নাউরাং ঝর্না
আমার পায়ের তলায় সর্ষে আছে আর সে যদি পূজার সময় হয়, তাহলে তো কথাই নেই। মন খালি বলে, পালাই পালাই। সবাই যখন পূজার বাজার করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে তখন আমি পালাবার জায়গা খুঁজি। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। আমি উড়লাম আকাশে, অরুনাচলের পথে।
কলকাতা থেকে গৌহাটির পথে উড়ান ধরলাম সকালে। গুয়াহাটি থেকে গাড়ি করে পৌঁছলাম তেজপুর। প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। অপূর্ব সুন্দর পথের শোভা। চারিদিক শুধু সবুজ। কচি ধান গাছে খেত ভরে আছে। পাশে চলেছে ছোটো নদী, নদির ধারে কাশ ফুল হাওয়ায় দোলা দিচ্ছে। মনে হয় ছবি। তেজপুর পৌঁছে উঠলাম অসম ট্যুরিজ্ম এর গেস্ট হাউসে। সেই দিনটা অখানেই কাটল।
পরদিন সকাল সাতটায় আমরা বেরলাম অরুনাচলের উদ্দ্যেশে। প্রথম গেলাম ভালুকপং। ছোট শহর। ওখান থেকে অরুণাচল যাবার অনুমতি পত্র নিতে হলো। এখন কলকাতা থেকেও অনলাইন করা যায়। ওখানেই সকালের নাস্তা খেয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। অনেকটা এলাকা জুড়ে সৈনিক আবাস। নদীর ধারে সুন্দর টিনের তৈরি সবুজ রঙের ছাউনি। রাস্তার ধারে সুন্দর দুটি ঝর্না পেলাম। একটা লুমুম আর একটা সাইদেল। অনেক ওপর থেকে দুধ সাদা জল প্রচণ্ড বেগে ফানাইত হয়ে ঝরে পড়ছে তৃষিত ধরার পরে। আরও এগিয়ে পেলাম নাগ মন্দির। ওখানে দুপুরের খাওয়া সেরে এগিয়ে গেলাম বমডিলার দিকে। ভালুকপং থেকে বমডিলা যাওয়ার পথ খুব সুন্দর। একপাশে নেচে নেচে চলেছে পাহাড়ি নদী। আপন মনে, নিজের খেয়ালে সে চলেছে পায়ে তরঙ্গের লহর তুলে। পেছনে সবুজ পাহাড়। আর একদিকে উঁচু পাহাড় আকাশ ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। খানিক দূরে দূরেই নির্ঝরিণী নেমে এসেছে পাহাড়ের বুক চিড়ে।
যত তাড়াতাড়ি লিখলাম তত সহজে পৌছনো গেলনা কিন্তু। রাস্তার অবস্থা ভাল না, তাই বমডিলা পৌঁছলাম প্রায় সন্ধ্যে পেরিয়ে। ওখানে এক বৌদ্ধ আশ্রমে রাতের ঠিকানা মিলল। জায়গাটা বেশ উঁচুতে। তাই একটু শ্বাস কষ্ট হয়।
আজ সকালে বমডিলা থেকে বের হলাম সাতটার সময়। যেতে হবে অনেক দূর, প্রায় ১৬৫ কিলোমিটার। ওখান থেকে গেলাম দিরাং, প্রায় ৫০ কিলমোমিটার দূরে। ছোট সুন্দর শহর দিরাং। সেদিন আর সকালের খাবার হলনা। কিছু প্যাস্ট্রি আর কেক কিনে নিলাম।
দিরাং থেকে খানিক্টা এসে রাস্তা খুব খারাপ। ধস নেমে পুরো রাস্তা কাদা মাটিতে ভর্তি। প্রাণ হাতে নিয়ে গাড়ি চালাতে হচ্ছিল। একদিকে পাহাড় আর একদিকে বিশাল খাদ। একটু ভুল হলেই আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। এক জায়গায় তো ধস নেমে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। সেনা বাহিনী আর বর্ডার রোড অরগানাইজেসান অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে কাজ করলেও আমরা ওখানে দেড় ঘণ্টা আটকে রইলাম।
