতরাং আমি না যাওয়ার সিদ্ধান্তে আটকে রইলাম আর ওরা চলে গেলো।

প্রথম ভালোলাগার পথ ধরে ফিরতে শুরু করা ফটোগ্রাফারঃ ওয়াহিদুর রহমান

নিপুণ আপু আর ফ্রু আপু সকালের নাস্তা তৈরি করতে লাগলো। ওয়াহিদ ভাইয়া দাদার বাচ্চাদের সাথে মিশে সময় কাটালো, ওদের সাথে গল্প করলো। আর আমি সকালের রোদ উপভোগ করতে করতে ব্রাশ করে নিলাম। সেদিন সকালের রোদটা খুব সুন্দর ছিলো। মেঘমুক্ত নীল আকাশের নিচে সেই মিষ্টি রোদটুকু মাথায় নিয়ে একা একা পাড়ার বেশ খানিকটা জায়গা হেটেছিলাম। ঠিক তখন মনে হয়েছিলো ঝর্না দেখতে না যাওয়ার সিদ্ধান্তটা ঠিক ছিলো। গেলে হয়তো সেই অল্প সময়ের একান্ত নিজেকে নিয়ে নিজের সুখকর অনুভুতিটুকু পাওয়া হতো না। এরপর ফিরে এসে ভাবলাম গতরাতের সবার ভেজা জামাকাপড় গুলো রোদে শুকাতে দিলে ভালো হয়। কিছুটা শুকালেও বাকি পথটুকু বহন করতে হাল্কা হবে। ব্যাগ থেকে নাদিয়ার ভেজা কাপড় বের করে এবং বাকিদের যেগুলো সামনে পেলাম সব বাঁশের বেড়ার ওপর শুকাতে দিলাম।

সবাই বসে গল্প করছি এমন সময় গাইড দাদার বড় ছেলে ঘরে এসে বলল পাড়ায় নাকি আর্মি এসেছে। ও বাংলা জানে তাই দাদার পরে ওর সাথেই আমরা কিছুটা যোগাযোগ করতে পারি।  শুনেই আমরা সতর্ক হয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। ছেলেটা দরজা কিছুটা লাগিয়ে চলে গেলো ওর মা কে খুজতে। ওর মা এসে দেখলো আমরা ঘরের মধ্যে বসে আছি। ইশারায় আমাদের কথা বলতে বারণ করলো। দিদি আবার বাংলা পারে না। আমরা তার বড় ছেলের সাহায্যে তাকে কিছু বলি। হঠাৎ আমার মনে পরলো বাইরে আমাদের সবার ভিজা কাপড় শুকাতে দেওয়া। যেটা দেখলেই আমাদের ধরা পরতে হবে। কিন্তু কথাটা দিদিকে বোঝাবো কিভাবে সেটা নিয়ে মুশকিল।  আশেপাশে তার বড় ছেলেকেও দেখছি না এবং আমরাও বের হতে পারছি না। কোনোমতে ইশারায় তাকে বোঝালাম এবং তার ছেলেও তখন চলে আসে। মা ও ছেলে মিলে সব জামাকাপড় দৌড়ে গিয়ে ঘরে নিয়ে আসে।

