মেঘ-বরফের রাজ্য দার্জিলিং ও সিকিম

ইচ্ছেটা হঠাৎ করেই উদয় হলো। গত বছর ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে (১৫ই আগস্ট) আমি আর আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু মেঘালয় গিয়েছিলাম। ভাবলাম এবার দার্জিলিং গেলে কেমন হয়? দার্জিলিং-এ বসন্তকাল মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত। তাই ৫ এপ্রিল স্বস্ত্রীক ঢাকার কল্যাণপুর থেকে মানিক এক্সপ্রেস (এসি)-এ বুড়িমারির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম রাত ৯টায়। ভাড়া পড়লো জনপ্রতি ৯০০ টাকা। সকাল সাড়ে ৭টায় আমরা বুড়িমারি স্থলবন্দরে পৌঁছলাম। পৌঁছেই আমাদের পাসপোর্ট জমা দিয়ে দিলাম মানিক এক্সপ্রেস-এর কর্মচারিদের কাছে। তারা জনপ্রতি ২৫০ টাকা বিনিময়ে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনের সকল কাজ সম্পন্ন করে দেয়। এটা কিভাবে করে? এর ভিতরের গল্পটা আর নাইবা বললাম। আমরা সেখানে ফ্রেশ হয়ে বিখ্যাত বুড়ির হোটেলে নাস্তা করলাম। সকাল ৯টায় ইমিগ্রেশন অফিস খোলার পর শুধু ছবি তোলার কাজটা লাইন ধরে সারতে হলো। ব্যাস, বাংলাদেশ বর্ডারের কার্যক্রমের এখানেই ইতি। এবার হেঁটে ভারতীয় ইমিগ্রেশনে ঢুকলাম। সেখানেও যথারীতি দালালের দৌরাত্ম। ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কাজ জনপ্রতি ১০০ রুপিতে সারতে হলো।

দুই বর্ডারের কার্যক্রম শেষ হলো। আমাদের প্রথম কাজ ছিল ঘড়ির সময় ৩০ মিনিট পেছানো। তাই করলাম। এবার যেতে হবে শিলিগুড়ি। রিজার্ভ ট্যাক্সিতে মোটামুটি ১,২০০-১,৫০০ রুপি, শেয়ারে গেলে জনপ্রতি ২৫০ রুপি আর ১০ সিটের জিপে জনপ্রতি ভাড়া পড়ে ১৫০ রুপি। আমাদের ট্যাক্সি শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলো ১২টায়। পৌঁছাতে লাগবে মোটামুটি ৩ ঘন্টার মতো। মাঝপথে আসতেই শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। দারুণ! দার্জিলিং এর ফ্লেভার শিলিগুড়িতেই পাওয়া গেল। এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আমরা শিলিগুড়ির দার্জিলিং জিপস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম দুপুর ৩টার দিকে। আমাদের বড় একটা ব্যাকপ্যাক আর একটা লাগেজ আছে। দু’টোই তুলে দিলাম জিপের ছাদে। বৃষ্টি থেকে মালামাল বাঁচাতে পলিথিন দিয়ে দেয়া হলো। এবার জিপ ছুটতে শুরু করলো দার্জিলিং এর উদ্দেশ্যে। ভাড়া জনপ্রতি ২০০ রুপি।

জিপ মিনিট চল্লিশ যাবার পরই দূরে চোখে পড়লো সুউচ্চ পাহাড়। এই পাহাড়ের গাঁ বেয়েই আমাদের জিপ উপরে উঠতে শুরু করল। পাহাড়ি রাস্তা যথেষ্ট মসৃণ ও আঁকাবাঁকা। ভয়ের ব্যাপারটা ঘটল তখন যখন দেখলাম বাঁপাশে কোন রেলিং বা সীমানা প্রাচীর নেই। প্রায় আধঘন্টা পর আবিষ্কার করলাম নিচের দিকে তাকালে ভয়ে গায়ে কাটা দিচ্ছে। আমাদের গাড়ি মোটামুটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২,৫০০ ফুট উপর দিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠছে। শত শত বাঁক এই পাহাড়গুলিতে। গাড়ি উপরে উঠছে তো উঠছেই, ছুটছে তো ছুটছেই ; যেন এর কোন বিরাম নেই। ৩০ বা ৪০ মিনিট পরপর আমরা সমতল কোন একটি শহরে পৌঁছে যাচ্ছি আর তখনই মনে হচ্ছে এটাই বুঝি আমার স্বপ্নের দার্জিলিং। আশাভঙ্গ হয় তখনই যখন সেই শহরগুলোকেও পিছু ফেলে আমাদের গাড়ি ছুটে যায় সামনের দিকে। যাহোক, যখন আমরা দার্জিলিং (Darjeeling) এ পৌঁছলাম তখন সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা। ক্ষুধায় পেট চো-চো করছে। বৃষ্টি সেই যে পিছু নিল আর কিন্তু থামেনি এক দন্ডের জন্যেও। সুতরাং আমরা তাড়াতাড়ি আমাদের বাক্স-পেটরা নিয়ে ছাতার নিচে মাথা গুঁজে একটি মুসলিম হোটেলের সন্ধানে বের হলাম।

একজনকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, আপনারা বড় মসজিদের কাছে মুসলিম হোটেল পাবেন। তাই করলাম, ফলাফলও হলো শুভ। চকবাজার থেকে হেঁটে প্রায় ৫/৬ মিনিটের খাড়াই ঢালু পথ দিয়ে উঠতেই আমরা মসজিদটির সন্ধান পেলাম। মসজিদের কাছেই দু’টি মুসলিম হোটেল। একটি ছোট আর আরেকটি বড়। আমরা বড়টাতে ঢুকে পেটচুক্তি গরুর মাংস দিয়ে ভাত খেলাম। হোটেলের নাম ইসলামিয়া রেস্টেুরেন্ট। যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ও ছিমছাম। গরুর মাংস ৬০ রুপি। যথেষ্ট সুস্বাদু কিন্তু অনেক ঝাল। মুসলিম হোটেলের পাশেই একটি আবাসিক হোটেল পেলাম। নাম হোটেল ক্রিস্টাল প্যালেস (লামা রোডে অবস্থিত)। সেখানে দিনপ্রতি ১,৫০০ রুপিতে একটা রুম নিলাম। হোটেলে ডকুমেন্ট হিসেবে প্রত্যেকের পাসপোর্ট আর ভিসার ফটোকপি রাখলো। সুন্দর ছিমছাম রুম। ওয়াইফাই, গীজার, টিভিসহ যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা আছে। দার্জিলিং এ রাত ৮টার পর সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। তাই ক্লান্ত শরীরে আর হোটেল থেকে বের হলাম না। লম্বা জার্নির পর লম্বা একটা ঘুম দেয়াটাই শ্রেয় মনে হলো।

পরদিন সকাল ৭টায় ঘুম ভাঙল। জানালায় ভারি পর্দা ছিল। পর্দা সরাতেই মুখ দিয়ে একটি কথাই বেরিয়ে এলো আর তাহলো ‘‘ওয়াও!! অসাধারণ’’। রোদ্রজ্জ্বল আবহাওয়া। পাহাড়ের প্রতিটি ধাপে ধাপে বাড়ি আর হোটেল। ধাপগুলি শেষ হবার পর প্রায় ৭,০০০ ফুট গভীর খাদ। পুরু ঘনত্বের সাদা সাদা মেঘগুলি ভাসছে খাদের উপর যত্রতত্রভাবে যা হোটেলের উচ্চতা থেকেও অনেকটা নিচে। মনে হচ্ছে হোটেল থেকে নেমে ৩০/৪০ মিনিট নিচে নামলেই মেঘ ছুঁতে পারবো। এমন ভিউ কিন্তু সব হোটেল থেকে দেখা যায় না বা হোটেলের সব রুম থেকেও দেখা যায় না। আমরা সৌভাগ্যবান ছিলাম, তাই প্রকৃতি আমাদের নিরাশ করেনি। যাক, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আবার ইসলামিয়া হোটেলে নাস্তা সারলাম পরটা, ডিম আর চা দিয়ে।