দিরাং ছাড়িয়ে প্রায় দু ঘণ্টা চলার পর এলাম Jaswant Garh War Memorial 1962. তখন দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু খাবার কোন ব্যাবস্থা নেই। ওখানে সেনাবাহিনীর তত্বাবধানে একটা ছোট দোকানে পেলাম চা, শিঙ্গাড়া আর মোমও। তাই দিয়ে পেটের আগুন নেভাতে হলো। পাশেই Jaswant Singh এর স্মৃতি বিজড়িত সংগ্রহশালা। ১৯৬২ চীনা যুদ্ধের শহীদদের স্মরণে।
আমরা এগিয়ে চললাম। দাঁড়াবার জো নেই। অনেক দূর পথ। এগিয়ে চললাম সেলা পাসের দিকে। এই জায়গাটা অনেক উপরে, প্রায় ১৩৫০০ ফুট। আবহাওয়া খুব খারাপ। চারিদিক মেঘে ধেকে আছে, ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে, তার সাথে বৃষ্টি। এখানেও খাবার মত কিছু পেলাম না। এখানেই আছে সেলা লেক। রাস্তা থেকে অনেক নিচে, যাওয়া গেলনা। এখানে নিঃশ্বাস নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল।
সেলা পাস থেকে বেরলাম যখন, ঘড়ি বলছে চারতে বাজে। যেতে হবে অনেকটা, তাই আর দেরি না করে এগিয়ে গেলাম। চলতে চলতে এলাম জাং। বেশ বড় শহর। সমসত রাস্তাটি সেনাবাহিনীর অধিনে। এখানে আমাদের পারমিট দেখাতে হল। জাং ছেরে আমরা এগোতে লাগলাম।
ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আস্তে লাগলো। আমাদের ড্রাইভার এই পথে নতুন, সে ভয় পাচ্ছিল। আমরা তাকে অভয় দিয়ে গুগল ম্যাপ খুলে রাস্তার দিক ঠিক করে চললাম। অন্ধরকারে কিছুই দেখা যায় না। পাহাড়ের ঘোরালো পদ ধরে কোন রকমে এগোতে থাকলাম। অবশেষে সন্ধ্যে সাতটার সময় পৌঁছলাম তাওয়াং। শীতের চাদর মুড়ি দিয়ে, অন্ধকারে তাওয়াং তখন রাত্রিযাপনের প্রস্তুতি করছে। আমরাও সেই রাতের মত একটা হোটেলে আশ্রয় নিলাম। কাল যাব আরও অনেক দূর। তাই আজকের মত এখানেই শেষ।
তাওয়াং থেকে আমাদের যাওয়ার কথা সাঙ্গেসার লেক, যার প্রচলিত নাম মাধুরী লেক। ওখানে মাধুরী দিক্ষিত এর কোন সিনেমার চিত্রায়ন হয়েছিল। তারপর থেকে এই নাম।
সকাল আটটা নাগাদ আমরা ওখানকার গাড়ি নিয়ে বেরলাম। সাঙ্গেসার লেক ১২,৪৬৭ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। গাড়ি যত উপরে উঠতে লাগলো প্রকৃতির রূপ তত পরিবর্তন হতে লাগলো। ধীরে ধী্রে গাছপালা কম হতে লাগল। বড় বড় পাইন গাছের বদলে দেখা দিল Rhododendron গাছের ঝোপ। চারিদিকে ঝোপের মত ফুটে আছে সাদা ভৃঙ্গরাজ ফুল। এই ফুল মহৌষধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
লোকালয় কম হয়ে শুধু সেনা শিবির চোখে পড়ল। আশ্চর্য রকমের তৎপরতার সঙ্গে তারা এই প্রতিকূল পরিবেশে অক্লান্ত ভাবে দেশের প্রতি তাদের কর্তব্য করে যাচ্ছে। অদের এই বলিদানের ফলস্বরুপ আমরা নিজদের ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি। ওখানে দেখলাম বফরস কামান, শত্রুর মোকাবিলায় তৈরি হয়ে আছে।
যত ওপরে উঠতে লাগলাম তত গাছের সংখ্যা কমতে লাগল। একসময় শুধু কালো পাথরের মধ্যে লাল, সবুজ, বেগুনি, হলুদ রঙের ছোট ছোট ফুলের গাছ ছাড়া আর কিছুই চোখে পরলনা।
আমরা পৌঁছলাম সাঙ্গেসার লেক (Sangestar Tso), অপূর্ব সুন্দর। একবারে সমতল জায়গা, কিন্তু সমুদ্র তল থেকে অনেক উঁচুতে। জলের রং কালো দেখাচ্ছে, পাশ থেকে একটা ছোট ঝর্ণার জল এসে নদীতে মিশছে। সুন্দর করে সাজানো। একটা ছোট রেস্টুরেন্ট আর একটা কটেজ আছে। সব কিছুই সেনা বাহিনীর তত্বাবধানে।
