ভালুকপং, দিরাং ও সেলা পাস ভ্রমণ

আমাদের ভ্রমণটাকে আধা অরুণাচল ভ্রমণ বলাই শ্রেয় কারণ আমাদের গন্তব্য ছিল ভালুকপং, দিরাং ও সেলা পাস। সময়ের অভাবে তাওয়াং যেতে পারি নি।

কলকাতা থেকে গুয়াহাটি যাওয়া আসার এয়ার টিকিট আগেই কাটা ছিল। হাতে সময় ছিল মাত্র ৫ দিন। কলকাতা থেকে ফোন ও ই-মেল এর মাধ্যমে ভালুকপং এর হোটেল Waii International এর মালিক Mr. James এর সাথে গাড়ি ও হোটেল এর একটি প্যাকেজ বুক করি। প্যাকেজ এ ছিল গুয়াহাটি থেকে গুয়াহাটি একটি ইনোভা গাড়ি, ভালুকপং এ দু রাত্রি ও দিরাং এ দু রাত্রি ব্রেকফাস্টসহ হোটেল ভাড়া । সব মিলিয়ে দুই পরিবার এর খরচা ৪০ হাজার। ২০ হাজার অগ্রিম দিয়ে কলকাতা থেকেই বুকিং কনফার্ম করি।

গুয়াহাটি থেকে ভালুকপং (Bhalukpong) পৌঁছাতে সময় লাগলো প্রায় ছয় ঘন্টা। ভালুকপং এর হোটেল Waii International মন্দের ভালো। অনেক রকম সুবিধা যেমন উপলব্ধ নয় সেরকম পরিচ্ছন্নতার ও অভাব। এই ছোট্ট শহরটিতে দেখারও কিছু নেই। তাওয়াং যাবার পথে প্রথম হল্ট মাত্র।

ভালুকপং থেকে পরের দিন সকাল এ দিরাং (Dirang) রওনা দিলাম। সময় লাগলো প্রায় সাত ঘন্টা। পথে টেঙ্গা ভ্যালি একটি অসাধারন টুরিস্ট স্পট। ইন্ডিয়ান আর্মি দ্বারা পরিচালিত রেস্টুরেন্ট, পার্ক ও স্যুভিনির শপ।

দিরাং এর হোটেল নরফেল রিট্রিট এর রিসেপশনটি সুন্দর সাজানো গোছানো হলেও ঘরগুলি আহামরি কিছু নয়। ঘরের অবস্থা দেখে বরং হতাশই হয়েছি। হোটেলে পৌঁছানোর রাস্তাও সেরকমই দুর্গম। ঘর থেকে ভ্যালি যদিও সুন্দর দৃশ্যমান।

নরফেল রিট্রিট

পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম সেলা পাস। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। যাবার পথে দুবার দাঁড়াতে হলো প্রায় আধ ঘন্টা করে কারণ রাস্তা সারানোর কাজ চলছিল । সময় লাগলো প্রায় ৫ ঘন্টা। আমার ছয় বছরের ছেলে ইতিমধ্যেই অসুস্থ ও বমি করতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডাও মারাত্মক। পৌঁছানোর পর সামান্য তুষারপাত দেখার ও সৌভাগ্য হয়। সৌন্দর্য্য অতুলনীয়। সেলা পাস (Sela Pass) এর উচ্চতা ১৩,৭০০ ফুট। তাই উচ্চতাজনিত সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। তাই বুঝে শুনে প্ল্যান করা ভালো এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সঙ্গে রাখা আবশ্যিক। সৌভাগ্যবশত অক্সিজেন এর অভাবজনিত কোনো সমস্যা আমাদের হয় নি যদিও সঙ্গে in-haler ও baby mask ছিল। ফটো তুলতে গিয়ে হাতে একটু frost bite মতো হয়ে যায়। হাত সঙ্গে সঙ্গে অসাড় হয়ে যায় সাথে লাল হয়ে যায়। গাড়ির ড্রাইভার হিটার চালিয়ে দেয়। সঙ্গে ফ্লাস্ক এ গরম জল ছিল সেটা হাত এ ঢালতে সমস্যা দূর হয়। কিছুটা সময় কাটিয়ে দিরাং ফিরে আসি।

সেলা লেক

দিরাং মোনাস্ট্রি খুবই সুন্দর ভাবে তৈরি, এখনো ভিতরে কাজ চলছে। মোনাস্ট্রি থেকে দিরাং শহর অপূর্ব লাগে। পাহাড়ের কোলে জমে থাকা মেঘ, নীচ দিয়ে বয়ে যাওয়া কামেঙ নদী সত্যিই অপরূপ। বৃষ্টির জন্য হট স্প্রিং যাবার রাস্তা এতই পিছল, যাবার সাহস হলো না।

দিরাং মোনাস্ট্রি

পরের দিন সকাল থেকে রোদ, সুন্দর আবহাওয়া। দিরাং থেকে ভালুকপং রওনা দিলাম সকাল ১০ টা নাগাদ। দুদিনের বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা শোচনীয়। ৫ টা নাগাদ ঘন কুয়াশায় সব ঢেকে গেলো। ভালুকপং তখন ও প্রায় ৮০কিমি। তার ওপর শুরু হলো বৃষ্টি। এরপর বাকি রাস্তা কিভাবে পৌছালাম তার বর্ণনা দিতে গিয়ে এখনো আমার হাড় হিম হয়ে যায়। গাড়ির ড্রাইভার কৃষ্ণর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ সেদিন অক্ষত ভালুকপং পৌঁছে দেবার জন্য। ওই কয়েক ঘন্টা আমার ভীষণ আফসোস হয়েছে শিলং বা কাজিরাঙা ছেড়ে অরুণাচল কে গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম বলে। এরপর যে পথে গেছি সেই পথেই আবার কলকাতায় ফিরে আসা।

কামেঙ নদী

অরুণাচল (Arunachal) ঘুরে একটা কথা আমার বার বার মনে হয়েছে, এখানকার মানুষ এবং সরকার ট্যুরিজম নিয়ে বড়ই উদাসীন। সব আছে কিন্তু সেই আতিথেয়তা নেই যা অন্যান্য পাহাড়ে আমরা দেখে থাকি। ভাষার ও সমস্যা। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা, ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়ি জার্নি মাঝে মাঝেই ঘোরার আনন্দকে গ্রাস করছিল। চারিদিকে সুন্দর ভ্যালি, পাহাড়ে মেঘের লুকোচুরি খেলা চোখ ভরে দেখছিলাম, কিন্তু কোথায় যেন কি একটা না পাওয়ার অনুভূতি লেগেই ছিল। খালি মনে হচ্ছিলো ওই সবুজ পাহারগুলোর পিছনে যদি একটা শ্বেত শৃঙ্গ থাকতো তাহলে কত ভালো হতো। কাঞ্চনজঙ্ঘাপ্রেমী বাঙালি মনের কাছে আর কি ই বা আশা করা যায়।

Leave a Comment
Share