ভ্যান্টেজ পয়েন্ট হোমস্টে থেকে দার্জিলিং শহর।
দার্জিলিং (Darjeeling) জায়গাটায় কিন্তু মাঝেমধ্যেই যাওয়া যায়। Meandering roads, splash green coniferous trees, majestic Kanchenjunga, canopy of mist, Gothic architecture, illustrious history, cultural legacy, fuming cup of exotic teas এবং আরও অনেক কিছু….. সব মিলিয়ে জায়গাটার মধ্যে যে রোমান্টিসিজম আছে তার জুড়ি মেলা ভার। অনেকে বলবেন খুব ঘিঞ্জি হয়ে গেছে, বড় ট্রাফিক জ্যাম হয়; কিন্তু সে আর কোন প্রমিনেন্ট হিল স্টেশনটাতে হয়না বলতে পারেন? শিমলা, মানালি, নৈনিতাল, গ্যাংটক, শিলং …… কিছু বাদ আছে?
দার্জিলিঙে গেলে আর কিছু দেখি আর না দেখি পদ্মজা নাইডু জু আর HMI কখনোই বাদ দিই না, আর এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে পরের দিন দার্জিলিঙে আমি আর আমার গিন্নী সম্পূর্ণ পায়ে হেঁটে শহরটাকে এক্সপ্লোর করার চেষ্টা করেছি; সেখানেই এই পোস্টের প্রাসঙ্গিকতা।
দার্জিলিং এ কোন হোটেল নয়, এবারে আমরা একটা হোমস্টেতে ছিলাম যার নাম ভ্যানটেজ পয়েন্ট হোমস্টে। এই জায়গাটা ম্যাল ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে গান্ধী রোড বরাবর সার্কিট হাউস পেরিয়ে মোটামুটি এক কিলোমিটার দূরে। ঠিক করে নিয়েছিলাম যে পরের দিন আমরা তথাকথিত কোন সাইটসিইং করতে যাব না, তার বদলে শহরটা পায়ে হেঁটে ঘুরবো। তা সেই গান্ধী রোড বরাবর ম্যালের দিকে আসতে ম্যাল ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের একটু আগে রাস্তার বাঁদিকে পাওয়া যাবে হিমালায়ান টিবেট মিউজিয়াম। ট্যুরিস্টরা এই মিউজিয়ামের খবর রাখেন বলে মনে হয় না। আমরা যে এক ঘন্টা ছিলাম ওখানে সেই এক ঘন্টায় আমরা ছাড়া আর একজন পর্যটককেও দেখিনি এই মিউজিয়াম ভিজিট করতে। সম্পূর্ণ এসি মিউজিয়ামে তিব্বতের ইতিহাস, তার সামাজিক, আর্থিক এবং কালচারাল হিস্ট্রি খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা আছে অজস্র আইডল, পেইন্টিং এবং ফ্রেস্কোর মাধ্যমে। বেসমেন্টের ফ্লোরে তিব্বতের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে; বিশেষ করে দলাই লামা এবং ‘টিবেটান অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইন এক্সাইল’ এই বিষয়গুলো অজস্র ছবি ও তথ্যের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। সামান্য যে ক’জন স্টাফ এই মিউজিয়ামে আছেন তারা সবাই অত্যন্ত ভদ্র এবং সাহায্যকারী মানুষ। 50/- টাকা এন্ট্রি ফির বিনিময়ে আপনি ছবি তোলার সুযোগ সহ সম্পূর্ণ মিউজিয়াম টি নিজের মতো ঘুরে দেখতে পারেন। যারা দার্জিলিংয়ের leisure trip করতে চান বা করতে যান, তারা এই মিউজিয়ামটা ঘুরে দেখে আসতে পারেন; আশা করি খারাপ লাগবে না।
মিউজিয়াম দেখা শেষ করার পরের অবশ্য গন্তব্য ছিল Keventer’s. 100 বছরের পুরনো সাহেবি আমলের শুধুমাত্র সাহেবি ব্রেকফাস্ট রেস্টুরেন্টে দুপুর বারোটার পরে ব্রেকফাস্ট মেনু দিয়েও যে অনায়াসে লাঞ্চ করা যায় সেটা Keventer’s এ না গেলে বুঝতে পারা সম্ভব নয়। Hot Platter আর কফি, উফফ, জিভে জল আনার জন্য যথেষ্ট।