লেকের মধ্যে বড় বড় মরা পাইন গাছের সারি জায়গাটাকে আরও মোহময় করে তুলেছে। লেকের জলে দুস্প্রাপ্য Golden Duck দেখতে পেলাম। একজোড়া ঘুরছে। ছবি তোলা গেল না। অনেক দূরে ছিল।
আমরা বুমলা পাস গেলাম না। পারমিট করানো হয়নি, তার ওপর রাস্তা খুব খারাপ। দেখার বলতে সীমান্ত।
এবার ফেরার পালা। ফেরার পথে অজগর লেক দেখলাম। ওখানেও Golden Duck পেলাম। দুপুর দেড়টা নাগাদ ফিরে এলাম তাওয়াং।
দুপুরের খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বেরলাম তাওয়াং মোনাস্ট্রি দেখতে। বহু পুরনো। কিছুদিন আগে এখানেই এসেছিলেন শ্রী দলাই লামা। সে নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে। সন্ধ্যে হয়ে গেছিল, বৃষ্টিও পড়ছিল। তাড়াহুড়ো করে ছুটলাম, Tawang war memorial দেখতে। ওখানে Light & Sound দিয়ে ১৯৬২ সালের চীনের সাথে ভারতের যুদ্ধের ইথাস দেখানো হল। খুব সুন্দর উপস্থাপনা। দেখে শরীরের প্রতিটি লোম খাঁড়া হয়ে গেল। শ্রদ্ধা ও গর্বে চোখে জল এসে গেল।
আজ রাত তাওয়াং এই কাটবে। কাল সকালে ফেরার পালা।
আজ আমাদের ফেরার পালা। রাস্তার অবস্থা ভালো না, তাই ভোরের আলো ফুটতেই সাড়ে পাঁচটার সময় আমরা বেড়িয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য আজকেই গুয়াহাটি পৌঁছনো। কিন্তু বিধি বাম। মানুষ ভাবে এক, আর ওপরওয়ালা ভবেন আর এক।
প্রথম কয়েক ঘণ্টা ভালুই কাটলো। সেদিন যাওয়ার সময় অন্ধকার হয়ে যাওয়ার জন্য অনেক কিছুই দেখতে পাইনি। আজ সকালের আলোয় সেই সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে চললাম। প্রথমেই দেখতে পেলাম নাউরাং ঝর্না। কি বিশাল তার রূপ আর তেজ। পাহাড়ের অনেক ওপর থেকে প্রবল বিক্রমে সে ঝরে পড়ছে নীচে। সাদা ফেনার মুকুট থেকে আলোর দ্যুতির মত ধোঁয়া চারিদিক সাদা করে দিচ্ছে।
সামনে যত এগোতে লাগলাম, পাহাড়ের সৌন্দর্য মুগ্ধ করল। কামাং নদী ষোড়শী কিশোরীর মত চঞ্চল গতিতে উপত্যকার মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে। দুধারে ছবির মত গ্রাম, চাষের ক্ষেত। সেখানে ভুট্টা, রাগি, বাঁধাকপির চাষ হচ্ছে। মেয়েরা পিঠে ঝুড়ি নিয়ে ফসল কাটছে। ভাবতে অবাক লাগে, কি অপরিসীম কায়িক পরিশ্রম করে এরা। কিন্তু কোথাও ক্লান্তি নেই, অভিযোগ নেই। মেয়েরা সবাই খুব সুন্দর করে সেজে থাকে।
এবার এসে পড়লাম সেই জায়গায়, যেখানে রাস্তায় ধস নেমে যাওয়ার সময় আটকে গেছিলাম। এবার অবস্থা আরও খারাপ। সেনা বাহিনীর পদস্থ অফিসার এবং বর্ডার রোড অরগানাইজেসান এর কর্মীরা অন্ত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে রাস্তা পরিষ্কার করছেন এবং যাতে কনরকম বিপদ না ঘটে তার জন্য অত্যন্ত সতরক ভাবে প্রতিটা গাড়িকে পার করে দিচ্ছেন। ওখানে আমাদের এক ঘণ্টা সময় চলে গেল।