এবার গন্তব্য চকবাজার মোড় ট্যাক্সিস্ট্যান্ড। দরদাম করে সাইট সিয়িং এর জন্য ট্যাক্সি নিলাম ১,৫০০ রুপিতে। প্রথমে গেলাম ঘুম রেলস্টেশন ও ঘুম রেলওয়ে মিউজিয়াম। এই স্টেশন ইউনেস্কো ওয়ার্ড হেরিটেজের একটি অংশ, যা পৃথিবীর সবচেয়ে উচুঁ রেলস্টেশন (৭,৭০৪ ফুট)। রেলস্টেশনের অদূরেই ঘুম মনেস্ট্রি। এটি একটি বৌদ্ধ মঠ। এটির জনপ্রিয় নাম হল ইগা চেওলিং মঠ। এটি ঘুম শহরে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। মঠে মৈত্রেয় বুদ্ধের একটি ১৫ ফুট লম্বা মূর্তি আছে। ১৮৭৫ সালে লামা শেরাব গ্যাতসো এই মঠ স্থাপন করেন। ঘুম শহরের তিনটি মঠের মধ্যে এটি বৃহত্তর। সেখান থেকে গেলাম দালি মনেস্ট্রি, খুবই সুন্দর।

তারপর সেখান থেকে সরাসরি পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুওলজিক্যাল পার্ক। পার্কের প্রবেশ পথেই অনেকগুলি দোকান সাজানো আছে। সেখানে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসে থাকে দোকানিরা। শীতের শাল, জ্যাকেট, ট্রেডিশনাল ছুড়ি, পেইন্টিংসহ নানা জিনিসপত্র এখান থেকে দরদাম করে কেনা যায়। পার্কের প্রবেশমূল্য সার্কভুক্ত দেশের জন্য জনপ্রতি ৬০ টাকা। এই পার্কের ভিতর প্রবেশ করলেই প্রথমে পড়বে চিড়িয়াখানা। অনেক ছোট একটা চিড়িয়াখানা কিন্তু সমৃদ্ধ। রয়েল বেঙ্গল টাইগার থেকে শুরু করে কালো বাঘ, চিতা বাঘ, স্নো লেপার্ড, হিমালয়ান উলফ, বিলুপ্তপ্রায় লাল পান্ডাসহ ম্যাকাও পাখিও রয়েছে এখানে। এর পাশেই রয়েছে জাদুঘর। সুন্দর ও ছিমছাম। চিড়িয়াখানা থেকে বের হলেই চোখে পড়বে হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। এখানে নিয়মিত এডভেঞ্চার, বেসিক এবং উন্নত মাউন্টেনিয়ারিং কোর্সগুলি পরিচালনা করা হয়।

জুওলজিক্যাল পার্ক থেকে বের হয়ে গেলাম রঞ্জিত ভ্যালি প্যাসেঞ্জার রোপওয়ে’তে (Cable Car)। সিঙ্গলা চা বাগানের প্রায় ৫০০ ফুট উপর দিয়ে ক্যাবল কারটি অপরপ্রান্ত সিঙ্গলা বাজারে পৌঁছতে প্রায় ২০ মিনিট সময় লাগে। অর্থাৎ আসা-যাওয়াসহ প্রায় ৪০ মিনিট। ক্যাবল কার থেকে নিচের সবুজ চা বাগান আর দূরের সুবিস্তৃর্ণ পাহাড়ের রাশি আর মেঘমালার মনোরম দৃশ্য যে কাউকে মুগ্ধ করতে বাধ্য। এর বিনিময়ে জনপ্রতি খরচ হবে মাত্র ২০০ রুপি। তবে এটিতে চড়তে প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘন্টার দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এই লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে বোরিং না হয়ে এখানকার মোমো আর পাপড়ি চাট চেখে নেয়া যায়। মোমো ৮ পিছ ৬০ রুপি আর পাপড়ি চাট প্লেটপ্রতি ৪০ রুপি। তারপরের গন্তব্য ছিল তেনজিং রক। এটা উল্লেখ করার মতো কিছু না। সেখান থেকে গেলাম ভারতের বিখ্যাত হ্যাপি ভ্যালি টি স্টেটে। সেখান থেকে কয়েক প্যাকেট চা কিনলাম।