নিষ্পাপ কিছু ভালো অনুভুতির মুহূর্ত ফটোগ্রাফারঃ ওয়াহিদুর রহমান

ছেলেটা কিছুক্ষন পরে আবার এসে আমাদের সতর্ক করে গেলো কথা বলতে বারণ করলো আর বলল আর্মি নাকি পাড়ার দোকানে চলে এসেছে। আমরা ভিতরে খুব একটা একটা ভয় ভয় নিয়ে বসে আছি। ফিসফিস করে কথা বলছি। তার মধ্যেই আমি ওয়াহিদ ভাইকে দিয়ে গাইড দাদার পিচ্চি বাচ্চার সাথে ছবি তুলে নিলাম। দোলনায় ঘুমন্ত ফুটফুটে শিশুর সাথে ছবি তুলতে পেরে আমি বলতে গেলে ভীষণ খুশি। এবং আরো একবার আমি সকালের সেই ঝর্নায় না যাওয়ার সিদ্ধান্তের জন্য যারপরনাই সন্তুষ্ট হলাম। এর মধ্যেই সময়ের কথা খেয়াল হতেই মনে পড়লো ঝর্না দেখতে যাওয়া টিমের ফিরে আসার সময় হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে ওরা পাড়ায় ঢুকলে একেবারে আর্মির মুখোমুখি পরবে। নিপুণ আপু ওদের ফোনে পাওয়ার চেস্টা করলো যেহেতু বাকলাই পাড়ায় নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। প্রথমে রাসেল ভাইয়াকে কল দিলো কিন্তু পেলো না। এর পরে তন্ময়কে কল দিলে সেটা রিং হলো, কল রিসভও হলো কিন্তু কন্ঠটা একটু অন্যরকম রাগলো। নিপুণ আপু ফিসফিস করে বলে দিলো “তোমরা এখন পাড়ায় এসো না, আর্মি এসেছে।” ওপাশ থেকে কথা বুঝতে পেরেছে এমন কোনো রেসপন্স আসলো না। আপু ফোন রেখে রাসেল ভাইয়ার ফোনে একটা মেসেজ পাঠিয়ে রাখলো।

এর মধ্যে আমরা শুনতে পেলাম আর্মি লোকটি আমরা যেই ঘরে তার ঠিক পাশেই কথা বলছে গাইড দাদার বাবার সাথে। তার কথা আমরা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। তখন আমরা নিশ্চুপ বসে ছিলাম। মনে হচ্ছিলো যেন নিজেদের নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছিলাম। কিছুক্ষন এভাবে থাকার পর গাইড দাদার বোন এসে বললো চিন্তা না করতে, আর্মি চলে যাচ্ছে। আর্মি যাওয়ার ও প্রায় আধঘন্টা পরে ওরা ফিরে এসেছিলো। এসেই নাদিয়া আর আসিফ বললো না গিয়ে ভালোই করেছি খুব কষ্ট হতো। ওদের প্রায় চার ঘন্টার সফর শেষে সবাই ক্লান্ত। বিশ্রাম নিয়ে আমরা সকলে মিলে সকালের নাস্তা সেরে নিলাম। তারপর আমরা ওদের আমাদের আর্মির কাছে ধরা পড়ার সম্ভাবনার রোমাঞ্চকর মুহুর্তের গল্প শোনালাম আর ওরা আমাদের বাকলাই ঝর্নার গল্প শোনালো। তখন আমরা জানতে পারলাম রাসেল ভাইয়া ফোন পাড়াতেই রুমে রেখে গেছে সাইলেন্ট অবস্থায় আর তন্ময়ের ফোনে নেটওয়ার্ক না থাকায় কল ফরওয়ার্ড হয়ে ওর বাবার কাছে চলে গেছে। তার মানে নিপুণ আপু কথা বলেছে তন্ময়ের বাবার সাথে।

বিশ্রামের সাথে চলল কিছু গল্প আর আড্ডা। তখন খবর হলো ১১ কিলো থেকে যেই জীপ এসে নিয়ে যাবে সে তাড়াতাড়ি আসতে পারবে না ধরা পরে যাওয়ার ভয়তে। সুতরাং আমাদের পাড়া থেকে দেরি করে বের হতে হবে। তাই সকলের মধ্যেই একটা গা ছাড়া ভাব চলে এলো। ক্লান্তিতে নাদিয়ে বসে বসে চোখ বন্ধ করে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলো। এরপরে সবাই ধীরে সুস্থে ব্যাগ গুছিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হলো। তন্ময় বললো আমরা আস্তে আস্তে হাটা শুরু করি জীপ আসতে আসতে যতটুকু আগাতে পারি আর কি। সবাই বের হলাম এবং পাড়া ছাড়ার আগে দোকান থেকে সবাই মিলে চা খেয়ে নিলাম। এরপরে আবার হাটতে হাটতে পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। সূর্যের করা রোদ মাথায় করে নিয়ে পথ চলা। গল্প, কথা আর সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে এগিয়ে চলা। তখনো জীপ কখন আসবে সেটা অনিশ্চিত। এমনকি থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার জীপ ও থানচি গিয়ে ঠিক করতে হবে। নেটওয়ার্ক পেলেই ওরা চেষ্টা করছে যোগাযোগ করার। এভাবে হাটতে হাটতে একটা দোকানের সামনে এসে সবাই বিশ্রাম নিলো আমরা পেপে আর চা খেয়ে নিলাম। সেখানে কথা হলো রোড কনস্ট্রাকশনের সাথে জরিত এমন একজনের সাথে। সে আমাদের সবাইকে দাওয়াত ও করলো। কিন্তু গ্রহণ করা সম্ভব নয় কারণ সবাইকে ফিরতে হবে তার কর্মস্থলে। তখন সে বললো থানচি থেকে জীপের ব্যবস্থা সে করে দিবে। এরপরে থানচি অভিমুখে সেও আমাদের সাথেই চললো। কতদুর হাটতে হাটতে দেখতে পেলাম একটা খালি জীপ আসতেছে। কাছাকাছি আসায় কথা বলতে গেলে জানা গেলো পিছনে আরো একটি টিম আছে এটা তাদের আনতে যাচ্ছে।  এরপর হাটতে হাটতে কোনো এক উচু খাড়া রাস্তার বাকে সবাই মিলে বসলাম। সময়টা তখন পড়ন্ত বিকেল।