বেলা একটা নাগাদ আমরা দিরাং পার হলাম। এদিনও সকালে আমাদের খাওয়া হলও না। ঠিক করলাম, একবারে তিনটে নাগাদ বমডিলা পৌঁছে দুপুরের খাওয়া সেরে নেব। দুপুর আড়াই টে নাগাদ এসে পৌঁছলাম বেখুই নামের ছোট একটা গ্রামে। ওখান থেকে বমডিলা মাত্র আট কিলোমিটার। গাড়ি রীতিমত ছুটছে। কিন্তু প্রকৃতির কাছে আমাদের দৌড়ের ইতি টানতে হল। বেখুই এসে শুনলাম, আর আগে যাওয়া যাবেনা। পাহাড় থেকে পাথর ঝুলে পড়ছিল, তাকে ফাটাবার ব্যবস্থা চলছে।
অগত্যা থেমে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। শোনা গেল বিকেল ছটা নাগাদ রাস্তা খুলতেও পারে। উপায় না দেখে সামনেই একটা ছোট দোকানে খেতে হল। অপূর্ব খাবার। সকাল থেকে না খেয়ে তখন ওই গরম ভাত, রাজমা ডাল, খেতে থেকে তুলে আনা শাক আর স্কোয়াশ এর তরকারি অমৃত মনে হল।
কিন্তু সন্ধ্যে হয়ে গেল, রাস্তা ঠিক হওয়ার কোন লক্ষন দেখা গেল না। বিশাল একটা পাথরকে জিলেটিন দিয়ে ফাটানো হলোও, কিন্তু এত সহজে ওই রাস্তা পরিষ্কার করে চালু করা যে যাবেনা, সে আমরা ভালই বুঝলাম। বিকেল পাঁচটার সময় অন্ধকার হয়ে গেল। অগত্যা ওখানেই ওই অন্ধকার পাহাড়ে গাড়ির মধ্যেই রাত্রিযাপন নিশ্চিত জেনে রাতের খাওয়া সেরে গাড়ির মধ্যে আশ্রয় নিলাম।
চারিদিক অন্ধকার, নিঝুম। মেঘের জন্য আকাশও দেখা যাচ্ছেনা। শুধু ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া কিছু নেই। প্রায় আট নটা গাড়ি একসাথে রইল, যাতে কোন অঘটন না ঘটে।
বেখুই নামের এক অখ্যাত, প্রত্যন্ত গ্রামে গাড়ির মধ্যে রাত কাটলো। আমি এত বছর পাহাড়ে ঘুরছি, কোনদিন এই অভিজ্ঞতা হয়নি। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে চোখ খুলল। স্বচ্ছ ভারতের কল্যাণে ওইরকম জায়গায়ও প্রাতঃক্রিয়ার অসুবিধা হলনা। কিন্তু মনে একটাই চিন্তা, কি করে আর কতক্ষণে সমতলে নেমে আসব। ড্রাইভাররাও সবাই এই এক চিন্তা করছে। ওরা গেল খবর আনতে।
আমাদের সবাইকে বলল যে সকালের খাওয়া সেরে তৈরি হয়ে থাকতে। রাস্তা পরিষ্কার হওয়ার খবর পেলেই আমরা রওনা দেব। সকাল বেলায় গ্রামের ব্যস্ততা দেখতে ভাল লাগল। মেয়েরা খেতে থেকে টাটকা বাধা কপি, টমেটো, মুলো তুলে এনে বিক্রি করছে। দোকান সাজাচ্ছে। ওখানে সব কাজ দেখলাম মেয়েরাই করে।
আমরা সকালের জলখাবার গরম হাতে করা রুটি, খেত থেকে তুলে আনা বাধা কপির তরকারি আর কাঁচা লঙ্কা টমেটোর আচার দিয়ে সারলাম। সাড়ে দশটা নাগাদ এসে বলল যে বমডিলার দিকের রাস্তা ঠিক হতে অনেক সময় লাগবে। তাই দিরাং দিয়ে ভূটান সীমান্তের একটা রাস্তা আছে, সেখান দিয়ে যেতে হবে। সেই রাস্তায় বিপদ আছে উগ্রপন্থীর উপদ্রব আছে, তার ওপর প্রায় ২০০ কিলোমিটার রাস্তা বাড়তি যেতে হবে।
যাই হোক, একসঙ্গে আটটা গাড়ি একসঙ্গে রওনা দিলাম। গাড়ি তাড়াতাড়ি যেতে পারছেনা, রাস্তা ভালো না। বেশ অনেকটা যাওয়ার পর রাস্তা একটু ঠিক হলো। গাড়িগুলো প্রচণ্ড জোরে যাচ্ছিল, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। একটা নাগাদ এক জায়গায় গাড়ি থামলো। চারিদিক মেঘে ঢাকা। ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটা ছোট্ট বাড়ি, তার সঙ্গে দোকান। দুপুরের খাওয়ার জন্য ওখানেই থামতে হলো। খাওয়া বলতে ম্যাগি। তাই খেতে হল। কারণ পরে আর কিছু জুটবে কিনা কে জানে?