Keventer’s থেকে নেমে এসে নেহরু রোড ধরে ম্যালের রাস্তায় উঠতে থাকুন। Glenary’s ছাড়িয়ে একটু গেলে বাঁদিকে দাস স্টুডিও পড়বে। সবাই নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, কিন্তু ভেতরে ঢুকেছেন কি? দার্জিলিংয়ের দেড়শ বছরের ইতিহাস এই দাস স্টুডিওতে ছোট-বড়-মাঝারি বিভিন্ন সাইজে আক্ষরিক অর্থে ফ্রেমবন্দী হয়ে আছে। যদিও দাস স্টুডিও কোন মিউজিয়াম নয়, নিতান্তই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, তবুও ওদের কালেকশনটা স্বচক্ষে না দেখলে ইতিহাসের কয়েকটা পাতা যেন অদেখা, অচেনাই রয়ে যায়।
মোটামুটি চার চৌকো ম্যালের দুই দিক থেকে ছ’টা রাস্তা বেরিয়েছে; আমরা এই ছ’টা রাস্তাই এক্সপ্লোর করেছিলাম। ভানু ভক্তের মূর্তির ডান দিকে যে মহাকাল বাজার আছে সেই বাজার পেরিয়ে একটু গেলেই মহাকাল মন্দির ওঠার রাস্তা দেখা যায়। সামান্য একটু খাড়াই রাস্তা অতিক্রম করে মহাকাল মন্দির চত্বরে গেলে এক অদ্ভুত দৃশ্য চোখে ধরা দেয়….. হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান; রুদ্র আর বুদ্ধ পাশাপাশি বসে আছেন এবং তাদের সামনে পন্ডিত জী এবং বৌদ্ধ ভিক্ষু আপন মনে নিজেদের কাজ করে চলেছেন। এই শান্তি যদি প্রকৃত অর্থে সর্বত্র বিরাজ করতো তাহলে পৃথিবীর ইতিহাসই অন্যরকম ভাবে লেখা হতো, আর ভূগোলটাও ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেত না।
ভানুভক্তের মূর্তির বাঁ দিকের রাস্তা রাজভবন হয়ে সোজা পদ্মজা নাইডু চিড়িয়াখানার দিকে চলে গেছে। রাজভবন রোড আমার মতে দার্জিলিংয়ের সবথেকে সুন্দর এবং অভিজাত রাস্তা। এই রাস্তা ধরে হাঁটার অভিজ্ঞতাই আলাদা; বহুল পরিচিত এই রাস্তায় সেদিন আলাদা করে আর হাঁটা হয়নি। আর তার পাশের রাস্তায় (পরিবার নিয়ে গেলে) আশা করি সবাই একবার না একবার ঢুঁ মেরেছেন বা যেতে বাধ্য হয়েছেন; কারণ ওটাই যে বিখ্যাত ম্যাল মার্কেট..!!
এবারে আমাদের যাওয়া অন্য রাস্তা ধরে। পুলিশ চৌকির পাশ দিয়ে গোল্ডেন টিপস এর টি বার কে ডান হাতে রেখে যে রাস্তা সোজা নিচে নেমে গেছে তার নাম হলো দেশবন্ধু রোড। এই রাস্তা ধরে সিধে নীচে নামলে বাঁদিকে সাদা রংয়ের একটা বাড়ি পাওয়া যায়। বর্তমানে বন্ধ এই বাড়িতেই 1925 সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই বাড়িতে এক সময় দেশবন্ধুর নামে এক সংগ্রহশালা ছিল কিন্তু সেই সংগ্রহশালাও বর্তমানে বন্ধ। ঐতিহাসিক এই বাড়িতে সামগ্রিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব বড় প্রকট। জানিনা প্রশাসন কেনো এই ঐতিহাসিক নিদর্শন এইরকম অবহেলায় ফেলে রেখেছে। যাই হোক, এই রাস্তা ধরে আরো নীচে নেমে গেলে ভুটিয়া বস্তি রোডের শেষে একটি টিবেটান মনস্ট্রি আছে। আমাদের লক্ষ্যই ছিল এই মনাস্ট্রি তে পৌঁছানো। কিন্তু ভাগ্য ছিল নিতান্তই খারাপ; প্রবল বৃষ্টি শুরু হওয়ায় ওই খাড়াই