সব শেষে যান্ত্রিকতায় চেপে বসা ফটোগ্রাফারঃ আব্দুল আল মামুন

যাওয়ার সময় সুন্দর একটা গাড়ির কালার ছিলো। আসার সময় বার বার বলতেছিলাম হলুদ রংয়ের কোনো গাড়ি হলে ভালো হবে। কিছুক্ষণ পরে হলুদ না হলেও হলুদের কাছাকাছি রংয়ের একটি গাড়ি এলো। এবং সেটাই নাকি আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য এসেছে। রং সুন্দর দেখে মামুন ভাইকে বলে কয়েকটা ছবিও তুলে নিলাম গাড়ির ওপরে বসে। এবং সেই দৃষ্টিনন্দ পথটুকু পাড়ি দিয়ে আমরা থানচি চলে এলাম। আমাদের সাথে সেই লোকটিও এলো। সে ই আবার বান্দরবান শহরের জন্য একটি জীপ ঠিক করে দিলো। রাতের আধারে হেডলাইট জালিয়ে চলতে শুরু করলো জীপ। নয়টায় আমাদের ঢাকাগামী বাস। যারা ঢাকা আসবো তারা কিছুটা চিন্তিত সময়মত বাস ধরতে পারবো কিনা সেটা নিয়ে। পথের মধ্যেই জীপের চাকা পাঞ্চার হওয়ায় চাকা পরিবর্তন করতে হলো। সেখানেও কিছুটা সময় গেলো। এরপরে আবার চলতে শুরু করা।এবারে বাস মিস করার চিন্তাটা আরো বেড়ে গেলো। জীপে বসে কাউন্টারে যোগাযোগ করা হলো। ক্লান্ত শরীর নিয়ে নাদিয়ার কোলে পরে ঘুমাতে ঘুমাতে চলে আসলাম বান্দরবান শহরে প্রায় সাড়ে নয়টার দিকে। এসে দেখি ঢাকাগামী  বাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করে মাত্রই কাউন্টার থেকে রাস্তায় চলে এসেছে। আমরা কোনোমতে জীপ থেকে নেমেই বাসে উঠে পরলাম। উঠে আবার ঘুম। মাঝরাতে ঢাকার সায়েদাবাদে বাস নামিয়ে দিলো। এবং সেখান থেকে যে যে যার যার বাসায়। জীবনের প্রথম বান্দরবান গিয়ে অসংখ্য সুখস্মৃতি আর মনের খোরাক নিয়ে ফিরে এলাম।

 “পালামৌ” বইতে সঞ্জীবচন্দ্র চট্যোপাধ্যায় বলেছিলো “বঙ্গবাসীদের কেবল মাঠ দেখা অভ্যাস, মৃত্তিকার সামান্য স্তূপ দেখিলেই তাহাদের আনন্দ হয়”। আর আমি তো অনেক পাহাড়, ঝর্না আর গহীন অরন্য দেখেছিলাম। তাই সেই আনন্দের পরিমানটা যে  কতগুন বেশি ছিলো সেটাও হয়তো প্রকাশ করে বোঝানো যাবে না।

Leave a Comment
Share
ট্যাগঃ Bandarbanjadipai