সবগুলি স্পট দেখে বিকেল ৪:৩০ মিনিটে ড্রাইভার আমাদের চকবাজারের দার্জিলিং মল এ নামিয়ে দিল। এই স্থানকেই দার্জিলিং-এর হার্ট বলা হয়। বিকেলটাতে প্রচুর পর্যটকের সমাগম হয়। এখানে একটি ‘ওপেন এয়ার থিয়েটার’ রয়েছে। যে কেউ নাম এন্ট্রি করে স্টেজে গিয়ে নাচ, গান, আবৃত্তি বা অন্য যেকোন পারফরম্যান্স করতে পারে, তাও সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এই থিয়েটারের আয়োজক দার্জিলিং পুলিশ কর্তৃপক্ষ। ভাল একটি পদক্ষেপই বলা যায়। মল এর কাছেই রয়েছে কম খরচে রেডিমেট পোশাকের মার্কেট। একটি হলো নিউ মহাকাল মার্কেট আর আরেকটি হলো মল মার্কেট। এখানে বেশিরভাগই হলো শীতের পোষাক। ঘন্টা দু’য়েক সেখানে ঘুরাঘুরি করে চলে গেলাম চকবাজার এর কেএফসি’তে। সেখানে বার্গার, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর কোক দিয়ে রাতের হালকা ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে এসে হোটেল মালিককে বললাম যে আমরা আগামীকাল টাইগার হিলে যাব, ব্যবস্থা করুন। তিনি একটি জিপ ড্রাইভারকে ফোন দিয়ে আমাদের কনফার্ম করলেন এবং বললেন ভোর সাড়ে ৪টায় হোটেলের সামনে থাকবেন। জিপ আপনাদের তুলে নিয়ে যাবে। এজন্য দিতে হবে জনপ্রতি ২০০ রুপি। তাই করলাম।

ভোরে হোটেলের সামনে থেকে জিপে উঠলাম। জিপে আমরা ১০ জন ছিলাম। অন্ধকারে হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে চলল জিপ। টাইগার হিল দার্জিলিং শহর থেকে ১১ কিমি দূরে। শুধু আমাদের জিপ নয়, দেখলাম শত শত জিপ আর ট্যাক্সি ছুটছে টাইগার হিলের পথে। প্রায় ৪০ মিনিট পর আমরা টাইগার হিলের পাদদেশে । সেখান থেকে হাঁটাপথে লাগে ১০ মিনিট। সূর্যোদয়ের সময় নিচু উচ্চতায় সূর্যকে দেখতে পাওয়ার আগেই কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরগুলি আলোকিত হয়ে ওঠে। ইউটিউবে এই ভিডিও বহুবার দেখেছি আর রোমাঞ্চিত হয়েছি। কিন্ত আজ বিধিবাম। টাইগারহিল থেকে ঘন মেঘ ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এদিকে সূর্যোদয় হয়েছে তাও প্রায় ১০ মিনিট। তাই আমরা দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে আবার জিপে চেপে বসলাম। জিপ আমাদের আরেকটা লোকেশন বাতাসিয়া লুপ-এ নিয়ে গেল। চমৎকার লোকেশন। বাতাসিয়ায় বিশাল চত্বর পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে। ফুলের বাগান। সবুজে ছাওয়া ঘাস। পাতাবাহার-লতাবাহার বাঁধানো পথ। চত্বরের মাঝখানে বিশাল উঁচু কালচে গোলাকার স্তম্ভ। ১৯৮৭ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতদের স্মরণে তৈরি হয়েছে এটি। এই বাতাসিয়া পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু শেষ মাথা ছুঁয়ে ঘুরে এসেছে রেল লাইন। ২ ফুট শর্ট গেজের রেললাইন। অনেকটা খেলনা রেল লাইনের মতো। নাম যে এর টয় ট্রেন! যেহেতু এই লুপ লাইনটি গন্তব্যে পৌঁছার জন্য নয়, বিনোদন দেয়ার জন্য; আর তাই হয়তো এরকম লুপ তৈরি করা হয়েছে। এই লুপের বিশেষত্ব হলো এটি একটি পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত। অনেকটা মালভূমির মতো। উপর থেকে নিচে ক্রমশ সুষম ঢালু।

এখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। অবশ্যই আকাশ পরিষ্কার থাকা সাপেক্ষে। ভাগ্যবিধাতা এবার আমাদের প্রতি সদয় হলেন। আকাশ ক্রমশ পরিষ্কার হলো, মেঘ কেটে গেল আর বাতাসিয়া লুপ থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট হয়ে উঠল। কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা ৮,৫৮৬ মিটার বা ২৮,১৬৯ ফুট। নিজ চোখে না দেখলে এর সৌন্দর্য আর বিশালতা বর্ণনায় প্রকাশ করা সম্ভব না। প্রকৃতি তার রূপ-রস-গন্ধ দিয়ে এই কাঞনজঙ্ঘাকে ঢেলে সাজিয়েছে। বাতাসিয়া লুপ থেকে বাইনোকুলার দিয়েও দেখা যায় এই কাঞ্চনজঙ্ঘা। খরচ জনপ্রতি ৪০ রুপি। তবে খালি চোখে দেখার মজাই আলাদা। বাতাসিয়া লুপ থেকে আমরা সকাল ৮টা নাগাদ হোটেলে পৌঁছলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম হোটেল ছেড়ে দিব এখনই। উদ্দেশ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আরেক লীলাভূমি সিকিম (Sikkim) যাব। তাই বাক্স-পেটরা নিয়ে সকাল ১০টায় হোটেল ছেড়ে দিলাম। যথারীতি ইসলামিয়া রেস্টুরেন্টে নাস্তা সেরে চকবাজার জিপস্ট্যান্ডে আসলাম। সেখান থেকে দার্জিলিং টু গ্যাংটক এর শেয়ার জিপ এর টিকেট কাটলাম। ভাড়া জনপ্রতি ২৫০ রুপি।

গ্যাংটক (Gangtok) হলো সিকিমের রাজধানী। সিকিম ভারতের একমাত্র অর্গানিক রাজ্য। এখানে কৃষি জমিতে অজৈব কোন সার ব্যবহার করা যায় না। আর এই নির্দেশ অমান্যে জেল-জরিমানারও বিধান রয়েছে। দুপুর ঠিক ১২টায় যাত্রা শুরু হলো আমাদের। দুপুর সাড়ে ৩টায় রাংপো’তে আমরা জিপ থামিয়ে পাসপোর্ট, ভিসার ফটোকপি আর এককপি ছবি দিয়ে ফরেইন রেজিস্ট্রেশন অফিস থেকে রেস্ট্রিকটেড এরিয়া পারমিট (RAP) নিলাম। ভারতীয় নাগরিক ব্যতিত সবাইকেই সিকিমে প্রবেশের সময় এই পারমিট নিতে হয়। বিকেল ৫টায় গ্যাংটকের জিপস্ট্যান্ড-এ পৌঁছলাম। জিপস্টান্ড থেকে রিজার্ভ ট্যাক্সিতে ১০০ রুপিতে গ্যাংটক মার্কেট এ গেলাম। এটাই মূলতঃ সিকিমের টুরিস্ট হাব। আমরা এখানেই একটি হোটেলে রুম নিলাম। নাম হোটেল মেরিগোল্ড। ভাড়া দিনপ্রতি ১,৫০০ রুপী। পাশেই সিকিম পুলিশ হেডকোয়ার্টার। হোটেল থেকে মিনিট পাঁচেকের পথ হলো লাল বাজার। সেখানে একটি মুসলিম খাবার হোটেল আছে। নাম হোটেল জান্নাত। আমরা রাতের খাবার হিসেবে কাচ্চি বিরিয়ানি আর কোক খেলাম। বিরিয়ানি প্রতি প্লেট ১৩০ রুপি। উদরপূর্তি করে আমরা যে হোটেলে উঠেছি তার পাশের একটি টুরিস্ট কোম্পানিতে গেলাম, কারন সিকিমের যেকোন টুরিস্ট লোকেশনে ঘুরতে সিকিম পুলিশের বিশেষ অনুমতি লাগে, যদি সে বিদেশী নাগরিক হয়। আর তার জন্য যেসব পেপার্স পূরণ করতে হয় সেগুলি আমাদের কাছে নেই। তাই বাইরের দেশের নাগরিকদের সিকিমের কোন একটি টুরিস্ট কোম্পানির দ্বারস্থ হতেই হয়।