আধ ঘণ্টার মধ্যে আমরা আবার ছুটলাম ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। চারিদিকে কোন বসতির চিনহ নেই। শুধু পাহাড় আর জঙ্গল। আমাদের চোখ শুধু মাইল স্টোনের দিকে। আমাদের পৌঁছতে হবে ওরাং। বেলা তিনটের সময় থামতেই হল, প্রকৃতির ডাকে। পনের মিনিটের বিরতির পর আবার ছোটা। পাহাড়ের যেন শেষ নেই। আমার মনে ভয় নেই, আমি দু চোখ ভরে প্রকৃতিকে গ্রাস করতে করতে চলেছি। ছবি তোলা হচ্ছেনা, গাড়ির গতির জন্য। মাঝে মাঝে ছোট ছোট গ্রাম পড়ছে। আমরা সব ছাড়িয়ে ছুটে চলেছি।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যে হয়ে এল। চারিদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেদিন আকাশে একাদশীর চাঁদ, মেঘের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে। অন্ধকারেও সমস্ত আকাশ এক স্বর্গীয় আলোয় উদ্ভাসিত। আকাশের বুকে সাদা মেঘ পেঁজা তুলোর মত ভেসে বেড়াচ্ছে, আর পাহাড়ের কোলে জমে থাকা কালো মেঘের মধ্যে থেকে বিদ্যুৎ চমক সমস্ত পৃথিবীকে আলোয় ভাসিয়ে নিচ্ছে।
এই অন্ধকার রাতে যখন সবাই প্রাণের সংশয় নিয়ে চিন্তিত, আমি তখন ঈশ্বরের অপরূপ সৃষ্টিতে মন্ত্রমুগ্ধ। আমার প্রাণে তাঁর উপস্থিতি নতুন করে অনুভব করলাম।
রাস্তা অত্যন্ত খারাপ, তার ওপর চারিদিকে মাঝে মাঝে এমন মেঘে ঢেকে জাচ্ছে যে গাড়ি চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। গাড়ি থামিয়ে সামনের কাচ মুছে আবার চলতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের গাড়ি বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়লো। আমাদের ড্রাইভার বেশ ভয় পেল। আমরা তাকে সাহস জোগাতে লাগলাম, গুগল ম্যাপ খুলে তাকে রাস্তার বলে দিচ্ছিলাম। এই সময় সাহস হারানো খুবই বিপজ্জনক, তাই ওকে ভয় পেতে দিলাম না।
প্রায় দেড়শ কিলোমিটার এসে আমরা এসে সমতলে পড়লাম। কিন্তু তখনও পথ অনেক বাকি। সমতলে পড়ে গাড়ি ঝরের বেগে চলল। অন্ধকার চা বাগানের মধ্যে দিয়ে এসে আমরা আরও ১০০ কিলোমিটার পথ এসে রাত এগারোটার সময় গুয়াহাটি পৌঁছলাম। সেদিনের মত ওখানেই শেষ।
সকালে কামাখ্যা মন্দির দর্শন করে আমরা কলকাতা ফেরার প্লেন ধরলাম। অরুনাচল ভ্রমণ আমার সারাজীবন স্মৃতির পটে আঁকা থাকবে। সুন্দর, ভয়ঙ্কর মিলে মিশে একাকার হয়ে প্রকৃতির যে রূপ দেখলাম, তা ভোলার নয়।
Leave a Comment