রাস্তা ধরে আর নীচে নামার মতো সময় আর সুযোগ ছিল না। তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই ওই মনাস্ট্রির কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া সত্ত্বেও ছাতা মাথায় দিয়ে আমরা উপরে উঠতে শুরু করি। খাড়া চড়াই ভেঙে আধঘন্টা ধরে উপরে ওঠার পরে প্রথম কাজটাই ছিল গোল্ডেন টিপসে ধূমায়িত Oolong Tea এর আস্বাদ গ্রহণ করা। আমাদের হয়নি, তবে আপনারা চাইলে কিন্তু এই Guiders Monastry ঘুরে আসতে পারেন, ভালো লাগবে।
চা পান শেষ হলে আমাদের গন্তব্য ছিল একমাত্র বাকি থাকা জাকির হুসেন রোড ধরে হন্টন। পুলিশ চৌকি কে বাঁ হাতে রেখে ঘোড়ার আস্তাবলের পাশ দিয়ে যে রাস্তা চলে গেছে সেটাই জাকির হুসেন রোড। এই রাস্তা ধরে সামান্য একটু এগিয়ে বাঁদিকে একটি বাড়ির দোতলায় একটা স্থানীয় রেস্টুরেন্টের সন্ধান পাই; নাম ফুড হাউস, দার্জিলিং। এই রেস্তোরাঁয় চাকচিক্য বা চমক কোনটাই নেই, কিন্তু যেটা আছে সেটা হল প্রকৃত তিব্বতি রান্নার অসাধারণ স্বাদ; লোকে ইংরিজিতে aithentic cuisine ও বলে থাকে। আমি ও আমার গিন্নী ছাড়া ওই রেস্টুরেন্টে ওই সময় বাকি যারা ছিল তারা সবাই স্থানীয় লোক। বোঝাই যায় ট্যুরিস্টরা এই সব খাবারের দোকানে খুব একটা আসেনা। আমরা এখানে গিয়ানথুক থুকপা অর্ডার দিয়েছিলাম; এত ভালো থুকপা আমরা এর আগে কখনো খাইনি। 160/- টাকার এক প্লেট থুকপা দুজনের জন্য যথেষ্ট। এই জাকির হুসেন রোডেই বেশ কয়েকটি ভালো এবং বড় কনফেকশনারী ও আছে। সদ্য বেকড হওয়া বিস্কিট ও কেকের গন্ধে জায়গাটা ম-ম করে।
তারপর ম্যালে মেঘ আর সন্ধ্যা একসঙ্গে নামল। আরো কিছুটা সময় ম্যালে ঘোরাঘুরি করে ফেরার পথ ধরা। Glenary’s এ আগের দিন সন্ধ্যাতেই খাওয়া-দাওয়া করা হয়েছিল বলে এই দিন আর যাওয়া হয়নি। আর হ্যাঁ, নেহরু রোড এবং জাকির হোসেন রোড, এই দুই রাস্তাতেই কিন্তু স্ট্রীট ফুডের বেশ বড়সড় রমরমা আছে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাওয়ায় ইচ্ছা থাকলে এই দোকানগুলো ট্রাই করতে পারেন। ভালো চা কেনার থাকলে ম্যাল থেকে নেহেরু রোড ধরে নীচে নামার পথে ডানদিকে ময়ূখ বলে যে দোকানটা আছে তার কথা ভেবে দেখতে পারেন। এরা বিভিন্ন এস্টেটের চা ঠিকঠাক দামে বিক্রি করে; ফার্স্ট ফ্লাশ, সেকেণ্ড ফ্লাশ, উলং, মাস্কাটেল, আর্ল গ্রে, রোস্টেড…. এবং আরো বহু ভারাইটি পাওয়া যায়।
যাইহোক এই পোষ্টের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের মতো আরো কোন উৎসাহী ব্যক্তি যদি সারাদিনটা হেঁটে হেঁটে দার্জিলিং এর ফ্লেভার উপভোগ করতে চান তাহলে কিভাবে করতে পারেন তার একটা বিবরণী। হতেই পারে যে আরও অনেকে আরো অন্য ভাবে দার্জিলিং শহর কে উপভোগ করেছেন। সেই কাহিনী নিশ্চয়ই অন্যরকম এবং মনোগ্রাহীও বটে; আমি শুধু আমাদের কাহিনী এখানে শেয়ার করলাম। যদি কারোর উপকারে লাগে তাহলে খুশি হব।
ভালো থেকো দার্জিলিং; আবার ফিরে আসবো তোমায় নতুন করে খুঁজে নিতে, তোমায় নতুন করে চিনে নিতে।
Leave a Comment