তাওয়াং (Tawang) ভারতের সেরা পাহাড়ি শহর গুলির মধ্যে অন্যতম যা অরুণাচল প্রদেশে অবস্থিত। ১০২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত তাওয়াং এমন এক শহর যার তুলনা ভারতের অন্য কোন পাহাড়ী শহরের সাথে চলে না। অদ্ভুত সুন্দর এই শহরের উত্তরে উত্তুঙ্গ পর্বতমালা আর দক্ষিণে গভীর কামেং নদী উপত্যকা। ভারতের অন্তর্গত হলেও ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে চীন যে ৬টি স্থানকে দক্ষিণ তিব্বতের অংশ হিসেবে ঘোণা করে তার মধ্যে একটি হলো তাওয়াং।
প্রধানত মনপা উপজাতির লোকজনের বাসস্থান। শহর থেকে ৫কিমি দূরে আর্জলিং গোম্ফা আছে। তাওয়াং জেলায় প্রায় ১০৮টি ছোট-বড়ো হ্রদ আছে। এরমধ্যে ৪২ কিমি দূরে সাংগাসার লেক (Sangesar Lake) বিশেষ উল্ল্যেখযোগ্য। এটি মাধুরী লেক নামেও পরিচিত। চিন সীমান্তের বুমলা পাস (Bumla Pass) ও সাংগাসার লেক যাওয়ার পথে তাওয়াং থেকে ১৬ কিমি দূরে পি টি সো লেক (Piti So)।
তাওয়াংয়ের সেরা আকর্ষণ ৪০০ বছরের প্রাচীন তাওয়াং মনাস্ট্রি। বর্তমানে প্রায় ৫০০ জন বৌদ্ধ লামা এখানে বসবাস করেন। মনাস্ট্রির প্রধান মন্দিরে রয়েছে ২৬ ফুট উচ্চ বুদ্ধ মূর্তি। মন্দির কক্ষটি বেশ প্রশস্থ। তিব্বতি ঢাকের শব্দ, শিঙ্গাধ্বনির সঙ্গে লামাদের ছন্দোবদ্ধ মন্ত্রপাঠ শুনতে শুনতে এক অদ্ভুত ভাল লাগায় মন ভরে যায়। তাওয়াং মনাস্ট্রি প্রাঙ্গণ থেকে গোটা তাওয়াং শহর ও নদী উপত্যকার শোভা মনোমুগ্ধকর।
তাওয়াং মনাস্ট্রির সংগ্রহশালাটিও দেখার মত। এখানে দেখে নিতে পারেন প্রাচীন পুথি সহ কাঠের মুখোশ, বৌদ্ধ ধর্মগুরুদের মূর্তি, দুটি বিশাল আকারের হাতির দাত, কয়েকশো বছরের প্রাচীন বাসনপত্র, থাংকা, ধাতু নির্মিত বৌদ্ধের মূর্তি প্রভৃতি।
তাওয়াং মনাস্ট্রির ১২ কিমি দূরে বৌদ্ধ ভিক্ষুনীদের মঠ আন্নি গুম্ফা। মঠটির বয়স প্রায় ৩৫০ বছর। তাওয়াং ভ্রমণে এটি অবশ্য দ্রষ্টব্য।
প্রত্যেক বছর অক্টোবর মাসের শেষে তাওয়াং গুম্ফা চত্বরে অনুষ্ঠিত হয় তাওয়াং উৎসব। বিচিত্র এবং রঙিন এই উৎসবের সাক্ষী হতে দেশ বিদেশের পর্যটকরা ভীড় জমায় তাওয়াং এ।
তাওয়াংয়ের আর এক দ্রষ্টব্য ওয়ার মেমোরিয়াল। ১৯৬২ সালের চীন ভারত যুদ্ধে মৃত সেনাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছে। প্রতিদিন সূর্যাস্তের পর সন্ধ্যায় light & sound এর মাধ্যমে তাওয়াং এর ইতিহাস ও ১৯৬২ সালের ভারত চীন যুদ্ধের ইতিহাস উপস্থাপন করা হয়। এখানে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়।
বর্তমান গুম্ফাটি একটি অবয়ব যা তার জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত। ১৬৮৩ সালে তিনি ঐ স্থান ছেড়ে চলে যান সঙ্গে নিয়ে যান একাধিক ধর্মফলক, একটি গাছ। ঐ স্থানের একটি ফলক অনুযায়ী ষষ্ঠ দালাইলামা ঐ স্থান ছেড়ে তিব্বতের উদ্দেশে পাড়ি দেওয়ার সময় নিজের হাতের লাঠিটি উক্ত স্থানে পত্তন করেন আর ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে তিনি আবার ঐ স্থানে ফিরে আসবেন যখন ঐ লাঠিটি থেকে সময় উচ্চতাসম্পন্ন গাছের কাঠের জন্ম হবে। সকলেই তা বিশ্বাস করেন। ১৯৫৯ সালে এরকম সম উচ্চতা সম্পন্ন গাছের সৃষ্টি হয় ঐ লাঠি থেকে এবং বর্তমান দালাইলামাও তিব্বত থেকে পালিয়ে ঐ স্থানে পদার্পণ করেন, যদিও ৩টি লাঠির ১টি ঝড়ে ভেঙে যায় । ফলে স্থানীয়দের মধ্যে ঐ ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে বিশ্বাস জন্মায়। বর্তমানে যায়গাটি অত্যন্ত সুন্দর কিন্তু কোনো বৌদ্ধ ভিক্ষু ওখানে বসবাস করেন না।
এটি ১০০মিটার উচ্চতা সম্পন্ন ভারতের একটি অন্যতম সুদৃশ্যমান জলপ্রপাত। এটি জং শহর থেকে ২কিমি দূরে অবস্থিত তাই এর আরেক নাম জং ফলস। এখানে একটি জলবিদ্যুত্ কেন্দ্র রয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত যে, নুরানাঙ্গ নদী আর নুরানাঙ্গ ফলস নামটি এসেছে একজন স্থানীয় মনপা মেয়ের নাম থেকে, যে ভারত চীন যুদ্ধের সময় বীর সেনানায়ক যশবন্ত সিং রাওয়াত কে সহায়তা করেন।
১৯৬২ সালে ইন্দো-চিন যুদ্ধে, ভারতীয় সেনা যশবন্ত সিংহ রাওয়ত একা তিন দিন ধরে চিনা সেনার বিরুদ্ধে লড়াই করে শহিদ হয়েছিলেন। নিজের জীবন বাঁচাতে না পারলেও চিনের কবল থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ভারতকে। তাঁরই স্মরণে এই গড়।
দিরাং থেকে তাওয়াং এর দূরত্ব ১৩৮কিমি। দিরাং থেকে ৪০কিমি দূরে ১৩,৭২১ ফুট উচ্চতায় সেলা পাস (Sela Pass) ও সেলা লেক (Sela Lake)। সেলা থেকে তাওয়াং যাওয়ার পথেই পড়বে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে নিহত শহীদ যশোবন্ত সিং রাওয়াতের স্মৃতি মন্দির যশোবন্তগড় (Jashowantgarh)। তাওয়াং-এর ঠিক আগেই নুরানাং জলপ্রপাত (Nuranang Falls)।
তাওয়াং এ অরুণাচল ট্যুরিজমের লজে থাকাটাই সুবিধাজনক। এছাড়া বেশকিছু হোটেল আছে শহর জুড়ে।
Leave a Comment