যাহোক, আমরা সেই টুরিস্ট কোম্পানি’র লোকদের বললাম যে আগামীকাল সকালে আমরা পূর্ব সিকিমের (East Sikkim) সাঙ্গু লেকে যাব। তারা আমাদের দু’জনের তিনকপি করে পাসপোর্ট আর ভিসার ফটোকপি আর ৩ কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি নিল আর বলল, কাল সকাল ৮টায় এখানে উপস্থিত থাকবেন। আমরা সেই অনুযায়ী হোটেলে গিয়ে লম্বা একটা ঘুম দিলাম। পরদিন সকাল সাড়ে ৭টায় নাস্তা করে টুরিস্ট কোম্পানিতে গেলাম। সাঙ্গু লেকের ভ্রমণ খরচ ধরা হয়েছি ৩৫০০ রুপী, আমরা তা পেমেন্ট করলাম। কিছুক্ষণ পর টয়োটার একটা ১০ সিটের লাক্সারি মাইক্রো এলো। এই জিপে কেবল আমরা দু’জনই যাত্রী! ড্রাইভার একজন নেপালি। বলা বাহুল্য, দার্জিলিং আর সিকিমের বেশিরভাগ গাড়ির ড্রাইভারই নেপালি আর তাদের প্রধান শখ মনে হয় গাড়িতে লাউড স্পিকারে হিন্দি গান শোনা। আমাদের ড্রাইভারও এর ব্যতিক্রম নয়।

গাড়ি ঘন্টাখানেক পর মূল গ্যাংটক শহর ছেড়ে পাহাড়ে উঠতে শুরু করল। পাহাড়ের দু’পাশে পাইন গাছের সারি। দার্জিলিংয়েও পাইন গাছ দেখেছি, তবে এত পরিমাণ দেখিনি। রাস্তার অবস্থা খুব একটা ভালো না, ভাঙাচোরা। গাড়ি যখন প্রায় অর্ধেক পথ আসলো তখন আমার উচ্চতা ভীতি শুরু হয়ে গেল। কারণ এই পাহাড়গুলির উচ্চতা দার্জিলিং এর পাহাড় থেকেও অনেক বেশি। দার্জিলিং শহরের উচ্চতা প্রায় ৭ হাজার ফুট হলেও গ্যাংটকের যে পাহাড়গুলি বেয়ে এখন আমরা উঠছি সেগুলির উচ্চতা প্রায় ১০,০০০ ফুট। আর আমাদের গন্তব্য সাঙ্গু লেকের ( Tsomgo Lake) উচ্চতা ভুপৃষ্ঠ থেকে ১২,৩১৩ ফুট উঁচুতে। যথারীতি পাহাড়ের খোলা পাশটাতে এখানেও কোন রেলিং নেই। এমন পরিস্থিতিতে ভয় না পাওয়াটাই অস্বাভাবিক। নিচের দিকে তাকালে গ্যাংটক শহরের ৫/৬ তলা বাড়িগুলিকে চিনির দানার মতো ছোট দেখা যায়। আর ঘন সাদা মেঘগুলি আমাদের বর্তমান উচ্চতা থেকে কম করে হলেও ২০০ ফুট নিচে। সর্পিলাকার পথ ধরে যে পাহাড়গুলি বেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে উঠবো সেই পাহাড়গুলিতে দেখলাম, ঘন কুয়াশা সেখানে। মনে হয় পাহাড়গুলির উপরে কেউ আগুন ধরিয়েছে আর কুয়াশাগুলো হলো সেই আগুনের ধোঁয়া। অর্থাৎ সেখানে অনেক ঠান্ডা। আমাদের জিপ আরো প্রায় মিনিট পনেরো পরে কয়েকটি দোকানের সামনে থামলো। আমার দোকানে ঢুকে ডিম দিয়ে ম্যাগি নুডুল্স খেলাম, সাথে কফি। এই দোকানগুলিতে সাঙ্গু লেকে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় গরম কাপড় ভাড়া দিয়ে থাকে। একটি হুডি জ্যাকেট, একজোড়া গামবুট আর হ্যান্ড গ্ল্যাভস ভাড়া পড়লো ২৫০ রুপী। এগুলো পরিধান করে আবার জিপে চেপে রওনা হলাম। বেশিক্ষণ লাগেনি। ২০ মিনিট পরই আমরা পৌঁছলাম আমাদের কাঙ্খিত সাঙ্গু লেকে।

অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা। লেকের পানির প্রায় ৮০ ভাগই বরফ হয়ে আছে আর লেকটাকে চারদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে বরফের পাহাড়। এই লেকটা ভারত-চীন সীমানায় পড়েছে। এই পাহাড়গুলির উপর দিয়ে চলাচল করছে রোপওয়ে। আমরা যেহেতু দার্জিলিং-এ রোপওতে উঠেছি তাই এবার আর উঠলাম না। এখানে পৌঁছানোর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তুষারপাত (স্নোফল) শুরু হলো। তার মানে হলো এখানে কিছুক্ষণ পরপরই স্নোফল হয়। সেকি দৃশ্য! বাস্তবে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। যেদিকে চোখ যায় শুধু বরফ আর বরফ। এই বরফ দিয়ে কেউ পেঙ্গুইন বানাচ্ছে, ঢালু জায়গা থেকে নিচের দিকে পিছল খাচ্ছে আবার কেউবা তার প্রিয়জনকে বরফ দিয়ে ঢিল ছুড়ছে। সত্যিই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য। এখানে যে কেউ সামান্য অর্থের বিনিময়ে ইয়াকের পিঠে উঠে ঘুরতে পারেন। ধীরে ধীরে আমরা লেকের কাছে গেলাম। লেকটার সর্বোচ্চ গভীরতা ৪৯ ফুট বা ১৫ মিটার আর আয়তম ৬০.৫ একর। লেকের পানির বেশিভাগ অংশ বরফ হয়ে যাওয়ায় লেকের ভেতর অনেকটা হেঁটে যাওয়া যায়। আমিও অনেকটা ভিতরে গেলাম, যদিও বরফের চাই বেশি পুরু না হলে ধসে যাবার সম্ভাবনা প্রবল। কি আর করা। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ, সেটা তো থাকবেই। ঘন্টাখানেক ঘোরাফেরা করার পর তুষারপাত সহ্যের বাইরে চলে গেল। প্রচন্ড ঠান্ডায় শরীর তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারাতে শুরু করল। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই তাড়াতাড়ি গাড়িতে ফিরে এলাম। ড্রাইভারকে বললাম, হোটেলে চল। আসার সময় যে গতিতে ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছিল এখন আর তা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ রাস্তায় বরফের স্তর জমে পিছল হয়ে গিয়েছে। তাই আমাদের ফিরতে কিছুটা সময় বেশি লেগেছিল। হোটেলে ফিরে বুঝতে পারলাম, শীতে আমাদের শরীর অবশ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি লেপের ভিতর ঢুকে একটা ঘুম দিলাম। ঘুম ভাঙল সন্ধ্যা ৭টার পর। প্রচন্ড শীতের কারনে ডিনারের জন্য লাল বাজারে যেতে মন চাইছিল না। তাই আমাদের হোটেলের পাশের ডোমিনোজে গেলাম আর একটা পিজ্জা খেলাম ১৮৫ রুপী দিয়ে। হোটেল থেকে বেরিয়ে আবার রুমে ফিরে কম্বলের নিচে ঘুম।

পরদিন সকালে হোটেল চেক আউট করে জিপস্ট্যান্ডে চলে আসলাম জনপ্রতি ২০ রুপি ভাড়া দিয়ে। এখানে এসে শুনলাম কোন গাড়ি আজ শিলিগুড়ি যাবে না, কারন আগামীকাল ১১ এপ্রিল সিকিমে লোকসভার ভোটগ্রহন। অগত্যা একটা আউটের জিপে করে ২৫০ রুপির ভাড়া ৫০০ রুপি দিয়ে দুপুর ১টায় শিলিগুড়ির বাস ডিপোতে আসলাম। বাস ডিপোতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম ডিপো থেকে কোন বাস আজ ছাড়বে না, কারণ একটাই। কাল নির্বাচন। এই উপলক্ষে পুলিশ গাড়ি রিকুইজিশন করছে। কি আর করা। অটোতে ১০০ রুপিতে হাওড়া ফিলিং স্টেশন বাসস্ট্যান্ডে এসে ১,২০০ রুপিতে একটি রিজার্ভ ট্যাক্সি নিয়ে ঠিক ০৪:৪৫ মিনিটে চেংরাবান্ধা পৌঁছলাম। দু’পাশের বর্ডারে আবারো প্রায় ৫০০ টাকা উৎকোচ দিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখলাম।

অনেকের কাছে খরচটা একটু বেশি হলেও মনে রাখতে হবে এটা একটা ফ্যামেলি ট্যুর। আর এ ধরনের ট্যুরে বাজেট সবসময় নিজের আয়ত্বে থাকে না। তবে এক কথায় ভ্রমণটা ছিল দারুণ। বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় না গিয়ে তুষারপাত দেখাটা ছিল আসলেই মনে রাখার মতো।